পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । শেষ পর্ব ।
৮ম উপায় : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ
রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণেই সকল কল্যাণ নিহিত। মানব জীবনে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি পেতে চাইলে অবশ্যই নবী করীম (ছাঃ)-এর অনুসরণ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ ‘(হে নবী) তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস তবে আমার অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন ও তোমাদের পাপ সমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়’ (আলে ইমরান ৩/৩১)। আয়াতটির ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, ‘এই আয়াত প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফায়ছালাকারী যে আল্লাহর মুহাববতের দাবী করে অথচ সেই দাবী মুহাম্মাদী তরীকায় হয় না, সে ব্যক্তি তার দাবীতে মিথ্যাবাদী। যতক্ষণ না সে তার যাবতীয় কথাবার্তা ও কাজকর্মে মুহাম্মাদী শরী‘আত ও দ্বীনে নববীর অনুসরণ করে’।[1] এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত’।[2] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا، فَهْوَ رَدٌّ ‘কেউ যদি এমন কাজ করে, যে বিষয়ে আমাদের নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[3]
উপরোল্লিখিত আয়াত এবং হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করার মধ্যেই সকল কল্যাণ নিহিত এবং শরী‘আতে অতিরঞ্জিত কিছু করাই বিদ‘আত। সুতরাং রাসূল (ছাঃ) যা দিয়ে গেছেন তার অনুসরণ করতে হবে এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হ’তে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৭)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের পক্ষ থেকে বানিয়ে কোন কথা বলেননি। মহান আল্লাহ বলেন, وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى، مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى، وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوْحَى ‘শপথ নক্ষত্রের, যখন সেটা হয় অস্তমিত, তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট নয়, বিভ্রান্তও নয় এবং তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। এটা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়’ (নাজম ১-৪)। যিনি অহি-র মাধ্যম ছাড়া কথা বলেন না, তাঁরই অনুসরণ করতে হবে। কোন পীর বা ওলী-আওলিয়ার নয়। মহান আল্লাহ বলেন, اِتَّبِعُوْا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوْا مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيْلاً مَا تَذَكَّرُوْنَ ‘তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর, আর তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কোন বন্ধু বা অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’ (আ‘রাফ ৩)।
কুরআন-সুন্নাহর বাণী সুস্পষ্ট হওয়ার পরেও কেউ যদি অন্য পথের অনুসরণ করে তাহ’লে সে বিপথগামী হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا ‘আর সুপথ প্রকাশিত হওয়ার পর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং বিশ্বাসীগণের বিপরীত পথের অনুগামী হয়, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব। ওটা নিকৃষ্টতর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (নিসা ১১৫)। অন্য পথের সন্ধান নয়, বরং রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শের অনুসরণ করার মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি মিলবে। মহান আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ২১)।
প্রকৃত মুমিন হওয়ার পূর্বশর্ত হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা এবং দুনিয়ার সকল কিছু থেকে ও নিজের নাফস থেকেও তাঁকে ভালবাসা। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ِ لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হই’।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে, لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ مَالِهِ وَأَهْلِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সম্পদ, পরিবার-পরিজন ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হই’।[5]
রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার অর্থই হচ্ছে তাঁর রেখে যাওয়া অমিয় বাণী সমূহের অনুসরণ করা। ছহীহ হাদীছ পাওয়ার সাথে সাথে তা, অবনতমস্তকে মেনে নেওয়া, তাঁর উত্তম আদর্শ সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এবং তাঁর সুন্নাতের বিরোধিতা না করা।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَحْسَنَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ، وَأَحْسَنَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم، وَشَرَّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا ‘সর্বোত্তম কালাম হ’ল আল্লাহর কিতাব আর সর্বোত্তম পথ নির্দেশনা হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পথ নির্দেশনা। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে নব উদ্ভাবিত বিষয়সমূহ’।[6]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ أُمَّتِىْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَىْ. قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنْ أبَى؟ قَالَ: مَنْ أَطَاعَنِىْ دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِىْ فَقَدْ أَبَىْ. ‘আমার সকল উম্মাতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করে সে ব্যতীত। ছাহাবীগণ বললেন, কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে, সেই অস্বীকারকারী’।[7]
রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ অবলম্বন করলে সঠিক পথ হ’তে বহু দূরে সরে পড়বে। হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, يَا مَعْشَرَ الْقُرَّاءِ اسْتَقِيْمُوْا فَقَدْ سُبِقْتُمْ سَبْقًا بَعِيْدًا فَإِنْ أَخَذْتُمْ يَمِيْنًا وَشِمَالاً، لَقَدْ ضَلَلْتُمْ ضَلاَلاً بَعِيْدًا ‘হে কুরআন পাঠকারী সমাজ! তোমরা (কুরআন ও সুন্নাহর উপর) সুদৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই তোমরা অনেক পশ্চাতে পড়ে আছ। যদি তোমরা ডান দিকের কিংবা বাম দিকের পথ অনুসরণ কর, তাহ’লে তোমরা সুদূর ভ্রান্তিতে নিপতিত হবে’।[8]
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, إذا وجدتم سنة لرسول الله صلي الله عليه وسلم فاتبعوها ولاتلتفتوا إلى أحدٍ، ‘যখন তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর কোন সুন্নাত পেয়ে যাবে, তখন তারই অনুসরণ কর। অন্য কারো দিকে তোমরা লক্ষ্য রেখ না’ (অন্য পথের অনুসরণ কর না)।[9]
কুরআন-সুন্নাহর ইত্তেবা করলেই মানব জীবনে সুখ-শান্তি বয়ে আসবে, অপর পক্ষে বিরোধিতা করলেই চির অশান্তি নেমে আসবে। মহান আল্লাহ বলেন,قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيْعًا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّيْ هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلاَ يَضِلُّ وَلاَ يَشْقَى، وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِيْ فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى، قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِيْ أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا، قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيْتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى- ‘তিনি বললেন, তোমরা উভয়ে (আদম ও হাওয়া) একই সঙ্গে জান্নাত হ’তে নেমে যাও। তোমরা পরস্পরের শত্রু। পরে আমার পক্ষ হ’তে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না। যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তিনি বলবেন, এভাবেই আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল; কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হবে’ (ত্বহা ১২৩-১২৬)।
কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ না করে অন্যপথ ধরলে পরকাল হারাতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّيْ هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ، وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَكَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا أُوْلَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ ‘পরে যখন আমার পক্ষ হ’তে তোমাদের নিকট সৎ পথের কোন নির্দেশ আসবে তখন যারা আমার সৎপথের নির্দেশ অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। আর যারা অবিশ্বাস করবে ও আমার নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করবে তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা সদা অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ، وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُوْدَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيْهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِيْنٌ- ‘এবং যে কেউ আললাহ ও তদীয় রাসূলের আনুগত্য করবে তিনি তাকে এরূপ জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন, যার নীচ দিয়ে স্রোতস্বিণী সমূহ প্রবাহিত হবে, সেখানে তারা সদা অবস্থান করবে এবং এটাই মহা সাফল্য। আর যে কেউ আল্লাহ ও তদীয় রাসূলকে অমান্য করে এবং তাঁর নির্দিষ্ট সীমাসমূহ অতিক্রম করে, তিনি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন, যেখানে সে সদা অবস্থান করবে এবং তার জন্যে লাঞ্ছনাকর শাস্তি রয়েছে’ (নিসা ৪/১৩-১৪)।
কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ না করে অন্যের পথ অনুসরণ করলে পরকালে আফসোস করতে হবে। সেদিন সমাজ নেতা, পীররা জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন, يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوْهُهُمْ فِيْ النَّارِ يَقُوْلُوْنَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُوْلاَ، وَقَالُوْا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّوْنَا السَّبِيْلاَ، رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا، ‘যেদিন তাদের মুখমন্ডল অগ্নিতে উলট-পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম। তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন এবং তাদেরকে দিন মহা অভিশাপ’ (আহযাব ৩৩/৬৬-৬৮)।
কিয়ামতের দিন হায়, হায় করে কোনই লাভ হবে না। সুতরাং এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের উপর পরকালীন স্থায়ী জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের অনুসরণ করতঃ পরকালীন মুক্তি লাভের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে হবে। নচেৎ লাঞ্ছনার গ্লানি ভোগ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُوْلُ يَا لَيْتَنِيْ اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلاً، يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِيْ لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيْلاً، لَقَدْ أَضَلَّنِيْ عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِيْ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُوْلاً- ‘যালিম ব্যক্তি সেদিন নিজ হস্তদ্বয় কামড়াতে কামড়াতে বলবে, হায়! আমি যদি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট উপদেশ (কুরআন) পৌঁছবার পর। আর শয়তান মানুষের জন্যে মহাপ্রতারক’ (ফুরক্বান ২৭-২৯)।
শিরক-বিদ‘আত ছেড়ে দিয়ে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং রাসূলেরই অনুসরণ করতে হবে, তাহ’লেই মানব জীবনে কল্যাণ বয়ে আসবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هَذِهِ سَبِيْلِيْ أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيْرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِيْ وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ ‘বলুন! এটাই আমার পথ, আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১০৮)। প্রকাশ থাকে যে, সকল কল্যাণ এবং হিদায়াত রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আর সকল পথভ্রষ্টতা এবং দুর্ভাগ্য রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধাচরণে। সারা বিশ্বের দিকে তাকালে পরিলক্ষিত হয় যে, ফিৎনা-ফাসাদ এবং নিকৃষ্ট বিষয়াদি প্রচার হচ্ছে রাসূলের সুন্নাতের বিপরীত পথে চলার কারণে এবং সে বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে। অতএব বান্দার ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ হচ্ছে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ।[10]
রাসূল (ছাঃ)-এরই অনুসরণ করতে হবে, অন্য কারো তাক্বলীদ করা যাবে না। তাইতো ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, ‘ইত্তেবা হ’ল রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবীগণ হ’তে যা কিছু এসেছে তা গ্রহণ করা’। অতঃপর তিনি বলেন, ‘তোমরা আমার তাক্বলীদ কর না এবং তাক্বলীদ করো না মালেক, ছাওরী ও আওযা‘ঈর। বরং সেখান থেকে গ্রহণ কর যেখান থেকে তারা গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ।[11]
ওলামায়ে কেরাম তাক্বলীদ এবং ইত্তেবার মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে বলেন, তাক্বলীদ হ’ল বিনা দলীল-প্রমাণে কারো কথা গ্রহণ করা। পক্ষান্তরে ইত্তেবা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর উপর যা অবতীর্ণ করেছেন (কুরআন-সুন্নাহ) তার অনুসরণ করা। আলেমগণের ছহীহ দলীল ভিত্তিক কোন কথাকে মেনে নেওয়ার নাম হচ্ছে ইত্তেবা, তাক্বলীদ নয়। এজন্যই শারঈ বিষয় সমূহে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা মানব জাতির উপর অপরিহার্য কর্তব্য।[12]
ছহীহ দলীল মুতাবেক কোন আলেমের অনুসরণ আসলে দলীলেরই অনুসরণ করা। পক্ষান্তরে দলীলের অনুসরণ না করে কোন ইমামের নিজস্ব রায়ের অনুসরণ করলে সেটাই হবে তাক্বলীদে মাযমূম (নিন্দনীয় তাক্বলীদ) এবং কুরআন-সুন্নাহর বিরোধিতা। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُوْنَ ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের উপর এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি’ (যুখরুফ ২৩)। তিনি আরো বলেন, وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لاَ يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَلاَ يَهْتَدُوْنَ ‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার অনুসরণ কর; তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষগণকে পেয়েছি; যদিও তাদের পিতৃ-পুরুষদের কোনই জ্ঞান ছিল না এবং তারা সুপথগামী ছিল না তবুও’? (বাক্বারাহ ২/১৭০)।[13]
৯ম উপায় : সালাফে ছালেহীনের পথে চলা
ছাহাবায়ে কেরাম ইসলামী বিধান সমূহকে যথাযথভাবে বুঝেছেন এবং তা নিজেদের সার্বিক জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন। এজন্য তাদের প্রতি আল্লাহর রহমত ও সন্তোষ অবধারিত হয়েছিল। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,وَالسَّابِقُوْنَ الْأَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهَاجِرِيْنَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِيْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ- ‘আর যেসব মুহাজির ও আনছার (ঈমান আনয়নে) প্রথম অগ্রগামী এবং যেসব লোক একান্ত নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুগামী, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর আল্লাহ তাদের জন্যে এমন উদ্যানসমূহ প্রস্ত্তত করে রেখেছেন যার তলদেশ দিয়ে নহরসমূহ বইতে থাকবে, যার মধ্যে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। আর এটা মহাসাফল্য’ (তওবা ৯/১০০)।
সালাফে ছালেহীনকে ভালবাসা এবং তাদের পথ ধরে চলার মধ্যে সফলতা নিহিত রয়েছে। কেননা যারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঘর-বাড়ী ছেড়ে সকল কষ্ট-ক্লেশ ধৈর্যের সাথে মাথা পেতে মেনে নিয়েছেন, যাদের প্রতি আল্লাহ স্বয়ং খুশি হয়েছেন, তাদের প্রতি শত্রুতা করলে ও গালি-গালাজ করলে ধ্বংস ছাড়া আর কি হ’তে পারে? তাই মহান আল্লাহ যাদের ভালবাসেন আমরা তাদের ভালবাসব। যাদের তিনি ভালবাসেন না, আমরাও তাদের ভালবাসব না। মহান আল্লাহ বলেন,لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِيْنَ الَّذِيْنَ أُخْرِجُوْا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُوْنَ فَضْلاً مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُوْنَ، وَالَّذِيْنَ تَبَوَّءُوْا الدَّارَ وَالْإِيْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّوْنَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلاَ يَجِدُوْنَ فِيْ صُدُوْرِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوْا وَيُؤْثِرُوْنَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوْقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ، وَالَّذِيْنَ جَاءُوْا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوْفٌ رَحِيْمٌ- ‘এই সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্যে, যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও সম্পত্তি হ’তে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-কে সাহায্য করে। তারাই তো সত্যাশ্রয়ী। মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এই নগরীতে বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে তারা মুহাজিরদেরকে ভালবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার জন্যে তারা অন্তরে আকাঙ্খা পোষণ করে না, আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হ’লেও। যারা কার্পণ্য হ’তে নিজেদেরকে মুক্ত করেছে তারাই সফলকাম। যারা তাদের পরে এসেছে, তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভ্রাতাদেরকে ক্ষমা করুন এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু’ (হাশর ৮-১০)।
ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, خَيْرُ أُمَّتِىْ قَرْنِى ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ‘আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ হ’ল আমার যুগের লোক (অর্থাৎ ছাহাবীগণ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক’ (অর্থাৎ তাবেঈগণ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবে তাবেঈন)।[14] সুতরাং যখন কেউ কোন বিষয়ে মতপার্থক্য দেখবে তখন সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের অনুসরণ করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِىْ فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘তোমাদের মধ্যে থেকে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে, তারা অচিরেই অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। অতএব (মতপার্থক্যের সময়) আমার সুন্নাত এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা হবে তোমাদের অপরিহার্য কর্তব্য। এ সুন্নাতকে মযবূতভাবে মাড়ির দাঁত দিয়ে অাঁকড়ে ধরে থাকবে। আর সমস্ত বিদ‘আত থেকে বিরত থাকবে। কেননা প্রত্যেকটি বিদ‘আতই নবসৃষ্টি। আর প্রত্যেকটি বিদ‘আতই গুমরাহী’![15]
মোদ্দাকথা, কুরআন-সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরার পর সালাফে ছালেহীনের পথ ধরতে হবে। অর্থাৎ ছাহাবীগণের, তাবেঈগণের, তাবে তাবেঈগণের ও ইমামগণের, যাঁরা মানব জাতিকে কুরআন-সুন্নাহর পথ দেখিয়ে গেছেন। বর্তমানেও যারা মানব জাতিকে কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার জন্য আহবান করেন তাদের সাথে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে দাওয়াতী কাজ করার মাধ্যমে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে শান্তি বয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ। উল্লেখ্য যে, ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ ও ইমামগণের কথার সাথে যদি কুরআন-সুন্নাহর বিরোধ দেখা দেয়, তবে বিষয়টি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে সোপর্দ করে দিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ ‘অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ হয় তবে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে সেটাকে ফিরিয়ে দাও’ (নিসা ৪/৫৯)। সুতরাং আমরা যদি কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরি এবং ছহীহ দলীলের অনুসরণ করি তাহ’লেই মানব সমাজে শান্তি বয়ে আসবে।
১০ম উপায় : রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শে জীবন গড়া
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শকে মযবূতভাবে অাঁকড়ে ধরতে হবে, তাহ’লেই মানব সমাজ ইহকালীন কল্যাণ লাভ করবে এবং পরকালীন জীবনে জান্নাতের সুখময় স্থানে বসবাস করবে ইনশাআল্লাহ। কেননা রাসূলকে আল্লাহ সর্বোত্তম আদর্শের ধারক বলে উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে এরশাদ করেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের উপর রয়েছে’ (কলম ৪)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ৩৩/২১)। উত্তম আদর্শ হ’ল তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা, কুরআন-সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা এবং শিরক-বিদ‘আতমুক্ত আমল করা, রাসূলের দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী ছালাত আদায় করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্জ সম্পাদন করা, ছিয়াম সাধন করা, সদা সর্বদা সত্য কথা বলা, আমানতের খিয়ানত না করা, একে অপরের গীবত না করা, ভাল কাজে সহযোগিতা করা, ইসলামের সকল হুকুম-আহকাম মেনে চলা, সকল অশ্লীল বেহায়াপনা কাজ থেকে বিরত থাকা, জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা, বিনয়-নম্রতা প্রকাশ করা ইত্যাদি।
মাসরূক্ব (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমরা আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। তিনি আমাদের কাছে হাদীছ বর্ণনা করছিলেন। তিনি বললেন, রাসূল (ছাঃ) স্বভাবগতভাবে অশালীন ছিলেন না এবং তিনি ইচ্ছে করে কাউকে অশালীন কথা বলতেন না। তিনি বলতেন,إِنَّ خِيَارَكُمْ أَحَاسِنُكُمْ أَخْلاَقًا ‘তোমাদের মধ্যে যার স্বভাব-চরিত্র উত্তম, সেই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম’।[16] উত্তম আদর্শ হচ্ছে রাসূল যা দিয়েছেন সেটাকে অাঁকড়ে ধরা এবং যা থেকে নিষেধ করেছন তা পরিত্যাগ করা। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হ’তে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৭)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,دَعُونِى مَا تَرَكْتُكُمْ، إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِسُؤَالِهِمْ وَاخْتِلاَفِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ، فَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَىْءٍ فَاجْتَنِبُوهُ، وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘তোমরা আমাকে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাক, যে পর্যন্ত না আমি তোমাদেরকে কিছু বলি। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা তাদের নবীদেরকে বেশি বেশি প্রশ্ন করা ও নবীদের সঙ্গে মতভেদ করার জন্যই ধ্বংস হয়েছে। তাই আমি যখন তোমাদেরকে কোন ব্যাপারে নিষেধ করি, তখন তা থেকে তোমরা বেঁচে থাক। আর যদি কোন বিষয়ে আদেশ করি, তাহ’লে সাধ্য অনুসারে মেনে চল’।[17]
১১তম উপায় : জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা
কুরআন-সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরতে হবে এবং যে সমস্ত জামা‘আত কুরআন-সুন্নাহর দিকে মানব জাতিকে আহবান করে তাদের জামা‘আতে সংঘবদ্ধ হয়ে দাওয়াতী কাজ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَا وَصَّى بِهِ نُوْحًا وَالَّذِيْ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوسَى وَعِيْسَى أَنْ أَقِيْمُوْا الدِّيْنَ وَلاَ تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ ‘তিনি তোমাদের জন্যে বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে আর যা আমি অহী করেছিলাম তোমাকে এবং যার নিদের্শ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা এই দ্বীনকে (তাওহীদকে) প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে মতভেদ কর না’ (শূরা ১৩)।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِيْنَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ ‘যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তারা বিভক্ত হ’ল তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরেও’ (বাইয়িনাহ ৪)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদ বাহক ও ভয় প্রদর্শকরূপে নবীগণকে প্রেরণ করলেন এবং তিনি তাদের সাথে সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করলেন যেন (ঐ কিতাব) তাদের মতভেদের বিষয়গুলো সম্বন্ধে মীমাংসা করে দেয়। অথচ যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছিল, স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ তাদের নিকট সমাগত হওয়ার পর পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষবশতঃ তারা সে বিষয়ে বিরোধিতা করত’ (বাক্বারাহ ২/২১৩)।
তিনি আরো বলেন, ‘তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির (ইসলাম) অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটা সরল দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। বিশুদ্ধচিত্তে তাঁর অভিমুখী হয়ে তাঁকে ভয় কর, ছালাত কায়েম কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের দ্বীনে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল’ (রূম ৩০-৩২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত হ’তে আহার কর ও সৎকর্ম কর; তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি অবগত। তোমাদের এই জাতি একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব তোমরা আমাকে ভয় কর। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহুধা বিভক্ত করেছে; প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়েই আনন্দিত’ (মুমিনূন ৫১-৫৩)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلاَ تَفَرَّقُوْا ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়রূপে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ১০৩)।
উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হ’ল যে, (কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপর) ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার কারণে একে অপরের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং এর মধ্যে সঠিক দ্বীনের উপর অটল থাকা যায়। আর এ কারণেই গোপনে প্রকাশ্যে সকল আমলই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয়ে থাকে, যার মধ্যে শিরকের লেশমাত্রও থাকে না। পক্ষান্তরে (কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপর) ঐক্যবদ্ধ জামা‘আত থেকে পৃথক হওয়ার কারণে একে অপরের মাঝে ফাটল সৃষ্টি হয় এবং বান্দা অনেক কল্যাণমূলক কাজ থেকে বঞ্চিত হয়। জামা‘আতবদ্ধ হয়ে থাকার ফল হ’ল, আল্লাহর রহমত অর্জন, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন, তাঁর কৃপা অর্জন এবং ইহকালীন এবং পরকালীন জীবনে সৌভাগ্যবান হওয়া। অপরপক্ষে জামা‘আত থেকে পৃথিক হওয়ার পরিণাম হ’ল, আল্লাহর গযবে নিপতিত হওয়া, তাঁর লা‘নত অর্জন, মুখমন্ডল মলিন হওয়া। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের থেকে দায়মুক্ত।[18] রাসূল (ছাঃ) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের তিনটি কাজের উপর সন্তুষ্ট হন। এগুলো হ’ল, তোমাদের ইবাদত সমূহ তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই করো, তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করো না এবং তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে অাঁকড়ে ধরো এবং তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না’।[19] রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, ‘জামা‘আতবদ্ধভাবে থাকা তোমাদের উপর অপরিহার্য এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে সাবধান। নিশ্চয়ই এক জনের সঙ্গী হয় শয়তান এবং সে দু’জনের থেকে দূরে থাকে। অতএব যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামা‘আতকে অপরিহার্য করে নেয়’।[20] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন হ’ল রহমত এবং বিচ্ছিন্ন জীবন হ’ল আযাব’।[21]
[চলবে]
হাফেয আব্দুল মতীন
লিসান্স ও এম.এ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. তাফসীর ইবনে কাছীর (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২২ হিঃ), ২/৩৫।
[2]. মুসলিম হা/২৯৮৫।
[3]. মুসলিম হা/১৭১৮ ।
[4]. বুখারী হা/১৫; মিশকাত হা/৭।
[5]. নাসাঈ হা/৫০১৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৫৮২।
[6]. বুখারী হা/৭২৭৭; মিশকাত হা/৯৫৬।
[7]. বুখারী হা/৭২৮০; মুসলিম হা/২৯৯০; মিশকাত হা/৪৮৩০।
[8]. বুখারী হা/৭২৮২; মিশকাত হা/২৭৪।
[9]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মুখতাছার ছাওয়াইকুল মুরসালাহ, ৪/১৪৪২, প্রকাশক: আযওয়াউস সালাফ, রিয়াদ, ১ম সংস্করণ, ১৪২৫ হিঃ।
[10]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া (মিসর : দারুল ওয়াফা, তা.বি.) ১৯/৫২।
[11]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ৩/৪৬৯।
[12]. ড. আব্দুল মুহসিন তুর্কী, উছূলু মাযহাবিল ইমাম আহমাদ (বৈরূত : মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪১৬ হিঃ), পৃঃ ৭৬৫-৭৬৬।
[13]. ইবনু আবিল ইয হানাফী, আল-ইত্তেবা, তাহক্বীক : মুহাম্মাদ আতাউল্লাহ হানাফী, পৃঃ ২৩।
[14]. বুখারী হা/৩৬৫০; মুসলিম হা/২৫৩৩; মিশকাত হা/৬০০১।
[15]. আবু দাঊদ হা/৪৬০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪৩; তিরমিযী হা/২৫৭৬; মিশকাত হা/১৬৫, সনদ ছহীহ।
[16]. বুখারী হা/৬০৩৫; মিশকাত হা/৫০৭৫।
[17]. বুখারী, হা/৭২৮৮।
[18]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউ ফাতাওয়া, ১/১৭।
[19]. মুসলিম হা/১৭১৫।
[20]. তিরমিযী হা/২১৫৬, সনদ ছহীহ।
[21]. মুসনাদে ইমাম আহমাদ হা/১৮৪৭৩; ছহীহা হা/৬৬৭।