ভুল ধারণা-৭ :
আহলেহাদীছদের দাওয়াতের উদ্দেশ্য মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করা :
সব মতভেদ কি মন্দ? না, বরং সেই মতভেদ মন্দ, যা হকের বিরোধিতায় করা হয়। হকের বিরোধিতা করা গোমরাহী। কিন্তু বাতিলের বিরোধিতা করা ফরয। ইসলাম এটা শিক্ষা দেয় না যে, আপনি সঠিককে ভুল এবং বেঠিককে সঠিক বলবেন। যদি এ নীতি অবলম্বন করা হয় তাহ’লে সমাজ থেকে অন্যায় কর্ম নিষেধ করার আমল শেষ হয়ে যাবে। এমনকি ভুল ও সঠিকের পার্থক্যও ঘুচে যাবে। সেকারণ ভুল কথাগুলির খন্ডন করা যরূরী। চাই সে ভুল গোমরাহী হোক অথবা জ্ঞানগত ভুল হোক।
(১) আহলেহাদীছদের নিকটে নিন্দিত মতভেদ সেটা, যা হকের মোকাবিলায় করা হয় :
আসল মন্দ হ’ল হকের সাথে মতভেদ। সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর তা অস্বীকার করা অথবা তার বিরোধিতা করা এবং হকপন্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের একটা দল তৈরী করা আল্লাহর নিকট শাস্তি পাওয়ার মত উপযুক্ত একটি কাজ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ- ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও তাতে মতভেদ করেছে। এদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)।
বুঝা গেল যে, সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর তার অনুসরণ করার পরিবর্তে নিজের যিদের উপর অটল থাকা এবং আপোসে ঝগড়া-বিবাদ করা সব মন্দের মূল।
কিন্তু ঐক্যের দোহাই দিয়ে একে অপরের ধর্মীয় ভুল-ত্রুটিগুলি এড়িয়ে যাওয়া এবং সংশোধনের জন্য মুখ না খোলা ঠিক নয়। কারণ শুধু ঐক্য উদ্দেশ্য নয়, চাই সেই ঐক্য সঠিক জিনিসের উপর হোক অথবা ভুল জিনিসের উপর। বরং আসল লক্ষ্য হ’ল মুসলমানদের সত্যের উপরে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এজন্য দলীল দ্বারা সাব্যস্ত সত্যের উপরে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে সঠিক কথা বলা যরূরী। এ দায়িত্ব পালন না করলে আলেম সমাজ দায়মুক্ত হ’তে পারেন না।
(২) উম্মতের মতভেদের সময়ে সুন্নাতের অনুসরণেই মুক্তি রয়েছে :
নবী করীম (ছাঃ) পরবর্তী যুগে উম্মতের মাঝে সৃষ্ট মতভেদ সম্পর্কে পূর্বেই অবহিত করেছিলেন। তিনি সে সময় এ কথা বলেননি যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ মতের উপরে অটল থেকে ঐক্য বজায় রাখবে। বরং উম্মতের মতভেদের এ যুগে তিনি তাঁর ও স্বীয় হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের পথ গ্রহণ করার তাকীদ করেছিলেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
‘আমার মৃত্যুর পর তোমাদের মধ্যে যারা
জীবিত থাকবে তারা অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার ও খুলাফায়ে
রাশেদীনের সুন্নাতকে ধারণ করবে। তোমরা সেগুলি কঠিনভাবে অাঁকড়ে ধরবে এবং
মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। আর তোমরা ধর্মের নামে নতুন সৃষ্টি করা হ’তে
বিরত থাকবে। কেননা প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই
ভ্রষ্টতা’।[1]
যদি বাস্তবে চিন্তা করা যায় তবে দেখা যাবে যে, নিজের মতকে দ্বীন আখ্যা দিয়ে এর উপরে গো ধরা এবং নিজের ইচ্ছামত দ্বীনে পরিবর্তন করাই মতভেদের মূল কারণ।
(৩) উম্মতের মতভেদের সময় সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা সহজ কাজ নয় :
পরবর্তী
যুগে অনৈক্য এত ব্যাপক আকার ধারণ করবে যে, উম্মতের মাঝে মতভেদের সময় সেই
মতভেদ দূর করার জন্য নববী সমাধানের দিকে প্রত্যাবর্তন প্রায় অসম্ভব হয়ে
পড়বে। মানুষ ফেরকাবাযী ও দলীয় গোড়ামির চশমা পরে সমস্যার সমাধান করবে। এমন
সময় কুরআন ও সুন্নাহকে অন্য সব কিছুর উপরে অগ্রাধিকার দানকারীদেরকে তীব্র
বিরোধিতা ও দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হ’তে হবে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)
বলেছেন,اَلْمُتَمَسِّكُ بِسُنَّتِيْ عِنْدَ اخْتِلَافِ أُمَّتِيْ
كَالْقَابِضِ عَلَى الْجَمْرِ- ‘আমার উম্মতের মতভেদের সময় আমার সুন্নাতকে
অাঁকড়ে ধারণকারীদের অবস্থা এমন হবে, যেমন জ্বলন্ত অঙ্গার ধারণকারীর অবস্থা
হয়’।[2]
(৪) অপসন্দনীয় হ’লেও আহলেহাদীছদের নিকট সত্য কথা বলা যরূরী :
মানুষের
শত্রুতা ও অসন্তুষ্টির ভয়ে হক কথা গোপন করা মানুষকে জনগণের মাঝে সস্তা
খ্যাতি, গ্রহণযোগ্যতা এবং সাময়িক নিরাপত্তা দিতে পারে, কিন্তু তা আল্লাহ
তা‘আলার নিকট মানুষের নিকট হক প্রকাশ করার দায়িত্ব থেকে তাকে মুক্তি দিতে
পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلَا لَا يَمْنَعَنَّ رَجُلًا هَيْبَةُ
النَّاسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ إِذَا عَلِمَهُ ‘খবরদার! হক জানার পর
মানুষের ভয় তা প্রকাশ করা থেকে যেন কোন ব্যক্তিকে বিরত না রাখে’।[3]
(৫) অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা যরূরী :
আল্লাহর
নবী (ছাঃ) পরবর্তী যুগের হকপন্থীদের এই বিশেষ ফযীলত বর্ণনা করেছেন যে,
তারা মানুষকে ভুল বিষয় থেকে নিষেধ করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ مِنْ
أُمَّتِيْ قَوْمًا يُعْطَوْنَ مِثْلَ أُجُوْرِ أَوَّلِهِمْ فَيُنْكِرُوْنَ
الْمُنْكَرَ ‘আমার উম্মতের মাঝে এমন কিছু মানুষ বিদ্যমান থাকবে যাদেরকে
পূর্ববর্তীদের মত পুরস্কার দেওয়া হবে। তারা ঐ সকল লোক যারা অন্যদেরকে মন্দ
থেকে নিষেধ করবে’।[4]
খোলা কথা হ’ল নিষেধ করার পর কিছু লোক তাদের কথা মানবে এবং কিছু লোক মানবে না। যার ফলে মতানৈক্য দেখা দিবে। কিন্তু শুধু মতভেদ দেখা দেওয়ার ভয়ে মন্দের বিরোধিতা ছেড়ে দেয়া নববী নীতি ও দাওয়াতী হিকমতের সরাসরি বিরোধী।
(৬) দ্বীনী ইলম সমূহকে কুসংস্কারের জাল থেকে পবিত্র করা যরূরী :
আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ
يَنْفُونَ عَنْهُ تَحْرِيفَ الْغَالِينَ وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ
وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِيْنَ ‘পরবর্তীদের মধ্য থেকে এমন মানুষ এ ইলমের
ধারক ও বাহক হবেন, যারা হবেন ন্যায়পরায়ণ। তারা সীমালংঘনকারীদের পরিবর্তন,
মিথ্যা দাবীদারদের অভিযোগ এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে এ ইলমকে পবিত্র
করবেন’।[5]
এ হাদীছ থেকে এটাও জানা গেল যে, দ্বীনকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও অপব্যাখ্যা থেকে নিরাপদ রাখার জন্য ভুলের প্রতিবাদ করা যরূরী। অন্যথায় দ্বীনের আসল শিক্ষা সমূহ কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজের পর্দার পিছে আত্মগোপন করে থাকবে। এজন্য হকপন্থীরা সর্বদা দ্বীনের হেফাযতের এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও পালন করতে থাকবেন। অনুরূপভাবে যারা বিপথগামী হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে হকপন্থী প্রমাণ করতে তৎপর রয়েছে এবং উম্মতের সরল-সিধা মানুষদেরকে স্বীয় প্রতারণাপূর্ণ কথার ফাঁদে ফেলে তাদেরকে নিজেদের দুনিয়া কামানোর মাধ্যম বানিয়েছে, এমন লোকদের স্বরূপ উন্মোচন করা শুধু হকের প্রতিরক্ষাই নয়; বরং উম্মতের কল্যাণকারিতার অন্যতম দাবীও বটে। সেকারণ আহলেহাদীছদের বক্তৃতা ও লেখনী সমূহে যেমন দ্বীনে হকের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও কল্যাণের প্রতি উৎসাহ থাকে, তেমন বাতিল ও বাতিলপন্থীদের খন্ডনও থাকে। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কোন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির পক্ষ থেকেও কোন মাসআলায় জ্ঞানগত ভুল হয়ে গেলে সেটাকেও দ্বীনের হেফাযত এবং হক প্রকাশের জাযবায় আহলেহাদীছরা তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেন। এতে কোন ব্যক্তির খন্ডন উদ্দেশ্য থাকে না। বরং আসল লক্ষ্য থাকে হক প্রকাশ করা। আসলে আহলেহাদীছদের নিকটে হকের স্থান ব্যক্তির অনেক ঊর্ধ্বে।
[চলবে
[1]. আহমাদ হা/১৭১৮৪; আবূদাঊদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪৩; ছহীহুল জামে‘ হা/২৫৪৯।
[2]. ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬৭৬, সনদ হাসান।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/৪৩৪৪।
[4]. আহমাদ হা/১৬৬৪৩; ছহীহুল জামে হা/২২২৪।
[5]. বায়হাকীা/২০৯১১; মিশকাত হা/২৪৮।