পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । শেষ পর্ব ।

৬. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকটে বরকত চাওয়া :

বরকতের মালিক কেবল আল্লাহ তা‘আলা। তাই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মানুষের নিকট বরকত চাওয়া যাবে না। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকটে বরকত প্রার্থনা শিরক। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَفَرَأَيْتُمُ اللاَّتَ وَالْعُزَّى، وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্বন্ধে? (নাজম ১৯-২০)

আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালি (রহঃ) বলেন, মূর্তিপূজার অন্যতম হচ্ছে যে, মুরিদরা মূর্তির নিকট বরকত চায়, তাকে অধিক সম্মান করে, তার নিকট সাহায্য চায়, তার উপর আশা-ভরসা করে, তার কাছে শাফা‘আত চায় ইত্যাদি। এসব কাজ শিরক। যেমনটি কবরপূজারীরা নেক্কার ব্যক্তির কবরের নিকট করে থাকে। অনুরূপভাবে লাত, মানাত, উযযা এবং গাছপালা-পাথর ইত্যাদিকে মুশরিকরা পূজা করত। কোন ব্যক্তির মাযারে গিয়ে বরকত চাওয়া, সম্মান করা, শাফা‘আত ও সাহায্য চাওয়া, সবই শিরক।[1]

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এ ধরনের বরকত নিতে নিষেধ করেছেন। আবু ওয়াক্বীদ আল-লায়ছী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে হুনাইনের (যুদ্ধের) উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। আমরা তখন সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি। এক স্থানে মূর্তিপূজকদের একটি কুল গাছ ছিল; যার চার পার্শ্বে তারা বসত এবং তাদের সমরাস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। গাছটিকে তারা ‘যাতু আনয়াত’ বলত। আমরা একদিন একটি কুল গাছের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মুশরিকদের যেমন ‘যাতে আনয়াত’ আছে, আমাদের জন্যও অনুরূপ যাতে আনয়াত (একটি গাছ নির্ধারণ) করুন। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আল্লাহু আকবার তোমাদের এ দাবীতো পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি ছাড়া কিছুই নয়। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা এমন কথা বলছ, যা বাণী ইসরাঈল মূসা (আঃ)-কে বলেছিল। তারা বলেছিল, হে মূসা! তাদের যেরূপ মা‘বূদ রয়েছে, আমাদের জন্যও ঐরূপ মা‘বূদ বানিয়ে দিন। তখন মূসা বললেন, তোমরা একটি গন্ডমূর্খ জাতি (আ‘রাফ ১৩৮)। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতিই অনুসরণ করছ।[2]

কুরআন ও হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, কুল গাছে অস্ত্র-শস্ত্র ঝুলিয়ে বরকত নেওয়া শিরক। ইমাম ত্বারতুশি বলেন, লক্ষ্য কর, আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন। তোমরা যেখানে কুল গাছ (অথবা যেকোন গাছ) যার দ্বারা মানুষের উদ্দেশ্য থাকে গাছটিকে সম্মান করা এবং তার থেকে কোন রোগের আরোগ্য কামনা করা এবং বরকতের উদ্দেশ্যে অস্ত্র-শস্ত্র ঝুলিয়ে রাখা, এরূপ গাছ যেখানেই পাবে, সেটাই যাতে আনয়াত। বিধায় তাকে কেটে ফেল।[3]

ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যে গাছের নীচে বসে ছাহাবীদের বায়‘আত নিয়েছিলেন, সে গাছটিকে তিনি কাটতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কেননা মানুষেরা গাছটির ছায়াতলে আশ্রয় নিত (বরকত নেওয়ার জন্য)। ইবনে ওমর ফিৎনার ভয় করে গাছটি কেটে ফেলেন।[4]

যেসব বিষয়ে মানুষকে ফিৎনা-ফাসাদে ফেলে সেগুলোকে সমূলে উৎখাত করা শরী‘আত সম্মত হবে, যদিও সেটা কোন মানুষ হয় কিংবা কোন জীব-জন্তু অথবা কোন জড় পদার্থ হয়।[5]

ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, গাছ-পাথর, অথবা প্রতিমা-মূর্তি, ভাষ্কর্য ইত্যাদির পার্শ্বে (বরকতের উদ্দেশ্যে) অবস্থান করা অথবা নবী করীম (ছাঃ) বা অন্যদের কবরে, অথবা নবী যেখানে বসতেন সেখানে বা কোন পীর-আওলিয়ার স্থানে বসা, অবস্থান করা কোন মুসলমানদের দ্বীন নয়, বরং সেটা মুশরিকদের দ্বীনের ন্যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো এর পূর্বে ইবরাহীমকে সৎ পথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তাঁর সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক অবগত। যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন; এই প্রতিমাগুলি কী? যেগুলোর পূজায় তোমরা রত আছ? তারা বলল, আমরা আমাদের পিতৃ পুরুষদেরকে এদের পূজাকারী হিসাবে পেয়েছি। তিনি বললেন, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃ-পুরুষরাও রয়েছে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য বাণী নিয়ে এসেছ, না তুমি খেল-তামাশা করছ? তিনি বললেন, না, তোমাদের প্রতিপালক তো আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং এই বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী। শপথ আল্লাহর! তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের প্রতিমাগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করব। অতঃপর তিনি সেগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন তাদের বড় (প্রধান) প্রতিমাটি ব্যতীত, যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে’ (আম্বিয়া ৫১-৫৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘তাদের নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। তিনি যখন তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা কিসের ইবাদত কর? তারা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে তাদের সম্মানে রত থাকি। তিনি বললেন, তোমরা প্রার্থনা করলে তারা কি শোনে? অথবা তারা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করতে পারে? তারা বলল, বরং আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে এরূপই করতে দেখেছি। তিনি বললেন, তোমরা কি সেগুলো সম্বন্ধে ভেবে দেখেছ, যেগুলোর পূজা করছ? তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষরা, তারা সবাই আমার শত্রু, জগত সমূহের প্রতিপালক ব্যতীত। তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শ করেন। তিনিই আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয় এবং রোগাক্রান্ত হ’লে তিনিই আমাকে রোগ মুক্ত করেন। আর তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাবেন। অতঃপর আমাকে পুনর্জীবিত করবেন। আশা করি তিনি ক্বিয়ামত দিবসে আমার অপরাধ সমূহ মার্জনা করে দিবেন’ (শু‘আরা ৬৯-৮২)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি বাণী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে দিলাম, অতঃপর তারা প্রতিমা পূজায় রত এক জাতির সংস্পর্শে আসল, তখন তারা বলল, হে মূসা! তাদের যেরূপ মা‘বূদ রয়েছে, আমাদের জন্যও ঐরূপ মা‘বূদ বানিয়ে দিন। তখন মূসা বললেন, তোমরা একটি গন্ডমূর্খ জাতি। এসব লোক যে কাজে লিপ্ত রয়েছে, তা তো ধ্বংস করা হবে, আর তারা যা করছে তা অমুলক ও বাতিল বিষয়। তিনি আরো বললেন, আমি কি আল্লাহকে ছেড়ে তোমাদের জন্য অন্য কোন মা‘বূদের সন্ধান করব? অথচ তিনিই হ’লেন একমাত্র আল্লাহ যিনি তোমাদেরকে বিশ্বজগতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (আ‘রাফ ১৩৮-১৪০)

সুতরাং এটাই হচ্ছে মুশরিকদের অবস্থান। আর মুমিনগণ আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান ও ইবাদত করেন, যিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। পক্ষান্তরে মুশরিকরা প্রতিমার পার্শ্বে, কবরের পার্শ্বে, মাযারের পার্শ্বে অবস্থান করে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত করে এবং তাদেরই নিকট আশা-ভরসা করে, তাদেরকেই ভয় করে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের কাছেই শাফা‘আত চায়।[6]

৭. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকটে শাফা‘আত প্রার্থনা করা :

শাফা‘আত আল্লাহর নিকট চাইতে হবে, কোন মাযার বা কোন পীর, ওলী-আওলিয়ার নিকটে নয়। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,أَمِ اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِ اللهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوْا لاَ يَمْلِكُوْنَ شَيْئًا وَلاَ يَعْقِلُوْنَ، قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيْعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ ‘তারা কি আল্লাহ ছাড়া অপরকে শাফা‘আতকারী গ্রহণ করেছে? বল, যদিও তারা কোন ক্ষমতা রাখে না এবং তারা বুঝে না? হে নবী! বলুন, যাবতীয় শাফা‘আত আল্লাহরই ইখতিয়ারে, আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। অতঃপর তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (যুমার ৪৩-৪৪)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَيَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنْفَعُهُمْ وَيَقُوْلُوْنَ هَؤُلاَءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللهِ قُلْ أَتُنَبِّئُوْنَ اللهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُوْنَ ‘আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন বস্ত্ত সমূহেরও ইবাদত করে যারা তাদের কোন অপকারও করতে পারে না এবং তাদের কোন উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুফারিশকারী। আপনি বলুন! তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিচ্ছ যা তিনি অবগত নন, না আকাশ সমূহে, এবং না যমীনে? তিনি পবিত্র ও তাদের মুশরিকী কার্যকলাপ হ’তে অনেক ঊর্ধ্বে’ (ইউনুস ১৮)

আলোচ্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের নিকট শাফা‘আত চাইবে, সে মুশরিক।[7]

আল্লামা ইসমাঈল দেহলভী বলেন, আয়াতটি দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, অবশ্যই যে কোন ব্যক্তি কোন সৃষ্টি জীবের ইবাদত করে এ বিশ্বাসে যে, সে তার জন্য আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করবে, সে শিরক করল এবং মুশরিক হয়ে গেল। কেননা আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে, তারা বলে আমরা তো এদের পূজা এজন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দিবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তাঁর ফায়ছালা করে দিবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন না’।[8]

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্যই, তাঁর সাথে অন্যকে অংশীদার স্থাপন করার জন্য নয়। সুতরাং কোন ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের পূজা করলে, যে তার কোন উপকার ও অপকার কোনটাই করতে পারবে না, যদিও তিনি ফেরেশতা অথবা নবী হন। এ ধরনের ইবাদত শিরক হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে নবী! বলুন, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে মা‘বূদ মনে কর তাদেরকে আহবান কর; দেখবে তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করবার শক্তি তাদের নেই। তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে তাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হ’তে পারে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ’ (বানী ইসরাঈল ৫৬-৫৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘হে নবী বলুন! তোমরা আহবান কর তাদেরকে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (মা‘বূদ) মনে করতে, তারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং এতদুভয়ে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ তার সহায়কও নয়। যাকে অনুমতি দেয়া হয়, তার ছাড়া আল্লাহর নিকট কারো সুফারিশ ফলপ্রসূ হবে না। পরে যখন তাদের অন্তর হ’তে ভয় বিদূরিত হবে তখন তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তোমাদের প্রতিপালক কি বললেন? তদুত্তরে তারা বলবে, যা সত্য তিনি তাই বলেছেন। তিনি সর্বোচ্চ মহান’ (সাবা ২২-২৩)

আলোচ্য আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ক্বিয়ামতের দিন কারো কোন সুফারিশ কাজে আসবে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে অনুমতি দিবেন এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন তাকে ব্যতীত। তাই মহান আল্লাহ বলেন, وَكَم مِّن مَّلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لاَ تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئاً إِلاَّ مِن بَعْدِ أَن يَأْذَنَ اللهُ لِمَن يَشَاءُ وَيَرْضَى ‘আকাশ সমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে, তাদের কোন সুফারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন’ (নাজম ২৬)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, পীর বা অলী-আওলিয়াগণ ক্বিয়ামতের দিন তাদের মুরীদগণকে সুফারিশ করে জান্নাতে পাঠাবে, এ ধারণা ভুল ও বাতিল। ক্বিয়ামতের দিন সবাই ভয়ে ভীত হয়ে থাকবে, এমনকি নবী-রাসূলগণও। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, মা‘বাদ ইবনু হিলাল আল-আনাযী হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা বছরাবাসী কিছু লোক একত্রিত হয়ে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর কাছে গেলাম। আমাদের সঙ্গে ছাবিত (রাঃ)-কে নিলাম, যাতে তিনি আমাদের কাছে আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত শাফা‘আত সম্পর্কে হাদীছ জিজ্ঞেস করেন। আমরা তাঁকে তাঁর মহলেই চাশতের ছালাতরত পেলাম। তাঁর কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলে তিনি আমাদেরকে অনুমতি দিলেন। তখন তিনি তাঁর বিছানায় উপবিষ্ট অবস্থায় ছিলেন। অতঃপর আমরা ছাবিত (রাঃ)-কে অনুরোধ করলাম, তিনি যেন শাফা‘আতের হাদীছটি জিজ্ঞেস করার পূর্বে অন্য কিছু জিজ্ঞেস না করেন। তখন ছাবিত (রাঃ) বললেন, হে আবূ হামযাহ! এরা বছরাবাসী আপনার ভাই, তারা শাফা‘আতের হাদীছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছে। অতঃপর আনাস (রাঃ) বললেন, আমাদের নিকট মুহাম্মাদ (ছাঃ) হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, ‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষ সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তাই তারা আদম (আঃ)-এর কাছে এসে বলবে, আমাদের জন্য আপনার রবের নিকট সুফারিশ করুন। তিনি বলবেন, এ কাজের আমি যোগ্য নই। বরং তোমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি হ’লেন আল্লাহর খলীফা। তখন তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর কাছে যাবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের জন্য নই। তবে তোমরা মূসা (আঃ)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। তখন তারা মূসা (আঃ)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি তো এ কাজের জন্য নই। তোমরা ঈসা (আঃ)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি আল্লাহর রূহ ও বাণী। তারা তখন ঈসা (আঃ)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি তো এ কাজের জন্য নই। তোমরা বরং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কাছে যাও। এরপর তারা আমার কাছে আসবে। আমি বলব, আমিই এ কাজের জন্য। আমি তখন আমার রবের নিকট অনুমতি চাইব। আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। আমাকে প্রশংসাসূচক বাক্য ইলহাম করা হবে, যা দিয়ে আমি আল্লাহর প্রশংসা করব। যেগুলো এখন আমার জানা নেই।

আমি সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে প্রশংসা করব এবং সিজদায় পড়ে যাব। তখন আমাকে বলা হবে, ইয়া মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তুমি বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে। সুফারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মত! আমার উম্মত! বলা হবে যাও, যাদের হৃদয়ে যবের দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে দাও। আমি গিয়ে এমনই করব। তারপর আমি ফিরে আসব এবং পুনরায় সেসব প্রশংসা বাক্য দ্বারা আল্লাহর প্রশংসা করব এবং সিজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে। সুফারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার রব! আমার উম্মত! আমার উম্মত! তখন বলা হবে, যাও, যাদের অন্তরে এক অণু কিংবা সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের কর। আমি গিয়ে তাই করব। আমি আবার ফিরে আসব এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব। আর সিজদায় পড়ে যাব। আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও দেয়া হবে। সুফারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। আমি তখন বলব। হে আমার রব! আমার উম্মত। আমার উম্মত। এরপর আল্লাহ বলবেন, যাও যাদের অন্তরে সরিষার দানার চেয়েও অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আন। আমি যাব এবং তাই করব।

আমরা যখন আনাস (রাঃ)-এর নিকট থেকে বের হয়ে আসছিলাম, তখন আমি আমার সঙ্গীদের কোন একজনকে বললাম, আমরা যদি আবু খলীফার বাড়িতে নিজেকে গোপনে রাখা হাসান বছরীর কাছে গিয়ে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি তাঁর কাছে বর্ণনা করতাম। এরপর আমরা হাসান বছরীর কাছে এসে তাঁর কাছে অনুমতির সালাম দিলাম। তিনি আমাদের প্রবেশের অনুমতি দিলেন। আমরা তাঁকে বললাম, হে আবু সাঈদ! আমরা আপনার ভাই আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর নিকট হ’তে আপনার কাছে আসলাম। শাফা‘আত বিষয়ে তিনি যেমন বর্ণনা দিয়েছেন, তেমন বর্ণনা করতে আমরা আর কাউকে শুনিনি। তিনি বললেন, আমার কাছে সেটি বর্ণনা কর। আমরা তাঁকে হাদীছটি বর্ণনা করে শোনালাম। তিনি বললেন, আরো বর্ণনা কর। আমরা বললাম, তিনি তো এর অধিক আমাদের কাছে বর্ণনা করেননি। তিনি বললেন, জানি না, তিনি কি ভুলেই গেলেন, না তোমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বলে বাকীটুকু বর্ণনা করতে অপসন্দ করলেন? বিশ বছর আগে যখন তিনি শক্তি-সামর্থ্যে ও স্মরণ শক্তিতে দৃঢ় ছিলেন, তখন আমার কাছেও হাদীছটি বর্ণনা করেছিলেন। আমরা বললাম, হে আবু সাঈদ! আমাদের কাছে হাদীছটি বর্ণনা করুন। তিনি হাসলেন এবং বললেন, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে খুব বেশী ধ্রুততাপ্রিয় করে। আমিতো বর্ণনার উদ্দেশ্যেই তোমাদের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করলাম। তিনি তোমাদের কাছে যা বর্ণনা করেছেন, আমার কাছেও তা বর্ণনা করেছেন, তবে পরে এটুকুও বলেছিলেন, আমি চতুর্থবার ফিরে আসব এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব এবং সিজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে। শাফা‘আত কর, গ্রহণ করা হবে। আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তাদের সম্পর্কে শাফা‘আত করার অনুমতি দান কর, যারা ‘লা-ইলা-হা ইল্লাহ’ বলেছে। তখন আল্লাহ বলবেন, আমার ইয্যত, আমার পরাক্রম, আমার বড়ত্ব ও আমার মহত্বের শপথ! যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, আমি অবশ্য অবশ্যই তাদের সবাইকে জাহান্নাম থেকে বের করব’।[9]

আলোচ্য হাদীছ থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, কোন পীর, অলী-আওলিয়া বা কোন সৎ মানুষের শাফা‘আত করার কোন অধিকারই থাকবে না। শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলা যাকে অনুমতি দিবেন এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন সে ব্যতীত। উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা আরো জানা যায় যে, সকল নবী-রাসূলই নিজ নিজ ওযর পেশ করবেন এবং বলবেন আমি এ কাজের যোগ্য নই। সবশেষে রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর প্রশংসা করবেন এবং সিজদায় পড়ে কাঁদবেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাফা‘আতের অনুমতি দিবেন। সেদিন নবী করীম (ছাঃ) শিরককারীদের জন্য শাফা‘আত করবেন না। শুধুমাত্র তাওহীদপন্থীদের জন্য শাফা‘আত করবেন। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ক্বিয়ামতের দিন আপনার শাফা‘আত দ্বারা সমস্ত মানুষ থেকে অধিক ভাগ্যবান হবে কোন ব্যক্তি? তখন তিনি বলবেন, হে আবু হুরায়রাহ! আমি ধারণা করেছিলাম যে, তোমার আগে কেউ এ ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করবে না। কারণ হাদীছের প্রতি তোমার চেয়ে বেশী আগ্রহী আমি আর কাউকে দেখিনি। ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত দ্বারা সবচেয়ে ভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি হবে যে বিশুদ্ধ অন্তরে বলে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই’।[10]

মানুষ গুনাহ করলেই কাফের হয়ে যায় না এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামীও হয় না। বরং জাহান্নামী হওয়া, না হওয়া আল্লাহর হাতে। যেমন হাদীছে এসেছে, উবাদাহ ইবনু ছামিত (রাঃ) যিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও লায়লাতুল আকাবার একজন নকীব ছিলেন তিনি বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর পাশে একজন ছাহাবীর উপস্থিতিতে তিনি বলেন, তোমরা আমার নিকট এই মর্মে বায়‘আত গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবে না এবং সৎ কাজে নাফরমানী করবে না। তোমাদের মধ্যে যে তা পূর্ণ করবে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হ’লে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে গেলে, তা হবে তার জন্য কাফফারা। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়লে এবং আল্লাহ তা অপ্রকাশিত রাখলে, তবে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যদি চান, তাকে মার্জনা করবেন আর যদি চান, তাকে শাস্তি প্রদান করবেন। আমরা এর উপর বায়‘আত গ্রহণ করলাম।[11]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘জান্নাতবাসীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের বলবেন, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম হ’তে বের করে আন। তারপর তাদের জাহান্নাম হ’তে এমন অবস্থায় বের করা হবে যে, তারা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। অতঃপর তাদের বৃষ্টিতে বা হায়াতের (বর্ণনাকারী মালিক (রহঃ) শব্দ দু’টোর কোনটি এ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন) নদীতে নিক্ষেপ করা হবে। ফলে তারা সতেজ হয়ে উঠবে, যেমন নদীর তীরে ঘাসের বীজ গজিয়ে ওঠে। তুমি কি দেখতে পাও না সেগুলো কেমন হলুদ বর্ণের হয় ও ঘন হয়ে গজায়?[12] ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) সূত্রে নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শাফা‘আতে একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদেরকে জাহান্নামী বলেই সম্বোধন করা হবে।[13]

বরকত দান ও শাফা‘আতের মালিক কেবল মহান আল্লাহ। এগুলো করার কোন ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। সেজন্য কোন মানুষ বা পীর, অলী, গাউছ-কুতুবকে শাফা‘আতকারী মানা যাবে না, তাদের নিকটে বরকতও প্রার্থনা করা যাবে না। যেখানে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কোন নবী-রাসূল শাফা‘আত করার সামর্থ্য রাখেন না, সেখানে সাধারণ মানুষ কি করে সুফারিশ করতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারে সকলকে সাবধান হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাযত করুন- আমীন!

[চলবে]

হাফেয আব্দুল মতীন

এম.এ (অধ্যায়ন রত), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।

[1]. আদ-দ্বীনুল খালেছ ২/১৭৭-৭৮

[2]. তিরমিযী হা/২১৮০, সনদ ছহীহ

[3]. আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদা‘ পৃঃ ১০৫

[4]. তদেব, পৃঃ ১৪৮, ১৬০; ফতহুল বারী ৭/৪৪৮

[5]. ফতহুল বারী ৮/৭৩

[6]. ইবনু তায়মিয়া, ইকতেযাউছ ছিরাতিল মুস্তাকীম ২/৮১৮-১৯

[7]. যিয়ারাতুল কুবূর আশ-শারইয়াহ ও শিরকিয়াহ, পৃঃ ৩৩-৩৫

[8]. যুমার ৩; রিসালাতুত তাওহীদ, পৃঃ ৫৩-৫৪

[9]. বুখারী হা/৭৫১০

[10]. বুখারী হা/৬৫৭০

[11]. বুখারী হা/১৮

[12]. বুখারী হা/২২

[13]. বুখারী হা/৬৫৬৬






রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ভালবাসা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ইহসান ইলাহী যহীর
আমাদের পরিচয় কি শুধুই মুসলিম? - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
রবার্ট ক্লাইভ : ইতিহাসের এক ঘৃণ্য খলনায়ক - ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
গোপন ইবাদতে অভ্যস্ত হওয়ার উপায় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ : একটি পর্যালোচনা (জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী সংখ্যার পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আধুনিক বিজ্ঞানে ইসলামের ভূমিকা - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মানবসম্পদ উন্নয়নে ইমামদের ভূমিকা - জামীলুর রহমান - কোরপাই, বুড়িচং, কুমিল্লা
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত - মুযাফফর বিন মুহসিন
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান (শেষ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
শরী‘আতের আলোকে জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আরও
আরও
.