‘যাকাত’ অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে ঐ দান, যা আল্লাহর নিকটে ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং যাকাত দাতার মালকে পরিশুদ্ধ করে। ‘ছাদাক্বা’ অর্থ ঐ দান, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। পারিভাষিকভাবে যাকাত ও ছাদাক্বা মূলতঃ একই মর্মার্থে ব্যবহৃত হয়।

যাকাত ও ছাদাক্বার উদ্দেশ্য : যাকাত ও ছাদাক্বার মূল উদ্দেশ্য হ’ল দারিদ্র্য বিমোচন ও ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَاءِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَاءِهِمْ- ‘আল্লাহ তাদের উপরে ছাদাক্বা ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে নেওয়া হবে ও তাদের গরীবদের মধ্যে দেওয়া হবে’।[1]

যাকাতের প্রকারভেদ : যাকাত চার প্রকার মালে ফরয হয়ে থাকে। ১. স্বর্ণ-রৌপ্য বা সঞ্চিত টাকা-পয়সা ২. ব্যবসায়রত সম্পদ ৩. উৎপন্ন ফসল ৪. গবাদি পশু। টাকা-পয়সা একবছর সঞ্চিত থাকলে শতকরা আড়াই টাকা বা ৪০ ভাগের ১ ভাগ হারে যাকাত বের  করতে  হয়।  ব্যবসায়রত  সম্পদ  ও  গবাদি  পশুর মূলধনের এক বছর হিসাব করে যাকাত দিতে হয়। উৎপন্ন ফসল যেদিন হস্তগত হবে সেদিনই যাকাত (ওশর) ফরয হয়। এর জন্য বছরপূর্তি শর্ত নয়।

যাকাতের নিছাব : ১. স্বর্ণ-রৌপ্যে পাঁচ উক্বিয়া বা ২০০ দিরহাম। ২. ব্যবসায়রত সম্পদ-এর নিছাব স্বর্ণ-রৌপ্যের ন্যায়। ৩. খাদ্য শস্যের নিছাব পাঁচ অসাক্ব, যা হিজাযী ছা‘ অনুযায়ী ১৯ মণ ১২ সেরের কাছাকাছি বা ৭১৭ কেজির মত হয়। এতে ওশর বা এক দশমাংশ নির্ধারিত। সেচা পানিতে হ’লে নিছফে ওশর বা /২০ অংশ দিবে। ৪. গবাদি পশু : (ক) উট ৫টিতে একটি ছাগল (খ) গরু-মহিষ ৩০টিতে ১টি দ্বিতীয় বছরে পদার্পণকারী বাছুর (গ) ছাগল-ভেড়া-দুম্বা ৪০টিতে একটি ছাগল।[2]

যাকাতুল ফিৎর : এটিও ফরয যাকাত, যা ঈদুল ফিৎরের ছালাতে বের হওয়ার আগেই মাথা প্রতি এক ছা‘ বা মধ্যম হাতের চার অঞ্জলী (আড়াই কেজি) হিসাবে দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হ’তে প্রদান করতে হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের স্বাধীন ও ক্রীতদাস, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ খেজুর, যব ইত্যাদি (অন্য বর্ণনায়) খাদ্যবস্ত্ত ফিৎরার যাকাত হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে আদায় করার নির্দেশ দান করেছেন’।[3] ছোট-বড়, ধনী-গরীব সকল মুসলিম নর-নারীর উপরে যাকাতুল ফিৎর ফরয। এর জন্য ‘ছাহেবে নিছাব’ অর্থাৎ সাংসারিক প্রয়োজন সমূহ বাদে ২০০ দিরহাম বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপা কিংবা সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণের মালিক হওয়া শর্ত নয়। এটি ঈদের ১ বা ২ দিন পূর্বে জমাকারীর নিকট জমা করতে হয়। পরে দিলে সেটি সাধারণ ছাদাক্বায় পরিণত হয়। এটি ফরয ছাদাক্বা। যা আদায় না করলে তার উপর ঋণ হিসাবে থেকে যাবে (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩৮৬)

বায়তুল মাল জমা করা : ফিৎরা ঈদের এক বা দু’দিন পূর্বে বায়তুল মালে জমা করা সুন্নাত। ইবনু ওমর (রাঃ) অনুরূপভাবে জমা করতেন। ঈদুল ফিৎরের দু’তিন দিন পূর্বে খলীফার পক্ষ হ’তে ফিৎরা জমাকারীগণ ফিৎরা সংগ্রহের জন্য বসতেন ও লোকেরা তাঁর কাছে গিয়ে ফিৎরা জমা করত। ঈদের পরে হকদারগণের মধ্যে বণ্টন করা হ’ত।[4]

যাকাত-ওশর-ফিৎরা-কুরবানী ইত্যাদি ফরয ও নফল ছাদাক্বা  রাষ্ট্র কিংবা কোন বিশ্বস্ত ইসলামী সংস্থা-র নিকটে জমা করা, অতঃপর সেই সংস্থা-র মাধ্যমে বণ্টন করাই হ’ল বায়তুল মাল বণ্টনের সুন্নাতী তরীকা। ছাহাবায়ে কেরামের যুগে এ ব্যবস্থাই চালু ছিল। তাঁরা কখনোই নিজেদের যাকাত নিজেরা হাতে করে বণ্টন করতেন না। বরং যাকাত সংগ্রহকারীর নিকটে গিয়ে জমা দিয়ে আসতেন। এখনও সঊদী আরব, কুয়েত প্রভৃতি আরব দেশে এ রেওয়াজ চালু আছে।

ছাদাক্বা ব্যয়ের খাত সমূহ : পবিত্র কুরআনে সূরা তওবার ৬০ আয়াতে ফরয ছাদাক্বা সমূহ ব্যয়ের আটটি খাত বর্ণিত হয়েছে। যাকাতুল ফিৎর এর অন্তর্ভুক্ত। যদিও ফকীর-মিসকীনকে অধিকহারে দেওয়ার ব্যাপারে তাকীদ রয়েছে। খাতসমূহ :-

১. ফকীর : নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী। ২. মিসকীন : অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যে নিজের প্রয়োজন মিটাতেও পারে না, মুখ ফুটে চাইতেও পারে না। বাহ্যিকভাবে তাকে সচ্ছল বলেই মনে হয়। ৩. ‘আমেলীন : যাকাত আদায়ের জন্য নিযুক্ত সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ। ৪. ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তিগণ : অমুসলিমদেরকে ইসলামে দাখিল করাবার জন্য ও নও মুসলিমদের ইসলামের উপর দৃঢ় রাখার জন্য এই খাতটি নির্দিষ্ট। ৫. দাসমুক্তি : এই খাত বর্তমানে শূন্য। তবে অনেক বিদ্বান অসহায় কয়েদীদের মুক্তিকে এই খাতের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন (কুরতুবী)৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি : যার সম্পদের তুলনায় ঋণের অংক বেশী। কিন্তু যদি তার ঋণ থাকে ও সম্পদ না থাকে, এমতাবস্থায় সে ফকীর ও ঋণগ্রস্ত দু’টি খাতের হকদার হবে। ৭. ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা। এটি জিহাদের খাত হিসাবে অগ্রগণ্য। ৮. দুস্থ মুসাফির : পথিমধ্যে কোন কারণবশতঃ পাথেয় শূন্য হয়ে পড়লে পথিকগণ এই খাত হ’তে সাহায্য পাবেন। যদিও তিনি নিজ বাড়ীতে সম্পদশালী হন। ফিৎরা অন্যতম ফরয যাকাত হিসাবে তা উপরোক্ত খাত সমূহে বা ঐগুলির একাধিক খাতে ব্যয় করতে হবে। খাত বহির্ভূতভাবে ৪ নং খাত ব্যতীত অন্য কোন অমুসলিমকে ফিৎরা দেওয়া জায়েয নয়। কারণ মুসলিমদের নিকট থেকে যাকাত নিয়ে মুসলিম হকদারদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য হাদীছে নির্দেশ এসেছে। যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।[5]


[1]. বুখারী হা/১৪৯৬; মুসলিম হা/১৯ মিশকাত হা/১৭৭২ ‘যাকাত’ অধ্যায়।

[2]. বিস্তারিত নিছাব দ্রঃ ‘বঙ্গানুবাদ খুৎবা’ ‘যাকাত’ অধ্যায়।

[3]. বুখারী হা/১৫০৩, ১৫০৬; মুসলিম হা/৯৮৬, ৯৮৫; মিশকাত হা/১৮১৫-১৬।

[4]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/১৫১১-এর আলোচনা, মির‘আত ১/২০৭ পৃ.।

[5]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩৬২-৭৪; মির‘আত হা/১৮৩৩-এর ব্যাখ্যা, ১/২০৫-৬।





চুল ও দাড়িতে মেহেদী ব্যবহার করার বিধান - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
বিশ্ব ভালবাসা দিবস - আত-তাহরীক ডেস্ক
লজ্জাশীলতা উত্তম চরিত্রের ভূষণ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
তালাকের শারঈ পদ্ধতি ও হিল্লা বিয়ের বিধান - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ছালাত পরিত্যাগকারীর ভয়াবহ পরিণতি (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আল্লাহর উপর ভরসা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৯ম কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
শবেবরাত : কতিপয় ভ্রান্ত ধারণার জবাব - আত-তাহরীক ডেস্ক
অপরিবর্তনীয় জ্ঞান বনাম পরিবর্তনীয় জ্ঞান - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
হজ্জ : ফযীলত ও উপকারিতা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
সার্ভকোয়াল মডেলের আলোকে শিক্ষা পরিষেবার গুণমান নির্ণয় - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
শারঈ ইমারত - ড. নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.