পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । শেষ পর্ব ।
১২তম উপায় : হক্বের উপর অটল থাকা
কুরআন ও ছহীহ হাদীছ জানার সাথে সাথে তার প্রতি আমল শুরু করতে হবে। যদি পূর্বে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন বাতিল আমল চালু থাকে তৎক্ষণাৎ সে আমল বর্জন করে হক্ব গ্রহণ করতে হবে। কারণالْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلاَ تَكُنْ مِنَ الْمُمْتَرِيْنَ ‘হক্ব তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে। সুতরাং তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/৬০)। যারা জান্নাত পেতে চায় তাদের অবশ্যই হক্বের উপর অবিচল থাকতে হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِيْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ ‘নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর তাতে অবিচল থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা এবং বলে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০)। হক্বের উপর দৃঢ় থাকতে হ’লে নিজের ইচ্ছা মত চলা যাবে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,فَلِذَالِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلاَ تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ اللهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ ‘সুতরাং তুমি উহার দিকে আহবান কর এবং তাতেই দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাক যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছ এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। বল, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস করি এবং আমি আদিষ্ট হয়েছি তোমাদের মধ্যে ইনছাফ করতে। আল্লাহই আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক’ (শূরা ৪২/১৫)। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ আছ-ছাক্বাফী হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম,يَا رَسُوْلَ اللهِ قُلْ لِىْ فِى الإِسْلاَمِ قَوْلاً لاَ أَسْأَلُ عَنْهُ أَحَدًا بَعْدَكَ وَفِىْ حَدِيْثِ أَبِىْ أُسَامَةَ غَيْرَكَ قَالَ قُلْ آمَنْتُ بِاللهِ فَاسْتَقِمْ. অর্থাৎ ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন একটি কথা বলুন, যে সম্পর্কে আপনার পর অন্য কাউকে আমি জিজ্ঞেস করব না। আবু উসামা বর্ণিত হাদীছে এসেছে, আপনাকে ছাড়া অন্যকে জিজ্ঞেস করব না। তিনি (ছাঃ) বললেন, তুমি বল, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম, অতঃপর এর উপরই দৃঢ় থাকো’।[1]
মোদ্দাকথা হক্ব এবং বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে, যখন কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ কোন বিষয়কে বাতিল সাব্যস্ত করে এবং শিরক-বিদ‘আত বলে জানা যাবে তখনই হক্ব বিষয়টিকে গ্রহণ করতে হবে। আর বাতিল বিষয়টিকে চিরতরে পরিত্যাগ করতে হবে। কোন মাযহাবী গোঁড়ামি না করে হক্বকে মযবূত করে ধরতে হবে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে জীবিত করতে হবে। নিজে হক্বের উপর দৃঢ় থাকতে হবে, অপরকে হক্বের পথে ডাকতে হবে এবং হক্বপন্থী জামা‘আতের অনুসারী হ’তে হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَزَالُ مِنْ أُمَّتِى أُمَّةٌ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللهِ، لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ وَلاَ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল আল্লাহর নির্দেশের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে, পরিত্যাগকারীরা এবং বিরোধিতাকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[2] অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِىْ يُقَاتِلُوْنَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ عَلَى مَنْ نَاوَأَهُمْ حَتَّى يُقَاتِلَ آخِرُهُمُ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হক্বের উপর লড়াই করতে থাকবে। তারা তাদের শত্রুদের উপর বিজয়ী থাকবে। এমনকি তাদের শেষ দলটি দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’।[3]
১৩তম উপায় : কুরআন গবেষণা করা
মহান আল্লাহ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন মানব জাতির হিদায়াতের জন্য। তিনি বলেন,إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِيْ لِلَّتِيْ هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِيْنَ الَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيْرًا ‘নিশ্চয়ই এই কুরআন পথ নির্দেশ করে সেই পথের দিকে যা সুদৃঢ় এবং সৎকর্মপরায়ণ বিশ্বাসীদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে রয়েছে মহা পুরস্কার’ (বানী ইসরাইল ১৭/৯)।
পবিত্র কুরআনে মানব জাতির রোগ-ব্যাধির আরোগ্য নিহিত রয়েছে। এতেই রয়েছে সকল উপদেশ বাণী এবং রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির দিশা। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُوْرِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِيْنَ ‘হে মানুষ! তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে উপদেশ এবং তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তার আরোগ্য এবং মুমিনদের জন্য পথ নির্দেশ ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,قُلْ هُوَ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا هُدًى وَشِفَاءٌ ‘হে নবী! বলুন, মুমিনদের জন্য এটা পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিষেধক’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৪)।
এটি এমন এক গ্রন্থ যার মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই এবং যা মুত্ত্বাকীদের জন্য হিদায়াত স্বরূপ। মহান আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِلْمُتَّقِيْنَ ‘এটা সেই গ্রন্থ যাতে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। আল্লাহভীরুদের (মুত্তাক্বীদের) জন্যে এটি পথনির্দেশ’ (বাক্বারাহ ২/২)। তিনি আরো বলেন, هَذَا بَيَانٌ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِلْمُتَّقِيْنَ ‘এটা (পবিত্র কুরআন) মানবমন্ডলীর জন্য স্পষ্ট বিবরণ এবং আল্লাহভীরুদের জন্য হিদায়াত ও উপদেশ’ (আলে ইমরান ৩/১৩৮)। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই তাঁর ইবাদত-বন্দিগী করে, সে আল্লাহর রহমতে অবশ্যই হিদায়াতের পথ পাবে। মহান আল্লাহ বলেন,يَهْدِيْ بِهِ اللهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلاَمِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوْرِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيْهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ ‘তা দ্বারা আল্লাহ এরূপ লোকদেরকে শান্তির পন্থাসমূহ বলে দেন যারা তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এবং তিনি তাদেরকে নিজ অনুমতিক্রমে (কুফরীর) অন্ধকার থেকে বের করে (ঈমানের) আলোর দিকে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’ (মায়েদাহ ৫/১৬)। আর আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-কে মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তিনি এরশাদ করেন, هُوَ الَّذِيْ أَرْسَلَ رَسُوْلَهُ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ ‘তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত এবং সত্য দ্বীনসহ সকল দ্বীনের উপর ওকে বিজয়ী করার জন্যে, যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে’ (তওবা ৯/৩৩; ছফ ৬১/৯)। আয়াতটিতে ‘আল-হুদা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে (রাসূল) প্রেরিত হয়েছেন (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সত্য সংবাদদাতা এবং সত্য বার্তাবাহক হিসাবে, সঠিক ঈমান নিয়ে এবং উপকারী জ্ঞান নিয়ে। ‘দ্বীনুল হক্ব’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সৎ আমল এবং সে সৎ আমলটি সঠিক কল্যাণকর যেটি ইহকাল ও পরকালীন জীবনে কল্যাণ বয়ে আনবে।[4]
উপরের আয়াতদ্বয় দ্বারা বুঝা যায় যে, সকল প্রকার ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে; কোন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে করলে শিরক হবে। দ্বিতীয়তঃ রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করতে হবে যথাযথ। অর্থাৎ ছহীহ হাদীছ পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। অন্যের কথাকে রাসূলের কথার উপর প্রাধান্য দিলে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে এবং যারা রাসূলের উপর ঈমান এনেছে তাদেরকে সাহায্য করবেন মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি মানব জাতিকে তার কর্মের প্রতিদান দিবেন। যদি তারা ভাল আমল করে তার প্রতিফল ভাল পাবে, পক্ষান্তরে যদি খারাপ আমল করে তার প্রতিফলও সে অচিরেই পাবে। অতএব যে ব্যক্তি কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহকে মানবে না এবং রাসূলগণের বিরোধিতা করবে, সে অবশ্যই তার পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করবে। যে শাস্তি পেয়েছিল ফেরাঊন, হামান ও কারূন। মূসা (আঃ)-এর নাফরমানি করার কারণে ফেরাঊনকে ও তার অনুসারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ধ্বংস করেছিলেন।[5] সুতরাং আসুন! কুরআন বুঝে পড়ি এবং সে অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করি। কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা করি, যে সঠিক ব্যাখ্যা রাসূল (ছাঃ) এর উপর অবতীর্ণ হরেছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلاَ يَأْتُوْنَكَ بِمَثَلٍ إِلاَّ جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيْرًا ‘তারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করে না, যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করি না’ (ফুরক্বান ২৫/৩৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, اَللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيْثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُوْدُ الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِيْنُ جُلُوْدُهُمْ وَقُلُوْبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللهِ ذَلِكَ هُدَى اللهِ يَهْدِيْ بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ ‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন সর্বোত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের গাত্র রোমাঞ্চিত হয়, অতঃপর তাদের দেহ-মন প্রশান্ত হয়ে আললাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটাই আল্লাহর পথ নির্দেশ, তিনি যাকে ইচ্ছা ওটা দ্বারা পথ-প্রদর্শন করেন। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন পথ-প্রদর্শক নেই’ (যুমার ৩৯/২৩)।
কুরআনকে বুঝে সে অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এবং ইহকালীন ও পরকালীন জীবন সুখময় করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, الَّذِيْنَ يَسْتَمِعُوْنَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُوْنَ أَحْسَنَهُ أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ هَدَاهُمُ اللهُ وَأُوْلَئِكَ هُمْ أُوْلُو الْأَلْبَابِ ‘যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে এবং ওর মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহ সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং তারাই বোধশক্তি সম্পন্ন’ (যুমার ৩৯/১৮)।
উপরের আয়াতদ্বয় থেকে বুঝা যায় যে, ভাল কাজ করার ফলে ঈমান বৃদ্ধি পায়, পক্ষান্তরে খারাপ কাজ করলে ঈমান কমে যায়। অপরপক্ষে কুরআনের অপব্যাখ্যা করলে দ্বীনের সঠিক পথ পাওয়া যায় না। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِيْ هَذَا الْقُرْآنِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُوْنَ، قُرْآنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِيْ عِوَجٍ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ ‘আমি এই কুরআনে মানুষের জন্যে সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত প্রদান করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ কর। আরবী ভাষায় এই কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে মানুষ তাক্বওয়া অবলম্বন করে’ (যুমার ৩৯/২৭-২৮)। তিনি আরো বলেন, وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِيْ اخْتَلَفُوْا فِيْهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُوْنَ ‘আমি তো তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যারা এ বিষয়ে মতভেদ করে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিবার জন্যে এবং মুমিনদের জন্যে পথ নির্দেশ ও রহমত স্বরূপ’ (নাহল ১৬/৬৪)। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ إِنِّىْ أُوتِيْتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘তোমরা জেনে রেখ, আমি কিতাব (কুরআন) এবং তার সাথে তার অনুরূপ আরেকটি বস্ত্ত (হাদীছ) প্রাপ্ত হয়েছি’।[6] উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াত এবং হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহকে মযবূতভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। যদি কেউ উভয়ের একটিকে অস্বীকার করে তাহ’লে সে যেন উভয়কে অস্বীকার করল। যেমন কেউ যদি একজন নবী-রাসূলকে অস্বীকার করে তাহ’লে সে যেন সকল নবী-রাসূলকে অস্বীকার করল, যার কারণে সে দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে। অতএব কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকে বুঝে পড়ে আমল করার মাধ্যমে মানব জাতি সাফল্য লাভ করতে পারে। আল্লাহ বলেন, الر تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْمُبِيْنِ، إِنَّا أَنزَلْنَاهُ قُرْآناً عَرَبِيّاً لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ- ‘আলিফ লাম-রা। এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত। আমি তাকে অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কুরআন (রূপে), যাতে তোমরা বুঝতে পার’ (ইউসুফ ১২/১-২)।
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন বুঝা, আমল করার জন্য ও গবেষণার জন্যে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ- ‘আমি এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করি মানুষের জন্য, যাতে তারা চিন্তা করে’ (হাশর ৫৯/২১)। অত্র আয়াতটিতে কুরআন গবেষণার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,أَفَلاَ يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوْبٍ أَقْفَالُهَا- ‘তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)। এ আয়াতে মহান আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে কুরআন নিয়ে গবেষণা এবং চিন্তা-ভাবনা ও বুঝে (আমল করার জন্য) আদেশ করেছেন এবং আমল থেকে বিমুখ হ’তে নিষেধ করেছেন। কারণ যারা তা থেকে বিমুখ হবে তাদের অন্তর তালাবদ্ধ হয়ে যাবে।[7] আল্লাহর যিকর বা স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِيْ فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى، قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِيْ أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا، قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى- ‘যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তিনি বলবেন, এরূপই আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হ’লে’ (ত্বা-হা ২০/১২৪-১২৬)। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অাঁকড়ে ধরে সে অনুযায়ী আমল করলে মানব জাতি সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহন করবে। আর উভয় থেকে মুখ ফিরালে অধঃপতনের অতল তলে নিমজ্জিত হবে।
ইবনু আওন বলেন,ثَلاَثٌ أُحِبُّهُنَّ لِنَفْسِىْ وَلإِخْوَانِىْ هَذِهِ السُّنَّةُ أَنْ يَتَعَلَّمُوْهَا وَيَسْأَلُوْا عَنْهَا، وَالْقُرْآنُ أَنْ يَتَفَهَّمُوْهُ وَيَسْأَلُوْا عَنْهُ، وَيَدْعُوا النَّاسَ إِلاَّ مِنْ خَيْرٍ ‘তিনটি বিষয় আমি আমার নিজের জন্য ও আমার ভাইদের জন্য পসন্দ করি। এই সুন্নাত, যা তারা শিখবে এবং জানার জন্য এ বিষয়ে প্রশ্ন করবে। কুরআন, যা তারা ভালভাবে বুঝতে চেষ্টা করবে এবং জানার জন্য এ বিষয়ে প্রশ্ন করবে এবং মানুষকে একমাত্র কল্যাণের দিকে আহবান জানাবে।[8]
অতএব কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ গবেষণা করতঃ সালাফে ছালেহীনের মাসলাক গ্রহণ করে সে অনুযায়ী সঠিক ব্যাখ্যা করে আমল করতে হবে। তাহ’লে ইহকালীন কল্যাণ এবং পরকালীন নাজাত মিলবে। কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর ভুল ব্যাখ্যা করে যেমন ইহকালীন কল্যাণ হবে না, তেমনি পরকালীন নাজাতও মিলবে না।
উপরে উল্লিখিত (৮-১৩) পয়েন্ট থেকে শিক্ষামূলক বিষয়গুলো হ’ল- ১. কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকেই সর্বাগ্রে পেশ করতে হবে ২. রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করতে হবে। কোন আমলের ক্ষেত্রে ছহীহ হাদীছ পেয়ে গেলে কোন ইমামের কথার উপর আমল করা চলবে না। কারণ সকল কল্যাণ রয়েছে রাসূলের ইত্তেবায় এবং সকল অধঃপতন নিহীত আছে রাসূলের বিরোধিতায়। ৩. নিজের জান-মাল, পিতা-মাতা, সন্তন-সন্ততি, সকল মানুষের চেয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে অধিক ভালবাসতে হবে। ৪. কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ বুঝার এবং আমল করার ক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীনের মাসলাক গ্রহণ করতে হবে। ৫. জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ গ্রহণ করতে হবে। ৬. কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকে যারা জীবনের চলার পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করেছেন তাদেরকে জামা‘আতবদ্ধ থাকতে হবে। জামা‘আতবদ্ধ থাকা রহমত স্বরূপ, আর বিচ্ছিন্ন থাকা আযাব স্বরূপ। ৭. হক্বের উপর দৃঢ় থাকতে হবে এবং এজন্য আল্লাহর নিকট তাওফীক কামনা করতে হবে। নিজের ইচ্ছা মত চলা যাবে না। চললে পথভ্রষ্ট হ’তে হবে।
[চলবে]
হাফেয আব্দুল মতীন
লিসান্স ও এম.এ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. মুসলিম, হা/৩৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[2]. মুসলিম হা/১৯২০, ‘ইমারত’ অধ্যায়।
[3]. আবু দাঊদ হা/২৪৮৪, ‘জিহাদ’ অধ্যায় সনদ ছহীহ।
[4]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৪/১৪৫।
[5]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/৯৩।
[6]. আবু দাঊদ হা/৪৬০৪, ‘সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়, সনদ ছহীহ।
[7]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৭/৩২২।
[8]. বুখারী, ৯৬/২ ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়।