একটি বেসরকারী সংস্থার হিসাব মতে
এবারে পঞ্চম শ্রেণী সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের শতকরা ৭৫ জন
বাংলা লিখতে জানে না’। ইংরেজী ও গণিতের অবস্থা আরও করুণ। বলা হয়েছে, গত বছর
ইন্টারমিডিয়েট থেকে উত্তীর্ণ জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ৮০ শতাংশ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এগুলো সেই
সময়কার টাটকা হিসাব যখন অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী জিপিএ-৫ পাওয়ায় মাননীয়
শিক্ষামন্ত্রী মহা উল্লসিত। নিঃসন্দেহে অন্যেরাও উল্ললিত। কিন্তু
ভুক্তভোগীদের নিকট এগুলি দুঃসংবাদ মাত্র। কারণগুলির কিছু কিছু তুলে ধরা
হ’ল।- (১) বোর্ড কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশে পরীক্ষকদের অধিক নম্বর দিতে
উদ্বুদ্ধ করা (২) অল্প সময়ের মধ্যে অধিক খাতা মূল্যায়নে বাধ্য হওয়া (৩)
দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষকদের পরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া (৪) হাতের লেখার
সৌন্দর্য ও বানান ভুলের জন্য নম্বর কর্তনের বিধান না থাকা (৫)
ছাত্র-ছাত্রীদের ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের প্রতি অধিক যোর দেওয়া (৬) মোবাইলের
মাধ্যমে এবং এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা নকল
সরবরাহ করা। এমনকি বই দেখে লেখা (৭) ব্যাকরণ শিক্ষা ও ভাষাগত ভিত মযবুত
করার চাইতে কথিত সৃজনশীল পদ্ধতি ও এমসিকিউ পদ্ধতির প্রতি অধিক যোর দেওয়া।
(৮) ক্লাসে ও প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশের বাড়তি কোন সুযোগ না
থাকা (৯) শিক্ষকদের মধ্যে মানুষ গড়ার কারিগর হবার বদলে স্রেফ চাকুরী ও
অর্থোপার্জনের মানসিকতা সৃষ্টি হওয়া (১০) ঘুষ, ডোনেশন ও দলীয় বিবেচনায়
ডিগ্রীসর্বস্ব অযোগ্য শিক্ষক নিযুক্ত হওয়া (১১) শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে
শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্কের বদলে ‘বন্ধু’ ও ‘ভাই’ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতি
অতি উৎসাহ প্রদর্শন করা ইত্যাদি।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে অন্যান্যদের চাইতে ডাক্তার ও প্রকৌশলীদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বেশী। যা ভাবতেও অবাক লাগে। অথচ এরাই সমাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশ এবং সর্বোচ্চ মেধাসম্পন্ন পেশাজীবী। এজন্য সবচেয়ে বড় দায়ী হ’ল সরকার। কেননা বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রত্যেক পেশার জন্য পৃথক না করে কলেজ-মাদরাসা-ডাক্তার সবার জন্য একই ধরনের প্রশ্নপত্র তৈরী করা। স্বাভাবিকভাবেই এতে অংশগ্রহণে তারা অনীহাবোধ করে এবং অংশ নিলেও ফেল করে। (খ) চাকুরী ক্ষেত্রে উৎকট দলীয়করণ, অন্যায় পোস্টিং ও ট্রান্সফারের খড়গ, প্রয়োজনীয় সুবিধাদি থেকে বঞ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি অন্যদের সমান গণ্য করে তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারিত হওয়ায় তাদেরকে সর্বদা হীনমন্যতায় ভুগতে হয়। (গ) উচ্চতর ডিগ্রী ব্যতীত এমবিবিএস ডাক্তারদের মূল্যায়ন না করা, উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনে সিনিয়র প্রফেসরদের অঘোষিত বাধা সৃষ্টি ও ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করিয়ে দেওয়া। এক বিষয়ে ফেল করলে পুনরায় নতুনভাবে সকল বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়া এবং দলাদলির অভিশাপ ছাড়াও নানারূপ বাধা তাদেরকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনে নিরুৎসাহিত করে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের প্রতি সিনিয়র প্রফেসরদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও নোংরা ব্যবহার ভুক্তভোগীদের নিকট অত্যন্ত অমর্যাদাকর হিসাবে গণ্য হয় (ঘ) মেডিকেলের অধিকাংশ উচ্চতর প্রশিক্ষণ ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ায় মফস্বল শিক্ষার্থীদের উচ্চতর ডিগ্রী হাছিল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে (ঙ) বিদেশে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের উচ্চ বেতন ও মর্যাদা তাদেরকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেশত্যাগে বাধ্য করে। ফলে জাতি তাদের মূল্যবান সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। (চ) নকল বা নিম্নমানের ঔষধ কোম্পানীগুলি বিভিন্ন গিফট ও ঘুষ দিয়ে ডাক্তারদের অধিক দামে বাজে কিংবা অপ্রয়োজনীয় ঔষধ লিখতে প্রলুব্ধ করে। পক্ষান্তরে সরকারী দলের ক্যাডারদের চাপে বা উচ্চতর তদবিরে ডাক্তারদের অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় রিপোর্ট লিখতে এমনকি তাদেরকে পেশা বহির্ভূত কাজে বাধ্য করা হয়। না করলে ট্রান্সফার-ওএসডি, পদাবনতি ইত্যাদির হুমকি প্রভৃতি বিষয়গুলি সৎ ও মেধাবী ডাক্তারদের সর্বদা সরকারী চাকরীতে নিরুৎসাহিত করে। (ছ) ট্রান্সফার ও পদোন্নতির জন্য এমনকি পরীক্ষায় পাস করার জন্য সরকার দলীয় ছাত্রনেতা বা শিক্ষক নেতাদের কাছে তদবীর করা অত্যন্ত অমর্যাদাকর হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবতা তাদেরকে অনেক সময় বাধ্য করে। যা তাদেরকে অত্র পেশায় নিরুৎসাহিত করে (জ) পাবলিক মেডিকেলে সুযোগ না পেয়ে বহু টাকার বিনিময়ে বেসরকারী মেডিকেল থেকে ডিগ্রী অর্জনকারীদের মর্যাদা সমান গণ্য করায় মেধাবীরা এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে ডাক্তারীর মত সেবামূলক ও অতি গুরুত্বপূর্ণ পেশায় ক্রমেই মানহীনদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। (ঝ) বহু বছরের অভিজ্ঞ ডাক্তারদের উচ্চতর ডিগ্রী না থাকায় তাদেরকে আজীবন জুনিয়র করে রাখা অত্যন্ত অমানবিক বিষয়। তাদেরকে সংক্ষিপ্ত কোর্স করে উচ্চতর ডিগ্রী দিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করায় তারা হীনমন্যতায় ভোগেন। (ঞ) হাসপাতালগুলিতে মহিলা রোগীদের জন্য মহিলা ডাক্তারদের অগ্রাধিকার না দিয়ে লিঙ্গ বৈষম্য সমান গণ্য করায় মেধাবী ভদ্র ও পর্দানশীন মহিলা ডাক্তারগণ এই পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে সেসব স্থান দখল করে অযোগ্য ও মানহীন ডাক্তাররা।
এবারে আসা যাক মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়ে। এটা সবাই জানেন যে, ধর্মনিরপেক্ষ কোন সরকারই ইসলামী শিক্ষার প্রতি আন্তরিক নয়। তারা যা কিছু করেন, কেবল ভোটের স্বার্থে করেন। বৃটিশ সরকার যেভাবে ওল্ডস্কীম-নিউস্কীম ও আলিয়া নেছাব সৃষ্টি করে ইসলামী শিক্ষার গলা টিপে ধরেছিল, স্বাধীন দেশের মুসলিম সরকারগুলি তার চেয়ে নিকৃষ্টভাবে এটা করে যাচ্ছে। কোন কোন মন্ত্রী মাদরাসাগুলিকে জঙ্গী প্রজনন ক্ষেত্র বলছেন নির্লজ্জভাবে। আলিয়া মাদরাসা শিক্ষকদের জাতীয় সংগঠন জমিয়তুল মুদাররেছীন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ সরকার মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করেছেন। তাদের দাবীকৃত ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস করেছেন। প্রথমতঃ এর মাধ্যমে সরকার তাদের মুখ বন্ধ করেছে। দ্বিতীয়তঃ ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় যে কেমন সোনার পাথরবাটি, তা আমরা আজও জানতে না পারলেও ফাযেল-কামিল ডিগ্রীগুলি অনার্স ও মাস্টার্সের মান পাবে বলা হয়েছে। তাদের জন্য মুফতী, ফক্বীহ, মুহাদ্দিছ, প্রধান মুহাদ্দিছ-এর মত অতীব উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পদ সমূহ সৃষ্টি করা হয়েছে। যা ঐসব লকবের সাথে অত্যন্ত অমর্যাদাকর। কাউকে ধ্বংস করতে গেলে তাকে প্রথমে মাথায় তুলে পরে ছুঁড়ে ফেলতে হয়। আলিয়ার শিক্ষকদের সাথে সেটাই করা হচ্ছে। সিলেবাসে ২০০ নম্বরের ইংরেজী ও অন্যান্য বস্ত্তগত বিষয় চাপিয়ে দিয়ে একে অত্যন্ত কঠিন করা হয়েছে। ফলে অধিকাংশ ছাত্র ফেল করবে এবং একসময় ছাত্রবিহনে মাদ্রাসাগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। তাদেরকে বেতনের টোপ গিলিয়ে সরকার এখন কওমী শিক্ষকদের পিছনে কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদেরকে দু’ভাগ করা হয়ে গেছে। বাকীটা সত্বর হবে। অবশেষে এরাও টোপ গিলবেন। অতঃপর এদের হাত দিয়েই ইসলামী শিক্ষা ধ্বংসের বাকী কাজটি সারা হবে। ইতিমধ্যেই ফলাফল দাঁড়িয়েছে এই যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মত মাদ্রাসা শিক্ষিতরাও অনেকটা কেবল ডিগ্রীধারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। মেধা, যোগ্যতা ও উন্নত চরিত্রের ছোঁয়া সেখানে নেই বললেও চলে। এমনকি বাহ্যিক দাড়ি-টুপী-পোষাক ও চাল-চলনের পার্থক্যটুকুও প্রায় ঘুচে যেতে বসেছে।
দূরীকরণের উপায় : এ বিষয়ে ইতিপূর্বে আমরা সরকারের নিকট কতগুলি পরামর্শ পেশ করেছি। তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান বিষয়টি পুনরায় পেশ করছি। আর তা হ’ল (১) শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে এবং সরকারকে কেবল সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে (২) বেসরকারী উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে (৩) ডিগ্রীকে সাধারণ মান রেখে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন-ভাতার মান নির্ধারণ করতে হবে (৪) পেশা ভিত্তিক পৃথক বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে (৫) শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিচার বিভাগে যাবতীয় রাজনৈতিক দলাদলি নিষিদ্ধ করতে হবে। সাথে সাথে এসবের প্রশাসনিক কাঠামোকে সরকারী ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।