
গত ২১শে আগস্ট শনিবার বিকাল ৫.২২ মিনিটে ঢাকায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিক্ষোভ-পূর্ণ সমাবেশে বিরোধী দলীয় নেত্রীর* বক্তৃতা শেষে তাঁর ট্রাক-মঞ্চ লক্ষ্য করে পরপর ১২/১৪টি শক্তিশালী গ্রেনেড হামলায় ১৪ জন নিহত ও তিন শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। দুই পা হারিয়ে মর্মান্তিকভাবে আহত মহিলা আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমানের স্ত্রী মিসেস আইভি রহমান সহ এ যাবত নিহতের সংখ্যা ১৮ জন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। যে স্থানের নাম ‘গুলিস্তান’ অর্থাৎ ফুল বাগিচা, তা সেদিন রক্তের নহরে পরিণত হয়েছিল। চোখের পলকে এতগুলো প্রাণ ঝরে পড়লো, এতগুলো মানুষ রক্তাক্ত ও পঙ্গু হ’ল, কত মায়ের বুক খালি হ’ল, কত স্ত্রী তার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে হারালো, কত স্বামী তার প্রাণাধিক প্রিয়া স্ত্রীকে হারালো, কত বোন তার ভাইকে হারালো, কত সন্তান তার পিতাকে হারিয়ে পাগলপারা হ’ল, কত সংসার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসলো, কত পঙ্গু প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরবে ও সেই সাথে নিজের সংসারকে পঙ্গু করবে, ভিটে-মাটি বেঁচে নিঃশেষ হয়ে যাবে, তার হিসাব কে করবে? নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ পরবর্তী যুগের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা এই নারকীয় ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা দুঃখিত, মর্মাহত ও বেদনাহত। আমরা নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। সাথে সাথে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি। একই সাথে আমরা সরকারের অসতর্ক গোয়েন্দা বিভাগ ও দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি।
কিন্তু জনমনে প্রশ্ন, কেন এমনটি হ’ল? বিরোধী নেত্রীর তাৎক্ষণিক জবাব, ‘সরকার একাজ করেছে, প্রধানমন্ত্রী এক নম্বর খুনী। আমরা সরকারের পদত্যাগ চাই’। কারু বক্তব্য, দেশবিরোধী চক্রান্তে এটা ঘটেছে। প্রথমটি বিশ্বাস করা কঠিন এজন্য যে, কোন সরকারই দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় না। বিশেষ করে বিরোধী নেতৃবৃন্দকে একত্রে একই মঞ্চে প্রকাশ্য দিনমানে গ্রেনেড মেরে হত্যা করার মত নির্বুদ্ধিতা সরকার দেখাতে যাবে না বা এমন অকল্পনীয় রিস্ক নেবার দুঃসাহস সরকার দেখাবে না। বিশেষ করে সরকার যখন সিলেটে উপর্যুপরি বোমা হামলার কুল-কিনারা করতে না পেরে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে এবং প্রলয়ংকারী বন্যার ক্ষত কাটিয়ে উঠতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। তবে শাসক হিসাবে সরকার উক্ত ঘটনার দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সে হিসাবে অবশ্যই সরকারকে দায়ী করা চলে।
২য় বিষয়টি সত্য হওয়ার ব্যাপারে সচেতন মহলের ধারণা ক্রমেই প্রবলতর হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, এই দেশবিরোধী চক্রটি কে? কোন্ সে অপশক্তি, যে বাংলাদেশের স্বাধীন ও শক্তিশালী অস্তিত্বকে সহ্য করতে পারে না? কিছু লোক কথায় কথায় বলেন, ওরা হ’ল মৌলবাদী চক্র, যারা শুরু থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। অথচ যারা একথা বলেন, তারা ভালভাবেই জানেন যে, পার্থ সাহাদের সৃষ্ট তথাকথিত মৌলবাদী বা জঙ্গীবাদী চরমপন্থীরা নয়, বরং সত্যিকারের ইসলামপন্থীরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। তারা ইসলামের স্বার্থেই এদেশের এক ইঞ্চি মাটির জন্য জীবন দেবে হাসিমুখে। যা অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয়। এর দ্বিতীয় কারণ হ’ল এই যে, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের জন্য পৃথিবীর সর্বত্র দুয়ার খোলা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ইসলামপন্থীদের জন্য সকল দুয়ার বন্ধ। বিশেষ করে উপমহাদেশের কোথাও তাদের স্থান হবে না। তাই জানমাল সবকিছু কুরবানী দিয়ে হ’লেও এদেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখা ও তাকে নিরংকুশ ও শক্তিশালী করা ভিন্ন তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। ভুলে যাওয়া ঠিক নয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মানচিত্রের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। এই মানচিত্রকে শুরু থেকেই মেনে নেয়নি উপমহাদেশের সেই আধিপত্যবাদী শক্তিটি, যে স্বাধীন বাংলাদেশকে তাদের কথিত ‘মায়ের অঙ্গহানি’ বলে মনে করে। যারা বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া হাযার হাযার কোটি টাকা মূল্যের সমরাস্ত্র সমূহ এবং দেশের বড় বড় শিল্প কারখানার মূল্যবান যন্ত্রপাতি সমূহ লুট করে নিয়ে শুরুতেই দেশটিকে পঙ্গু করে দেয়। অতঃপর ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি করে এদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
অতঃপর অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে রাখার জন্য গঙ্গা ও তিস্তা সহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে ইচ্ছামত বন্যায় ডুবিয়ে ও খরায় শুকিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে এবং বর্তমানে ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করলে দেশটিকে পুরোপুরি মরুভূমি বানিয়ে ফেলার চক্রান্ত পাকাপোক্ত হয়ে যায়। অতঃপর যার মর্মান্তিক ফল হিসাবে ভূগর্ভস্থ পানি আর্সেনিক দুষ্ট হবে ও তা পান করে দেশের কোটি কোটি মানুষ ধুঁকে ধুঁকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। শুধু এতে তারা ক্ষান্ত নয়, প্রকাশ্য বাণিজ্য দস্যুতা ও চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বর্তমানে তাদের একচেটিয়া বাজার বানিয়ে ফেলেছে এবং এদেশের কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হ’তে চলেছে। বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা দেশের সিকি আয়তন বিশিষ্ট বিশাল চরটি তারা স্রেফ গায়ের জোরে দখল করে রেখেছে ও বাংলাদেশকে চারদিক দিয়ে বেষ্টন করে ফেলেছে। এখন তাদের প্রয়োজন এদেশে একজন লেন্দুপ দর্জির, যার আহবানে তারা রাতারাতি আর্মি মার্চ করিয়ে সিকিমের ন্যায় দেশটিকে তাদের মানচিত্রভুক্ত করে নিতে পারে। এদেশে লুকিয়ে থাকা দেশবিরোধী চক্রের এজেন্টরাই যাবতীয় সন্ত্রাসের মূল নায়ক। নইলে গ্রেনেড হামলার পরপরই ঢালাওভাবে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, সরকারী ও ব্যক্তি মালিকানাধীন মূল্যবান জীপ, বাস, প্রাইভেট কার, এমনকি গার্ড সহ চলন্ত ট্রেনের মূল্যবান বগি সমূহ জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেওয়া, তার কিছু দিন পূর্বে হরতালের পূর্ব রাতে দোতলা বিআরটিসি বাসে আগুন ধরিয়ে ১০ জন যাত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা নিশ্চয়ই কোন দেশপ্রেমের পরিচয় নয়। বিক্ষুব্ধ জনগণের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এগুলি নিঃসন্দেহে দেশবিরোধী চক্রের পরিকল্পিত সন্ত্রাস। বিরোধী নেতৃবৃন্দকে আহত বা হত্যা করে তারা জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তাল করে তুলতে চায়। অতঃপর সেই ঘোলা পানিতে তারা মাছ শিকার করতে চায়।
আমরা মনে করি, এই নারকীয় ঘটনার জন্য সরকারী বা বিরোধী দল নয়, বরং প্রকৃত দায়ী হ’ল দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা। যারা এদেশেই ঘাপটি মেরে থেকে বিদেশী নীল নকশা বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে। অতএব দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের স্বার্থে দেশপ্রেমিক সকল নাগরিককে সদা সতর্ক প্রহরী হিসাবে কাজ করতে হবে। নইলে সেদিন দূরে নয়, যেদিন পুনরায় মীরজাফর ও ঘসেটি বেগমদের ষড়যন্ত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ পুনরায় পরাধীন বঙ্গদেশে পরিণত হবে। কেননা ভয়ের কথা এই যে, বিগত সরকারের আমলে ৮টি এবং এ সরকারের আমলে এযাবৎ ৮টি বোমা হামলার কোনটারই প্রকৃত দোষীরা আজও ধরা পড়েনি। এসব হামলার পিছনে বিদেশী চক্রান্ত থাকলে প্রকৃত আসামীরা কোন দিন ধরা পড়বে বলে বিশ্বাস নেই। আমরা আন্তর্জাতিক তদন্তের নামে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাকে এদেশে ঢুকতে দেওয়াকে ভাল চোখে দেখছি না। যারা নিজ দেশের টুইন টাওয়ারে হামলাকারীদের আজও চিহ্নিত করতে পারেনি, তারা এখানে এসে কি পাবে? মাঝখানে তারা সরকারকে বাধ্য করার সুযোগ নিতে পারে এদেশে তাদের দীর্ঘমেয়াদী হীন স্বার্থ আদায়ের জন্য। অতএব সরকারী প্রশাসন ও দেশপ্রেমিক জনগণ সাবধান হৌন। হে আল্লাহ! আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে তুমি হেফাযত কর- আমীন![1]
[1]. ৭ম বর্ষ ১২তম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ২০০৪। * শেখ হাসিনা।