আমেরিকার এক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড (৪৬)-কে এক ঠুনকো কারণে গত ২৫শে মে সোমবার প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় উপুড় করে ফেলে জনৈক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ৮ মিঃ ৫৬ সেঃ তার গলা মাটিতে চেপে ধরে হত্যা করল। সাথী বাকী তিন পুলিশ তাতে নীরব সমর্থন দিল। সে নাকি এক দোকান থেকে জাল ডলার দিয়ে মাল কিনেছিল। তাই দোকানদারের ফোন পেয়ে সাথে সাথে পুলিশ এসে দোকানের অনতিদূরেই তাকে হত্যা করে। ছোট দুই সন্তানের পিতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বার বার বলেছে, আমি শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে গেলাম। আমাকে ছাড়ুন’। কিন্তু নিষ্ঠুর ঐ পুলিশ কর্মকর্তার চেহারায় কোনরূপ পরিবর্তন দেখা যায়নি। কারণ তারা অঘোষিতভাবে নিজেদেরকে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যায় দায়মুক্ত মনে করে। মোবাইলে যখন এই মর্মান্তিক দৃশ্য ভাইরাল হয়, তখন স্বভাবতই মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। করোনা ভীতি, লকডাউন, কারভিউ, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট কোন কিছুই মানুষের আক্রোশকে দমাতে পারেনি। এমনকি বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের When looting, then shooting ‘যখনই লুট, তখনই গুলি’ এই কড়া নির্দেশকে উপেক্ষা করে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল যখন দুর্ভেদ্য হোয়াইট হাউজের দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত, তখন এই বীরপুঙ্গব প্রেসিডেন্ট ভয়ে হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ বাংকারে গিয়ে এক ঘণ্টা লুকিয়ে থাকেন।

হ্যাঁ গণতন্ত্রের মুখোশধারী সভ্যতাগর্বী আমেরিকার এ বর্ণবাদী চরিত্র নতুন নয়। সেদেশের কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট সাংবাদিকতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে যেসব বর্ণবাদী খবর বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তার  মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত ছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার রক্ষায় লড়াকু সৈনিক আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯২৯-১৯৬৮)। ১৯৬৪ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের ক্ষোভ তাতে আরও জ্বলে ওঠে। ১৯৬৮ সালের এক সকালে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নির্মল বায়ু সেবন করা অবস্থায় এক উগ্রপন্থী শ্বেতাঙ্গের গুলিতে তিনি প্রাণ হারান। সেসময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন লিন্ডন বি জনসন (১৯৬৩-১৯৬৯)। অতঃপর আরেকজন প্রসিদ্ধ ছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গ মুষ্টিযোদ্ধা ক্যাসিয়াস ক্লে (১৯৪২-২০১৬)। যিনি ১৯৬০ সালে বক্সিংয়ে বিশ্ব অলিম্পিকে সোনা জিতেও কেবল কৃষ্ণাঙ্গ বলে একটি রেস্তোঁরায় কাজ করার সুযোগ পাননি। রেস্তোঁরা মালিক তার মুখের উপর বলে দেয় যে, এখানে কেবল শ্বেতাঙ্গরাই কাজ পাবে’। সেদিন মনের দুঃখে তিনি তার স্বর্ণপদক আমেরিকার ওহাইয়ো নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। শুধু কি তাই! ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগদানের অন্যায় আদেশ উপেক্ষা করায় ১৯৬৭ সালে তার অতি মূল্যবান বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন খেতাব পর্যন্ত ছিনিয়ে নেওয়া হয়। হ্যাঁ তাতেও তাকে দমানো যায়নি। পরপর তিনবার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে তিনি তার হারানো খেতাব পুনরুদ্ধার করেন এবং ১৯৭৪ সালে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা’ হওয়ার বিশ্ব খেতাব অর্জন করেন। ইতিমধ্যে তিনি ইসলাম কবুল করে মোহাম্মাদ আলী ক্লে নাম ধারণ করেন ও নিজেকে মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। ২০১৬ সালে তাঁর ৭৪ বছরের সংগ্রামী জীবনের অবসান হয়। তিনি আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নোবেল জয়ী বারাক হোসেন ওবামাকে দেখে যেতে পেরেছেন। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে সব নাগরিকের মুখে সমানাধিকার ভোগের হাসি দেখে যেতে পারেননি। ৮ বছরের ওবামা শাসন (২০০৯-২০১৭) কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি পুলিশের মত একটা পেশাদারী প্রতিষ্ঠানের হাতে কৃষ্ণাঙ্গরা বিনা বিচারে নিহত হচ্ছে সর্বদা সর্বত্র।

এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, কেবল সরকারী ক্ষমতা দিয়ে সমাজ পরিবর্তন হয় না। বরং সে পরিবর্তনের জন্য চাই তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক নৈতিক শিক্ষা। যা মানুষের জীবন পরিবর্তন করে দেয়। সেই নৈতিক তথা ধর্মীয় শিক্ষা না থাকায় খোদ কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে অসংখ্য বর্ণবাদী নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছে। আর বর্তমান শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো স্পষ্টভাবেই একজন বর্ণবাদী। তার কাছে রাজনীতির অর্থ হ’ল কেবলই ভোটে জেতার খেলা। অতএব সংখ্যাগুরু শ্বেতাঙ্গদের খুশী করাই তার রাজনীতি। যেভাবে ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের খুশী করাই বিজেপির রাজনীতি। সেখানে চলছে ধর্মীয় বর্ণবাদ। একইভাবে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যত্র চলছে মুসলিম বিনাশের নোংরা বর্ণবাদ।

মানবতা বিধ্বংসী বিশ্বপরিস্থিতি পরিবর্তন করে এ পৃথিবীকে মনুষ্য বাসোপযোগী করার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। প্রত্যেকে ছিলেন গোত্রীয় নবী। কিন্তু শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী। তাইতো তাঁর লক্ষ্য ছিল বিশ্ব পরিবর্তন। আর তার আহবান ছিল বিশ্ব সমাজের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি...’ (সাবা ৩৪/২৮)

ফলে ক্ষিপ্ত হ’লেন আরব নেতারা। কিন্তু কোনই তোয়াক্কা করলেন না তিনি। মুসলিম হওয়ার জন্য তিনি সাথীদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার তথা বায়‘আত নিলেন। শুরু করলেন অল্প সংখ্যক আল্লাহপ্রাণ সাথী নিয়ে বৃহত্তর সমাজের বিরুদ্ধে আপোষহীন দাওয়াতী অভিযান। নেতারা তাঁকে বাধা দিয়েছে সর্বাত্মকভাবে। কিন্তু সব বাধাই তিনি অতিক্রম করেছেন আল্লাহর বিশেষ রহমতে। ফলে যে কৃষ্ণাঙ্গ বেলাল ভেবেছিল শ্বেতাঙ্গ কুরায়েশ মনিবের নির্যাতন ভোগ করা তার নিয়তি, সে স্বাধীন মানুষের মর্যাদা পেয়ে মুক্তির হাসিতে উচ্ছ্বল হল। যে নারী এতদিন ক্রীতদাসী ছিল। সে এখন স্বাধীন হওয়ার সুযোগ পেল। যে নারী ছিল অধিকারহীন, সে এখন পিতা, স্বামী ও সন্তানের সম্পদের উত্তরাধিকারী হ’ল। এমনকি অত্যাচারী স্বামী থেকে ‘খোলা’-র মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হবার সুযোগ পেল। যে বৃদ্ধ পিতা-মাতা এতদিন পরিবারের বোঝা ছিল, তাদের পায়ের তলে সন্তানের জান্নাত বলে ঘোষণা করা হ’ল। যে কন্যা সন্তানকে মা নিজ হাতে প্রসবের পরেই খুঁড়ে রাখা গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করত। সেই অবহেলিত কন্যা সন্তান প্রতিপালন করাকেই জাহান্নাম থেকে বাঁচার পর্দা হিসাবে সর্বোচ্চ সম্মান ঘোষণা করা হ’ল (বুখারী হা/১৪১৮)। ফলে সারা আরবে এক সামাজিক কম্পন শুরু হয়ে গেল। মানবতার এই মুক্তির আওয়ায পৌঁছে গেল বিশ্বের সর্বত্র। ইসলাম কবুল করল সুদূর পারস্য থেকে আগত সালমান ফারেসী, হাবশার বেলাল, রোমের ছোহায়েব। অথচ ব্যর্থ হ’ল আবু জাহল, আবু লাহাব প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা। বর্তমান বিশ্বের শ্বেতাঙ্গ নেতারা একইভাবে ব্যর্থ হয়েছেন সুপথ পেতে। কে না জানে যে, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সৃষ্টিতে মানুষের কোন হাত নেই। সবকিছুই আল্লাহ করেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। কিন্তু শয়তানের ধোঁকায় পড়ে দাম্ভিক মানুষ তা বুঝতে চায় না।

১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণে উপস্থিত লক্ষাধিক জনতার সম্মুখে প্রদত্ত ভাষণে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে জনগণ! নিশ্চয় তোমাদের পালনকর্তা মাত্র একজন। তোমাদের পিতাও মাত্র একজন। মনে রেখ! আরবের জন্য অনারবের উপর, অনারবের জন্য আরবের উপর, লালের জন্য কালোর উপর এবং কালোর জন্য লালের উপর কোনরূপ প্রাধান্য নেই আল্লাহভীরুতা ব্যতীত’। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু। তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের নিকট পৌঁছে দিলাম? লোকেরা বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, অতএব উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দেয়’। ইতিপূর্বে ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘হে জনগণ! আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অংশ ও পূর্ব পুরুষের অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। মানুষ দু’প্রকারের : মুমিন আল্লাহভীরু অথবা পাপাচারী হতভাগা। তোমরা আদম সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী’ (অতএব মাটির কোন অহংকার নেই)। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করলেন, ‘হে মানবজাতি! আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হ’তে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পার। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং তিনি সবকিছুর খবর রাখেন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩; ছহীহাহ হা/২৭০০; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ৭২৩, ৫৩৮ পৃ.)

অতএব এ যুগে যদি কোন সমাজ দরদী বর্ণবাদ দূর করতে চান, তবে তাকে ফিরে আসতে হবে ইসলামের কাছে। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের মুক্তির পথ- ইসলাম। অন্য কোন তন্ত্র-মন্ত্র কখনোই নয়। এজন্য পরিবর্তন পিয়াসী ও সংস্কারবাদী একদল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার পরিবর্তনের চাইতে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে হবে আল্লাহর নামে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! (স.স.)।  






বিষয়সমূহ: সমাজ-সংস্কার
সার্বভৌমত্ব দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
৮ বছর ৮ মাস ২৮ দিন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহর সামনে ঝগড়া - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কসোভোয় মুসলিম নির্যাতন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বাধীন ‘আরাকান রাষ্ট্র’ ঘোষণা করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
গ্রাহক ও এজেন্ট সংগ্রহের ফরম
বর্ণবাদী আমেরিকার মুক্তির পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জবাবদিহিতার অনুভূতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
২০২৩ সালের সিলেবাস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বাঁচার পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইনোসেন্স অফ মুসলিম্স - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী আইনের কল্যাণকারিতা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.