গত ১৪ই এপ্রিল
মঙ্গলবার ১লা বৈশাখের সন্ধ্যায় ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
টিএসসি চত্বরে ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেইটে কয়েকজন নারী যৌন হামলার শিকার
হয়েছেন। তারা তাদের বস্ত্র হারিয়েছেন ও সংস্কৃতিবাজ দুর্বৃত্তদের হামলায়
ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দী তাদের বাঁচাতে
গিয়ে নিজের হাত ভেঙ্গেছেন। বর্তমানে যিনি হাসপাতালে আছেন। শাড়ী-ব্লাউজ
হারানো একটি মেয়েকে উদ্ধার করে তিনি রিকশায় তুলে দিয়েছেন ও নিজের গায়ের
জামাটি খুলে মেয়েটির গায়ে ছুঁড়ে মেরে তার লজ্জা নিবারণে সাহায্য করেছেন।
তিনি চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভাই, মেয়েটা মারা যাচ্ছে ওকে বাঁচতে দিন’ (প্রথম আলো ২০ এপ্রিল, শিরোনাম)। আমরা তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সাথে সাথে আমরা উক্ত ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।
১৩১টি ভিডিও ক্যামেরার ফুটেজে ঐসব দুর্বৃত্তের ছবি এসেছে। অথচ তিন স্তরের নিশ্ছিদ্র পুলিশী নিরাপত্তার কোন নমুনা সেদিন দেখা যায়নি। গত এক সপ্তাহেও পুলিশ তাদের কাউকে ধরতে পারেনি। কারণ সরকারের মুখপাত্র বলেছেন, ‘এ রকম কোন ঘটনার প্রমাণ আমরা পাইনি’। এমতাবস্থায় পুলিশ কিভাবে বলবে যে, আমরা প্রমাণ পেয়েছি? অতএব এখন তারা গণরোষ থেকে বাঁচার জন্য কয়েকদিন দৌড়ঝাঁপ করবে ও ‘তদন্ত চলছে’ বলে লোকদের সান্ত্বনা দিবে। তারপর একদিন সবাই ভুলে যাবে। যেমন প্রতি বছরের এরূপ ঘটনাগুলি মানুষ ভুলে গেছে।
বিগত ২০০০ সালের থার্টি-ফার্স্ট নাইট (৩১শে ডিসেম্বর) উদযাপনের সময় একই টিএসসি চত্বরে গভীর রাতে ‘বাঁধন’ নামে এক তরুণীকে বিবস্ত্র করা হয়। তৎকালীন সরকারী দলের বহু আলোচিত এমপি জয়নাল হাজারী এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন এবং নারীকে পর্দার প্রচলিত সামাজিক প্রথা মেনে চলার পরামর্শ দেন। সাথে সাথে তিনি এই বেলেল্লাপনা সংস্কৃতি বন্ধের দাবী জানান। তিনি সংস্কৃতির নামে এই উলঙ্গপনার বিরুদ্ধে বই লিখে মানুষের মধ্যে ফ্রি বিতরণ করে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। ফলে কথিত নারীনেত্রী ও সংস্কৃতিকর্মীরা হাজারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা বাঁধনের বস্ত্রহরণের বিষয়টিকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে প্রচার করে নিজেদের প্রগতিশীলতা যাহির করেন। হ্যাঁ, ১৫ বছর আগের সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাই এবার সর্বসমক্ষে এক ঘণ্টারও বেশী সময় ধরে তারা ‘অবিচ্ছিন্ন ঘটনা’য় পরিণত করল। অন্যান্য শহরেও এরূপ ঘটনা ঘটেছে বলে পত্রিকায় এসেছে। সেদিনের মত এদিনও চিহ্নিত এইসব নেতা-নেত্রীরা চুপ আছেন। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা গা ছাড়া ভাব। যখন উক্ত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করার দাবী উঠেছে সর্বত্র, তখন যারা নারীর অধিকার নিয়ে নিত্যদিন গলাবাজী করেন এবং কথায় কথায় আলেম-ওলামাদের তু্চ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, সেই সব এনজিও নেত্রী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা আজ নীরব কেন?
একজন সুপরিচিত প্রবীণ কথাসাহিত্যিক লিখেছেন, বহুদিন আগে ২৫ বছরের একজন তরুণী আমাকে বলেছিলেন, আপনারা, পুরুষেরা কখনোই আমাদের বেদনাটা বুঝবেন না। একটা ছোট উদাহরণ দিই। চৈত্রের রাত ১১টায় ধরুন বিদ্যুৎ নেই, গরমে ছটফট করতে করতে আপনি ভাবলেন, যাই, ঘর থেকে বেরিয়ে একটু রাস্তায় যাই, হাওয়া খেয়ে আসি। আপনি চাইলে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে এটা করতে পারবেন, কিন্তু আমি কি সেটা পারব? এটা কি এই দেশে হওয়ার জো আছে? আমি উত্তর দিতে পারিনি। সেই সামান্য না পারার অসামান্য বেদনাটা বুঝে চলার চেষ্টা করছি আজও। একদিন আমার ছোট্ট মেয়েটি, আমার হাত ধরে রিকশায় করে ফিরছিল স্কুল থেকে। ধানমন্ডি ৮ নম্বরের খেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, কত ছেলে ক্রিকেট খেলছে, ফুটবল খেলছে, এর মধ্যে একজনও মেয়ে নেই কেন? আমার বুক বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, এই প্রশ্নের কী জবাব আমি দেব আমার চার-পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে?
হ্যাঁ। এর জবাব তিনি পাবেন নিজের বাড়ীতে গিয়েই। যদি তিনি তার ২৫ বছরের মেয়েকে রাত ১১-টার সময় তীব্র গরমে তারই সাথে একটি হাফ প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরে খোলা রাস্তায় হাটতে বলেন। অথবা তার যুবক ছেলেকে তার যুবতী মেয়ের সাথে একই রূপ অর্ধনগ্ন পোষাকে লোক সমক্ষে ফুটবল খেলতে বলেন। নিঃসন্দেহে তারা রাযী হবে না তাদের স্বভাবজাত লজ্জাশীলতার কারণে। এটাই হ’ল সংস্কৃতি। যা মানুষের ভিতরকার অনুশীলিত কৃষ্টির বাহ্যিক পরিশীলিত রূপ। আর এটাই হ’ল তাওহীদী সংস্কৃতি। যার বিপরীত হ’ল শিরকী অপসংস্কৃতি। যা করতে গিয়েই আজকে ঘটছে যত বিকৃতি। ফলে লেখকের ‘অসামান্য বেদনাটা’ হ’ল মূলতঃ শয়তানী বেদনা। সেখান থেকে তওবা করলেই তিনি খুঁজে পাবেন নিষ্কলুষ মানবীয় চেতনা এবং ফিরে পাবেন এক আলোকময় ইলাহী সংস্কৃতি। আমরা সেদিকেই তাঁকে আহবান জানাই।
আরেকজন বৃদ্ধ জাতীয় অধ্যাপক একটি দৈনিকে লিখেছেন, ইংরেজদের নিউ ইয়ার্স ডে পালনের দেখাদেখি শিক্ষিত নাগরিক সমাজে নববর্ষ পালন শুরু হয় উনিশ শতকের শেষভাগে। নৃত্যগীতবাদ্য দিয়ে দিনটিকে সুশোভিত ও আমোদিত করার কাজে অগ্রণী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর তা ছড়িয়ে গিয়েছিল সবখানে। বাংলাদেশ-অঞ্চলে নববর্ষ উৎসব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ছায়ানটের উদ্যোগে। পাকিস্তান সরকার নববর্ষ পালনে আপত্তি করে জেনে আমাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। এখন তো ছায়ানটের পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট বা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলা একাডেমির বক্তৃতা ও কবিতা পাঠের আসর, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর সংগীতানুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে। রবীন্দ্র-সরোবরে বসছে গানের আসর’। একটু পরে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সমাজে কিছু মানুষ সবক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে আনেন এবং শিরক ও বেদাতের সন্ধান করেন।... মেয়েদের কপালে টিপ পরা থেকে শুরু করে পিচ-ঢালা পথে আলপনা আঁকাকে তাঁরা বিধর্মীয় আচার বলে সাব্যস্ত করেন এবং তা দমন করতে তৎপর হন। এসব প্রয়াসে তাঁরা যে একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন, তা নয়। মেয়েদের সাম্প্রতিক পোশাক-আশাক দেখলে তা বোঝা যাবে। কেউ তার পছন্দমতো খাওয়া-পরা চলাফেরা করতেই পারে। গোলমাল লাগে যখন কেউ অপরের পছন্দ-অপছন্দে হস্তক্ষেপ করে, তখন’।
লেখকের কথাতেই প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে ‘বর্ষবরণ’ ঊনিশ শতকের শেষভাগে আবিষ্কৃত একটি নতুন অনুষ্ঠান, যা আগে ছিল না। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে যা পরে ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। অতএব নববর্ষ অনুষ্ঠানটি যে ‘ইসলামী’ নয়, সেটা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ। সমস্যা হ’ল এই যে, এঁরা নামে মুসলিম হ’লেও ইসলাম সম্পর্কে কোনই জ্ঞান রাখেন না। ইসলাম মানুষের সার্বিক জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ প্রেরিত একটি অভ্রান্ত জীবন বিধানের নাম। মুসলিম জীবনের কোন অংশই ইসলামী বিধানের বাইরে যাওয়ার অবকাশ নেই। যতটুকু যাবেন, ততটুকু হবে শয়তানের দাসত্ব। আর সেটাই হ’ল শিরক-বিদ‘আত। শয়তান সর্বদা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে জাহান্নামের পথে নিয়ে যেতে চায়। পক্ষান্তরে প্রকৃত মুসলমানেরা যেকোন মূল্যে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চায়। কথিত সংস্কৃতিজীবীগণ এদেশের ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই মনের কথা শুনতে পান কি? আল্লাহ আমাদের হেদায়াত করুন- আমীন! (স.স.)। এই সাথে পাঠ করুন : সম্পাদকীয় ‘নববর্ষ সংস্কৃতি’ ২/৮ম সংখ্যা মে’৯৯ এবং ‘নষ্ট সংস্কৃতি’ ১৪/৮ম সংখ্যা মে’১১।
সংশোধনী : এপ্রিল’১৫ সংখ্যার সম্পাদকীয়ের ৪র্থ প্যারায় ‘শিরক ও বিদ‘আতে নিমজ্জিত মুসলমানরা’ স্থলে ‘নানাবিধ পাপকর্মে নিমজ্জিত মুসলমানরা’ পড়তে হবে। (স.স.)।