‘আহ্ল’ অর্থ অনুসারী, হাদীছ অর্থ বাণী। আল্লাহর বাণী ও রাসূলের বাণী উভয়কে ‘হাদীছ’ বলা হয়। ‘আহলুল হাদীছ’ বা আহলেহাদীছ অর্থ কুরআন ও হাদীছের অনুসারী। জীবনের সকল দিক ও বিভাগে আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী ব্যক্তিকে ‘আহলুল হাদীছ’ বা ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। আহলেহাদীছ হওয়ার জন্য আহলেহাদীছ পিতামাতার সন্তান হওয়া শর্ত নয়। বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে মেনে নেওয়াই হ’ল আহলেহাদীছ হওয়ার মৌলিক শর্ত। সংকীর্ণ দুনিয়াবী স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে যদি কোন ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ মেনে চলা হয় ও কোন ক্ষেত্রে অমান্য করা হয় বা এড়িয়ে চলা হয়, তাহ’লে সেটি পূর্ণাঙ্গ আহলেহাদীছ হওয়ার পরিচায়ক নয়। ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম ও হাদীছপন্থী ওলামায়ে কেরাম সকলেই আহলুল হাদীছ ছিলেন, আজও আছেন, পরবর্তীতেও থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
রাজনৈতিক বিভক্তি ও মাযহাবী দলবাজির কারণে কিছুসংখ্যক লোক বিগতযুগেও যেমন নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছের অনুসরণ থেকে দূরে থেকেছে ও মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, আজও তেমনি করে চলেছে। তারা বিগত যুগে ইসলামী বিধানের দ্বিতীয় উৎস হাদীছের মতনের মধ্যে বিভিন্ন শব্দ বা বর্ণ ঢুকিয়ে কিংবা সনদের মধ্যে দুর্বল রাবী থাকার কারণে হাদীছ যঈফ গণ্য হওয়ার অজুহাতে হাদীছ শাস্ত্রকে একদিকে যেমন জনগণের নিকটে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করে, অন্যদিকে তেমনি জাল ও যঈফ হাদীছের উপরে ভিত্তি করে নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু ইমাম মালেক, আহমাদ, বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য আহলুল হাদীছ বিদ্বানগণের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে কুচক্রীদের অপতৎপরতা নস্যাৎ হয়ে যায় এবং ছহীহ হাদীছ সমূহ বাছাই হয়ে সংকলিত আকারে জনসমক্ষে উপস্থাপিত হয়। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সহ চার ইমাম তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে গিয়েছেন, ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমাদের মাযহাব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, আমি তোমাদের নিকটে দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা কখনোই বিভ্রান্ত হবে না যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্ত্তকে অাঁকড়ে থাকবে। আর তা হ’ল : আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’। দলবাজ ও স্বার্থবাদীরা সর্বদা মুসলিম উম্মাহকে ঐ দু’টি বস্ত্ত থেকে পৃথক করতে চেয়েছে ও তাদের মনোযোগকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। এই অপচেষ্টায় তারা অনেকখানি সফল হয়েছে দু’দল লোকের মাধ্যমে। এক- স্বার্থদুষ্ট রাজনীতিক বা সমাজ নেতাদের মাধ্যমে, দুই- সরলসিধা অথবা দুনিয়াদার আলেমদের মাধ্যমে। এই সকল আলেম একদিকে যেমন কুরআনের তাফসীরের নামে নিজ নিজ রায় ও কল্পনার আলোকে কুরআন ব্যাখ্যা করেন। অন্যদিকে তেমন স্ব স্ব মাযহাবী ফিক্বহ বা ফৎওয়ার বিরোধী ছহীহ হাদীছ সমূহকে সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে নিজ নিজ দলীয় অবস্থানকে মযবুত করার অহেতুক কোশেশ করেন। কোন অবস্থাতেই নিজ দলীয় ফিক্বহের ফৎওয়া পরিত্যাগ করে নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছের অনুসারী হ’তে তারা রাযী নন। এইসব তৎপরতার বাইরে গিয়ে এবং কোন নির্দিষ্ট বিদ্বানের অন্ধ অনুসারী মুক্বাল্লিদ না হয়ে ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসারী হওয়ার আহবান জানিয়ে হাদীছপন্থী বিদ্বানগণ ইসলামের প্রথম যুগ থেকে এযাবত দেশে দেশে যে দাওয়াত পরিচালনা করে আসছেন, সেটাই ইতিহাসে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ নামে পরিচিত।
পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে মানুষের সার্বিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে পরিচালনার গভীর প্রেরণাই হ’ল আহলেহাদীছ আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি। এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ও উক্ত নৈতিক ভিত্তির উপরে দৃঢ়ভাবে দন্ডায়মান হয়ে একজন প্রকৃত ‘আহলেহাদীছ’ আল্লাহর পথে স্বীয় জানমাল কুরবানী করতে প্রস্ত্তত হয়ে যায়। তার সম্মুখে আল্লাহর ভালবাসা ও রাসূলের আনুগত্য ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির নিঃশর্ত তাক্বলীদের পর্দা থাকে না। রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথে চলে সে কেবলই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার মদদ কামনা করে। ‘হক’ যার কাছ থেকেই পাওয়া যায়, তাকেই সে সম্মান করে ও ‘হক’ অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করে। সে আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে চূড়ান্ত সত্যের মানদন্ড হিসাবে বিশ্বাস করে। মানুষের ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগত ‘রায়’ যদি উক্ত মহাসত্যের বিরোধী হয়, তাহ’লে সে তা নিঃসংকোচে পরিত্যাগ করে এবং অহি-র বিধানের নিকটে আত্মসমর্পণ করে। মানবিক জ্ঞানকে সে অহি-র ব্যাখ্যাকারী বলে মনে করে, বিরোধকারী হিসাবে নয়।
আহলেহাদীছদের এই নির্ভেজাল ও দৃঢ়চিত্ত ঈমান সুবিধাবাদী লোকদের হৃদয়ে চিরকাল কম্পন সৃষ্টি করেছে। তাই তারা ছলে-বলে-কৌশলে সর্বদা আহলেহাদীছ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে। যুগে যুগে অসংখ্য তাবেঈ বিদ্বান, মুহাদ্দেছীনে কেরাম ও মুজতাহিদ আইম্মায়ে দ্বীন এইসব দুনিয়াদার পাশব শক্তির কুটকৌশলের শিকার হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তবুও যুগে যুগে এ আন্দোলন চলেছে, এখনও চলছে, ক্বিয়ামত পর্যন্ত চলবে ইনশাআল্লাহ। এই আন্দোলন না থাকলে ইসলাম তার আদি রূপ হারিয়ে ফেলত। ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) তাই বলেছেন, আহলেহাদীছ জামা‘আত যদি পৃথিবীতে না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’।
দুর্ভাগ্য, বর্তমানে আহলেহাদীছ আন্দোলনের অগ্রগতি দেখে কিছু লোকের নতুন করে গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। বিগত যুগের ন্যায় তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মহান আন্দোলনের বিরোধিতা করে চলেছেন। বিশেষ করে ইসলামপন্থী বলে পরিচিত বিদ্বানদের গা-জ্বালা যেন একটু বেশী। তারা আহলেহাদীছ আন্দোলনকে কটাক্ষ ও তাচ্ছিল্য করে চলেছেন। তাদের পরিচালিত কয়েকটি মাসিক পত্রিকার লক্ষ্যই হ’ল আহলেহাদীছ আন্দোলনের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা। শরৎচন্দ্র যেমন মুসলমান ও বাঙ্গালীকে পৃথক জাতি হিসাবে গণ্য করে উপন্যাস লিখেছেন, এইসব ইসলামপন্থী বিদ্বানদের কেউ কেউ এখন ‘মুসলমান’ ও ‘আহলেহাদীছ’কে পৃথক সম্প্রদায় হিসাবে আখ্যায়িত করছেন। এদের মূর্খতা দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। অথচ নিজেরা ‘সুন্নী’ হবার দাবীদার হয়েও চার মাযহাব মান্য করাকে ‘ফরয’ বলেন। অথচ মানেন একটি মাযহাব। আবার তার মধ্যেও রয়েছে পীরপূজা ও তরীকা পূজার ভাগাভাগি। এইসব ফের্কাবন্দী ছেড়ে সকলকে ছহীহ হাদীছের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মেনে নেবার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানায় যে আন্দোলন, সেই মহতী আহলেহাদীছ আন্দোলনকেই এঁরা বলেন ‘লা-মাযহাবী’ আন্দোলন। অথচ আসল ও আদি মাযহাব বা চলার পথ কেবল এঁদের কাছেই রয়েছে। বিরোধীদের এ হামলা ভিতর-বাহির সবদিক দিয়েই চলছে। সাংগঠনিক অগ্রগতি দুর্বল করার জন্য তারা যেমন অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দমন করার জন্য তেমনি আমাদের মারকাযসমূহে সরকারীভাবে তল্লাশী হয়েছে। সেই সাথে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকেও অপপ্রচার শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ‘হিন্দুস্তান টাইমসে’র এক খবরে বাংলাদেশে ৪টি জঙ্গীবাদী সংগঠনের মধ্যে ‘আহলেহাদীছ’-এর নামও এসেছে। অথচ এটা যে একেবারেই ভিত্তিহীন ও ডাহা মিথ্যা, সেটা কে-না জানে?
আমরা সকল বিষয়ে কেবল আল্লাহর উপরেই ভরসা করছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হেŠন- আমীন![1]
[1]. ৫ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০২।