বারাক হোসেন ওবামা গত ৬
নভেম্বর’১২ পুনরায় ৪ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। গতবারের ন্যায়
এবারও আইনসভার উচ্চকক্ষ (সিনেট) ডেমোক্রাটদের দখলে এবং নিম্নকক্ষ
(কংগ্রেস) রিপাবলিকানদের দখলে গেছে। সেদেশের ঐতিহ্য হ’ল দ্বিদলীয় নির্বাচন :
ডেমোক্রাট (গণতন্ত্রী) ও রিপাবলিকান (প্রজাতন্ত্রী)। প্রথমোক্ত দলের
মার্কা হ’ল ‘গাধা’ এবং দ্বিতীয় দলটির মার্কা হ’ল ‘হাতি’। গাধা ও হাতির
পুরোদস্ত্তর লড়াই। চার বছর অন্তর বলা হ’লেও নির্বাচনের দু’বছরের মাথায়
পরবর্তী নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। মার্কিন নির্বাচনকে পৃথিবীর
জটিলতম ও ব্যয়বহুল নির্বাচন প্রথা বলা হয়। সেখানে দলীয় মনোনয়ন পেতে প্রায়
দু’বছর ব্যাপী যে ধকল ও তহবিল সংগ্রহের বিড়ম্বনা পোহাতে হয়, তা পৃথিবীতে
বিরল। এবারের নির্বাচনে উভয় প্রার্থীর মোট ব্যয় হয়েছে ৬০০ কোটি ডলার। এজন্য
ইরানের প্রেসিডেন্ট একে ‘ধনিকদের যুদ্ধ’ বলেছেন। সেদেশের ৫০টি রাজ্যে ৫০
রকম সংবিধান ও নির্বাচনী বিধি। এক রাজ্যে যা সিদ্ধ, অন্য রাজ্যে তা
নিষিদ্ধ। ব্যালটে কেবল প্রেসিডেন্ট ভোটই থাকে না, আইনের বিষয় মতামতও দিতে
হয়। যেমন এবারের নির্বাচনে মেরিল্যান্ড রাজ্যের বাল্টিমোর সিটির এক স্কুল
শিক্ষিকা ভোট দিয়েছেন জুয়ার আড্ডা (ক্যাসিনো) চালুর পক্ষে এবং সমকামী বিবাহ
(গে ম্যারেজ) চালুর বিপক্ষে। জুয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, অবৈধ
তৎপরতার চেয়ে বৈধ উত্তম। ৭২ বছরের এক বৃদ্ধ, যার দু’চোখ অন্ধ এবং দু’পা
হাঁটু থেকে কাটা, হুইল চেয়ারে করে ভোট দিতে এসেছেন। তিনি ওবামা, ক্যাসিনো ও
গে ম্যারেজের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। অমনিভাবে সমকামী নারী ও পুরুষরা ওবামাকে
ব্যাপকহারে ভোট দিয়েছে। তাদেরও নিশ্চয়ই যুক্তি আছে। আমেরিকায় ভোট দু’রকম :
পপুলার ভোট এবং ইলেক্টোরাল ভোট। শেষোক্ত ভোটাররা হ’লেন দেশের জ্ঞানী-গুণী
মানুষ। যাদের মধ্যে থাকেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তিবর্গ। তাদের সংখ্যা সারা দেশে নির্ধারিত মোট ৫৩৮ জন। তাদের মধ্যে
যিনি অর্ধেক অর্থাৎ ২৭০ টি ভোট পাবেন, তিনিই প্রেসিডেন্ট হবেন। পপুলার ভোট
হ’ল সাধারণ মানুষের ভোট। তাতে কেউ বেশী পেলেও যায় আসে না। যেমন বিগত
রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ-এর চাইতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আল-গোর পপুলার
ভোট ১০ লাখ বেশী পেয়েছিলেন। কিন্তু ইলেক্টোরাল ভোট ৫টি কম পাওয়ায় তিনি
প্রেসিডেন্ট হ’তে পারেননি। এর মধ্যে একটা বিষয় শিক্ষণীয় যে, সেদেশে
জ্ঞানী-গুণীদের ভোটের মূল্য আছে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মত ইলিশ মাছ ও
পুটি মাছের দর এক নয়। আরেকটি বিষয় ভাল, সেটি হ’ল এই যে, তাদের মধ্যে
নির্বাচনী সহিংসতা নেই। যেটা আমাদের দেশে অপরিহার্য বিষয়। সম্ভবতঃ ভোটচুরিও
নেই। থাকলে সহিংসতা হ’ত। কিন্তু এই যে বিশ্ব কাঁপানো ইলেকশন। তার ফলাফলটা
কি?
আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর বলা হয়। আমেরিকাকে আর্থিক পরাশক্তি বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? মিট রমনি আর ওবামা ব্যক্তি ও দল হিসাবে যতই পৃথক হন, রাষ্ট্র হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র একটাই। প্রেসিডেন্ট বদলালেও সেদেশের জাতীয় স্বার্থ কখনো বদলায় না। সেই স্বার্থ ঠিক করে যুক্তরাষ্ট্রের সিভিকো-মিলিটারী করপোরেট ত্রিভুজ। ভিতর থেকে যাদের নিয়ন্ত্রণ করে একটি শক্তিশালী ইহুদী লবি। বর্তমানে ৩১ কোটি ৪৭ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে যাদের সংখ্যা মাত্র ৬৫ লাখ (২.১ %)। অথচ ১৯৬৭ সাল থেকে তারাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ামক। সেদেশের ব্যাংক, বীমা, ব্যবসা, মিডিয়া সব তাদের হাতে। প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের তহবিলের মূল যোগানদাতা তারাই। ফলে এদের প্রতাপকে সমীহ না করে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষেই ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকা সম্ভব নয়। এরপরেও চেক এন্ড ব্যালান্সের নামে কংগ্রেস আর সিনেটে দু’দলের টানাপোড়েনে প্রেসিডেন্টের কোন সদিচ্ছা বাস্তবায়ন করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই ব্যক্তি ওবামা যতই শান্তিতে নোবেলজয়ী হন না কেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা তা প্রমাণ করতে পারেননি বিগত চার বছরে। অন্যান্য প্রেসিডেন্টদের মত তিনিও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাঈলের স্বার্থের বরকন্দাজ। আফগানিস্তান, ইয়ামন ও পাকিস্তানে তিনি ড্রোন হামলাকারী ও শতশত নিরীহ মানুষের হত্যাকারী। লিবিয়াকে তিনি ধ্বংসকারী ও তৈল লুটকারী। এখন সিরিয়াকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনেছেন। কারণ সিরিয়া হ’ল ইস্রাঈলের নিকটতম প্রধান বিরোধী রাষ্ট্র। অথচ নিজের দেশের হাযার হাযার বেকার ও হতদরিদ্র মানুষ কর্মসংস্থানের দাবীতে ওয়াল স্ট্রীটে অবস্থান ধর্মঘট করছে। যারা নিজেদেরকে সেদেশের ৯৯ শতাংশ নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি বলে দাবী করছে। অর্থাৎ এক শতাংশ ধনিক শ্রেণী বাকী নিরানববই শতাংশ মানুষের রক্ত শোষণ করছে। বহু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। ফলে চিরশত্রু চীনের কাছ থেকে ও অন্যান্য বন্ধু দেশ থেকে ট্রিলিয়ন কি ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ও অস্ত্র ব্যবসা করে কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশটি। ফলে মার্কিন শাসনব্যবস্থা ও সেদেশের পুঁজিবাদী অর্থনীতি যে কতটা গণবিরোধী, তা ওবামার গত চার বছরের ব্যর্থতা দিয়েই পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাই ওবামা এবারে তাঁর শেষ বারে পারবেন কি ইস্রাঈলের স্বার্থ রক্ষাকারী না হয়ে মানবতার রক্ষক হতে? পারবেন কি গণতন্ত্র ফেরী করার নামে অস্ত্র ও সন্ত্রাস রফতানী বন্ধ করতে? পারবেন কি বাহরায়েন, কুয়েত, জর্ডান, কাতার, সঊদী আরব, ওমান, আরব আমিরাত, ইয়ামন, জিবুতি, মিসর, তুরস্ক, ইরাক, উযবেকিস্তান, তাযিকিস্তান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানসহ মোট ১৬টি মুসলিম দেশ থেকে তাদের সামরিক ঘাঁটি গুটিয়ে নিতে? পারবেন কি কিউবার গুয়ান্তানামো বে সহ বিভিন্ন দেশে তাদের স্থাপিত মুসলিম নির্যাতনকারী বন্দী শিবিরগুলি বন্ধ করতে? পারবেন কি বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়ার পাঁয়তারা বন্ধ করতে? শান্তির জন্য কাজ করতে না পারলেও অশান্তি ছড়াবেন না বা তার পক্ষে ভেটো দেবেন না, এটুকুও যদি করতে পারেন, তাহ’লেও তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আগামী ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ফিলিস্তীনের সদস্যপদ লাভের পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপিত হবে। সারা বিশ্ব এর পক্ষে। কিন্তু ভেটো ক্ষমতাধারী আমেরিকা এর বিপক্ষে। দেখা যাক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবাদের মোড়ল রাষ্ট্রটি সেখানে কি ভূমিকা রাখে। আগামী ১৯ নভেম্বর ওবামা যাচ্ছেন মিয়ানমারে। সেখানে গিয়ে শান্তিতে নোবেল জয়ী আরেক নেত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হবে। তারা দুই শান্তির মেডেলধারী ইচ্ছা করলে খুব সহজেই নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোনদের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। ইতিমধ্যে মিয়ানমারে আল্লাহর গযব নাযিল হয়েছে। শক্তিশালী ভূীমকম্পে রাখাইন রাজ্য তছনছ হয়ে গেছে। যালেম বৌদ্ধরা এখন এটাকে ভগবানের ক্রোধ বলে ভীত হয়ে পড়েছে। ওবামার আমেরিকাতেও সদ্য স্যান্ডির গযব হয়ে গেল। দুই অভিশপ্ত দেশের নেতারা তা থেকে কি উপদেশ গ্রহণ করেছেন, বিশ্ববাসী এখন সেটাই দেখবে। যদিও আমরা নিশ্চিত যে, ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য সহ তাবৎ অমুসলিম বিশ্ব এক। তবুও আমরা আশা করতে পারি এজন্য যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ ফাসেক-ফাজের লোকদের দিয়েও তার দ্বীনকে শক্তিশালী করে থাকেন’ (বুখারী)।
পরিশেষে বলব, আমেরিকার এই নির্বাচন ধনিক শ্রেণীর পাতানে ফাঁদের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ রক্ষার নির্বাচন মাত্র। ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বিগত ২৩৬ বছর ধরে চলে আসা আমেরিকার এই নির্বাচনী রাজনীতির ফলাফল গরীবদের জন্য শূন্য। দিন দিন তাদের অংশগ্রহণ কমছে। বুশ-এর নির্বাচনে ৫৪ শতাংশ লোক ভোট দেয়নি। এবার ওবামার নির্বাচনে ৫০ শতাংশেরও কম লোক অংশগ্রহণ করেছে। প্রদত্ত মোট ১২ কোটি ৩৫ লাখ পপুলার ভোটের ৫০.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ওবামা। তাহ’লে দেখা যাচ্ছে তিনি আমেরিকার মোট ভোটারের গড়ে সিকি শতাংশের প্রেসিডেন্ট। এই নির্বাচনী জুয়ার খেলা মানুষ ক্রমেই বুঝতে পারছে। ফলে মানুষ ক্রমেই এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অতএব আমরা বিশ্ববাসীকে দাওয়াত দেব, ফিরে এসো দল ও প্রার্থী বিহীন নেতৃত্ব নির্বাচনের দিকে। ফিরে এসো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর বিধানের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মেনে নিয়ে যোগ্য ও জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার দিকে। আল্লাহ আমাদের হেদায়াত দিন- আমীন! (স.স.)।