গত ১০ই মে বুধবার শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমাদ মজুমদার বলেন, ‘দেশের মানুষের ত্রাহি অবস্থা। পকেটে টাকা নেই, মানুষ বাজারে গিয়ে কাঁদে। সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে’ (দৈনিক ইনকিলাব ১১.০৫.২৩ বৃহস্পতিবার)। গত ১৭ই মে বুধবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সরকারী BIDS Research Almanac 2023 সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে এই গবেষণা তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটির মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, গত বছর এই শহরের মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন দরিদ্র’। অর্থাৎ আগে তারা দারিদ্র্য সীমার উপরে ছিল (ঐ, ২০.৫.২৩ সম্পাদকীয়)। সম্মেলনে প্রধান অতিথি পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. এ. মান্নান বলেন, দারিদ্র্য কোন অবধারিত বিষয় নয়। এটা সৃষ্ট সমস্যা। যা সমাজে তৈরী হয়েছে। ন্যায়বিচার ও সুযোগ সমতা ভিত্তিক করার মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমানো সম্ভব (ঐ)। অর্থাৎ এই সব দারিদ্র্য মানব সৃষ্ট। আল্লাহ সৃষ্ট নয়। কেননা তিনি বলেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিক আল্লাহর যিম্মায় নেই’ (হূদ-মাক্কী ১১/৬)।
দুই মন্ত্রীর সর্ব সাম্প্রতিক মন্তব্যে দেশের সার্বিক অবস্থা ফুটে উঠেছে। তাদের এই সরল স্বীকারোক্তির জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এইগুলো দূরীকরণের পূর্ণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি তাঁরা তা না করেন, তাহ’লে তাঁরা ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকটে কি জবাবদিহি করবেন? মুশকিল হ’ল দলীয় রাজনীতিতে দলীয় লোকদের দুর্নীতি ও অপকর্ম নীরবে সহ্য করা ছাড়া নেতাদের কিছুই করার থাকে না। আর সেকারণেই মন্ত্রীরা হতাশ। নিঃসন্দেহে ভুক্তভোগী জনগণ তাদের চাইতেও বেশী হতাশ। বস্ত্ততঃ ‘গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের পাতানো দু’ধারী কাঁচির মত। যার ফাঁকে আঙুল পড়লে তা কাটতে বাধ্য’। জনগণ হ’ল সরকারী ও বিরোধী দলীয় কাঁচির ফাঁকের মধ্যকার অসহায় শিকার। তাই তাদের আর্তনাদ শোনার কেউ নেই আল্লাহ ব্যতীত। অতএব আসুন! আমরা দেখি বিশ্বব্যাপী এই ফাঁদের মধ্যে আটকে পড়া নিষ্পিষ্ট মানবতাকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহর বিধান সমূহ কি?
শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের পূর্বে আরবের পুঁজিপতিরা নিজেদের ইচ্ছামত অর্থনৈতিক বিধান চালু করেছিল। ফলে সেখানে গাছতলা ও পাঁচতলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল। এই বৈষম্য দূরীকরণের জন্য একে একে আল্লাহর বিধান সমূহ নাযিল হয়। প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের মালিকানা আল্লাহর। অতএব আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বান্দার আয়-ব্যয় সবই পরিচালিত হবে (যুখরুফ-মাক্কী ৪৩/৩২)। সেখানে ব্যক্তি মালিকানা নিষিদ্ধ নয়। তবে হালাল ও হারাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ন্যায়বিচার ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করা হয়। ফলে ইসলামী অর্থনীতিতে গণতন্ত্রের নামে লাগামহীন ব্যক্তি পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের নামে জনগণকে নিঃস্ব করা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের কোন অবকাশ থাকে না। এক্ষণে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে আল্লাহ প্রদত্ত প্রধান উপায়গুলি নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-
১. আল্লাহর বিধান মতে উত্তরাধিকার বন্টন : এবিষয়ে সূরা নিসা ১১, ১২ ও ১৭৬ আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। কিন্তু জাহেলী আরবের ন্যায় অদ্যাবধি এদেশের মুসলমানদের অনেকের মধ্যে পিতার পরিত্যক্ত সম্পদে পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে ইসলামী বিধান মতে উত্তরাধিকার বন্টন হয় না। এটা ঠিকভাবে হ’লে পুঁজিপতিদের মৃত্যুর পরেই তাদের পুঁজি ভেঙ্গে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টিত হয়ে যেত। ২. মওজুদদারী বন্ধ করা : দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির কপট উদ্দেশ্যে সম্পদ মওজুদ করা হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মওজুদদার মহাপাপী’ (মুসলিম হা/১৬০৫)। ৩. ফটকাবাজারী বন্ধ করা : নিজ মালিকানায় সম্পদ নেই। কেবল চটকদার কথা ও প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করা বর্তমানে লাগামহীনভাবে বেড়ে গেছে। ফলে বিভিন্ন অপপ্রচারে ভুলে সাধারণ মানুষ দৈনিক নিঃস্ব হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের সাথে প্রতারণা করল, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (মুসলিম হা/১০১)। ৪. আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেওয়া : মাক্কী ও মাদানী উভয় জীবনে একই ভাষায় আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর। আর তোমরা নিজেদের জন্য যেসব সৎকর্ম অগ্রিম প্রেরণ কর, তা তোমরা আল্লাহর নিকটে পাবে’ (মুয্যাম্মিল-মাক্কী ৭৩/২০; বাক্বারাহ-মাদানী ২/১১০)। তিনি বলেন, ‘কোন সে ব্যক্তি যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে, অতঃপর তিনি তার বিনিময়ে তাকে বহুগুণ বেশী প্রদান করবেন? বস্ত্ততঃ আল্লাহই রূযী সংকুচিত করেন ও প্রশস্ত করেন। আর তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/২৪৫)।
[বাকী অংশ ৫৫ পৃষ্ঠা দ্রঃ] |
৫. অপচয় বন্ধ করা : আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ’ (বনু ইস্রাঈল-মাক্কী ১৭/২৭)। অথচ বাংলাদেশের ধনিক শ্রেণী প্রতিদিন যে খাবারের অপচয় করে, তা দিয়ে দেশের সকল না খেয়ে থাকা মানুষের পেট ভরানো সম্ভব। BBC বলেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত খাবার উৎপাদন হয়, তার একটি বড় অংশ ভাগাড়ে যায়। অর্থাৎ নষ্ট হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা UNEP ২০২১ সালে যে Food Waste Index প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১কোটি ৬ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়। তাছাড়া মাথাপিছু খাদ্য অপচয়ের হারও বাংলাদেশে বেশী। যদিও গত ৫ই এপ্রিল ১৩ই রামাযান বুধবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণের পাতে মোড়ানো জিলাপী ৫ হাযার টাকা পোয়া দরে বিক্রির ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদার কারণে ৯ই এপ্রিল রবিবার বিক্রি শেষ হয়ে যায়। যদিও সরকার ঐ হোটেলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সাথে সাথে দেখুন টিসিবির সামনে ভুখা-নাঙ্গা মানুষের দীর্ঘ লাইন। ধনী ও গরীবের পাহাড় প্রমাণ বৈষম্যের এই নিষ্ঠুর চিত্র দেখার পরেও আমরা নিশ্চিন্ত থাকি কিভাবে? উন্নত দেশগুলোতেও হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু সেসব দেশে বাংলাদেশের মত ‘স্বর্ণখেকো’ মানুষ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
৬. সূদী অর্থনীতি বন্ধ করা ও যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি চালু করা : জাহেলী আরবের ফেলে আসা সূদী অর্থনীতি অদ্যাবধি মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে চালু আছে। অথচ সূদ বজায় রেখে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কোন উপায় নেই। প্লেটো, এরিস্টেটলসহ বিশ্বের সকল জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি এ বিষয়ে একমত। অথচ আমরা কূয়ায় পচা বিড়াল রেখে পানি সেঁচে চলেছি। পবিত্র কুরআনে ৮টি আয়াতে সূদকে হারাম করা হয় এবং ইসলামী আরবে যাকাত ও ছাদাক্বা ভিত্তিক অর্থনীতি চালু করা হয়। যার ফলাফল দাঁড়ায় এই যে, খলীফা ওমরের সময় (১৩-২৩ হি.) ইয়ামনের গভর্ণর মু‘আয বিন জাবাল সেখানকার এক তৃতীয়াংশ ছাদাক্বার উদ্বৃত্ত মাল রাজধানী মদীনায় পাঠান। কিন্তু ওমর (রাঃ) তা নিতে অস্বীকার করে বলেন, আমি তোমাকে সেখানে কর আদায়কারীরূপে পাঠাইনি। বরং তোমাকে পাঠিয়েছি সেখানকার ধনীদের নিকট থেকে ছাদাক্বা নিয়ে হকদারদের মধ্যে তা বিতরণ করার জন্য। জবাবে গভর্ণর মু‘আয বলেন, ‘আমি আপনার নিকটে কিছুই পাঠাতাম না, যদি আমি সেখানে যাকাত নেওয়ার মত কোন হকদার পেতাম! একই কারণে পরের বছর তিনি সেখান থেকে ছাদাক্বার অর্ধাংশ প্রেরণ করেন। তৃতীয় বছর পুরোটাই প্রেরণ করেন। প্রতিবারেই ওমর (রাঃ) আপত্তি করেন এবং প্রতিবারেই মু‘আয (রাঃ) একই জবাব দেন’ (লেখক প্রণীত ‘যাকাত ও ছাদাক্বা’ বই পৃ. ৫২)। মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও আমরা কি পারিনা আমাদের দেশে খলীফাদের শাসন ফিরিয়ে আনতে? (স.স.)।