হযরত ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবসহ প্রায় পাঁচ হাযার নবীর কর্মস্থল এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মে‘রাজের স্মৃতিধন্য মুসলমানদের ৩য় ক্বিবলা বায়তুল আক্বছার আদি বাসিন্দা ফিলিস্তীনীদের একাংশ গাযা আজ উড়ে আসা বহিরাগত ইহূদীদের মাধ্যমে অবরুদ্ধ। খাদ্য, পানি-বিদ্যুৎ ও ঔষধ সবকিছু থেকে তারা বঞ্চিত। হযরত ইব্রাহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈলের মাধ্যমে মক্কা এলাকায় এবং তাঁর অন্য পুত্র ইসহাকের মাধ্যমে ফিলিস্তীন এলাকায় তাওহীদের দাওয়াত প্রসারিত হয়। ইসহাকের বংশে হযরত ঈসাসহ প্রায় সকল নবী এবং ইসমাঈলের বংশে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জন্ম হয়। মক্কা থেকে বায়তুল আক্বছা পর্যন্ত নৈশ সফরকে ‘ইসরা’ এবং সেখান থেকে আকাশে ভ্রমণকে ‘মে‘রাজ’ বলা হয়। ফলে মক্কা ও বায়তুল আক্বছা দু’টিই মুসলিম অধ্যুষিত হয়। ফিলিস্তীনে শতকরা ৯৩ ভাগ আরব মুসলিম ও ৭ ভাগ ছিল ইহূদী। কিন্তু পশ্চিমা ইহূদী-খৃষ্টান পরাশক্তি গুলির নগ্ন সমর্থনে ও অস্ত্র সাহায্যে তারা আজ অজেয় শক্তিতে গর্বোদ্ধত। অথচ ইহূদীরা আল্লাহর গযব প্রাপ্ত। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যেখানেই তারা থাকুক না কেন, কেবলমাত্র আল্লাহর অঙ্গীকার ও মানুষের অঙ্গীকার ব্যতীত। আর তারা নিজেদের উপর আল্লাহর ক্রোধকে ফিরিয়ে নিয়েছে এবং তাদের উপর পরমুখাপেক্ষিতা অবধারিত হয়েছে। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। কেননা ওরা অবাধ্য হয়েছিল এবং সীমালংঘন করত’ (আলে ইমরান ৩/১১২)। আয়াতে ‘আল্লাহর অঙ্গীকারে’র অর্থ হ’ল, আল্লাহ যাদেরকে নিজের বিধান অনুযায়ী আশ্রয় ও নিরাপত্তা দান করেছেন। যেমন তাদের নারী-শিশু এবং সাধক ও উপাসকগণ, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি, তারা নিরাপদে থাকবে।
অপরপক্ষে ‘মানুষের অঙ্গীকারে’র অর্থ অন্যদের সাথে সন্ধিচুক্তি। চাই সেটা মুসলমানদের সাথে হৌক বা অমুসলিমদের সাথে হৌক। যার বাস্তব উদাহরণ হ’ল বর্তমানের কথিত ‘ইস্রাঈল’ রাষ্ট্র। যা পাশ্চাত্যের ও বৃহৎ শক্তি বলয়ের সৃষ্ট একটি সামরিক কলোনী ছাড়া কিছুই নয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল তৈল ভান্ডার নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেখানকার মুসলিম রাষ্ট্রগুলির উপরে ছড়ি ঘুরানোর উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের স্বার্থে একে ‘রাষ্ট্র’ নাম দিয়েছে ও জাতিসংঘের সদস্য করে নিয়েছে। অথচ ঐসব শক্তির সমর্থন উঠে গেলে ইস্রাঈলের ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে আদৌ টিকে থাকার ক্ষমতা নেই। ইতিপূর্বে জার্মানীতে হিটলার ৬০ লাখ ইহূদীকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করে বলে শ্রুতি আছে। যা ‘হলোকস্ট ট্রাজেডী’ নামে খ্যাত। অতঃপর সেখান থেকে ও অন্যান্য স্থান থেকে অবশিষ্টদের এনে ফিলিস্তীনে জড়ো করা হয় এবং সেখানকার স্থায়ী মুসলিম আরব বাসিন্দাদের জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে এইসব ইহূদীদের বসতি স্থাপন করা হয়।
১৯৪৮ সালে এই অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজও সেখানে নিয়মিত রক্ত ঝরছে। তারা কখনোই শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। যখনই বর্তমান মানুষের দেওয়া এই অঙ্গীকার ছিন্ন হবে, তখনই ওরা আবার চূড়ান্ত লাঞ্ছনার শিকার হয়ে ঘুরতে থাকবে পৃথিবীব্যাপী। কারণ ওরা অবিরতভাবে তওরাত ও ইনজীলের অবাধ্যতা করেছে। কিতাব দু’টিকে বিকৃত করে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে। তাদের নবীদের হত্যা করেছে। এমনকি হযরত ঈসাকেও হত্যার অপচেষ্টা চালিয়েছে। অবশেষে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ওদের অনিষ্টকারিতা হ’তে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে মুসলিম উম্মাহকে সূরা ফাতিহায় প্রার্থনা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, ‘তুমি আমাদেরকে অভিশপ্ত (ইহূদী)-দের ও পথভ্রষ্ট (নাছারা)-দের পথে নিয়ে যেয়ো না’ (তিরমিযী হা/২৯৫৪)। তবে তাদের মধ্যে সর্বদা কিছু ভালো লোক থাকবে, যারা মুসলমান হয়ে শান্তিময় জীবন যাপন করবে। যেমন হাবশার বাদশাহ নাজাশী, মদীনার আব্দুল্লাহ বিন সালাম ও তাদের সাথীগণ।
১৯৭৩ সালের ৬ই অক্টোবর মিসর ও সিরিয়া কর্তৃক ‘ইয়ম কিপুর’-এর দিন ইস্রাঈলে অতর্কিত হামলার ন্যায় বিশ্বসেরা ইস্রাঈলী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদে’র শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে গত ৭ই অক্টোবর শনিবার ‘ইয়ম কিপুর’-এর দিন সকাল সাড়ে ৬-টায় ফিলিস্তীনের গাযা অঞ্চলের শাসক দল ইসলামপন্থী ‘হামাস’ ইস্রাঈলে অতর্কিত হামলা করে। ‘ইয়ম কিপুর’ হ’ল ইহূদীদের পাপ মুক্তির দিন। তাদের মতে, এই দিন প্রভু ইহূদীদের ভাগ্য লিখন শেষে খাতা বন্ধ করেন’। তাই অনেকে এবারের আকস্মিক হামলাকে সেই ‘ইয়ম কিপুর’ যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন। ২০ মিনিটে ৫০০০ রকেট বৃষ্টির মাধ্যমে তারা ইস্রাঈলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটায় এবং কাঁটা তারের বেড়া ভেঙ্গে ট্যাঙ্কসহ ইস্রাঈলের সীমানার মধ্যে ঢুকে কয়েকটি ইস্রাঈলী ট্যাঙ্ক দখল করে নিয়ে আসে। এতে ইস্রাঈল হতচকিত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক কুফরী শক্তি গুলি ছাড়াও যখন বাহরায়েন, কাতার, আরব আমিরাত এমনকি সঊদী আরব ইস্রাঈলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে, তখনই বিগত ১৬ বছর যাবৎ চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি ‘হামাস’ যোদ্ধারা এই হামলার মাধ্যমে বিশ্ব বিবেকের কাছে এটাই হয়ত তারা বলতে চেয়েছে যে, ফিলিস্তীনের আদি বাসিন্দা অবরুদ্ধ ২৩ লাখের অধিক মুসলিম নিশ্চিহ্ন হ’তে চায় না। তারা পূর্ণ মানবাধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইস্রাঈলী বোমা হামলায় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাস ব্যবহারে শহীদ হয়েছেন ৩ হাযারের অধিক ফিলিস্তীনী। পক্ষান্তরে হামাসের রকেট হামলায় নিহত হয়েছে ১৪০০-এর বেশী ইস্রাঈলী। হামাস যোদ্ধারা ইস্রাঈলের ২৮৬ জন সেনাসদস্যকে হত্যা করেছে এবং দুই শতাধিক ইস্রাঈলীকে ধরে এনে যিম্মী করেছে। এর মাধ্যমে তারা ইস্রাঈলের কারাগারে বন্দী ৫ হাযারের অধিক ফিলিস্তীনীকে মুক্ত করার সুযোগ পেতে পারে। তাদের অতীত যে কোন হামলার চেয়ে এবারের হামলায় তুলনামূলক বেশী সংখ্যক ইস্রাঈলী হতাহত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, গাযা উপত্যকা একসময় মিসরের অংশ ছিল। ওছমানীয় খেলাফতের পূর্ব থেকে ১৩০০ বছর পর্যন্ত কখনোই সেখানে কোন সংঘাত কোন ইহূদী বা মুসলিম প্রাণ হারায়নি। অথচ ১ম মহাযুদ্ধের শেষে ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর কুখ্যাত ‘বেলফোর ঘোষণার’ পর যখন ফিলিস্তীনে পৃথক ইহূদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়, তখন থেকেই সেখানে স্থায়ীভাবে রক্ত ঝরার সূত্রপাত হয়। অতঃপর ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তীন ভূখন্ডে জাতিসংঘ কর্তৃক জোরপূর্বক ‘ইস্রাঈল রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৭ সালের ৫ই জুন আরব-ইস্রাঈল যুদ্ধে ৩৬০ ব.কি.-এর গাযা ভূখন্ডটি ইস্রাঈলের দখলে চলে যায়। ১৯৯৩ সালে ‘অসলো চুক্তি’র পর গাযায় ফিলিস্তীনী কর্তৃপক্ষের সীমিত শাসন মেনে নেয় ইস্রাঈল। অতঃপর ২০০৫ সালে গাযা থেকে তারা ইহূদী বসতি পুরোপুরি গুটিয়ে নেয়।
কিন্তু ২০০৬ সালে ফিলিস্তীনের নির্বাচনে ‘হামাস’ বিজয়ী হলে তারা গাযা থেকে ‘ফাতাহ’ ও ফিলিস্তীন কর্তৃপক্ষকে হটিয়ে দেয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইস্রাঈল ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’-এর তকমা দিয়ে হামাসের জয় মেনে নিতে চায়নি। হামাসও ইস্রাঈলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার নীতিতে অটুট থাকে। এরপরই পূর্ব দিকে ইস্রাঈল ও দক্ষিণ দিকে মিসর গাযার সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। ২০০৭ সাল থেকে ইস্রাঈল গাযার ওপর নৌ, স্থল ও আকাশ অবরোধ আরোপ করে। এর ফলে খোলা আকাশের নীচে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারাগারে পরিণত হয় ‘গাযা’। তারা দিনের কিছু সময় সীমান্ত পেরিয়ে কাজের জন্য ইস্রাঈলে ঢুকতে পারে। জাতিসংঘ গাযার জন্য যে মানবিক ত্রাণ ও ঔষধপথ্য দেয়, তা নিতে হয় ইস্রাঈলের মর্যীর্ অনুসারে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলঘেঁষা হলেও সেখানে গাযাবাসীদের জন্য মাছ ধরা বা নৌকা চালানোয় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে ইস্রাঈল। মাঝখানে কিছুদিন মিসরের রাফাহ সীমান্ত দিয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যাতায়াতের ব্যয়বহুল পথ খোলা থাকলেও সেনানায়ক সিসি ক্ষমতায় আসার পর মিসর সেটাও বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায় বাঁচা-মরার মুখোমুখি হয়ে তারা ইস্রাঈলের অজেয় প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে হামলা করার ঝুঁকি নেয়। তাদের ধারণায় এর ফলে বিশ্ব বিবেক জেগে উঠবে। কিন্তু জেগে উঠেছে কি?
আমরা মনে করি, ইস্রাঈলী দখলদারিত্বের অধীনে বসবাস এবং ফিলিস্তীনী ভূখন্ডে জোরপূর্বক ইহূদী বসতি স্থাপন এই অঞ্চলে কখনই শান্তি বয়ে আনবে না। গত ১৭ই অক্টোবর মঙ্গলবার ইস্রাঈলে বাইডেনের উপস্থিতিতে গাযার হাসপাতালে বোমা হামলায় ৫ শতাধিক রোগী ও নারী-শিশুকে হত্যা করা ও তার চেয়ে অধিক নিরীহ মানুষকে আহত ও পঙ্গু করার মধ্যে আমেরিকা ও ইস্রাঈলের নৃশংস চরিত্র নগ্ন হয়ে ফুটে উঠেছে। তাতে আন্তর্জাতিক আদালতে নেতানিয়াহু ও বাইডেনের যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবী উঠেছে। অতএব আমরা আন্তর্জাতিক উদ্যোগে অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহবান জানাই। সেই সাথে ১৯৬৭ সালের ২২শে নভেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ২৪২ এবং ৩৩৮ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুসরণে স্বাধীন ফিলিস্তীন ও ইস্রাঈল দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান ও পাশাপাশি উভয়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কামনা করি। আল্লাহ যালেমদের উপযুক্ত বদলা দিন এবং মযলূমদের সহায় হৌন-আমীন! (স.স.)।