আমি মুহাম্মাদ ইবরাহীম। ফেনী যেলার দাগনভূঞা থানার এক সাধারণ মুসলিম পরিবারে জন্ম। একজন সাধারণ ছেলে যেভাবে বেড়ে উঠে আমারও সেভাবে বেড়ে উঠা। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ছিল না আমার মধ্যে। পরিবারেও তেমন আমল ছিল না। ছিল না কুরআন-হাদীছের সঠিক জ্ঞান। এভাবেই ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা শেষ করি। এসএসসি পরীক্ষার পরে হঠাৎ ‘পিস টিভি’ নযরে আসল। আলোচকদের বক্তব্যের সাথে আমাদের আচরিত আমল-আক্বীদার বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হ’ল। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগল। সঠিক পথের সন্ধান চেয়ে মহান আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলাম। একদিন দেখলাম মসজিদের এক ভাইয়ের ছালাত আমাদের থেকে ভিন্ন। ইমাম ছাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, উনার ছালাত কি ঠিক হচ্ছে? ইমাম ছাহেব চট করে বলে দিলেন, না না, উনারটা ভুল হচ্ছে। এই পার্থক্যের কারণ ভাবতে লাগলাম। পরে একদিন ঐ ভাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তার ছালাত সম্পর্কে সরাসরি ছহীহ হাদীছ দেখালেন। ফলে মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমি হক বুঝতে পারলাম এবং নিজে আমল শুরু করলাম। আমার সাথে আরো কয়েকজন যুবক ভাইও ছহীহ তরীকায় ছালাত শুরু করল। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
কিন্তু আমদের এই পরিবর্তন কোনভাবেই মসজিদের ইমাম, সমাজের মুরুববী, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও পীরভক্তরা মেনে নিতে পারল না। আমাদের সাথে অযথাই তারা বিতর্কে লিপ্ত হ’ত এবং নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিত। আমরা শত প্রতিকূলতায়ও হকের উপরেই দৃঢ় থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। পাশাপাশি তাদেরকেও বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারা বুঝতে চাইলেন না। এভাবেই চলতে থাকলো।
পরবর্তীতে বিষয়টি আমার পরিবারে জানাজানি হলে আমার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন আমার উপর প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করতে লাগল। কিন্তু তাদের কথায় আমি সাড়া দিলাম না। কিছুদিন পরে আমি কাতার চলে গেলাম। সেখোনে গিয়ে আরো চর্চা করতে লাগলাম। জানতে পারলাম, দাড়ি রাখা রাসূল (ছাঃ)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। ফলে দাড়ি ছেড়ে দিলাম। দাড়ি রাখার কারণে মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজন আমার উপর অসন্তুষ্ট হ’লেন। পরবর্তীতে প্রবাসে ভাল রূযীর সন্ধান না পেয়ে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দেশে ফিরে আসলাম।
দেশে আসার পর নানা অজুহাতে আমার উপরে চলে মানসিক নির্যাতন। মা অসুস্থ হওয়ার কারণে পরিবার থেকে আমাকে বিয়ে করতে বলে। কারণ আমি বড় ছেলে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি বিয়ে করি। বিয়ের সময় পরিবারের পক্ষ থেকে এই প্রতিজ্ঞা নেই যে, তারা কোনপ্রকার যৌতুক চাইবে না এবং আমার স্ত্রীকে পর্দার সাথে থাকতে দিবে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে আমাকে না জানিয়ে তারা আমার শ্বশুর বাড়ী থেকে যৌতুক আদায় করে। স্ত্রী পর্দার সাথে চলতে গেলে তাকে বাধা প্রদান করে। এক পর্যায়ে বাবা আমার নিকট থেকে পরিবারের সবার খরচ দাবী করে। যদিও তার কোন অভাব নেই। আর দেশে আয়-রোজগার কম হওয়ায় এই দাবী পূরণ করাও আমার পক্ষে ছিল সাধ্যাতীত। একদিন আমার পিতা আমাকে মারতে উদ্যত হন। আমার স্ত্রী দরজা বন্ধ করে দিলে রক্ষা হয়। অতঃপর আমাদের খাবার বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আম্মাকে নির্দেশ প্রদান করেন। ফলে সেই রাতে আর খাওয়া হল না। পরদিন সকালে ওনারা নাশতা করেন, কিন্তু আমাদের ডাকেন না। অপেক্ষা করে বেলা ১০-টার দিকে দোকান থেকে কলা-পাউরুটি কিনে খাই। দুপুরের অবস্থাও একই। পরিবারের সবাই খেয়ে নিল, কিন্তু আমাদের কোন খোঁজ-খবর নিল না। ওনাদের খাবার শেষ হ’লে বেলা আড়াইটার দিকে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আববা কি আমাদের খেতে দিতে নিষেধ করেছেন? মা বললেন, ‘তোদের খাবার দিতে নিষেধ করেছেন এবং তোদেরকে বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন’। অতঃপর সকালের ন্যায় আবারো পাউরুটি খেয়ে থেকে গেলাম। রাতে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরবর্তী হোটেল থেকে রুটি-ডাল এনে খেয়ে রাত কাটালাম। এভাবে চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে ২-দিন তারা আমার, আমার স্ত্রী ও আমার ৫ মাসের সন্তানের খাবার বন্ধ করে রাখে।
অতঃপর পরদিন সকালে ফজরের ছালাতের কিছু পরে বাড়ী থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছি। হঠাৎ দরজায় আম্মার কড়া নাড়ার শব্দ। ইতিবাচক মনে কেন যেন ভাবনা হ’ল- এই বুঝি আমাদেরকে নাশতার জন্য ডাকতে এসেছেন। প্রচন্ড আশা নিয়ে দরজা খুলতেই বিধি বাম। আম্মা বলছেন, ‘কিরে তোরা এখনও বাড়ী থেকে বের হসনি’। আম্মার এই কথা শুনে হতচকিত হয়ে গেলাম। ফলে আর বিলম্ব না করে সকাল ৯-টার দিকে স্ত্রী ও ৫ মাসের বাচ্চা নিয়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে যাই। প্রাথমিকভাবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শ্বশুর বাড়ীতে আশ্রয় নেই।
অতঃপর সহযোগী দ্বীনী ভাইদের সাথে যোগাযোগ করি। বিশেষ করে কাতারে থাকাবস্থায় পরিচিত দ্বীনী ভাই নোয়াখালী যেলার মাইজদী থানার মুহাম্মাদ ইসমাঈল ভাইকে সবকিছু জানাই। তিনি আমাকে নিয়ে গত ৩০শে নভেম্বর ঢাকা বংশালের যেলা কার্যালয়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলোদেশ’-এর দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব সহ আরো অনেকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। সেদিন আমি আমার মনের খোরাক পাই। সেই সাথে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সম্পর্কে ইতিপূর্বেকার ভুল ধারণাও ভেঙ্গে যায়। উল্লেখ্য, কাতার থাকাবস্থা পাবনার আব্দুল কাবীর ভাইয়ের মাধ্যমে এই আন্দোলনের দাওয়াত পেলেও গ্রহণ করিনি। কারণ এটিকে একটি ফিরক্বা মনে করতাম। এক্ষণে ভুল ভাঙ্গার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ‘প্রাথমিক সদস্য’ ফরম পূরণ করে এই ‘আন্দোলনে’র সদস্য হয়ে যাই। অতঃপর ২রা ডিসেম্বর ইসমাঈল ভাইয়ের সাথে রাজশাহী গমন করে আমীরে জামা‘আতের সাক্ষাত লাভ করি এবং তার নিকট থেকে দো‘আ নেই।
বর্তমানে আমি বাড়ী ছাড়া। আমি ড্রাইভিং জানি। মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল করে হালাল রূযীর সন্ধান করছি। তাই সকল দ্বীনী ভাইয়ের নিকটে আমরা দো‘আ প্রার্থী। মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে ছহীহ দ্বীনের উপর দৃঢ় থাকার তাওফীক দান করেন এবং আমার পিতা-মাতাকে হোদায়াত দান করেন-আমীন!