রংপুরের বদরগঞ্জ উপযেলার ১৪নং বিষ্ণপুর ইউনিয়নের ছোট হাজীপুর গ্রামে আমার বাড়ী। আশির দশকে কর্মসংস্থানের কারণে চলে আসি রংপুর শহরে। তখন থেকে এ শহরেই আছি। বর্তমানে জাহায কোম্পানী মোড়ের সন্নিকটে গুপ্তপাড়া আবাসিক এলাকায় থাকি।

ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে পুরোপুরি আশ্রয় নিতে না পারলে শয়তান যে কিভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, যার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে আমার জীবনে। একটি মুসলিম পরিবারেই আমার জন্ম। যেখানে দ্বীনের বিধান প্রতিপালনে ছিল না কোন বাধ্যবাধকতা। মীলাদ, কুলখানি, চল্লিশা পালন, হেমন্তে নবান্ন উৎসব, আবার শীতকালে বাড়ির উঠানে পালা গানের আসর বসানো ইত্যাদি পালিত হ’ত সাড়ম্বরে। পিতা, চাচা গ্রামে নাটক মঞ্চায়নও করতেন। তখন ভাবতাম, এটাই বুঝি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। বলছি, ষাটের দশকের মধ্যভাগের কথা।

পিতামহ পবিত্র হজ্জ সম্পন্ন করে বাড়িতে ফিরলেন। বন্ধ হ’ল পিতা-চাচাদের নাটক, পালা গানের আসর বসানো। কিন্তু মীলাদ, বার্ষিকী পালন ইত্যাদি অব্যাহত থাকল। মায়ের পীড়াপীড়িতে ‘নুরানী নামায শিক্ষা’ বই কিনলাম। ‘নাওয়াইতুয়ান...’ নিয়ত মুখস্থ করতেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। আম্মাপারার চার কুল অর্থাৎ সূরা কাফিরূন, ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস মুখস্থ করলাম। কিন্তু নিয়ত মুখস্থ হয় না, ছালাতও শুরু করা হয় না।

অবশেষে নিয়ত মুখস্থ করে ছালাত শুরু করতে পারলাম। কিন্তু ফজরের ছালাতে উঠা অসম্ভব হয় গেল। ছাত্রজীবন, বিধায় রাত জেগে লেখাপড়া করি। অভিভাবক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চান না, তাই ডাকেন না। তবে মসজিদে যোহর, আছর, মাগরিব ও এশার ছালাতে মুওয়ায্যিন ছাহেবের অনুপস্থিতিতে ইমামতি করার সুযোগ পেয়েছি। ইতিমধ্যে ‘মোকছেদুল মোমিনিন’ বইটি হাতে এলো। এতে লেখা ‘বেহেস্তের কুঞ্জি’। ভাবলাম, যাক বেহেস্তের সন্ধান পেলাম! গ্রামের পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে আশির দশকের শুরুতে পাড়ি জমালাম শহরে। কলেজে মিললো অনেক বন্ধু-বান্ধব। পড়ে গেলাম মার্ক্সবাদীদের খপ্পরে। তারা বিভিন্ন প্রকারের বই হাতে ধরিয়ে দিল। এসব বই পড়ে দেখি কাস্তে-হাতুড়ি ছাড়া ভাগ্যের পরিবর্তন নেই। প্রকৃতিই সব, সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ নেই। ‘পার্টিই জীবন, বিপ্লবেই জীবন’ শ্লোগানে সমাজ পরিবর্তনের হাতছানি। ধর্ম-কর্ম করে লাভ নেই।

ধর্মীয় জ্ঞান তেমন ছিল না। চটকদার কথা আর যুক্তির বিশ্লেষণের মোহে আকৃষ্ট হ’তে সময় লাগলো না। সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম। হয়ে গেলাম কম্যুনিস্ট। কেটে গেল আরো দুই দশক। পার্টিতে ফুলটাইম কাজ করার অদম্য স্পৃহা। ঈসায়ী ২০০০ সনের মধ্যভাগে জানতে পারলাম, ফুলটাইম কাজ করার যোগ্যতা আমার নেই। সমর্থক হয়ে থাকতে হবে। অনুসন্ধানে জানা গেল ত্রুটির কথা। সেটা হ’ল, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে দলের লোকজন মন্দিরে মন্দিরে ঘোরে পূজা-অর্চনার সময়, তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু মসজিদে যেতে মানা। এই ভ্রান্ত নীতির প্রতিবাদ করাটাই ছিল অযোগ্যতার কারণ।

সমর্থক থাকার সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। আমার এক আত্মীয় হঠাৎ বাসায় এসে উপস্থিত। হাতে ডাঃ যাকির নায়েকের লেকচারের সিডি। আমাকে দিয়ে বললেন, পারলে লেকচারটা শুনো। ‘কুরআন এন্ড মডার্ন সায়েন্স’-এর লেকচার। কৌতুহলবশে লেকচার শুনলাম। বিবর্তনবাদ মতবাদ নিয়ে চার্লস ডারউইনের একটি তথ্য প্রচন্ডভাবে ধাক্কা দেয় মনে। তিনি তার বন্ধুকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ‘তিনি (ডারউইন) তার মতবাদ নিয়ে নিজেই কনফিউজড’। চমকে উঠলাম। তত্ত্বে বিশ্বাস নেই স্বয়ং সেই তত্ত্বের জনকেরই। তাহ’লে আমি ঐ তত্ত্বকে পুঁজি করে রাজনীতি করছি কেন? গুটিয়ে নিলাম নিজেকে।

২০১০-এর ডিসেম্বর। ঢাকায় তখন একটি বীমা কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত। কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের আওতায় ‘বীমা’র উপর একটি কোর্স করছি। শুক্রবার রাত। আকস্মিকভাবে একটি নিদর্শন দেখলাম স্বপ্নে। যা নিয়ে কোনদিন ভাবিনি। স্বপ্নকে স্বপ্ন ভেবেই গুরুত্ব দেইনি। এক সপ্তাহ পর আবার একই স্বপ্ন। এভাবে চার সপ্তাহে চারবার একই স্বপ্ন। তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম। স্কুল থেকে ছেলেকে আনতে গিয়ে পূর্ব পরিচিত এক মৌলভীর সাথে সাক্ষাৎ। তাকে স্বপ্নের বিষয়টি বলি। তিনি বললেন, আল্লাহ আপানাকে হয়ত হেদায়াত দিবেন। দ্বীনের পথে আসুন। বাসায় ফিরে স্ত্রীকে বললাম, আমার পায়জামা-পাঞ্জাবী বের কর। মসজিদে যাব। সহধর্মিনী আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল।

নতুন করে মসজিদের মুওয়ায্যিনের কাছে কুরআনুল কারীম পড়া শিখলাম। বাসার মালিক (যে বাসায় ভাড়া থাকি) তাবলীগ জামাতের সাথে জড়িত। প্রায় প্রায় চিল্লায় যান। আমাকে হঠাৎ মসজিদে যাওয়া দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি আনন্দিত হন। তাদের জামাতে আমাকে অংশগ্রহণের আহবান জানালেন। প্রতিদিন ফজর ছালাতের পর পরামর্শ হয়। ‘ফাযায়েলে আমল’ আর ‘মুন্তাখাব হাদিস’ থাকে প্রতিদিনের পাঠ্যতালিকায়।

অবশেষে চিল্লায় যাওয়ার জন্য বেডিং কিনলাম। নির্ধারিত দিন এলো, সাথীরা সবাই প্রস্ত্তত। কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না। এলাকায় গাশত-এর দায়িত্বে রয়ে গেলাম। সেদিন ছিল শুক্রবার। গাশতে বেরিয়েছি। রাহবারের ভূমিকায় আমি। পথে দেখা হ’ল এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে। তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। পরদিন আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন, আপনাকে তো চক্ষুষ্মান হিসাবেই জানি। অন্ধদের সাথে আপনি কেন? বিস্মিত হয়ে কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘ওরা (ইলিয়াসী তাবলীগ) তো গোমরাহ। ফাযায়েলে নিসাব ছাড়া ওরা আর কিছু মানে না। বুখারী কিংবা কুরআনের তাফসীর নিয়ে ওদের ‘মাশওয়ারা’ (পরামর্শ) বৈঠকে জান। তাহ’লেই পরিষ্কার বুঝতে পারবেন’।

পরবর্তী বৈঠকে তাই করলাম। প্রস্তাব দিলাম, এই ‘ফাযায়ালে আমল’ তো অনেক পড়া হ’ল, এখন বুখারী ও কুরআনের তাফসীর পড়লে অনেক ফায়েদা হবে। আমীর ছাহেব সাথে সাথে এই প্রস্তাবে রাগান্বিত হয়ে উঠলেন। তার ভাষ্য হ’ল, ‘এসব চটি বই পড়ে লাভ হবে না। আমাদের জন্য ‘ফাযায়েলে আমল’ই যথেষ্ট। অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ভাবলাম, এরা কুরআনের তাফসীর, বুখারীর মত বিশুদ্ধ হাদীছ গ্রন্থ পড়তে চায় না। এটা আবার কোন ইসলাম? তাই ওদের সঙ্গ ত্যাগ করলাম। সঠিক ইসলাম কোথায় পাব, তালাশ করতে লাগলাম।

এক শুক্রবার সকাল ১১-টায় আমার এক আত্মীয় (যিনি জন্মসূত্রে আহলেহাদীছ) ফোন করলেন। এনটিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখার তাকীদ দিলেন। দেখলাম, ‘আপনার জিজ্ঞাসা’ অনুষ্ঠানে সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ড. মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ। চট্টগ্রাম থেকে এক বোন জানতে চাইলেন ছালাতের পর মাসনূন দো‘আ সম্পর্কে। তিনি তাওহীদ প্রকাশনীর ‘হিছনুল মুসলিম’ বইটি সংগ্রহ করে পড়ার পরামর্শ দিলেন।

চলে গেলাম ঢাকার বংশালে তাওহীদ প্রকাশনী খুঁজে বের করলাম। ‘হিছনুল মুসলিম’ ও বুখারীর ১ম খন্ড কিনে ফিরলাম। যতই পড়ছি ততই বুঝতে পারছিলাম যে, আমার ইতিপূর্বের ছালাতসহ কোন আমলই ছহীহ সুন্নাহ সম্মত হয়নি। বুখারীতে পাওয়া হাদীছ অনুযায়ী রাফউল ইয়াদাইন ও সূরা ফাতিহা শেষে উচ্চস্বরে আমীন বলা শুরু করতেই বাধলো বিপত্তি।

ইলিয়াসী তাবলীগের আমীর ছাহেব বললেন, ‘ও চটি বই (বুখারী) পড়ে পাগল হয়ে গেছে। মসজিদের খতীব ছাহেব আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, আপনি বুখারীর কি বুঝেন? আপনি কি মাদ্রাসায় পড়েছেন? আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থেকে পড়াশুনায় জোর দিলাম। এভাবে কেটে গেল আরো এক বছর। ২০১১ সালের মে মাস। স্কুলে যেতে হ’ল ছেলেকে আনতে। তখন ছুটি হয়নি। দেখি এক ভদ্রলোক ডাঃ যাকির নায়েকের বিষয়ে কথা বলছেন। তাকে বললাম, ভাই আপনি কি ওনার ভক্ত? উনি বললেন, ডাঃ ছাহেব হক কথা বলেন, বিধায় তাকে ভালোবাসি। তাকে বললাম, রংপুরে কি হকপন্থীদের মসজিদ নেই? তিনি বললেন, সেন্ট্রাল রোডে সালাফিয়া মসজিদের কথা। ঐ দিনই মাগরিবের ছালাতে দু’জনেই গেলাম। পরিতৃপ্তি সহকারে ছালাত আদায় শেষে সকলের সঙ্গে পরিচিত হ’লাম। বয়স্ক মুওয়ায্যিন শ্রদ্ধেয় আমজাদ ভাই পরামর্শ দিলেন শুক্রবারে মসজিদে আসতে। তিনি আরো বললেন, শুক্রবার রেযাউল নামের একটি ছেলে বই বিক্রি করে। বই কিনে পড়ুন, তাহ’লে সঠিক ইসলাম খুঁজে পাবেন।

অপেক্ষার প্রহর কেটে গেল। জুম‘আর  ছালাত আদায় শেষে দেখি রেযাউল রাস্তার পাশে একটি কাঠের খাটের উপরে হরেক রকম বই বিছিয়ে রেখেছে। ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের ছালাতুল রাসূল (ছাঃ), ফিরক্বায়ে নাজিয়া, ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি সহ বেশ কয়েকটি বই কিনলাম। বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাছাবীহ সহ আরো কিছু বই সংগ্রহ করার সুযোগ মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দিলেন। এসব বই পড়ে নতুন করে মুসলিম হ’লাম, বাপ-দাদার আমল ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

২০১২ সালে ডিসেম্বর মাস। আবার মহান আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্নে একটি নিদর্শন দেখালেন। এবার শরণাপন্ন হ’লাম একজন সালাফী আলেমের। স্বপ্নের ব্যাখ্যায় তিনি বললেন, আপনি দ্বীনের কাজে নিয়োজিত হন। শুরু হ’ল দ্বীনের তাবলীগ। মাযহাবী মসজিদে আমাদেরকে বসতেই দেয় না। ইতিমধ্যে বই পড়ে অবগত হ’লাম জামা‘আতবদ্ধভাবে দ্বীনের প্রচার করার তাকীদ। আর জানার সুযোগ হ’ল একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। ‘যার স্কন্ধে আমীরের বায়‘আত নেই, তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু’। এই হাদীছ জানার পর আমীর খুঁজে পাই না। তটস্থ হয়ে পড়লাম।

অবশেষে দেখা মিলল, মাস্টার খায়রুল আযাদ ছাহেবের। তাঁর সাথে পরিচিত হ’লাম। তিনি আমি বললেন, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর আছেন। তিনি হ’লেন ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব’। ভাই খায়রুল আযাদ তখন ঐ সংগঠনের যেলা সভাপতি। তাকে বললাম, ‘আমি স্যারের অনেক বই পড়েছি। তাঁর বই পড়ে সঠিক ইসলাম খুঁজে পেয়েছি। আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চলেন। তিনি সানন্দে রাযী হ’লেন।

২০১৪ সালের পবিত্র ঈদুল আযাহার পরদিন ভাই খায়রুল আযাদ ছাহেবের নেতৃত্বে আমরা ১২ জন মাইক্রোবাস ভাড়া করে পৌঁছলাম রাজশাহীর নওদাপাড়ায়। বাদ আছর মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের অফিস কক্ষে সাক্ষাৎ মিললো। তিনি আক্বীদা সম্পর্কে বুঝালেন। আমরা ১২ জন উপস্থিত থাকলেও তিনি কেন যেন আমার দিকেই বেশী তাকাচ্ছিলেন।

অতঃপর জানতে চাইলেন আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য কি? অন্যরা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, স্যার আমরা বায়‘আত নেয়ার জন্য এসেছি। সেই সাথে বায়‘আত সংক্রান্ত হাদীছটির প্রসঙ্গ তুলে ধরলাম। তিনি আমার পেশা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। বললাম, স্যার, আমি একটি বীমা কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। তিনি বললেন, আপনি কি জান্নাতে যেতে চান? বললাম, জি স্যার। তিনি বললেন, এই চাকুরী ছেড়ে দেন। বললাম, কেন স্যার? তিনি একটি হাদীছ শুনিয়ে বুঝিয়ে বললেন, এই পেশায় উপার্জিত অর্থ হারাম। হারাম খাদ্যে পরিপুষ্ট দেহ জান্নাতে যাবে না। আমি বললাম, ‘চাকুরী ছেড়ে দিলে পরিবার-পরিজন নিয়ে কি খাবো স্যার! তিনি বললেন, রিযিকদাতা আল্লাহ।

কথোপকথনে ৫৫ মিনিট পেরিয়ে গেল। একটু পরেই মাগরিবের ছালাতের আযান হবে। স্যার বায়‘আত নিচ্ছেন না। বুঝতে কষ্ট হ’ল না যে, হারাম পেশায় নিয়োজিত থাকলে আমীরে জামা‘আত বায়‘আত নিবেন না। মনস্থির করে স্যারকে জানালাম, চাকুরী ছেড়ে দেয়ার কথা। অতঃপর কাঙ্ক্ষিত বায়‘আত সম্পন্ন হ’ল। ফালিল্লাহিল হামদ

পরদিন ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে অফিস ভবনের ১৩ তলায় নিজস্ব চেম্বারে বসে চাকুরীতে ইস্তেফাপত্র লিখলাম। স্বাক্ষর করে একটি ইনভেলাপে ভরে উঠার প্রস্ত্ততি। এমন সময় পিয়ন এসে জানাল এম ডি স্যার সালাম দিয়েছেন। ১০ তলায় ওনার চেম্বার। সেখানে যেতেই স্যার জানালেন, পদোন্নতির কথা। হাতে চিঠি ধরিয়ে দিলেন। খুলে দেখি এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে পদোন্নতি পেয়েছি। বেতন-ভাতা সর্বসাকুল্যে ১ লাখ ৮০ হাযার টাকা (প্রায়)। চিঠিটি খামে ভরে এমডি স্যারের টেবিলে রাখলাম। এবার দিলাম আমার ইস্তেফাপত্র। বিস্মিত হয়ে স্যার বললেন, আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এত সুন্দর একটি চাকরী ছেড়ে দিবেন? বিনয়ের সাথে বললাম, স্যার আপনিতো মুসলমান। আপনি কি জান্নাতে যেতে চান? তাহ’লে আপনিও এই চাকুরী ছাড়ুন। আমীরে জামা‘আত ড. গালিব স্যার বলেছেন, হারাম উপার্জন দিয়ে জান্নাতে যাওয়া যাবে না।

অতঃপর বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের জানালাম। চাকুরী ছেড়ে দেয়ার কথা শুনে সবাই হতভম্ব। একটি পত্রিকা অফিসে চাকুরী পেলাম। মাসিক বেতন ছয় হাযার টাকা। প্রতি মাসে সংসার খরচ লাগত ১৮ হাযার টাকা। পত্রিকা সম্পাদকের অনৈতিক প্রস্তাব মেনে নেয়া সম্ভব হ’ল না। চাকুরী ছেড়ে দিয়ে নিজে কিছু করার চেষ্টা করলাম। এক দ্বীনি ভাই পাশে দাঁড়ালেন। তার পরামর্শে ইউনানী প্যারামেডিকেল কলেজে ভর্তি হ’লাম। তিনি খরচ যোগালেন। এমতাবস্থায় শহরের জনৈক বিত্তশালী তার বাসায় ডেকে নিলেন। দু’লাখ টাকার একটা চেক লিখে দিয়ে বললেন, ওষুধের ব্যবসা শুরু করতে। তাকে আশ্বাস  দিলাম, ইনশাআল্লাহ দু’বছরের মধ্যে সমুদয় টাকা ফেরত দেব। ছয় মাসের মধ্যে পঞ্চাশ হাযার টাকা ফেরত দিলাম।

২০১৫ সালের রামাযান মাস। খাসবাগ আহলেহাদীছ জামে মসজিদে ইফতারের দাওয়াত। সেখানে গিয়ে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হ’ল ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ছাহেবের সঙ্গে। সেই সাথে তৎকালীন ‘যুবসংঘে’র দায়িত্বশীল আদনান, শিহাবুদ্দীন, আব্দুল্লাহ আল-মাহমূদ, বর্তমান সভাপতি আব্দুন নূর সরকার সহ অনেকের সাথে পরিচিত হ’লাম। ঐদিন সংগঠনের যেলা কমিটি গঠন করা হয়। ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল আমাকে দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে ছহীহ তরীকায় দ্বীনের কাজ করার আহবান জানালেন।

২০১৬ সালের মার্চ মাস। যোহরের ছালাত শেষে সালাফিয়া মসজিদে বসে আছি। আমাকে যিনি দু’লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনিসহ আরও দু’জন আলেম আমাকে প্রস্তাব দিলেন তাদের সংগঠনে মুবাল্লিগ পদে যোগদান করতে। কিন্তু জমঈতে আহলেহাদীসের অনেক নেতা-কর্মী বিজাতীয় সংগঠনের সাথে জড়িত, তাদের অনেকে হারাম-হালাল বেছে চলে না, নানা বিদ‘আতের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার কারণে তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। পরদিন ঐ বিত্তশালী ব্যক্তির ম্যানেজার আমাকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে গেলেন ওনার বাসায়। ড্রইং রুমে ঢুকতেই আমাকে দেখে তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তৎক্ষণাৎ সব টাকা ফেরত দিতে চাপ সৃষ্টি করলেন। সেই সাথে গালি-গালাজও শুনতে হ’ল। সাতদিনের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে হবে, এই শর্তে বাসায় ফিরে এলাম। সব কথা শুনে আমার স্ত্রী তার মোহরানার ১ লাখ টাকা এবং এক দ্বীনি ভাই ৫০ হাযার টাকা আমার হাতে তুলে দিলেন। পরদিনই ঐ বিত্তশালী লোকের টাকা ফেরত দিতে পেরে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। পরবর্তীতে জানতে পেরেছি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এ সম্পৃক্ত হওয়াটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। মহান আল্লাহ তা‘আলা তাকে মাফ করে দিন-আমীন!

রংপুর শহরের সিটি বাযারের এক মুদি দোকানদার, যিনি আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। তার দোকানেই নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্যাদি কেনাকাটা করি। ঐ দোকানদার আমার পরিচিতজনদের সাবধান করতে লাগলেন আমার সম্পর্কে। তার বক্তব্য হ’ল, মুছতফা আহলেহাদীছ হয়ে গেছে। কাজেই সে ইসলাম থেকে খারিজ, ওর থেকে সতর্ক থাকবেন। পরবর্তীতে ঐ দোকানদার সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি জনৈক পীরের মুরীদ। ভারতের দেওবন্দে লেখাপড়া করা জনৈক মুফতী একদিন আমার সেন্ট্রাল রোডস্থ মসজিদ মার্কেটের ঔষধের দোকানে এলেন। পাশেই আহলেহাদীছ মসজিদ দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এদের থেকে সাবধান থাকবেন। কারণ ওরা মুসলমান নয়!

শুধু তাই নয়, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এ শামিল হওয়ায় শহরের বেশ কিছু আহলেহাদীছ দাবীদার ব্যক্তি আমাকে বাঁকা নযরে দেখেন। অবাক হয়ে ভাবি, হকপন্থীদের যারা পসন্দ করে না- এরা আহলেহাদীছ হয় কি করে?

প্রিয় পাঠক! শিরক ও বিদ‘আত পন্থী, বিভিন্ন ফের্কার জালে আবদ্ধ মানুষ, যারা সঠিক আক্বীদা কি, তা-ই বুঝে না, এরা যখন আহলেহাদীছদের নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করে, গালি-গালাজ করে তাদের ত্রুটি ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করা না করা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ছহীহ আক্বীদার ধ্বজাধারীরা যখন হক পন্থীদের ভৎর্সনা করে, তখন কী বলবেন? অতএব সাবধান! অহী-র বিধান কায়েম করার আন্দোলনের ঝান্ডা অাঁকড়ে ধরা ছাড়া ঈমান রক্ষার আর কোন বিকল্প পথ নেই। এই পথেই রয়েছে আল্লাহর সাহায্য ও নিশ্চিত বিজয়। নাছরুম মিনাল্লা-হে ওয়া ফাৎহুন ক্বারীব। আল্লাহ আমাদের সকলকে হকের উপরে টিকে থাকার তাওফীক দান করুন-আমীন!

মুছতফা, গুপ্তপাড়া, রংপুর।






অবশেষে হক-এর সন্ধান পেলাম - কামাল আহমাদ, লাকসাম, কুমিল্লা
তুমি বেলাইনে চলে গেছ - মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
ছহীহভাবে ছালাত আদায় করায় নিজের পিতাও বিদ্রূপ করা শুরু করলেন - আত-তাহরীক ডেস্ক
আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে বাড়ীছাড়া! - -মুহাম্মাদ ইবরাহীম, দাগনভূঞা, ফেনী।
হক-এর পথে যত বাধা
হক-এর পথে টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ - .
ও চটি বই পড়ে পাগল হয়ে গেছে...
‘সকলের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে বল, এখন থেকে ইমাম আবু হানীফার আদর্শ অনুযায়ী জীবন-যাপন করব’ (!)
থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব - -আব্দুল্লাহ, গাযীপুর।
‘তোমাকে সঊদী আরবের ভূতে ধরেছে’ - নূরুল ইসলাম, নাটোর
হক-এর পথে যত বাধা - হাসান আলী ঈশ্বরদী,পাবনা
জঘন্য ষড়যন্ত্র এক মুসলিমের বিরুদ্ধে - * মুহাম্মাদ সোহেল রানাবাঘা, রাজশাহী।
আরও
আরও
.