আমার বাড়ী রাজশাহী যেলার বাঘা থানার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের বলরামপর গ্রামে। ছোট্ট দরিদ্র পরিবারে আমার জন্ম। বগুড়া সরকারী আযীযুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে মার্কেটিং-এ অনার্স পড়ার সময় মেসে ছিলাম দু’বছর। ২০১০ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী সাহারা খাতুনের দেওয়া চিরুনী অভিযানে রাত ৩-টার সময় মেস ঘেরাও করে পুলিশ আমাদের ৭ জনকে ধরে নিয়ে গেল। ২৫ দিন পর জামিনে ছাড়া পেলাম। একদিন মেসে ছালাত আদায় করার সময় আহলেহাদীছ আন্দোলনের এক ভাই পায়ের সাথে পা লাগিয়ে ছালাতে দাঁড়ালো। যতই পা সরিয়ে নেই, ততই সে পা ভিড়িয়ে দেয়। রাগ সহ্য হ’ল না। মেসের সবাইকে ডেকে আহলেহাদীছের ঐ ভাইয়ের নামে অভিযোগ করলাম। এক বড় ভাই বলল, সোহেল আহলেহাদীছরা পায়ের সাথে পা লাগিয়েই ছালাত আদায় করে। এরপর তিনি বললেন, আহলেহাদীছের কোন ভাই সোহেলের পায়ের সাথে পা লাগিয়ে দাঁড়াবে না।

মনে বার বার একটি প্রশ্ন জাগল, আহলেহাদীছ ও হানাফীদের মধ্যে পার্থক্য কি? একই কুরআন, একই রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসারী হয়েও কেন এই পার্থক্য? সিদ্ধান্ত নিলাম হাদীছ পড়ার। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ ও ইবনু মাজাহ গ্রন্থের ছালাত অধ্যায়গুলো খুব ভালভাবে পড়লাম। ফলাফল যা পেলাম, তাহ’ল আমার ছালাতের সাথে হাদীছের ৯৫% মিল নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম হাদীছে যেভাবে ছালাতের পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই ছালাত আদায় করব। এতে যে যাই বলুক, এক ঘরে করে দিলে দিক। হানাফীদের গোজামিল দেওয়া পদ্ধতিতে আমি আর ছালাত পড়ব না।

২০১১ সালে এক ভাই বলল, সোহেল গণতন্ত্র হারাম। পবিত্র কুরআন গণতন্ত্রকে হারাম করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি যদি অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করে চল তাহ’লে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হ’তে বিচ্যুত করবে। তারা তো ধারণা ছাড়া অন্য কিছুর অনুসরণ করে না এবং অনুমানভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)। কুরআন বলছে, অধিকাংশ লোকের মতের ভোটের অনুসরণ করা যাবে না। করলে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। আর আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার অর্থ হ’ল জাহান্নাম। আমি বললাম, ভাই আগে গণতন্ত্র সম্পর্কে পড়া-শুনা করি, তারপর আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে জানাব।

অতঃপর এ বিষয়ে পড়াশুনা করে জানলাম, Democracy বা গণতন্ত্রের জনক হচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গের এক জনসভায় প্রথম তিনি গণতন্ত্রের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘Democracy is the government of the people by the people and for the people. চিন্তা করলাম, পৃথিবীর বুকে গণতন্ত্র এসেছে মাত্র ১৫২ বছর আগে। আর পবিত্র কুরআন এসেছে প্রায় দেড় হাযার বছর আগে। কাজেই এই গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।

গণতন্ত্রের মূলনীতি হ’ল ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ বা মালিক। অপরদিকে ইসলামের মূলনীতি হ’ল ‘আল্লাহই সকল ক্ষমতার মালিক’। কুরআন বলছে, ‘অধিকাংশ লোক ঈমান আনবে না’ (বাক্বারাহ ২/১০০), ‘লোকদের বেশিরভাগই শুকরগুযার হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৪৩)। ‘সামান্য কিছু লোক ব্যতীত ঈমানদার হবে না, লোকদের বেশিরভাগই শুকরগুযার হবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫)

এই ধরনের গণতন্ত্র বিরোধী অনেক আয়াত গণতন্ত্রপন্থী ইসলামী সংগঠনের ভাইদের দেখালাম। বললাম, আল্লাহ গণতন্ত্রকে হারাম করেছেন। সুতরাং গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাজনীতি করা যাবে না। কেননা হারাম কাজে আল্লাহ সাহায্য করবেন না।

তারা বলল, আবুবকর ও ওমর (রাঃ) সহ চার খলীফা গণতন্ত্রের মাধ্যমেই খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। একথা শুনে খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবনী পড়লাম। জানলাম, তাঁরা গণতন্ত্রের মাধ্যমে খলীফা নির্বাচিত হননি। বিশিষ্ট কয়েকজন জ্ঞানী ছাহাবীদের মতামতের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে আমি তাদেরকে অনেক প্রমাণ সহ বুঝালাম। কিন্তু তারা আমাকে বাতিলপন্থী আখ্যায়িত করল। ফলে আমি তাদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। একদিন সূরা রূমের ৫৮নং আয়াত পড়লাম। আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই এ কুরআনে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছি। তুমি তাদের নিকট কুরআনের আয়াত উপস্থাপন করলেও ফাসিকরা বলবে, তোমরা বাতিলপন্থী ছাড়া আর কিছুই নও’।

অতঃপর ২০১১ সালের ২০শে আগষ্ট কুচক্রীরা আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করল। আমি না-কি কুরআন পুড়িয়ে ফেলেছি, এই মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করল। গ্রামে বিচার বসল। মেম্বার, চেয়ারম্যান বলল, সোহেল যে কুরআন পুড়িয়ে ফেলেছে তার প্রমাণ কি? কে দেখেছে? কুচক্রীরা বলল, আমরা দেখিনি, তবে শুনেছি যে, ওর ছোট বোন রামাযান মাষ্টারের বাড়ীতে কুরআন পড়ে আসছিল, তখন সোহেল তার বোনের হাত থেকে কুরআন কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে।

বিচারে রামাযান মাষ্টার দাঁড়িয়ে বলল, আমার বাড়িতে মেয়েদের কুরআন শিখানো হয়। ভর্তি ফীস নেওয়া হয় এবং কুরআন শিক্ষার প্রাথমিক একটা তা‘লীম দেওয়া হয়। কিন্তু সোহেলের বোন আমার বাড়ীতে ভর্তিও হয়নি, কুরআন পড়তেও আসে না। যা হোক বিচারে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হ’ল। বিচারকরা কুচক্রীদের বলল, সোহেলের কাছে ক্ষমা চাও এবং কোলাকুলি কর।

আমি সঠিক আক্বীদা ও সঠিক ছালাতের দাওয়াত দিতে লাগলাম। আমার দাওয়াতে দুই জন যুবক সঠিক পথে ফিরে আসল। বিদ‘আতীরা সহ্য করতে পারল না। সবাইকে শাসিয়ে দিল যে, কেউ যেন সোহেলের সাথে কথা না বলে, না মিশে। ওর সাথে যে-ই মিশবে সে-ই আহলেহাদীছ, লা-মাযহাবী, ওয়াহাবী হয়ে যাবে। এখন অনেকে লুকিয়ে আমার সাথে দেখা করে এবং বিভিন্ন বিষয় জানতে চায়। অনেকে এখন বুকে হাত বাঁধে, রাফঊল ইয়াদায়েন করে, ফরয ছালাত শেষে হাত তুলে মোনাজাত করে না।

সূরা আন‘আমের ১৫৯ আয়াত পড়লাম। আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের দ্বীনকে খন্ড খন্ড করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই’। ফলে মাযহাবীদের সাথে আমি ছালাত আদায় বন্ধ করে দিলাম। ওদের ছালাত শেষ হ’লে মসজিদে একা একা ছালাত আদায় করতাম।

২০১৪ সালে এক মাযহাবী ভাই প্রশ্ন করল, আমাদের সাথে ছালাত আদায় করেন না কেন? আমি বললাম, তোমাদের ছালাতের সাথে আমার ছালাতের মিল নেই, তোমাদের আল্লাহর সাথে আমার আল্লাহর মিল নেই। তোমাদের আল্লাহ নিরাকার, আর আমার আল্লাহর আকার আছে। বলতেই এরা গালি-গালাজ করে আমাকে মারতে তেড়ে আসল।

২০১৫  সালের  ৩রা  সেপ্টেম্বর  মাগরিবের  ছালাত  শেষে মুছল্লীরা  প্রায় চলে গেলে আহলেহাদীছের অনুসারী এক ভাই বলল, বিদ‘আত  সম্পর্কে দু’একটি  হাদীছ  শোনাও।  আমি  ইবনু মাজাহর (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১ম খন্ড) ৪৯নং হাদীছটি আলোচনা করছিলাম। এমন সময় বিদ‘আতীদের একজন এসে বলল, তুমি তো আমাদের মত করে ছালাত আদায় কর না। কারণ আমাদের ছালাত হয় না। তাহ’লে আমাদের সাথে ছালাত আদায় কর কেন? এই বলে আমাদের সাথে খুব উচ্চবাচ্য করল।

এর ২দিন পর ৫ সেপ্টেম্বর’১৫ ৫/৬ জন যুবক গ্রামের দোকানের সামনে আমাকে ঘিরে ধরে বলল, আমাদের সম্পর্কে কি বলেছিস? আমি বললাম, ইবনু মাজাহ গ্রন্থের ৪৯নং হাদীছটি আলোচনা করেছি মাত্র। তখন এরা গালি দিয়ে বলল, শালা তুমি হাদীছ বিশারদ হয়ে গেছ, ফৎওয়া দেওয়া শিখেছ? এই বলে আমার উপর আক্রমণ করে বসল। এক পর্যায়ে এরা আমাকে ধাক্কা মেরে রাস্তার পাশের ইটের স্তূপের উপর ফেলে দিল। এতে আমার হাতের কনুই কেটে হাত রক্তাক্ত হয়ে গেল।  আর আমাকে বলা হ’ল যে, কারো কাছে আমি আহলেহাদীছের দাওয়াত দিতে পারব না, ওদের মসজিদে ছালাত আদায় করলে ওদের মত করে পড়তে হবে। হাদীছ-কুরআনের কথা কাউকে বলা যাবে না। এই গ্রামে থাকতে হ’লে হানাফী হয়েই থাকতে হবে। আমার বাড়ীর লোকদেরও একই কথা যে, আহলেহাদীছ না ছাড়তে পারলে বাড়ী ছাড়তে হবে। তোমার জন্য আমরা মানুষের সাথে ঝামেলা করতে চাই না।

এখন দেখছি হিজরত করা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। সত্যিই আমি অসহায়। ঢাকার শহীদ তিতুমির কলেজের মার্কেটিং বিভাগে মাষ্টার্স এ ভর্তি হয়েছি। হকের উপরে দৃঢ় থাকতে আমি সকলের নিকট খালেছ দো‘আ প্রার্থী। আল্লাহ আমাদের কবূল করুন-আমীন!







আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে বাড়ীছাড়া! - -মুহাম্মাদ ইবরাহীম, দাগনভূঞা, ফেনী।
‘সকলের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে বল, এখন থেকে ইমাম আবু হানীফার আদর্শ অনুযায়ী জীবন-যাপন করব’ (!)
আক্বীদার কারণে শত্রুতে পরিণত হওয়া আপন ভাইও শেষ পর্যন্ত হকের দিশা পেলেন - আত-তাহরীক ডেস্ক
মাযহাব না মানার কারণে আশ্রয় হারাতে হ’ল - -খালিদ সাইফুল্লাহ, গাযীপুর।
আহলেহাদীছ আক্বীদায় বিশ্বাসী, এটাই কি আমার অপরাধ!
থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব - -আব্দুল্লাহ, গাযীপুর।
তোমাকে দাওয়াতী কাজের জন্য ঘর ভাড়া দেইনি - ডা. মুহাম্মাদ ফযলুল হক, সফিপুর, গাযীপুর।
যেভাবে হকের দিশা পেলাম! - আত-তাহরীক ডেস্ক
হক-এর পথে যত বাধা - হাসান আলী ঈশ্বরদী,পাবনা
কোন মুফতী লাগবে না... তুই কাফের হয়ে গেছিস - ডা. মুহাম্মাদ মাহবূবুর রহমান
যেভাবে আহলেহাদীছ আক্বীদা গ্রহণ করলাম - আত-তাহরীক ডেস্ক
ও চটি বই পড়ে পাগল হয়ে গেছে...
আরও
আরও
.