মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৫ম কিস্তি)

আল-ক্বাছীম প্রদেশের মূল প্রশাসনিক কেন্দ্র বুরাইদা থেকে ৭০ কি. মি. দূরত্বে অবস্থিত ছোট্ট একটি শহর রিয়াযুল খাবরা। শান্ত, নিস্তরঙ্গ। শহরের সবচেয়ে জনবহুল স্থানেও তেমন লোকজনের উপস্থিতি নেই। চমৎকার পার্কগুলো প্রায় জনশূন্য। তবে ফসলাদি, ক্ষেত-খামার, সবুজের ছড়াছড়ি বেশ চোখে পড়ে। খাবরা অর্থ পানি জমার স্থান। বিখ্যাত ওয়াদী রুম্মাহ, যেটি মদীনা থেকে শুরু হয়ে সুদীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচশত কি. মি. প্রলম্বিত হয়ে আল-ক্বাছীমের বুরাইদাহ এসে শেষ হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এই উপত্যকার পানি এই শহরে জমা হ’ত বলে এর নাম হয় খাবরা। ওয়াদী রুম্মাহ মূলতঃ নদী উপত্যকা, যেটি কেবল বর্ষা মৌসুমে জেগে ওঠে। বাকী সময়টা বালির স্তূপে ভরা মরুভূমি।

যোহরের ছালাত পড়ে আমরা শায়খ আখতার মাদানীর উষ্ণ আতিথেয়তায় দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। বাসা যেমন বড়, তেমনি আয়োজনের বিশালতা ভড়কে যাওয়ার মত। দেশীয় খাবারের সাথে সামুদ্রিক মাছ, উট, খাসির গোশত আর ফলমুলের ভরপুর আয়োজন। আব্দুল্লাহ ভাই, শাহাদত ভাই, আল-আমীন মুন্সীসহ আল-ক্বাছীমের ভাইদের গভীর ভালোবাসা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে দিল। আল্লাহ তাঁদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন-আমীন! বিকালে শায়খ আখতার মাদানী আমাদের খাবরার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে নিয়ে গেলেন। বিশেষ করে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আরব ঘর-বাড়িগুলো আমাদেরকে আরবমরুর সুদূর অতীতের অনাড়ম্বর, কষ্টসাধ্য অথচ প্রশান্তিময় যিন্দেগানীর কিঞ্চিৎ বাস্তবতা অনুধাবন করালো।

সন্ধ্যায় গগনপ্রান্তে চাঁদের আভাসের মধ্য দিয়ে শুরু হ’ল পবিত্র রামাযান মাস। তারাবী শুরু হবে আজ রাত থেকেই। আমরা শায়খ আখতার মাদানী যে মসজিদে ছালাত আদায় করান সেখানে আসলাম। রামাযান মাস যে শুরু হয়েছে, তার বিশেষ কোন অনুভব-আয়োজন-উদ্দীপনা বোঝা গেল না। মসজিদ ভরা নতুন মুছল্লীদের ভিড়ও তেমন পরিলক্ষিত হয় না। আমাদের দেশে চাঁদ ওঠা মাত্রই যেমন উৎসবমুখর পরিবেশ ফুটে ওঠে, তার কিছুই এখানে নেই। সবই যেন আগের মত স্বাভাবিক। মাদানী ছাহেবের শ্রুতিমধুর তেলাওয়াতে আট রাক‘আত তারাবী ও তিন রাক‘আত বিতর পড়ে শেষ করলাম। বের হওয়ার সময় এক অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার সাথে দেখা হ’ল, যিনি শায়খকে খুব সমাদর করেন। আমাদের আগমনের কথা শুনে মসজিদের পার্শ্বে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গাহওয়া-খেঁজুর নাশতা করালেন। ঝকঝকে বিশাল বাড়ি। থাকার কেউ নেই। ৪/৫ জন বাংলাদেশী ও ইন্ডিয়ান কর্মী রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছেন। তিনি তাদের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখেন। মাঝে-মধ্যে ওমরায় পাঠান। হিন্দু কর্মচারীদের মুসলমান বানানোর চেষ্টা করেন। আমাদের সামনে তাদেরকে ডেকে শায়খকে বললেন তাদের নছীহত করার জন্য। বর্তমানে কিছু ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন, তবে অনেকটা সময় কাটানোর জন্যই।

রাত দশটার দিকে ঢাকা, দোহারের সালমান ভাইয়ের ওয়ার্কশপ কাম সাংগঠনিক অফিসে দায়িত্বশীল ও সুধী বৈঠকে আমরা যোগদান করলাম। খাবরা, বুরাইদাহ, উনায়যাহ থেকে দায়িত্বশীল ও সুধীবৃন্দ এসে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠান ও প্রশিক্ষণমূলক বৈঠক হ’ল সাহারীর পূর্ব পর্যন্ত। দ্বীনী ভাইয়েরা তাদের সঠিক দ্বীন পাওয়ার আবেগময় অনুভূতি সবার সাথে শেয়ার করলেন। আলহামদুলিল্লাহ চমৎকার একটি সময় কাটলো তাদের সাথে। সাহারীর পর সেখানেই ফজরের ছালাত পড়লাম। তারপর দ্বীনী ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শায়খ আখতার মাদানীর বাসায় আসলাম।

***

পরদিন ২৩শে মার্চ’২৩ বুরাইদায় প্রোগ্রাম। সঊদী আরবের অধিকাংশ শহরের মতই নিরুত্তাপ শহর বুরাইদাহ। বিশেষ কোন জাঁকজমক নেই। মানুষের আনাগোনাও চোখে পড়ার মত নয়। আল-ক্বাছীম ‘আন্দোলন’ সভাপতি প্রিয় আবু যয়নাব ছাদ্দাম ভাই শহরতলীতে একটি ইস্তিরাহা ভাড়া করেছেন। বাদ আছর থেকে শুরু করে ইফতার পর্যন্ত সেখানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হ’ল। বুরাইদাহ শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দ্বীনী ভাইয়েরা বিশেষ করে কবীর ভাই, রাসেল হায়দার ভাই, রাজীব ভাই, ইসমাঈল ভাই, রাফসান হাসান প্রমুখদের আন্তরিক ভালোবাসার পরশ মেখে আমরা অনুষ্ঠান শেষে বিদায় গ্রহণ করলাম। ইফতার করলাম এক মিসরীয় বাফেট হোটেলে। সেখানেই রাতের খাবার সেরে বুরায়দা কেন্দ্রীয় মসজিদে এশা ছালাত এবং তারাবীর ছালাত আদায় করি। সেখানে বহু আলেম-ওলামাকে ছালাত আদায় করতে দেখলাম। মাশাআল্লাহ ইমাম ছাহেবের সুমধুর তেলাওয়াতও খুবই হৃদয়কাড়া। আট রাক‘আত তারাবীহ এবং তিন রাক‘আত বিতরের মাধ্যমেই ছালাত সমাপ্ত হ’ল। কেবল হারামাইন ব্যতীত সঊদী আরবে এর অতিরিক্ত তারাবীহ ছালাত আর কোথাও হয় না।

তারাবীর পর পুনরায় ইস্তিরাহাতে ফিরে এসে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এরমধ্যে এত রাতেই ছাদ্দাম ভাই এবং ইসমাঈল ভাই সম্পাদক ছাহেব এবং যুবসংঘ সভাপতিকে নিয়ে তাদের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গ্রীণ হাউজ কৃষি খামার দেখিয়ে আনলেন। প্রায় ১ কি.মি. দীর্ঘ সেই খামার থেকে ফিরে এসে তাদের গল্প শুনে খুব আফসোস হ’ল কেন গেলাম না সেখানে।

ছাদ্দাম ভাইয়ের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। নরসিংদী থেকে এসে তিনি এখন আল-কাছীমে বাংলাদেশীদের মধ্যে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। শুরুটা অনেক কঠিন ছিল। তবে সঠিক ব্যবসায়িক চিন্তাধারা এবং আল্লাহর অশেষ রহমত তাকে এই অল্প বয়সেই এখন সফল ব্যবসায়ী বানিয়েছে। তাঁর অধীনে বিভিন্ন শহরে প্রায় পাঁচশতাধিক কর্মী রয়েছে। এদেরকে তিনি বিভিন্ন কোম্পানীতে চুক্তিভিত্তিক সরবরাহ করেন। বর্তমানে পরিবার নিয়েই সঊদীতে আছেন। যেমন উপার্জন করেন, তেমনি দু’হাত খুলে ব্যয় করেন। বিশেষ করে দ্বীনী কাজে ব্যয় করার জন্য যেন উন্মুখ হয়ে থাকেন। আল-ক্বাছীম সফরের এই তিনদিনে শত আপত্তি সত্ত্বেও আমাদের আতিথেয়তায় তিনি যে বিপুল খরচ করলেন, তা অবিশ্বাস্য। তাঁর এই ভালোবাসার ঋণ নিঃসন্দেহে অপূরণীয়। দ্বীনের পথে এসেছেন বেশী দিন হয়নি। শায়খ আখতার মাদানীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তিনি নিজেকেই কেবল পরিবর্তন করেননি, বরং সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। বর্তমানে আল-ক্বাছীম আন্দোলনের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিজের কর্মীদেরকেও তিনি সাধ্যমত ছহীহ আক্বীদার সন্ধান দিচ্ছেন। গেলবার ২০২২ সালে মদীনায় এক হোস্টেলে আমরা প্রোগ্রামে গেলে তিনি তাঁর কর্মীদের উদ্দেশ্যে যে হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য রাখছিলেন, তা দেখে আমরা অভিভূত হয়েছিলাম। অনুভব করেছিলাম মানুষের হেদায়াতের জন্য তাঁর প্রাণভরা আকুতি। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁকে দ্বীনের জন্য কবুল করে নিন এবং দ্বীনের খেদমতে আরো বেশী অগ্রগামী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!

রাত ২টার দিকে আমরা স্থানীয় এক হোটেলে গেলাম। ছাদ্দাম ভাই বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছের এক বিশাল আয়োজন করেছেন সেখানে। রুটির সাথে মাছের সুস্বাদু ফ্রাই। আমরা প্রায় ১২জন মিলেও এত খাবার শেষ করতে পারলাম না। পরে হোটেলের বাঙালী কর্মচারীরাও শরীক হ’লেন। অতঃপর আল-খাবরায় শায়খ আখতার মাদানীর বাসায় ফিরে ফজরের ছালাত পড়ে বিশ্রাম নেই।

***

পরদিন ২৪শে মার্চ’২৩ দুপুরের দিকে আল-ক্বাছীমের প্রসিদ্ধ আলেম-ওলামার শহর উনায়যার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম আল-আমীন মুন্সীর গাড়িতে। সেখানে কুমিল্লার দেলাওয়ার ভাইয়ের ওয়ার্কশপে যোহরের পরপর আমরা পৌঁছে গেলাম। উনায়যাহ সেই শহর যেই শহরে প্রায় সারাটা জীবন ইলমের সন্ধানে এবং ইলমের বিতরণে কাটিয়েছেন বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ বিদ্বান শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (১৯২৯-২০০১খ্রি.)। ২০০১ সালের জানুয়ারী মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন আমি দাখিল পরীক্ষার্থী। মাত্র বছর দেড়েক পূর্বেই গত হয়েছেন সমকালীন বিশ্বের আরো দু’জন প্রাজ্ঞ বিদ্বান শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহ.) এবং শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহ.)। প্রায় একই সময়ে শায়খ উছায়মীনের মৃত্যু আহলেহাদীছ সমাজে দারুণভাবে নাড়া দেয়। ইতিমধ্যে দাখিল পরীক্ষা শেষ হ’লে ফল প্রকাশের পূর্ব অবসরে আববার উৎসাহে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে মাসিক আত-তাহরীকের জন্য নাতিদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখলাম। জুন, জুলাই ও আগষ্ট ৩টি সংখ্যায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হ’ল। এর মাধ্যমেই আত-তাহরীকে আমার প্রথম লেখালেখির হাতেখড়ি হয়।

আজ তাঁর স্মৃতিবিজড়িত শহরে এসে ভীষণ পুলকিত বোধ করলাম। আছরের পর ৩/৪টা গাড়ি নিয়ে উনায়যাহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে জামে মুহাম্মাদ ইবনুল উছায়মীন মসজিদে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাঁধ সাধলো হঠাৎ জ্বর আসায়। মনে হ’ল কোনভাবেই শয্যা থেকে উঠতে পারব না। কিন্তু এই শহরে এসে শায়খ উছায়মীনের স্মৃতিবিজড়িত মসজিদ, দরসগাহে যাব না? সম্পাদক ছাহেব, যুবসংঘ সভাপতি আমি যেতে পারছি না বুঝতে পেরে বাইরে এসে ইতিমধ্যে দ্বীনী ভাইদের সাথে গাড়িতে চড়ে বসেছেন। গাড়ি ছেড়েও দিচ্ছে। এসময় আমি ঘর থেকে বের হয়ে কোনমতে ওয়ার্কশপের মুখে আসতেই আমাকে দেখে টাঙ্গাইলের ওমর ফারূক ভাই রাস্তায় গাড়ি থামালেন। দুই সেকেন্ডের ব্যবধানে পিছনে পুলিশের গাড়ির হর্ণ। বুঝতে পেরে তিনি গাড়ি সাইড করলেন বটে। কিন্তু জরিমানা গুণতেই হবে। ওমর ফারূক ভাই জরিমানা দিয়ে হাসতে হাসতে ফিরলেন। জিজ্ঞাসা করলাম কত দিতে হ’ল। বললেন ১০০ রিয়াল (৩০০০ টাকা)। তাতেও এত খুশী? উনি বললেন, এটাই সর্বনিম্ন জরিমানা এখানে। এতটুকুতে পার পেয়ে যাওয়াই তার খুশীর কারণ। আমি ভীষণ অবাক হ’লাম আইনের এমন নিষ্ঠুর প্রয়োগ দেখে। প্রশস্ত ফাঁকা রাস্তা। গাড়িকে বিশেষ প্রয়োজনে হঠাৎ দাঁড়াতে হয়েছে। তাতেই সেকেন্ডের ব্যবধানে জরিমানা করতে হবে? অফিসার কি সতর্ক করেই ছেড়ে দিতে পারতেন না? দ্বীনী ভাইয়েরা জানালেন, আরবদের ক্ষেত্রে ওরা কিছুটা ছাড় দেয়। কিন্তু অনারবদের কখনও ছাড়া হয় না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের নামে অমানবিকতার প্রদর্শন কারো কাছে আইনের যথার্থ প্রয়োগ হিসাবে সন্তোষজনক মনে হ’লেও আমার কাছে হৃদয়শুন্য নিছক যান্ত্রিকতা মনে হয়। পৃথিবীতে মানবতার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। আইন তো কেবল শৃংখলা নিশ্চিত করার একটি মাধ্যমমাত্র। মানবতার উপরে তার স্থান হ’তে পারে না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করাই আইন সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ, আইনের নিষ্ঠুর প্রয়োগ নয়। আল্লাহর আইন ছাড়া আর কোন আইনই শাশ্বত নয়। তাই কথায় কথায় আইনের বাণী কপচানো আর হাইকোর্ট দেখানো আমার কাছে আইনের অপপ্রয়োগই মনে হয়।

আমরা তিনটি গাড়িতে উনায়যার প্রাণকেন্দ্রে জামে ছালেহ ইবনুল উছায়মীন মসজিদ চত্বরে এসে উপস্থিত হ’লাম। নতুন মসজিদের সাথে সংযুক্ত প্রাচীন আমলের মিনার দেখে বোঝা যায় পূর্বযুগের স্মৃতি সংরক্ষণে তাদের আন্তরিক প্রয়াস। প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে ৩/৪তলা উচ্চতার এই মিনারটি মাটি দিয়ে তৈরী করা হয়। বিশাল মসজিদের অভ্যন্তরভাগে ঢুকে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। ইতিহাসের খাঁজে খাঁজে অতীতের ঘ্রাণ নেই। এই তো প্রায় পৌঁনে একশত বছর আগে এখানেই নিয়মিত দরস দিতেন খ্যাতনামা বিদ্বান শায়খ আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী (১৯৮৯-১৯৫৭খ্রি.), যার তাফসীরের শৈল্পিক সহজবোধ্য ভাষাশৈলী শৈশবেই আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনিই ছিলেন শায়খ উছায়মীনের প্রধান শিক্ষাগুরু। সেই যুগে দুনিয়া বিমুখ এই শায়খকে উনায়যার কাযী হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেননি। জীবনের শেষদিকে আল-মা‘হাদুল ‘ইলমী, উনায়যার প্রধান হিসাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। তবে এ দায়িত্বের জন্য তাঁর বেতন ১০০০ রিয়াল (তৎকালীন সময়ে মোটা অংকের বেতন) নির্ধারণ করা হ’লে পরিচালকের কাছে তিনি ছাফ চিঠি লেখেন যে, তিনি এ দায়িত্বের জন্য কোন অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন না। সুবহানাল্লাহ!

১৯৫৭ সালে মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্র শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীনকে এই মসজিদের খতীব ও শিক্ষক হিসাবে নির্ধারণ করে যান, যে দায়িত্ব শায়খ আমৃত্যু পালন করেন। এই মসজিদেই তাঁর দরসে হাযারো দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করত। ইলমী কলরবে মুখরিত হ’ত উনায়যার রাস্তাঘাট। বহুবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আহবান জানানো হ’লেও তিনি এই মসজিদকেই নিজের কর্মক্ষেত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। শেষ জীবনে অবশ্য নিকটস্থ মুহাম্মাদ বিন সঊদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ক্বাছীম শাখায় শরী‘আহ বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮০ সালের দিকে একবার বাদশাহ খালেদ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তাঁর জীর্ণ মাটির বাড়ি-ঘর দেখে সরকারীভাবে নতুন বাড়ি করে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। শায়খ জবাবে বললেন, এর প্রয়োজন নেই। কেননা ছালিহিয়াহ এলাকায় আমরা একটি বাড়ি করছি। সেখানে অচিরেই স্থানান্তরিত হব। আপনি বরং আমার মসজিদটি পাকা করে দিন। অতঃপর বাদশাহ খালেদ মসজিদ পাকা করার নির্দেশনা দিয়ে বিদায় নিলেন। পরে ছাত্ররা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, শায়খ! ছালিহিয়াতে আপনার কোন বাড়ি আছে সে খবর তো আমরা জানতাম না? তিনি বললেন, أليست المقبرة في الصالحية فالقبر هناك نبنيه ونجهزه ‘ছালিহিয়াতে কবরস্থান আছে না? সেই কবরই আমরা তৈরী করছি এবং বসবাসের জন্য প্রস্ত্তত করছি!’ সুবহানাল্লাহ! এমনই দুনিয়াবী মোহমুক্ত জীবন অতিবাহিত করতেন আমাদের পূর্বসূরী বিদ্বানগণ!

মসজিদের খাদেমদের মধ্যে বাঙালী আছেন। তিনি মসজিদ সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য দিতে পারলেন না। কেবলই চাকুরীজীবী। শায়খ উছায়মীনের নাম বললে তার চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তবে জানালেন যে, এখনও নিয়মিত দরস হয় মসজিদে। বিভিন্ন খ্যাতনামা বিদ্বানগণ দরস দিয়ে থাকেন। মসজিদ পাকা হয়েছে। সেন্ট্রাল এসিতে দৈহিক প্রশান্তি আসে। তবে গত এক শতাব্দীকাল ব্যাপী ইলমের জোয়ার বহমান ছিল এই মসজিদকে কেন্দ্র করে, তা আজ জৌলুস হারিয়েছে। মসজিদটা পড়ন্ত বেলার নিষ্প্রভ আলোয় কেমন নির্জীব দেখায়। আলো ছড়ানোর সেই মানুষগুলোর অবর্তমানে এর প্রতিটি কোণা থেকে যেন হাহাকার ধ্বনি ভেসে আসছে। পার্শ্ববর্তী জমকালো উনায়যা শপিং মল কিংবা বিশাল জরীর বুকশপের দুনিয়াবী জৌলুস মুগ্ধ করল বটে, কিন্তু মাশায়েখ বিদ্বানদের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত সেই পবিত্র ইলমী দীপশিখার শূন্যতা কিছুমাত্র দূর করতে পারেনি।

আমরা আবার উনাইযাহ ইসলামিক সেন্টারের অদূরে দেলাওয়ার ভাইয়ের ওয়ার্কশপে ফিরে আসি। ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে দাওয়াতী প্রোগ্রাম হয়। শায়খ উছায়মীনের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেই। অবাক ব্যাপার যে, এই শহরে বসবাস করেও অনেক সচেতন ভাইও শায়খের ব্যাপারে তেমন অবগত নন! খাসির গোশতের ইন্ডিয়ান স্টাইলের কাচ্চি বিরিয়ানী দিয়ে ইফতারের আয়োজন করেছেন লিটন ভাই। ইফতারের পরও অন্তরঙ্গ পরিবেশে কিছুক্ষণ আলোচনা ও মতবিনিময় অব্যাহত থাকে। অতঃপর আমরা আবার আল-খাবরায় ফিরে এসে শায়খ আখতার মাদানীর পিছনে তারাবীর ছালাত আদায় করলাম। তারপর বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সাহারীর পর মদীনায় যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিলাম।

***

২৫শে মার্চ’২৩ সকালে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম পিরোজপুরের আল-আমীন মুন্সীর গাড়িতে। আল-আমীন মুন্সী শায়খ আখতার মাদানীর ছাত্র ও একান্ত শিষ্য। হালকা গড়নের চঞ্চলমতি এক লাজুক যুবক। তার সারল্যভরা হাসি আর মায়াবী চাহনীতে সহজেই আকৃষ্ট হওয়া যায়। সততা, একনিষ্ঠতা আর আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু তার একটাই দোষ- কোন কিছু অন্যায় মনে হ’লে একমুহূর্ত সে প্রতিবাদ ছাড়া থাকতে পারে না। ফলে ফেইসবুকে বা অন্য স্থানে অনেক সময় চাছাছোলা বেফাঁস মন্তব্য করে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছে। সংগঠনের সদস্য হওয়ায় একাধিকবার তার জন্য আমাদের কথা শুনতে হয়েছে। ছবরের নছীহত করলে কথা দেয়ার পর সে আবার ভুলে যায়। আবার শুধরে নিতে চায়। এই আল-আমীন মুন্সীই আজ আমাদের রাহবার, গাড়িচালক। সফরটা বেশ মাতিয়ে রাখল ছোট ছোট বুদ্ধিদীপ্ত কথায়। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন এবং দ্বীনে হকের উপর অটল থাকার তাওফীক দান করুন-আমীন! [ক্রমশঃ]






সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
বালাকোটের রণাঙ্গনে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
কোয়েটার ঈদস্মৃতি - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আমীরে জামা‘আতের নেতৃত্বে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে শিক্ষা সফর - ড. নূরুল ইসলাম
রিয়াদ সফরে অশ্রুসিক্ত সাংগঠনিক ভালবাসা - গোলাম কিবরিয়া আব্দুল গণী
বালাকোটের রণাঙ্গণে (আগষ্ট সংখ্যার পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
খাইবারের পাদদেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৫ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আরও
আরও
.