পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩। শেষ পর্ব ।
৬.
২৭শে জানুয়ারী ২০২০ বেলা ১১-টা। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে জেট স্টারের একটি ফ্লাইটে রওয়ানা হ’লাম ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার পথে। যাত্রীদের অধিকাংশই ইন্দোনেশীয়। চাইনিজ নববর্ষ উপলক্ষে ভ্রমণে গিয়েছিল সিঙ্গাপুর। বেশভূষায় তাদেরকে মুসলিম মনে হয় না। পরে জেনেছি ইন্দোনেশিয়ায় যে সমস্ত মহিলা হিজাব পরে না তারা মূলতঃ অমুসলিম তথা খ্রীষ্টান। মুসলিম মহিলারা যতই ধর্মহীন প্রকৃতির হোক না কেন, হিজাব পরিধান তাদের সংস্কৃতির আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। সুতরাং এখানে মুসলিম-অমুসলিম মহিলাদের মধ্যে পার্থক্যচিহ্ন হ’ল হিজাব। পুরো যাত্রাপথটি দক্ষিণ চিন সাগর হয়ে জাভা সাগরের উপর দিয়ে। ফলে নিচে ভুখন্ডের দিশা পাওয়া যায় না। মাঝে সুমাত্রা দ্বীপপুঞ্জের কিছু অংশ নযরে আসে। প্রায় পৌনে দু’ঘন্টার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে স্থানীয় সময় বেলা ১১-টা ৫৫ মিনিটে জাকার্তার সুকর্ণ-হাত্তা বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। বেশ সাদাসিধে এয়ারপোর্ট। তেমন ভিড় চোখে পড়ে না। বিশ্বের ২য় জনবহুল শহরে এসে এই নির্জনতা বেশ চোখে লাগে। ইমিগ্রেশনে পৌঁছে পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। বাংলাদেশীদের জন্য গত বছর থেকে এদেশে কোন ভিসা লাগে না। এমনকি কোন এন্ট্রি ফীও নেই। এর আগে ইন্দোনেশিয়া এসেছি কি-না জিজ্ঞাসা করে অফিসার পার্শ্ববর্তী এক কক্ষে নিয়ে গেলেন। হিজাবী এক মহিলা অফিসার দু’চারটি প্রশ্ন করলেন। তার কন্ঠস্বরে রুক্ষতা। মোটেও আতিথেয়তাসুলভ নয়। বেশী বাক্য ব্যয় না করে একমাসের এন্ট্রি দিয়ে পাসপোর্টে সীল মারলেন বটে, তবে তার দুর্বিনীত আচরণে বেশ অপ্রসন্নতা নিয়ে জাকার্তা সফর শুরু হ’ল। বাইরে এসে মানিচেঞ্জারে মাত্র ১০০ সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার ভাঙ্গাতেই প্রায় মিলিয়নিয়ার বনে গেলাম। অর্থাৎ বাংলাদেশী প্রায় সাড়ে ছয় হাযার টাকায় সাড়ে নয় লক্ষ ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়াহ মিলল। তারপর ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে ওয়াইফাই সংযোগ পেয়ে বন্ধু আহমাদ বদরুদ্দীনের সাথে যোগাযোগ করলাম। সে জানালো অফিস থেকে বের হ’তে তার প্রায় ২-টা বেজে যাবে। সুতরাং হাতে প্রায় দু’ঘন্টা সময়। বিমানবন্দর মসজিদে ফ্রেশ হয়ে যোহর-আছর ছালাত আদায় করে তার জন্য ২নং টার্মিনাল লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
ইন্দোনেশিয়া অর্থ ইন্ডিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। প্রায় পাঁচ হাযার দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম মৃসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ ইন্দোনেশিয়া। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে সুমাত্রাঞ্চলে ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে এবং ষোড়শ শতাব্দীতে জাভা, সুলাওয়েসীসহ দেশের অন্যান্য দ্বীপগুলোতেও অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান হয়ে যায়। বর্তমানে দেশটির প্রায় ৯০% মুসলমান।
পনের শতক থেকে শুরু করে ১৯৪৫ সাল ইন্দোনেশিয়া ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের করতলগত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশে দেশে উপনিবেশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠলে ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ সুকর্ণ (১৯০১-১৯৭০) এবং মুহাম্মাদ হাত্তা (১৯০২-১৯৮০)-এর নেতৃত্বে ১৯৪৫ সালে ইন্দোনেশিয়া ডাচ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সুকর্ণ হন নতুন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং মুহাম্মাদ হাত্তা ভাইস প্রেসিডেন্ট। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা লাভ ও নতুন দেশ গঠনে অসামান্য অবদান রাখেন দু’জনই। ১৯৬৫ সালে মেজর জেনারেল সুহার্তো (১৯২১-২০০৮) এক সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। সে চেষ্টা পুরোপরি ফলপ্রসূ না হ’লেও সুকর্ণের প্রভাব দুর্বল হ’তে থাকে এবং ১৯৬৮ সালে সুহার্তো ক্ষমতা লাভে সক্ষম হন। অতঃপর ১৯৯৮ সালে রাজনৈতিক চাপে পদত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর তিনি একাধারে দেশ শাসন করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে এদেশে ইসলামের প্রভাব যথেষ্ট রয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগই শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী, যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ছূফী তরীকার অনুসারী। এছাড়া সামান্য কিছু শী‘আ ও আহমাদিয়া রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের সাংগঠনিক যাত্রা শুরু হয় ১৯১২ সালে। দেশের মধ্যাঞ্চল ইয়োগিয়াকার্তায় তৎকালীন বিশিষ্ট আলেম আহমাদ দাহলান (১৮৬৮-১৯২৩) মুহাম্মাদিয়া এসোসিয়েশন (Persyarikatan Muhammadiyah) নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক বুৎপত্তি ঘটান। মূলতঃ মক্কায় হজ্জে গিয়ে তিনি অপর ইন্দোনেশিয়ান শায়খ আহমাদ খত্বীব[1] (১৮৬০-১৯১৬)-এর সান্নিধ্যে অধ্যয়ন করেন এবং তার কাছে এই আন্দোলনের প্রেরণা পান। বর্তমানে ইয়োগিয়াকার্তায় এই সংগঠনের প্রধান কেন্দ্র এবং রাজধানী জাকার্তাসহ দেশের সকল প্রান্তে এর কার্যক্রম রয়েছে। সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৩০ মিলিয়নের অধিক। ফলে বর্তমানে এটি ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সংগঠনটির ছাত্র, যুব ও মহিলা শাখা রয়েছে। ড. হায়দার নাছির (জন্ম : ১৯৫৮) বর্তমান সভাপতি (১৫তম) হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সংগঠনের অধীনে প্রায় ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৬০০০ স্কুল ও মাদ্রাসা এবং বৃহত্তর পরিসরে বেশ কিছু সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। সাংবিধানিক ধর্মীয় কাউন্সিল ‘মজলিসে ওলামা’য় সংগঠনটির নিয়মিত অংশগ্রহণ রয়েছে।
৭.
বদরুদ্দীন আমার রুমমেট ছিল ইসলামাবাদে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ইসলামাবাদের নিউ ক্যাম্পাসে হযরত আলী হোস্টেলের ১৩১ নং রুমে আমার সীট বরাদ্দ হ’লে এই ইন্দোনেশিয়ানকে আমি রুমমেট হিসাবে পাই। সে তখন তাফসীর বিভাগে এমএস করছিল এবং থিসিসের শেষ পর্যায়ে ছিল। ‘আদ-দাখীল ফিত তাফসীর’ বিষয়ে ইন্দোনেশিয়ার জনৈক মুফাস্সিরের লিখিত তাফসীরে ইসরাঈলিয়াত ও জাল-যঈফ হাদীছ সমূহের তাহক্বীক্ব ছিল তার থিসিসের বিষয়বস্ত্ত। সারা রাত জেগে গবেষণা করত। আমি হাদীছ বিভাগের হওয়ায় তাকে একাজে সহযোগিতা করি। ইতিপূর্বে সে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কুল্লিয়া উছূলুদ্দীন থেকে অনার্স করেছে। প্রায় আট বছর ছিল কায়রোতে। ফলে একাডেমিক ও প্রশাসনিক উভয় ক্ষেত্রে সে যথেষ্ট দক্ষ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দোনেশিয়ান স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের প্রধান ছিল সে। ফলে তার মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ান ছাত্রদের সাথে আমার একটা গাঢ় বন্ধন তৈরী হয়। প্রায় ছয় মাস আমরা এক রুমে ছিলাম। ২০১৫-এর এপ্রিলে সে থিসিস জমা দিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে যায়। তারপর থেকে পশ্চিম জাকার্তার একটি ইসলামী কলেজ Sekolah Tinggi Ilmu Syariah Nahdlatul Ulama (STISNU)-এ শিক্ষকতা করছে। এছাড়া সে তার পিতা ও শ্বশুরের পরিচালিত দু’টি মাদ্রাসা দেখাশোনা করে। ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও খ্যাতনামা প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. মা‘রূফ আমীন তার শ্বশুরকুলের দিক থেকে ঘনিষ্ট আত্মীয়। যিনি একসময় ইন্দোনেশিয়ার বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন নাহদাতুল ওলামার প্রেসিডেন্ট এবং সাংবিধানিক ধর্মীয় কাউন্সিল মজলিস ওলামা ইন্দোনেশিয়ার প্রধান ছিলেন।
সিঙ্গাপুর সফর নির্ধারিত হওয়ার পর জাকার্তা সফরের কথা চিন্তা করি মূলতঃ তাকে উদ্দেশ্য করেই। মেসেঞ্জারে তার সাথে পূর্বেই যোগাযোগ হয় এবং আমার সফর শিডিউল তাকে জানিয়ে দেই। বেলা আড়াইটার দিকে বদরুদ্দীন তার হোন্ডা সিআরভি কার নিয়ে হাযির হ’ল। প্রায় পাঁচ বছর পর দেখা। ইসলামাবাদ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় সে আমাকে জাকার্তা সফরের দাওয়াত দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেটা যে সত্যি সত্যিই একদিন বাস্তবে রূপ নেবে কে জানত! সবই আল্লাহর ইচ্ছা। গাড়িতে উঠেই সে জানায় কলেজ থেকে চারদিনের ছুটি নিয়েছে। আমাকে তার নিজ গ্রামের বাড়িসহ আশেপাশের কয়েকটি সিটিতে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার সফর তো মাত্র দু’দিনের। সিঙ্গাপুর থেকে রিটার্ন ফ্লাইট বলে সহজে শিডিউল পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না। নতুবা এ সুযোগ ছাড়তাম না। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে প্রথমেই এক হোটেলে বসে সুস্বাদু ইন্দোনেশিয়ান সাতেই কাবাব ও খাসির গোশতের স্যুপ দিয়ে ভাত খেলাম। ইন্দোনেশিয়ায় ভাতই প্রধান খাদ্য। রুটির প্রচলন তেমন নেই বললেই চলে। খাবার শেষে স্ট্র দিয়ে কোল্ড চা পান করলাম। বরফ কুচি দেয়া কোল্ড চা পান আমার এটাই প্রথম। স্বাদ মন্দ নয়। তবে এতে চায়ের গুণাগুণ আর অবশিষ্ট থাকে বলে মনে হ’ল না। হোটেল থেকে বের হয়ে রওয়ানা হ’লাম বদরুদ্দীনের শ্বশুরবাড়ির পথে। বানতেন প্রদেশের টাঙ্গেরাং যেলার ক্রেসেক গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি। বিমানবন্দর থেকে প্রায় দেড় ঘন্টার পথ। যাত্রাপথে আমরা টাঙ্গেরাং শহরের বৃহত্তম মসজিদ রায়া আল-আ‘যম মসজিদে বিরতি দিয়ে আছরের ছালাত আদায় করলাম। বদরুদ্দীনের বাবার বাড়ি এখান থেকে কাছেই। এই মসজিদে সে মাঝে মধ্যে জুম‘আর খুৎবাও দেয় এবং বাদ মাগরিব দারসে কুরআন প্রদান করে। ১৫ হাযার মুছল্লী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই মসজিদের গম্বুজটি খুবই আকর্ষণীয়। প্রধান গম্বুজকে ঘিরে রেখেছে চারটি গম্বুজ। যার মধ্যে কোন বিচ্ছিন্নতা নেই। নেই নীচে কোন পিলার। ফলে পাঁচটি গম্বুজ মিলে এক অবিচ্ছিন্ন সুবৃহৎ গম্বুজে পরিণত হয়েছে। এজন্য কারো কারো দাবী মতে এটি এককভাবে বিশ্বের বৃহত্তম গম্বুজও বটে। গম্বুজের নীচের মূল কম্পাউন্ডটি ষড়ভুজাকার। কোন পিলার না থাকায় সেটা আরো বিশাল দেখায়। বাইরে পার্কের মত সবুজ দীর্ঘ চত্বর। দর্শনার্থীরা সেখানে সময় কাটায়।
ছালাতের পর সুপ্রশস্ত মসৃণ জাকার্তা-মেরাক টোল রোড দিয়ে গাড়ি ছুটে চলে ক্রেসেক গ্রামের পথে। রাস্তার দু’ধারে সবুজ গাছ-গাছালীর ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। বিকেলের সোনারোদে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় ধান/গমের লকলকে সবুজ শীষ। পথের গতিময়তায় আমি হারিয়ে যাই দূর অতীতে। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর পূর্বে ১৯৭৯ সালে আমার নানা হাজী আকবার আলী (১৯২০-১৯৮৬খ্রি.) একবার ইন্দোনেশিয়ায় এসেছিলেন। চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পরপরই ৪ মাসের সফরে বেরিয়েছিলেন তাবলীগ জামা‘আতের সাথে। এই বিশাল দেশের কোথায় কোন প্রদেশে গিয়েছিলেন, তা জানা নেই। তবুও আজ ইন্দোনেশিয়ায় এসে তাঁর পদচিহ্ন খুঁজি।
প্রায় ৩০ কি.মি যাওয়ার পর গাড়ি গ্রামের অপ্রশস্ত রাস্তায় ঢোকে। এদিকে রাস্তাঘাট তেমন ভাল নয়। বাড়ী-ঘরও জুৎসই নয়। প্রথাগত মালয়ী ধাঁচের প্রাচীরঘেরা গ্রামীন বাড়িগুলো। প্রশস্ত উঠানে বিভিন্ন ফলের গাছ। দোতলা বাড়ির সংখ্যা খুব কম। রাস্তায় মটরসাইকেল প্রচুর। চালক (চালিকা?) বেশীরভাগ মহিলা। দোকানের সেলসম্যানও মহিলারাই। প্রায় শতভাগই হিজাবধারী। পথে-ঘাটে সর্বত্রই যেন মহিলাদের আধিপত্য। কিছু পার্ক দেখা গেলেও উন্মুক্ত খেলার মাঠ চোখে পড়ে না। বিকেলে শিশু-কিশোরদের ক্রিকেট, ফুটবল নিয়ে মেতে উঠতে দেখা যায় না। নেই রাস্তার মোড়ে বৃদ্ধ বা মধ্যবয়সীদের কোন জটলা। নিস্তরঙ্গ এক কোলাহলহীন বিকেল। এটিই নাকি ইন্দোনেশিয়ার স্বাভাবিক দৃশ্য। জাতিগতভাবে এরা খুব শান্ত ও নিরুপদ্রব। মাগরিবের পূর্বেই বদরুদ্দীনের গ্রামে পৌঁছে গেলাম। মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। গ্রামের মধ্যে ছবির মত সাজানো সবুজে ঘেরা এক মাদ্রাসা মা‘হাদুত তারবিয়া আল-ইসলামিয়াতে ঢুকলাম। বদরুদ্দীনের শ্বশুর এই মাদ্রাসার পরিচালক। আবাসিক বেশ কয়েকটি একতলা ভবনে ছাত্র-ছাত্রীরা থাকে। ওযূ করে মসজিদে প্রবেশ করলাম। চারপাশ খোলা চৌচালা সাধারণ মালয়ী শৈলীর মসজিদ। সাদা পোষাকে ছাত্র-ছাত্রীরা মসজিদে ছালাত আদায় করছে। সামনে ছাত্ররা, পিছনে ছাত্রীরা। মাঝখানে একটা পর্দা ঝুলানো। আমরা ছালাত শেষ করলে ছাত্ররা এগিয়ে এসে অত্যন্ত আদবের সাথে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করে হাতে চুম্বন করে। এটাই এদের সংস্কৃতি। মালয়ী ছাড়া আর কোন ভাষায় তারা স্বচ্ছন্দ্য নয়। আরবী বা ইংলিশে কথা বলতে চাইলাম। তারা কেবলই হাসে। বদরুদ্দীন তাদেরকে মৃদু বকা-ঝকা করে। এরা আরবী বোঝে না তা নয়। কিন্তু স্বভাবসুলভ লজ্জাবোধের কারণে আড়ষ্টতায় ভোগে।
মাগরিবের পর বদরুদ্দীনের শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করি। প্রাচীর ঘেরা বেশ বড়সড় একতলা বাড়ি। সুন্দর ডেকোরেশন। বাইরে ছোট্ট একটা মুছাল্লা আছে, যেখানে বাড়ির পুরুষ-মহিলারা ছালাত আদায় করে। গাড়ি বারান্দায় ৪টি গাড়ি দেখে অবাক হই। তার শ্বশুর ও শ্যালকরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। বাড়িতে প্রবেশ করার পর শরবত আর ঘরে বানানো স্নাক্স দিয়ে আপ্যায়ন করা হ’ল। তারপর বদরুদ্দীনের চিকিৎসক পত্নী, শ্বশুর ও দুই চাচা শ্বশুর দেখা করতে এলেন। বদরুদ্দীনের দেড় বছর বয়সী মেয়েটা এসে কোলে চড়ে বসে। আধো আধো বোলে সে বাবাকে ডাকে আর দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে। শ্বশুর ছাহেব একজন কিতাবী আলেমও বটে। কিন্তু মুখে দাড়ি নেই। ক্লিন শেভ্ড। শাফেঈ মাযহাবে দাড়ি রাখা অবশ্য যরূরী নয়। আরবীতে কথা বলায় পারদর্শী নন, তবে বোঝেন। বদরুদ্দীনের মাধ্যমে তার সাথে কিছু কথা হ’ল। অনেক খুশী হ’লেন। কথা বলার ফাঁকে এক সময় লাজমেশানো হাসি নিয়ে বললেন, সিগারেট ধরাতে চাই, অসুবিধা নেই তো! এবার সত্যিই তাজ্জব হওয়ার পালা। যদিও শাফেঈরা ধূমপানকে হারাম মনে করে না। তাই বলে একজন আলেম মানুষ এভাবে সিগারেট টানবেন? বড় অদ্ভূত! আমার বিস্মিত চেহারা দেখে বদরুদ্দীন হেসে ফেলে কানে কানে বলল, এদেশে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য ধূমপান একটি অপরিহার্য বিনোদন উপকরণ।
বাড়ির ছোট্ট মসজিদে এশার ছালাত পড়লাম। সেখানে বেশ কিছু আরবী কিতাব দেখে আগ্রহ সহকারে হাতে নেই। কিন্তু পড়তে গিয়ে হোঁচট খাই। একটা শব্দও পড়তে পারছি না কেন? বদরুদ্দীনকে দেখালে সে বলল, এটা স্থানীয় জাভানীজ ভাষায় লেখা। এতে ল্যাটিন অক্ষরের পরিবর্তে আরবী অক্ষর গ্রহণ করা হয়েছে। লেখশৈলীটা এমনই যে এটি আরবী ভিন্ন অন্য কোন ভাষা, তা ভাবাই কঠিন। ছালাতের পর আমরা বের হ’লাম গ্রামের পরিবেশ দেখতে। অন্ধকারে রাস্তার পার্শ্বে গমক্ষেত দেখা যায়। কিছুদূর হেঁটে একটা বাজার পেলাম। দোকানগুলো খোলাই ছিল। বিক্রেতা যথারীতি অধিকাংশই মহিলা। একটি মাদ্রাসা দেখা গেল। মাদ্রাসার নামের সাথে সালাফী যুক্ত আছে অর্থাৎ এটা সালাফীদের মাদ্রাসা। আমি সোৎসাহে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলাম। কিন্তু সে বলল, এ সময় ঢোকা ঠিক হবে না। এখানকার সংস্কৃতিতে এটা আপত্তিকর। মাদ্রাসার মেইন গেটের বাইরে এক দোকানে মাদ্রাসার পোষাক পরা কিছু ছাত্রের জটলা। দেখলাম তারা সবাই একসাথে ধূমপান করছে। আমার আৎকে ওঠা চেহারা দেখে বদরুদ্দীন আবারও হেসে উঠে বলে, এদের দেখে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এখানকার মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে চা পান আর ধূমপান একই জিনিস। তাই বলে সালাফী মাদ্রাসাতেও এই দৃশ্য দেখতে হবে? এ কেমন সালাফী মাদ্রাসা? আমার বিস্ময়ের পালা শেষ হয় না।
বাযার থেকে ফিরে এসে মেহমানখানায় বসে বদরুদ্দীনের সাথে দীর্ঘসময় গল্প-গুজব হ’ল। রাত ১০-টা বাজলে সে রাতের খাবার আনতে গেল। এদিকে আমি ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুম। সেই ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন ভোর রাত। বুঝতে পারলাম আমাকে গভীর ঘুমে দেখে বদরুদ্দীন আর ডাকেনি। ফজরের ছালাতের পর সকালের নাশতা এল। স্পাইসি ফ্রাইড রাইস আর ডিম পোচ। মালয়ী নাম নাসি গোরেং। এটা ওদের বেশ প্রিয় খাবার। ভালই লাগল। নাশতার পর দ্রুত গোসল করে তৈরী হ’লাম।
সকাল ৮-টায় আমরা বদরুদ্দীনের বাসা থেকে রওয়ানা হ’লাম। গতকালের হোন্ডা গাড়িটা রেখে আজ সে টয়োটা এ্যাভাঞ্জা বের করেছে গ্যারেজ থেকে। বলা বাহুল্য, ফ্যামিলি গাড়ি হিসাবে ইন্দোনেশিয়ায় এটি খুব জনপ্রিয়। এর প্রোডাকশনও হয় ইন্দোনেশিয়াতেই। প্রথমেই বদরুদ্দীন তার শ্বশুরের মাদ্রাসায় নিয়ে গেল। ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা মসজিদে দুই পার্শ্বে সুশৃংখলভাবে বসে আছে। বদরুদ্দীন আগেই বলে রেখেছিল বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমাকে জানায়নি। যাহোক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে হবে। অপ্রস্ত্তত অবস্থায় তাদের উদ্দেশ্যে প্রায় পনের মিনিট বক্তব্য রাখলাম আরবীতে। ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে। বদরুদ্দীন অনুবাদ করে দিল। অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষকরা এসে পরিচিত হ’লেন এবং ফটোসেশন করলেন। যথারীতি ছাত্ররা ধারাবাহিকভাবে এসে কুর্নিশের ভঙ্গি করে আর আমার ডান হাত চুম্বন করতে থাকে। বাধা দেয়ার কোন উপায় নেই। তারা স্থানীয় কিছু মিষ্টি পিঠা ও হালুয়া খেতে দিল। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওয়ানা হ’লাম জাকার্তা শহরের পথে।
(ক্রমশঃ)