
গত ২-৫ ডিসেম্বর মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি সাগরবক্ষের অনিন্দ্য সৌন্দর্য ও প্রসিদ্ধ চরাঞ্চল সমূহ পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র উদ্যোগে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর নেতৃত্বে ‘শিক্ষা ও দাওয়াতী সফর ২০২৪’ অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা সফরে আমীরে জামা‘আতের সাথে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগদান করেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম, প্রচার সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন, দফতর সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম, ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম, সহ-সভাপতি আবুল কালাম, সাধারণ সম্পাদক ফায়ছাল মাহমূদ, আল-‘আওনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব, সাংগঠনিক সম্পাদক হাফেয আহমাদ আব্দুল্লাহ শাকির ‘সোনামণি’র কেন্দ্রীয় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান প্রমুখ।
এছাড়া ৩৯টি সাংগঠনিক যেলা থেকে ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র সর্বমোট ২৯৮জন দায়িত্বশীল, কর্মী ও সুধী শিক্ষাসফরে অংশগ্রহণ করেন। যেলাগুলি হ’ল- ১. কক্সবাজার ২. কিশোরগঞ্জ ৩. কুমিল্লা ৪. কুড়িগ্রাম-উত্তর ৫. খুলনা ৬. গাইবান্ধা-পূর্ব ৭. গাইবান্ধা-পশ্চিম ৮. গাযীপুর-উত্তর ৯. গাযীপুর-দক্ষিণ ১০. চট্টগ্রাম ১১. চাঁপাইনবাবগঞ্জ-উত্তর ১২. জয়পুরহাট ১৩. জামালপুর-উত্তর ১৪. ঢাকা-উত্তর ১৫. ঢাকা-দক্ষিণ ১৬. দিনাজপুর-পূর্ব ১৭. দিনাজপুর-পশ্চিম ১৮. নওগাঁ ১৯. নরসিংদী ২০. নারায়ণগঞ্জ ২১. নাটোর ২২. পাবনা ২৩. পটুয়াখালী ২৪. বগুড়া ২৫. বি-বাড়িয়া ২৬. ময়মনসিংহ-উত্তর ২৭. মাদারীপুর ২৮. মেহেরপুর ২৯. রংপুর-পশ্চিম ৩০. রাজবাড়ী ৩১. রাজশাহী-সদর ৩২. রাজশাহী-পূর্ব ৩৩. রাজশাহী-পশ্চিম ৩৪. লালমণিরহাট ৩৫. শরীয়তপুর ৩৬. শেরপুর ৩৭. সাতক্ষীরা ৩৮. সিরাজগঞ্জ ও ৩৯. সিলেট-উত্তর।
২রা ডিসেম্বর বেলা ১-টা ২৫ মিনিটের ফ্লাইট যোগে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত রাজশাহী থেকে ২য় পুত্র ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীবসহ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ঢাকা বিমান বন্দরে রিসিভ করেন ঢাকা-দক্ষিণ যেলা ‘আন্দোলনে’র সভাপতি আলহাজ্জ মোশাররফ হোসেন এবং ‘যুবসংঘে’র সভাপতি ড. ইহসান ইলাহী যহীর। অতঃপর সেখান থেকে তাঁরা প্রাইভেটকার যোগে বিকাল ৩-টায় সদরঘাট নৌ টার্মিনালে পৌঁছেন।
ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন যেলা থেকে শিক্ষাসফরে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাস ও ট্রেন যোগে আগত কর্মীরাও সদরঘাটের ২০নং গেইট ‘লালকুঠি’ ঘাটে উপস্থিত হন এবং শিক্ষাসফরের জন্য রিজার্ভ করা বিলাসবহুল ‘পূবালী-১২’ লঞ্চে উঠে স্ব স্ব কেবিনে আসন গ্রহণ করেন। কেবিন বরাদ্দ ও সার্বিক প্রস্ত্ততি শেষ করতে মাগরিবের সময় হয়ে যায়। অতঃপর লঞ্চের নীচতলার ডেকে সফরকারীগণ জামা‘আতের সাথে এবং ২য় তলার ভিআইপি কেবিনে আমীরে জামা‘আত সেখানে উপস্থিত সাথীদের নিয়ে মাগরিব-এশার ছালাত জমা ও ক্বছরসহ আদায় করেন। এরপর আমীরে জামা‘আতের অনুমতিক্রমে মহান আল্লাহর নামে সাড়ে ৬-টায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় যেলা নোয়াখালীর হাতিয়া উপযেলার তমরুদ্দীন ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। সাথে নেওয়া হয় ২ দিন ৩ রাতের প্রয়োজনীয় খাদ্য-সামগ্রী, খাবার পানি, রান্নার জন্য চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার, শুকনা খাবার, ফল-ফলাদি ও ঔষধপত্র ইত্যাদি। এই সফরে আমীরে জামা‘আতের নির্দেশে সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর উপদেষ্টা মাওলানা তাসলীম সরকার এবং ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাংগঠনিক সম্পাদক অলী হাসান।
উল্লেখ্য যে, এটি নিছক শিক্ষাসফর ছিল না, সফরের পাশাপাশি ছিল দাওয়াতী কর্মসূচীও। বিভিন্ন স্পটে ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিকটে ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?’ ‘মীলাদ প্রসঙ্গ’ ‘আন্দোলন’-এর ‘পরিচিতি’ ও বিভিন্ন প্রচারপত্র সমূহ বিতরণ করা হয়। এছাড়া ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’ প্রকাশিত ‘জীবনের সফরসূচী’ এবং ‘ছালাতের পর পঠিতব্য দো‘আ সমূহ’ ইত্যাদি দেওয়ালপত্রও বিভিন্ন স্থানে টাঙিয়ে দেওয়া হয়।
আলোচনা সভা : সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ার কিছু সময় পর রাত সাড়ে ৮-টায় লঞ্চের নীচতলার ডেকে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ফায়ছাল মাহমূদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনা সভায় উপস্থিত সাথীদের উদ্দেশ্যে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত পানিপথে এই শিক্ষাসফরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেন। তিনি মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি নদী-সাগর বন-বনানী দেখে তাঁর শুক্রগুযার বান্দা হওয়ার জন্য সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। এ সময়ে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য পেশ করেন, ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম, দফতর সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম, ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম, সহ-সভাপতি আবুল কালাম, ‘সোনামণি’র কেন্দ্রীয় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠান শেষে ডেকের এক অংশে সাজানো ডাইনিংয়ে রাতের খাবার পরিবশেন করা হয়। খাবার গ্রহণ শেষে সকলে স্ব স্ব কেবিন ও ডেকে ঘুমিয়ে যান।
অতঃপর লঞ্চ চলতে থাকে। রাত পেরিয়ে ভোর হয়। ‘আল-আওনে’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হাফেয আহমাদ আব্দুল্লাহ শাকিরের ইমামতিতে লঞ্চের ডেকের নির্ধারিত স্থানে ফজরের ছালাত আদায় করা হয়। জামা‘আত শেষে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সফরসঙ্গীদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ দরস প্রদান করেন। অনেকদিন পর জামা‘আতের সাথে ফজরের ছালাত আদায় করতে পেরে তিনি মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। উল্লেখ্য, অসুস্থতার কারণে তিনি সম্প্রতি মসজিদে ফজরের জামা‘আতে শরীক হ’তে পারেন না।
অতঃপর একটানা সকাল সাড়ে ৮-টা পর্যন্ত চলার পর তমরুদ্দীন ঘাটে পৌছার বেশ কিছু পথ আগেই ভাটার কারণে লঞ্চ আটকে যায়। ফলে সেখানেই নোঙ্গর করতে হয়। ইতিমধ্যে সকালের নাশতা পরিবেশন করা হয়।
নিঝুম দ্বীপ পরিদর্শন : ৩রা ডিসেম্বর মঙ্গলবার। নাশতার পর সকলে প্রস্ত্তত সফরের পরবর্তী গন্তব্য নিঝুমদ্বীপ যাওয়ার জন্য। কিন্তু নিঝুম দ্বীপের সৌ পথে নাব্যতা কম থাকায় সেখানে বড় লঞ্চ যেতে পারে না। নৌকা বা স্পীড বোট ব্যতীত যাওয়ার সহজ কোন উপায় নেই। সেকারণ বালু পরিবহনের একটি ‘বাল্কহেড’ (বড় নৌকা) ভাড়া করা হয় নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার জন্য। প্রায় তিনশত যাত্রীর সকলে গাদাগাদি করে চেপে বসে নৌকায়। কেউ নৌকার সামনে-পিছনের ছাদে, কেউ মইয়ের সাহায্যে মধ্যখানের নিম্নাংশে নেমে ত্রিপাল বিছানো মেঝেতে, আবার কেউ দু’পাশে পা ঝুলিয়ে বসে। অতঃপর ৯-২০ মিনিটে যাত্রা শুরু হয়। ৩ ঘন্টা ১০ মিনিট নৌকা চলার পর বেলা সাড়ে ১২-টায় নিঝুম দ্বীপে নৌকা পেঁŠছে। এই সফরে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত অংশগ্রহণ করেননি। কারণ বিগত ২০১৯ সালের ৭-১০ই মার্চের সফরে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে লঞ্চে অবস্থান করেন ঢাকা-দক্ষিণ যেলা ‘আন্দোলনে’র সভাপতি মোশাররফ হোসেন এবং আল-‘আওনের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক মুহাম্মাদ জাহিদ (রাজশাহী)।
উল্লেখ্য, নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী যেলার দক্ষিণে হাতিয়া উপযেলার অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরের অগভীর মোহনায় অবস্থিত একটি ছোট দ্বীপ। এর পূর্ব নাম ছিলো চর-ওসমান, বাউল্লার চর, আবার কেউ কেউ একে ইছামতির চরও বলত। এ চরে প্রচুর ইছা মাছ (চিংড়ীর স্থানীয় নাম) পাওয়া যেত বলে একে ইছামতির চর বলা হত। ১৯৭৫ সালে হাতিয়া আসনের সংসদ সদস্য ও তৎকালীন মন্ত্রী আমীরুল ইসলাম কালাম এই দ্বীপের বিচ্ছিন্নতা এবং মৃদুমন্দ প্রকৃতি দেখে এর নামকরণ করেন ‘নিঝুম দ্বীপ’। শীতকালে হাযার হাযার পাখি এই দ্বীপে আসে। মৎস্যজীবীদের আদর্শ স্থান এই নিঝুমদ্বীপ। ১৯৪০ সালে এই দ্বীপটি জেগে ওঠে এবং ১৯৫০ সালে সেখানে বসতি শুরু হয়। ১৪০৫০ একরের এই দ্বীপটির আয়তন ৯১ বর্গকিলোমিটার। এ দ্বীপে রয়েছে ৯টি গুচ্ছ গ্রাম। এ দ্বীপে হরিণ ও মহিষ ছাড়া অন্য কোন হিংস্র প্রাণী নেই।
নিঝুম দ্বীপে ট্রলার থেকে নেমে সফরকারীগণ দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন। তারপর সেখানকার নামারবাজার মসজিদে যোহর ও আছরের ছালাত জমা ও ক্বছর আদায় করেন। অতঃপর সমুদ্র সৈকত, ওয়াচ টাওয়ার ও দ্বীপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরে দেখেন। এ সময়ে স্থানীয় মসজিদ, বাজার ও আশপাশের দোকানপাটে লিফলেট ও বই বিতরণ করা হয়। অতঃপর বিকাল ৩-টা ২০মিনিটে ফিরতি যাত্রা শুরু হয়। ৩ ঘণ্টা ২৫ মিনিট নৌকা চলার পর সন্ধা ৬-টা ৪৫ মিনিটে তারা হাতিয়ার তমরুদ্দীন ঘাটে পৌঁছেন।
তমরুদ্দীনে দাওয়াতী কাজ: নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে সফরকারীগণ লঞ্চে মাগরিব ও এশার ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তমরুদ্দীন ঘাটে নেমে স্থানীয় বাজারে, দোকান-পাটে দাওয়াতী লিফলেট ও বই-পুস্তক বিতরণ করেন। উল্লেখ্য, হাতিয়া উপযেলার সবচেয়ে ব্যস্ত ও বাণিজ্যিক বাজারের নাম তমরুদ্দীন ঘাট। এটি হাতিয়া উপযেলার তমরুদ্দীন ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। প্রতিদিন হাতিয়া-ঢাকা নৌরুটে লঞ্চ চলাচল এর সুবাদে তমরুদ্দীন বাজার হয়ে উঠেছে হাতিয়া উপযেলার পাইকারি বাজারের কেন্দ্রবিন্দু। নিঝুমদ্বীপ, জাহাযমারা, ওচখালী, সাগরিয়া, আফাযিয়া বাজারসহ হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এ বাজারে আসেন পাইকারি ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করার জন্য। দাওয়াতী কাজ শেষে লঞ্চে উঠে সকলে রাতের খাবার গ্রহণ করেন। অতঃপর রাত ১২-টায় মনপুরা দ্বীপের উদ্দেশ্যে লঞ্চ ছেড়ে যায়।
মনপুরা দ্বীপে অবতরণ : ৪ঠা ডিসেম্বর বুধবার ভোর ৬-টায় লঞ্চ মনপুরা দ্বীপে পৌঁছে। মনপুরা হচ্ছে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এলাকার উত্তর দিকে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি দ্বীপ উপযেলা। আয়তন ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটার। ভোলা যেলার মূল ভূখন্ড থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এ দ্বীপটির তিন দিকে মেঘনা নদী আর একদিকে বঙ্গোপসাগর। এর উত্তরে উপযেলার নাম তজুমদ্দীন, দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে নোয়াখালী যেলার হাতিয়া, পশ্চিমে রয়েছে তজমুদ্দীনের কিছু অংশ, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপযেলা। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মনপুরা সাগরের বুকে এক নয়নাভিরাম দ্বীপ। মনগাযী নামে এখানকার এক লোক একদা বাঘের আক্রমণে নিহত হ’লে তার নামানুসারে মনপুরা নামকরণ করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মনপুরা উপযেলায় লক্ষাধিক লোকের বসবাস।
আমীরের জামা‘আতসহ সফরকারীরা এই দ্বীপে অবতরণ করেন। অতঃপর কেউ পায়ে হেঁটে, কেউবা মোটর সাইকেলে, কেউবা ইজিবাইক যোগে মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণ করেন। আবার কেউ স্পীড বোটে দ্বীপের চারপাশ চক্কর দেন। আমীরে জামা‘আত কয়েকজন সাথী নিয়ে একটি ইজিবাইকে দ্বীপের দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেন। এখানেও দল ভাগ করে বই ও লিফলেট বিতরণ করা হয়। অতঃপর সকলে লঞ্চে ফিরে আসলে সকাল ৮-টা ১০ মিনিটে সফরের পরবর্তী গন্তব্য চরফ্যাশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়।
আমীরে জামা‘আতের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ : মনপুরা দ্বীপে আমীরে জামা‘আতের আগমনের সংবাদ শুনে সাক্ষাৎ করতে আসেন মাসিক আত-তাহরীক পত্রিকার এজেন্ট এবং চর-ফাইযুদ্দীন ফকিরহাট দাখিল মাদ্রাসার বিপিএড শিক্ষক আমীনুল ইসলাম এবং তার সাথী স্থানীয় ঔষধ ব্যবসায়ী মাসুম বিল্লাহ ও মুহাম্মাদ সোহাগ। এদের মধ্যে আমীনুল ইসলাম আমীরে জামা‘আতের সফরসঙ্গী হয়ে চরফ্যাশন গমন করেন।
চরফ্যাশন দ্বীপে অবতরণ ও জ্যাকব টাওয়ার পরিদর্শন : মনপুরা থেকে রওয়ানা হয়ে ভাটার কারণে লঞ্চ সরাসরি চরফ্যাশন যেতে পারেনি। কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। লঞ্চের তলদেশ চরে আটকে যায়। ফলে নদীর গভীর এলাকা দিয়ে ঘুরে তজমুদ্দীন হয়ে চরফ্যাশন পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে যায়। অবশেষে বেলা ২-টা ২৫ মিনিটে লঞ্চ চরফ্যাশনের বেতুয়া লঞ্চঘাটে পৌঁছে।
চরফ্যাশনে পৌঁছলে সেখানে আমীরে জামা‘আত ও তাঁর সফরসঙ্গীদের অভ্যর্ত্থনা জানান ভোলা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি কামরুল হাসান, অর্থ সম্পাদক মুহাম্মাদ অজীহুল্লাহ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক আমীরুল ইসলাম শামীম, ‘আন্দোলন’-এর দক্ষিণাঞ্চল বিষয়ক কেন্দ্রীয় দাঈ মুহাম্মাদ রাক্বীবুল ইসলাম, চরফ্যাশন গার্লস স্কুলের শিক্ষক মুহাম্মাদ নকীব এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ও সারওয়ার আলম প্রমুখ।
উল্লেখ্য, লঞ্চঘাট থেকে চরফ্যাশন শহরের দর্শনীয় স্থান জ্যাকব টাওয়ার দেখতে যাওয়ার জন্য ৫০টি ইজিবাইক ভাড়া করা হয়। প্রত্যেক ইজি বাইকের সম্মুখের গ্লাসে আহলেহাদীছ আন্দোলনের নামসহ শিক্ষা সফরের স্টীকার লাগানো ছিল। লঞ্চঘাটের অদূরে সারিবদ্ধভাবে বাইকগুলো রাখা হয়। আমীরে জামা‘আতের জন্য রাখা হয় প্রাইভেটকার। অতঃপর লঞ্চ থেকে নেমে সকলে নির্ধারিত বাহনে উঠে জ্যাকব টাওয়ার পরিদর্শনে যান। টাওয়ার থেকে সংলগ্ন অনিন্দ্যসুন্দর খাসমহল জামে মসজিদের আযান প্রচারিত হয়। আমীরে জামা‘আতসহ সফরকারীগণ লিফটের মাধ্যমে ১৮তলা বিশিষ্ট জ্যাকব টাওয়ারের উপরে উঠেন। এসময় উপরের গোলাকার টাওয়ারে সন্নিবেশিত মূল্যবান বিদেশী স্বচ্ছ ও অতি মযবুত গ্লাস সরবরাহকারী ঢাকার হায়দার আলী তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। সর্বোচ্চ তলায় উঠে আমীরে জামা‘আত সাথীদের উদ্দেশ্যে নাতিদীর্ঘ নছীহত পেশ করেন।
উল্লেখ্য, জ্যাকব টাওয়ার বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা দ্বীপের চরফ্যাশন শহরে অবস্থিত একটি ওয়াচ টাওয়ার। এ টাওয়ার থেকে চারপাশের ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এটি বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু ওয়াচ টাওয়ারগুলোর মধ্যে একটি। এই টাওয়ারের উচ্চতা ২২৫ ফুট। ২০১৩ সালে এর নির্মাণ শুরু হয়। উদ্বোধন করা হয় ২০১৮ সালে। ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল-ইসলাম জ্যাকবের নামে এর নামকরণ করা হয় ‘জ্যাকব টাওয়ার’। জ্যাকব টাওয়ার, টাওয়ার সংলগ্ন অনিন্দ্যসুন্দর খাসমহল জামে মসজিদ, শিশু পার্ক, বাজার পরিদর্শন এবং লিফলেট ও বই বিতরণ এবং দাওয়াতী কাজ শেষে সফরকারীগণ মাগরিবের ছালাতের পূর্বে লঞ্চ ঘাটে ফিরে আসেন।
বেতুয়া ঘাট মসজিদে দাওয়াতী বৈঠক : জ্যাকব টাওয়ার পরিদর্শন শেষে সফরকারীগণ লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে সেখানকার জামে মসজিদে মাগরিব ও এশার ছালাত আদায় করেন। অতঃপর স্থানীয় মুছল্লী ও সফরকারীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দাওয়াতী বৈঠক। বৈঠকে বক্তব্য পেশ করেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম, দফতর সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম, ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম, সহ-সভাপতি আবুল কালাম, সাধারণ সম্পাদক ফায়ছাল মাহমূদ, ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপদেষ্টা তাসলীম সরকার প্রমুখ। উক্ত মসজিদের মুওয়াযযিন সকলের নিকট মসজিদ নির্মাণে সহযোগিতা চাইলে তাৎক্ষণিক প্রায় ১৩ হাযার টাকা আদায় হয়, যা ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুওয়াযযিনে হাতে তুলে দেন। এতে তিনি খুশি হয়ে সকলের জন্য দো‘আ করেন।
রওয়ানা ও স্মৃতিকথা অনুষ্ঠান : চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর বুধবার রাত সাড়ে ১০-টায় লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ইতিমধ্যে লঞ্চে শুরু হয় আঞ্চলিক ভাষায় স্মৃতিকথা অনুষ্ঠান। ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি হাফেয শেখ সাদী ও সাধারণ সম্পাদক আরজু হোসাইন ছাববীরের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অতঃপর নবীন-প্রবীণ বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলগণ তাদের আঞ্চলিক ভাষায় স্ব স্ব ব্যক্তিগত ও সাংঠনিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি তুলে ধরেন। এরই মধ্যে ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম রাজশাহীস্থ মারকাযী জামে মসজিদ নির্মাণের জন্য সকলের নিকট সহযোগিতার আহবান জানান। এতে নগদ-বাকী মিলে প্রায় পৌনে চার লক্ষ টাকা আদায় হয়। রাত ১১-টায় অনুষ্ঠান শেষ হয়। আমীরে জামা‘আত অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না পারলেও তিনি অনলাইনে কেবিনে বসে সব কিছু প্রত্যক্ষ করেন।
বিদায়ী অনুষ্ঠান : রাত ১১-টায় স্মৃতিকথা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পর রাতের খাবার গ্রহণ করে সকলে ঘুমিয়ে পড়েন। লঞ্চ চলতে থাকে। ভোরে লঞ্চেই ফজরের আযান হয়। অতঃপর আল-‘আওনে’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হাফেয আহমাদ আব্দুল্লাহ শাকিরের ইমামতিতে ফজরের ছালাত আদায় করা হয়। ফজরের ছালাত শেষে আমীরে জামা‘আত গুরুত্বপূর্ণ বিদায়ী নছীহত পেশ করেন। তিনি বলেন, যে সংগঠন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করে। সে সংগঠনের উপর আল্লাহর হাত থাকে। এটি একটি পরিবারের মত। সমাজ সংস্কারের কঠিন লক্ষ্যে আমাদের সংগঠন পরিচালিত। আল্লাহর রহমত যাতে সর্বদা আমাদের সাথী হয়, সেজন্য নিজেদেরকে আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসাবে গড়ে তোলা আবশ্যক। তিনি বলেন, নীচে বিশাল সমুদ্র, পাশে চোখ জুড়ানো বনাঞ্চল, উপরে অনিন্দ্যসুন্দর নক্ষত্ররাজি সবই আল্লাহর আনুগত্য করে। সবাই তাঁর গুণগান করে। আল্লাহর এই অপূর্ব সৃষ্টি দেখে আমাদের সার্বিক জীবন আল্লাহর আনুগত্যে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষা সফর সুসম্পন্ন হৌক, এটাই কামনা করি। পূর্ণ আনুগত্য, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সুন্দর শৃংখলা বোধের পরিচয় দেওয়ার জন্য আমরা আপনাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ সকলকে নেকীর কাজে পরস্পরে প্রতিযোগিতা করার তাওফীক দান করুন-আমীন!
বিদায়ী ভাষণে তিনি খাদ্যবিভাগসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাসলীম সরকারসহ ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীল ভাইদের প্রতি প্রাণখোলা দো‘আ করেন। তিন দিনের সফর শেষে ৫ই ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল ১০-১৫ মিনিটে লঞ্চ ঢাকা সদর ঘাটে পৌঁছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।