বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সমাধিক্ষেত্র থেকে বের হয়ে আমরা লাহোরের কেন্দ্রস্থল আযাদী চক বা স্বাধীনতা স্কয়ারে আসি। আমাদের গন্তব্য ছিল লাহোরের সৌন্দর্যতিলক বাদশাহী মসজিদ সংলগ্ন লাহোর ফোর্ট। লাহোর সিটির মধ্যস্থলে প্রায় সর্বত্রই এই ফোর্টের প্রাচীর নযরে পড়ে। আমরা ভেতরে প্রবেশের উদ্যোগ নেই। কিন্তু বিধি বাম। শনিবার ফ্যামিলি ডে। অদ্ভুত নিয়মে আজ কেবল তাদেরই ঢোকার অনুমতি রয়েছে, যারা পরিবার নিয়ে এসেছে। আমাদের সাথে পরিবার নেই। তবুও শেষ চেষ্টা হিসাবে বিদেশী পাসপোর্ট দেখিয়ে ঢোকার বিশেষ সুযোগ নিতে চাইলাম। কিন্তু উপস্থিত পুলিশগুলো নির্মম নীতিপরায়ণতা দেখাল। কষ্ট পেলাম। এই নিয়ে অন্ততঃ তৃতীয়বার লাহোর ফোর্টে এসে ফিরে যেতে হ’ল। পূর্বে দু’বার যখন এসেছিলাম, নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য এবারে হাতে বেশ সময় নিয়েই এসেছিলাম। লাভ হ’ল না। তাক্বদীরে না থাকলে যা হয়। আমরা মন খারাপকে বিশেষ প্রশ্রয় না দিয়ে সমস্যার মাঝেই সম্ভাবনার দুয়ার খোঁজার নিয়তে সিএনজিতে উঠলাম।

লাহোর ফোর্ট থেকে অল্প দূরত্বে ওল্ড লাহোরের প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক রংমহল বাজার। সেখানে পৌঁছতে ১৮৪৯ সালে নির্মিত বৃটিশ প্যাটার্নের একটি দীর্ঘ পরিসরের দ্বিতল নকশাদার দালান নযরে আসে। এটি ক্রিশ্চিয়ান মিশন হাই স্কুল। স্কুল ড্রেস পরা কিছু ছাত্রকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। আমাদের গন্তব্য লাহোরের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম আহলেহাদীছ জামে মসজিদ চিনিয়াওয়ালী মসজিদ। এই বাযারেই ঐতিহাসিক চিনিয়াওয়ালী আহলেহাদীছ মসজিদের অবস্থান বলে জেনেছি। কিন্তু পুরানো ঢাকার মত অপরিচ্ছন্ন চিপাগলির মধ্য দিয়ে এগলি-সেগলি করে মসজিদের অনুসন্ধান পেতে বড় বেগ পেতে হয়। এক এক করে জনাদশেক লোকের সাহায্য নিয়ে অবশেষে মসজিদের খোঁজ পাওয়া গেল। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত লাহোরের সবচেয়ে পুরাতন আহলেহাদীছ জামে মসজিদ। ফলকে লেখা ১০৮০ হিজরী তথা ১৬৬৯ সালে প্রথম এটি নির্মিত হয়। এই হিসাবে এটাই কি উপমহাদেশের প্রথম কোন আহলেহাদীছ মসজিদ? আল্লাহ মা‘লূম। মাওলানা মুহাম্মাদ হোসাইন বাটালভী (১৮৪০-১৯২০খ্রি.), মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী (১৮১১-১৮৭৯খ্রি.)-এর পুত্র আব্দুল ওয়াহিদ গযনভী (মৃ. ১৯৩০খ্রি.), মাওলানা মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী (১৮৯৫-১৯৬২খ্রি.), ইহসান ইলাহী যহীর (১৯৪৫-১৯৮৭খ্রি.) প্রমুখ বিখ্যাত আহলেহাদীছ ব্যক্তিত্ব এই মসজিদের খতীব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন এই মসজিদের তৎকালীন খতীব আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর এক জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেছিলেন, যার ফলস্বরূপ মানুষ তাঁকে উপমহাদেশের নতুন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রূপে ভাবা শুরু করে। হাদীছ অস্বীকারকারীদের অন্যতম নেতা আব্দুল্লাহ চকড়ালভী (১৮৪৪-১৯১৪খ্রি.)-ও একসময় এই মসজিদের খতীব ছিলেন। পরে তাঁর ভ্রান্ত আক্বীদা প্রকাশিত হওয়ার পর মসজিদ থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। ১৯৯৭ সালে মসজিদটি পুনরায় সংস্কার করা হয়েছে এবং আয়তনেও বেশ বড় হয়েছে। ছাদের উচ্চতা ৩০ ফুটেরও ঊর্ধ্বে। পুরনো আবহ বেশ ভালভাবেও আটকে রয়েছে মিনারে, দেয়ালে আর মিম্বরের খাঁজে। মসজিদে ঢুকে আমরা আছরের ছালাত জামা‘আতে আদায় করি। ভেতরে গোল হয়ে নিম্নস্বরে খোশগল্পে ব্যস্ত একদল বয়স্ক মুছল্লী আমাদের দিকে আড়চোখে তাকায়। ছালাত শেষে আমাদেরকে চিত্রগ্রহণে ব্যস্ত লক্ষ্য করে একজন এগিয়েই আসে। আমরা পরিচয় দিলে তারা নিশ্চিন্ত হন এবং গ্রিন টি-এর আয়োজন করে উপস্থিত আতিথেয়তা দেন। মসজিদের বাইরে ছোট একটি হিফযখানা রয়েছে। সেখানে জনাকয়েক ছাত্র রয়েছে বলে জানতে পারলাম। কিন্তু নযরে পড়ল না কাউকে। আমরা সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে মুছল্লীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসি।

মাগরিবের আগে আরও ঘণ্টাখানিক সময় রয়েছে দেখে আমরা নতুন গন্তব্যের পথে রওনা হই। পথে লম্বা জ্যাম। নির্মীয়মাণ মেট্রো বাস প্রকল্পের কারণে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। সূর্য ডোবার আগেই পৌঁছি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সাথে লাগোয়া শালিমার বা শালামার বাগে। এটিও যথারীতি মোগল সাম্রাজ্যের প্রচন্ড সৌখিন শিল্পনির্দেশক সম্রাট শাহজাহানের আমলে ১৬৪২ সনে নির্মিত।

ছেলেবেলায় ইতিহাসের গল্পে অনেকবার এই শালিমার বাগের নাম পড়েছি। পাঠ্যবইয়ে শালিমার বাগের হাতে আঁকা একটি চমৎকার চিত্র ছিল। আজ মুখোমুখি দর্শনে সেই শালিমার বাগকে অবিশ্বাস্য রকম মনোমুগ্ধকর মনে হয়। কি বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত জলাধার, ফোয়ারা, ঝর্ণাধারা আর হাম্মামখানা! কেবল রাজকীয় কারবার বললে ভুল হয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কারের কয়েক শত বছর পূর্বেও তৎকালীন স্থাপত্যশিল্পীদের মন ও মনন কত আধুনিক ছিল এবং তাদের কলাকৌশল যে কত নিখুঁত ছিল, তার প্রামাণ্য চিত্র যেন এই গার্ডেন। তাজমহলের পর এটি মুঘল আমলের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক স্থাপনা হিসাবে স্বীকৃত। প্রায় ৫০ একর বা দেড়শ বিঘা ভূমি জুড়ে বিস্তৃত গার্ডেনটি ৩টি পৃথক বর্গাকার সমভূমিতে বিভক্ত। যার প্রতিটি স্তর একটি অপরটির চেয়ে কয়েক মিটার উঁচু। ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া গার্ডেনের প্রবেশমুখে দাঁড়ানো মাত্র দর্শকের চোখে এক পশলা প্রশান্তি আর বিস্ময়াবিষ্ট মুগ্ধতা দোলা দিয়ে যায়। আর সেই আবেশে দেহমন জুড়ে এক মোহনীয় সুরের ছন্দময় ধ্বনি যেন বাজতেই থাকে অবিরাম। সময়ের স্বল্পতায় আমরা সেই মুগ্ধতাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সান্ধ্যসূর্যের স্বর্ণালী আভায় মোড়া গার্ডেনের অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের সে সুযোগ দিল না। অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কতক্ষণ।

ভেতরে প্রথমে যে স্কয়ারটি নযরে আসে সেটি সবচেয়ে নিচু অংশ, যেখানে সাম্রাজ্যের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ নাগরিক ও দর্শনার্থীরা আগমন করতেন। এরপরের স্তরটি প্রথম স্তর থেকে ৪/৫ মিটার উঁচু। আয়তাকার এই স্তরটি সবচেয়ে সুন্দর ও কারুকার্যমন্ডিত। এটি সম্রাটগণ ব্যবহার করতেন। এতে কয়েকটি মার্বেল পাথরের জলপ্রপাত, ঠান্ডা ও গরম পানির গোসলখানা ও কাপড় পরিবর্তনের ঘর রয়েছে। জলাধারের চারপাশে রয়েছে বসার ব্যবস্থা। সর্বশেষ স্তরটি পূর্বের স্তর থেকে আরও ৪/৫মিটার উঁচু। এটি সম্রাটদের হারেম হিসাবে ব্যবহৃত হ’ত। সবমিলিয়ে এতে মোট ৪১০টি ফোয়ারা রয়েছে এবং এসব ফোয়ারার মাধ্যমে মার্বেল পাথর এবং লাল বালু দিয়ে নির্মিত জলাধারে অবিরাম পানির ধারা পতিত হয় নিঃশব্দ দ্যোতনায়। অবিচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের জন্য রাভী নদী এবং সুদূর কাশ্মীরের পাহাড় থেকে এই বাগান পর্যন্ত প্রায় ১৬০ কি.মি. খাল কাটা হয়েছিল। আর ফোয়ারামুখ পর্যন্ত পানির প্রবাহ পৌঁছাতে ব্যবহার করা হয়েছিল হাইড্রোলিক ট্যাংক সিস্টেম। চতুর্পাশ উঁচু প্রাচীর ঘেরা। কর্ণারে রয়েছে নকশাদার মিনার। ওয়াচটাওয়ার সদৃশ এই মিনারে দাঁড়ালে জলাধার আর গাছ-গাছালী ঘেরা পুরো গার্ডেন এলাকাটি দৃশ্যমান হয়। কৃত্রিম গার্ডেনের অকৃত্রিম সৌন্দর্যে আরও একবার বিমোহিত হ’তে হয় এখানে দাঁড়িয়ে। মাগরিবের আযান হ’লে আমরা ফেরার পথ ধরি।

রাতে ইউইটি হোস্টেলে ফিরে বিশাল ক্যাম্পাস চত্বর একবার ঘুরে দেখি। ছিমছাম, গোছালো ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস। বেশ ভাল লাগে। বিশেষ করে খাদ্য ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট উনণত ও তুলনামূলক অনেক সস্তা। শু‘আইব এক ক্যান্টিনে সুপ্রসিদ্ধ লাহোরী চিকেন কড়াই আর লাচ্ছির অসাধারণ স্বাদ চেখে দেখার বন্দোবস্ত করে। আমি খেতে খেতে ওর জীবনের গল্পগুলো শুনি। প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন পূরণে অনেক দূর এগিয়ে গেলেও নিজ গ্রামে সে একজন ভাল বক্তা ও খতীব হিসাবে পরিচিত। যে স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানে এসেছিল, তা প্রায় পূরণ হ’তে চললেও নিজের পূর্ব পরিচয় সে ভুলতে পারেনি। তাই প্রকৌশলবিদ্যা অধ্যয়ন শেষে স্বপ্ন দেখে ইসলামিক স্টাডিজে মার্স্টার্স ও পিএইচ.ডি করবে এবং নিজেকে দ্বীনের খাদেম হিসাবে আজীবন নিয়োজিত রাখবে। আমি তার পরিকল্পনা শুনে পুলকিত বোধ করি। যুবকদের মধ্যে দ্বীন সম্পর্কে সচেতনতা এবং দ্বীনের প্রতি অকপট ভালোবাসা বৃদ্ধির এই প্রবণতাকে মন থেকে স্বাগত জানাতে ইচ্ছে করে। কেবলই মনে হয় পৃথিবীর বুকে যত অন্ধকারই নেমে আসুক না কেন, তাতে আলো জ্বালাবার জন্য একদল মানুষকে আল্লাহ সবসময় তৈরী রাখবেনই। চারিদিকে হতাশার নৈরাজ্য ছাপিয়ে আশাবাদী হওয়ার মত এমন সব দারুণ উপাদানও আল্লাহ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছেন। ফালিল্লাহিল হামদ

পরদিন সকালে লাহোরের অভিজাত এলাকা গুলবার্গ-২-এ এলাম। আমার পিএইচ.ডি থিসিসের জন্য ফিল্ড ওয়ার্কের বিশেষ প্রয়োজন হয়নি। কেননা প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ বিভিন্ন সূত্রে সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। তবুও ইচ্ছা ছিল উপমহাদেশে হাদীছ অস্বীকারকারীদের প্রাণকেন্দ্রটি পরিদর্শন করার। গোলাম আহমাদ পারভেজ (১৯০৩-১৯৮৫খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত এই কেন্দ্র আজও পর্যন্ত হাদীছ অস্বীকারের ফিৎনাকে টিম টিম করে জাগ্রত রেখেছে। তাদের প্রকাশিত ‘তুলু‘-এ-ইসলাম’ পত্রিকা ৭৫তম বর্ষ অতিক্রম করেছে সম্প্রতি। বলা যায়, প্রকাশ্যভাবে হাদীছ অস্বীকারকারী এই পত্রিকাটিই আজ অবধি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। সুতরাং আজকের সফরসূচির শুরুতেই ছিল গুলবার্গের এই কেন্দ্রটি। সিএনজি থেকে নেমে অফিসটি খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হ’ল। কারণ বিল্ডিং-এর একটা বড় অংশ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে। মূল ভবনের শীর্ষে লেখা ‘পারভেজ মেমোরিয়াল (রিসার্চ স্কলার্স) লাইব্রেরী’। প্রবেশদ্বারের দু’পার্শ্বে ইংরেজী ও উদূর্তে লেখা ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’। স্টিলের সাধারণ দ্বিকপাট অর্ধচন্দ্রাকৃতির দরজাটি বন্ধ। অনেকক্ষণ নক করা হ’ল। তবুও কারও সাড়াশব্দ নেই। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল রবিবার সরকারী ছুটির দিন বলে অফিস বন্ধ। আমরা ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসা এক ব্যক্তি চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলল। সম্ভবত পিয়ন হবে। ভেতরে অবিন্যস্ত আঙিনায় ছড়িয়ে থাকা আসবাবপত্র দেখে একটি পোড়ো বাড়ীই মনে হয়। উন্মুক্ত বারান্দায় দাগ কাটা দেখে ধারণা হয় এটি তাদের ছালাত আদায়েরও জায়গা। পিয়ন জানায় ছুটির দিনে অফিসে কেউ নেই। তার কাছে বর্তমান অফিস ইনচার্জ ‘তুলূ-এ-ইসলাম’ পত্রিকা সম্পাদক আকরাম রাঠোরের মোবাইল নম্বর নিলাম। কিন্তু তার মোবাইলও বন্ধ পাওয়া গেল।

গুলবার্গ থেকে বের হয়ে আমরা লাহোর মডেল টাউনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আধুনিক যুগের অপর এক পরোক্ষ হাদীছ অস্বীকারকারী আলোচক ও লেখক জাভেদ আহমাদ গামেদী (জন্ম : ১৯৫২খ্রি.)-এর প্রতিষ্ঠিত আল-মাওরিদ ইনস্টিটিউট এখানে অবস্থিত। বেশ খুঁজে পেতে একটি লাল ইটের দোতলা সুরম্য ভবনে এসে বাড়ির নম্বর ৫১-কে মিলল। কিন্তু এখানেও পূর্বের মতই অবস্থা। দরজা বন্ধ। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর এক ব্যক্তি এলেন। জানালেন অফিস বন্ধ এবং জাভেদ আহমাদ গামেদী বর্তমানে কানাডা রয়েছেন। সুতরাং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হ’ল না। যদিও গবেষণার প্রয়োজনে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা ভেবেছিলাম এবং মনে মনে কিছু প্রশ্নপত্রও তৈরী করে রেখেছিলাম। সেটা আর হয়ে উঠল না। অবশেষে এই প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র ‘আল-ইশরাক’ পত্রিকার নির্বাহী সাজিদ হামিদের মোবাইল নম্বর নিয়ে ফেরত এলাম।

এরপর লাহোর মেট্রো যোগে আমরা রওনা হ’লাম শাহদারার উদ্দেশ্যে। সেখানে শু‘আইবের পূর্ব পরিচিত এক বাংলাদেশী ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হ’ল। যিনি পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ তৈরী পোষাক প্রস্ত্ততকারক প্রতিষ্ঠান নিশাত এ্যাপারেলস্-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বাড়ী কুমিল্লায়। তবে বৈবাহিক ও চাকুরী সূত্রে এখন লাহোরে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। আর সব বাঙ্গালীর মত তিনিও কথার ফাঁকে জানান যে, একসময় তিনি দেশে ফিরে যাবেন। বিদেশে প্রায় সব বাঙ্গালীই এভাবে নিজ দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকেন আজীবন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থ তাদেরকে খুব কমই এমন সুযোগ দেয়। ফলে শৈশবের স্মৃতিচারণ, দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের জন্য আফসোস আর হাহাকার তাদের আমৃত্যু সঙ্গী হয়ে থাকে। আমরা তাঁর অফিসে দুপুরের লাঞ্চ সেরে বিশাল পোষাক কারখানার আদ্যোপান্ত ঘুরে দেখলাম। ইতিপূর্বে দেশের কোন কারখানাতেও এভাবে পরিদর্শনের সুযোগ হয়নি। ফলে নতুন অনেক কিছু জানার ও দেখার সুযোগ হ’ল।

এই বাঙ্গালী ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা মেট্রোবাস যোগে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছলাম। পাকিস্তানের অন্যতম প্রাচীন এবং সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। গাছ-গাছালী ভরা সুবিশাল ক্যাম্পাস। সাম্প্রতিক বোমা হামলার কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর। আইডি কার্ড ছাড়া প্রবেশের সুযোগ নেই। তবুও কোন এক ফাঁকে ঢোকা গেল। ছাত্রদের আবাসিক হল স্যার সৈয়দ ইন্টারন্যাশনাল হল এবং আল্লামা ইকবাল হল ঘুরে দেখলাম। ব্যবস্থাপনা তেমন সন্তোষজনক মনে হ’ল না। পরে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী ও মসজিদে গেলাম। মসজিদের বিস্তৃত চত্বর ও অর্ধচক্রাকার খিলানের সারি দেখে প্রাচীন কায়রোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র ভেসে ওঠে। মধ্যএশীয় স্টাইলের তিনটি বিশাল গম্বুজ মসজিদকে অসাধারণ নান্দনিক সুষমা দান করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে একজনই বাংলাদেশী ছাত্র রয়েছে রায়হান নামে। তবে পিতার মৃত্যুর কারণে দেশে থাকায় তার সাথে সাক্ষাৎ হ’ল না।

শেষ বিকেলে মাগরিবের আগে আমরা আবার লাহোরের কেন্দ্রস্থল বাদশাহী মসজিদে এলাম। ১৬৭১ সনে মোঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের আমলে নির্মিত এই মসজিদ। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ হিসাবে স্বীকৃত ছিল। কত শত বছরেও এর আভিজাত্য, নান্দনিক কারুকাজ এতটুকু মলিন হয়নি। সূর্য ডোবার মুহূর্তে পুরো লাহোরের সৌন্দর্য যেন কেড়ে নেয় বাদশাহী মসজিদের ধূসর লাল পলেস্তারা। কত ক্যালেন্ডারের শোভা যে বর্ধন করেছে আর কত ফটোগ্রাফারের ফটোশু্যটের দৃষ্টিনন্দন মুহূর্ত হয়েছে যে এই মসজিদ, তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই। সুবিশাল ফটকের মুখে দর্শনার্থীদের ভিড়। দোতলায় একটি প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে। যেখানে নাকি রাসূল (ছাঃ)-এর লাঠি,  পাগড়ী,  চুল সংরক্ষিত রয়েছে। লাইন ধরে আবেগে টইটম্বুর মানুষ সেখানে ঢুকছে। আমরা তাদের দলে যোগ দিলাম। পুরনো পাগড়ী ও লাঠি দেখা গেল ঠিকই। কিন্তু সেগুলো রাসূল (ছাঃ)-এর কিনা, তার কি প্রমাণ রয়েছে এবং কিভাবে এগুলি এই সুদূর পাকিস্তানে এল? এর কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ফলে অন্যদের কাছে নিদর্শনগুলো যে পরম ভক্তির নৈবেদ্য পেল, তার কিছুই আমাদের স্পর্শ করল না।

নীচে নেমে বাদশাহী মসজিদের সুবিশাল উন্মুক্ত চত্বরে দাঁড়িয়ে মুওয়ায্যিনের গগণবিদারী আযানের কাপা কাপা সমধুর সুর শুনি। ছালাতান্তে মসজিদের অলিন্দে পা ঝুলিয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ। আধো আধো আলোয় সম্মুখের সুবিশাল চত্বরে মানুষের হাঁটাচলা দেখি আর আসমানের তারা গুনি। মাঝে মাঝেই কল্পনার জগতে ডুবে যাওয়া আমার প্রিয়তম অভ্যাস। প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে পরমাত্মার দৃষ্টিতে জগতের প্রাণস্পন্দন দেখার সে আনন্দ অনির্বচনীয়। আমি তন্ময় হয়ে সেই মোহনীয় সুধা উপভোগ করি। শু‘আইব এসে পাশে বসে। ওর সাথে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে সামনে পা বাড়াই।

মসজিদের বাইরে আযাদী স্কয়ার সংলগ্ন আলো ঝলমলে ইকবাল পার্ক ও মিনারে পাকিস্তানে অসংখ্য মানুষের মিলনমেলা। পার্কের মধ্যখান দিয়ে বয়ে চলা পানির নহরে অসংখ্য ফোয়ারার উচ্ছল আনাগোনা। রং-বেরঙের সেই ফোয়ারার এ্যাক্রোব্যাটিক নাচন বিমুগ্ধ করে। সেখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা ইউইটি ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। রাতেই ইসলামাবাদ ফিরতে হবে। রাত এগারোটার দিকে শু‘আইবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লাহোর রেলওয়ে সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ডে এলাম। সেখান থেকে স্কাইওয়েজের একটি কোচে ফিরলাম ইসলামাবাদ। এভাবেই শেষ হ’ল দু’দিনের সংক্ষিপ্ত লাহোর সফর। ফালিল্লাহিল হামদ







তাওহীদের এক চারণগাহ তাওহীদাবাদে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আমীরে জামা‘আতের নেতৃত্বে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে শিক্ষা সফর - ড. নূরুল ইসলাম
ঝিলাম-নীলামের দেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
বালাকোটের রণাঙ্গনে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
কোয়েটার ঈদস্মৃতি - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মালদ্বীপের পথে - আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল
মসজিদুল হারামে ওমরাহ ও ই‘তিকাফ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
মালয়েশিয়ায় কয়েকদিন - আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল
দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চলে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আরও
আরও
.