পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । শেষ পর্ব ।
ভূমিকা : নিকট অতীতে যেসকল সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ তা‘আলা স্থায়ী প্রসিদ্ধি দান করেছেন এবং স্বীয় বান্দাদের অন্তরে তাঁদের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন সৌভাগ্যবান হ’লেন ইমাম, আল্লামা, মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (মৃঃ ২২ জুমাদাল আখেরাহ ১৪২০ হিঃ, ২.১০.১৯৯৯ ইং)। আল্লাহ তাঁর অসীম দয়ায় তাঁকে আবৃত্ত করুন। যার দ্বারা অসংখ্য মানুষ উপকৃত হয়েছেন। তাদের সংখ্যা স্রেফ আল্লাহ-ই জানেন। পাঁচ ডজনের কাছাকাছি গ্রন্থ তিনি ইলমী উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে গেছেন, যেগুলি মুদ্রিত হয়েছে। তন্মধ্যে ‘সিলসিলাতুল আহাদীছ আছ-ছহীহা’ সাত খন্ডে ও ‘সিলসিলাতুল আহাদীছ আয-যঈফা’ চৌদ্দ খন্ডে সমাপ্ত। কিছু ভলিউম দুই, তিন খন্ডে বিভক্ত। এভাবে এই সিলসিলা বৃহদায়তন ত্রিশ খন্ডে সমাপ্ত। ‘ইরওয়াউল গালীল ফী তাখরীজি আহাদীছি মানারিস সাবীল’ আট খন্ডে রচিত। এগুলি ব্যতীত আরো গ্রন্থ রয়েছে।
শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ ছাড়া অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও প্রায় চার ডজনের বেশী। তাঁর ফাতাওয়াসমূহও ত্রিশ খন্ডে সংকলিত হয়েছে, যা প্রকাশিতব্য।
হযরত ইমাম শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর ছাত্ররা তাঁর পবিত্র জীবন এবং তাঁর চিন্তাধারার সমর্থনে ও প্রতিরক্ষায় যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং সেগুলি মুদ্রিত হয়ে (মানুষের) হস্তগত হয়েছে, তার সংখ্যা ৭৪। মুসলিম বিশ্বের নামী-দামী ব্যক্তিগণ তাঁর সম্পর্কে যে প্রশংসা করেছেন, সেগুলি স্বয়ং এক বৃহৎ রেজিস্ট্রার। অপ্রকাশিত ও উর্দূতে লিখিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধসমূহ এর চেয়ে বেশী।
এজন্য যদি বলা হয় যে, নিকট অতীতে দ্বীনে হানীফ-এর যতটুকু খেদমত শায়খ আলবানী (রহঃ) আঞ্জাম দিয়েছেন এবং সেগুলির উদ্ধৃতি দিয়ে যা কিছু লেখা হয়েছে তা অন্যের ভাগ্যে কমই জুটেছে, তবে অত্যুক্তি হবে না।
কোন বড় মানুষ সম্পর্কে তিন শ্রেণীর লোক থাকে-
(১) তার প্রতিটি কথাকে গ্রহণকারী এবং তার স্তুতি ও প্রশংসাকারী।
(২) তার প্রতি হিংসা পোষণকারী ও মানুষদেরকে তার প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী।
(৩) উদারপন্থী ও মধ্যমপন্থী, যারা তার ভাল দিকগুলির স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং এটাও মনে করেন যে, মানুষ হওয়ার দরুন তার ভুলও হ’তে পারে। সুতরাং তার ভাল কর্ম ও অপরিসীম খেদমতের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা একে স্রেফ সমালোচনা ও পর্যালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ত বানান না। অবশ্য তার ভুলগুলি সম্পর্কে সতর্ক করার ব্যাপারে তারা কোন দ্বিধা-সংকোচ করেন না। বরং জ্ঞানী-গুণীদের দায়িত্ব হ’ল, সাধারণ জনগণকে এরূপ ভুলসমূহ সম্পর্কে সাবধান করে দেয়া এবং হক ও ইনছাফের সাথে ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর পথে দিকনির্দেশনা দান করা। আমাদের পূর্বসূরীদের এটিই পথ ও পন্থা। আর এটিই শান্তির পথ।
শায়খ আলবানী (আল্লাহ তাঁর কবরকে আলোকিত করুন) সম্পর্কেও অনেকটাই এরকম ঘটেছে বলে মনে হয়। তাঁর প্রশংসাকারীদের সংখ্যাও অনেক। আর তাঁর প্রতি বিদ্বেষ-পোষণকারী ও তাঁর সমালোচনাকারীরাও তাঁকে ছেড়ে কথা বলেননি এবং তাঁর ভাল দিকগুলিকে খারাপে পরিবর্তিত করে দিতে এক মিনিটও দেরী করেননি। সুনানে আরবা‘আর ভাগ : ছহীহ আবূদাঊদ, ছহীহ তিরমিযী, ছহীহ নাসাঈ, ছহীহ ইবনু মাজাহ এবং যঈফ আবূদাঊদ, যঈফ তিরমিযী, যঈফ নাসাঈ, যঈফ ইবনু মাজাহ; অনুরূপভাবে ছহীহ আদাবুল মুফরাদ, যঈফ আদাবুল মুফরাদ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, যঈফ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, ছহীহুল জামে‘, যঈফুল জামে‘ ঐ সকল আলেমদের দৃষ্টিতে মোটেও সহ্য হয় না।
তাঁর সমালোচকদের মধ্যে শু‘আইব আরনাঊত্বও রয়েছেন, যিনি আরব বিশ্বের প্রসিদ্ধ আলেম ও মুহাক্বিক্ব। বরং শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর সাথে তাঁর বংশগত সম্পর্কও রয়েছে। শায়খ শু‘আইবের যোগ্য ছাত্র ইবরাহীম যীবাক্ব তাঁর জীবনী ও ইলমী খেদমত সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেটি المحدث العلامة الشيخ شعيب الارناؤط : سيرته في طلب العلم وجهوده في تحقيق التراث নামে বৈরূতের দারুল বাশাইর আল-ইসলামিয়া থেকে প্রকাশিত হয়ে আগ্রহীদের হাতে হাতে ঘুরছে। এই বইয়ের একটি অংশে শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর তাহক্বীক্বসমূহ সম্পর্কে কিছু সমালোচনামূলক কথা রয়েছে। গ্রন্থটির সেই অংশটির উর্দূ অনুবাদ করাচীর ‘মাসিক বাইয়েনাত’ পত্রিকার ৭৭তম বর্ষ ৮ম সংখ্যায় (শা‘বান ১৪৩৫ হিঃ/জুলাই ২০১৫) প্রকাশিত হয়েছে। যেটি জামে‘আতুল উলূম আল-ইসলামিয়াহ, বিন্নূরী টাউন-এর মুখপত্র।
শায়খ
শু‘আইব মনখুলে শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন এবং হাদীছ
বিষয়ে তাঁর খেদমতের প্রশংসা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘এই সত্য প্রকাশে আমার
কোন দ্বিধা নেই যে, শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) একইসাথে তাঁর পক্ষ ও
বিপক্ষ উভয় শ্রেণীর মধ্যে হাদীছ অধ্যয়ন ও সূক্ষ্মভাবে তা তাহক্বীক্ব করার
আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করার মর্যাদা হাছিল করেছেন। বলা যেতে পারে যে,
(নিকট অতীতে) তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মিসর ও সিরিয়ায় পুনরায় হাদীছ গবেষণা
পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এই কাজের জন্য মুসলমানদের পক্ষ থেকে
তাঁকে উত্তম পুরস্কার দান করুন।[1]
উপরন্তু
তিনি বলেছেন, ‘শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর প্রিয় বিষয় হ’ল ইলমে
হাদীছ। এই ইলম চর্চা ও গবেষণায় শায়খ তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময়, প্রায় ষাট বছর
ব্যয় করেছেন। অবশ্য শায়খ এই শাস্ত্রে অন্যান্য মুহাদ্দিছদের ন্যায় মর্যাদা
অর্জন করেছেন। অর্থাৎ তাঁর থেকে ভুল ও সঠিক উভয়ই প্রকাশ পেয়েছে’।[2]
তিনি
একেবারেই সত্য বলেছেন। বড় বড় আলেমের বক্তব্যে ভুল ও শুদ্ধতার সম্ভাবনা
রয়েছে। হাদীছের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতার বিষয় হৌক বা কোন ফিক্বহী মাসআলা হৌক;
এতে কারোই সকল অভিমত সঠিক হয় না। বরং ভুল-ভ্রান্তির বিপদ ও আশঙ্কা থাকে
এবং বাস্তবে তা হয়েও থাকে। ইমাম মালেক (রহঃ) এজন্যই বলেছেন,كُلُّ أَحَدٍ
يُؤْخَذُ مِنْ قَوْلِه، وَيُتْرَكُ إِلاَّ صَاحِبَ هَذَا القَبْرِ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘প্রত্যেকের উক্তি গ্রহণ করা যায়, আবার বর্জনও
করা যায়। কিন্তু এই কবরবাসী অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ছাঃ) ব্যতীত’।[3]
আল্লামা আলবানী (রহঃ)ও মানুষ। তাঁরও ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে। স্বয়ং এই অধমও তাঁর কতিপয় ফায়ছালার সাথে একমত নন। কিন্তু শায়খ শু‘আইবও তাঁর যে সকল ভুলচুক উল্লেখ করেছেন এবং কতিপয় বিষয় তাঁর প্রতি সম্বন্ধ করেছেন, সেগুলির সাথেও ঐক্যমত পোষণ করা মুশকিল। আমরা এখানে এ সম্পর্কে কতিপয় অভিযোগ সম্মানিত পাঠকদের খেদমতে পেশ করতে চাই।
এক আশ্চর্য মতামত :
শায়খ
শু‘আইব বলেছেন, ‘তিনি তাঁর তাহক্বীক্বের আলোকে ছহীহ আখ্যাদানকৃত হাদীছসমূহ
ও সুন্নাতের দিকে দাওয়াত দিতেন। তাঁর আকাংখা ছিল যে, তাঁর তাছহীহ অনুসরণীয়
ইমামদের ইজতিহাদের সমপর্যায়ের মর্যাদা লাভ করুক এবং বিতর্কিত মাসআলাগুলিতে
তাঁর রায়-কেই চূড়ান্ত ফায়ছালা আখ্যা দেয়া হোক’।[4]
কিন্তু
এই বক্তব্য আন্দাযে ঢিল ছোঁড়া ও দলীলবিহীন দাবীর নামান্তর। আল্লামা
আলবানীর মানহাজ হ’ল الةمسك بالسنة الصحيحة (ছহীহ সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা)।
আজীবন তিনি এরই দাওয়াত দিয়ে গেছেন। স্বীয় মত-কে ‘অকাট্য ফায়ছালা’ হিসাবে
গ্রহণ করার দাওয়াত তিনি কখনো দেননি। তাঁর বক্তব্য ও দাওয়াত ছহীহ হাদীছের
উপর আমল ছিল। আর ছহীহ হাদীছ-ই তাঁর নিকটে ‘অকাট্য ফায়ছালা’ ছিল। হাদীছের
বিশুদ্ধতা বা তার উপর আমল করা হোক সবদিক থেকে এমন কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া
কঠিন, যেখানে কোন হাদীছকে মুহাদ্দিছ ইমামগণ সর্বসম্মতভাবে যঈফ বলেছেন আর
আল্লামা আলবানী তাকে ছহীহ বলেছেন। অনুরূপভাবে এমন কোন হাদীছ নেই যার উপর
আমল সর্বসম্মতভাবে পরিত্যাজ্য হয়েছে, অথচ আল্লামা আলবানী (রহঃ) তাঁর উপর
আমল করার দাওয়াত দিয়েছেন। বরং আমরা দেখি যে, সফর হ’তে প্রত্যাবর্তনের পর
মসজিদে দু’রাক‘আত ছালাত পড়ার হাদীছটি কর্ম ও বাণী উভয়ভাবেই ছহীহ। আল্লামা
আলবানী (রহঃ) বলেছেন,وظاهر الأمر يفيد وجوب صلاة القدوم من السفر في المسجد
لكني لا أعلم أحدا من العلماء ذهب إليه فإن وجد من قال به صرنا إليه .
والله أعلم ‘বাহ্যিক হুকুম দ্বারা মুসাফিরের প্রত্যাবর্তনের পরে মসজিদে
ছালাতের ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমি অবগত নই যে, আলেমদের মধ্য
হ’তে কোন আলেম একে ওয়াজিব বলেছেন। যদি এটা জানা যায় তবে ওয়াজিব হওয়ার মতটি
গ্রহণ করব। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’।[5]
বরং
শায়খ আলবানী স্বীয় ছাত্রদেরকে বলতেন, اياك ان تتكلم في مسألة ليس لك فيها
امام ‘এমন মাসআলায় কথা বলা থেকে বিরত থাক, যেখানে তোমার কোন ইমাম নেই’।[6]
মতনের সমালোচনার প্রতি দৃকপাত না করা :
শায়খ
শু‘আইব এই শিরোনামের অধীনে এটাও বলেছেন, ‘শায়খ আলবানী ইলমে মুছত্বালাহুল
হাদীছে অবশ্যই পড়ে থাকবেন যে, ছহীহ হাদীছ তাকে বলে যার সনদ (অধস্তন) রাবী
থেকে নবী করীম (ছাঃ) পর্যন্ত মুত্তাছিল (সংযুক্ত) হবে এবং সেই বর্ণনাটি
ইল্লাত[7] বা শুযূয হ’তে মুক্ত থাকবে। কিন্তু আফসোস এই যে, হাদীছের উপরে হুকুম লাগানো প্রসঙ্গে না তিনি শুযূয[8] ও ইল্লাতের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন আর না হাদীছের মতনের উপর সমালোচনা করতে গিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন’।[9]
প্রথম কথাটির ন্যায় এ কথাটিও সঠিক নয়।تمام المنة في التعليق على فقه السنة -এর ভূমিকায় যে মূলনীতিসমূহ তিনি উল্লেখ করেছেন, তন্মধ্যে প্রথম মূলনীতি এটাই রয়েছে যে, رد الحديث الشاذ (শায হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করা)। যার অধীনে তিনি ইবনুছ ছালাহ (রহঃ)-এর ‘মুক্বাদ্দামা’ ও হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-এর ‘শরহে নুখবা’র উদ্ধৃতিতে পরিষ্কারভাবে লিখেছেন যে, হাদীছের বিশুদ্ধতার জন্য শর্ত হ’ল, তা শায ও মু‘আল্লাল (ত্রুটিযুক্ত) হবে না। আমরা এখানে সেই ইবারতগুলির অনুবাদ উল্লেখ করে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করতে চাই না। আলেম ও হাদীছের ছাত্ররা স্বচক্ষে অত্র ইবারতগুলি ‘মুক্বাদ্দামা ইবনুছ ছালাহ’ ও ‘শরহে নুখবা’ এবং ‘তামামুল মিন্নাহ’ গ্রন্থের ভূমিকাতেও (পৃঃ ১৫, ১৬) দেখতে পারেন। এত পরিস্কার ও দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট বাস্তবতার বিপরীতে শায়খ শু‘আইবের এ কথা বলা যে, ‘হাদীছের উপর হুকুম লাগানোর ক্ষেত্রে আল্লামা আলবানী শুযূয ও ইল্লাতের প্রতি গুরুত্ব দেননি’- একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত। এর চেয়ে আরো বেশী কিছু উপস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। তবে আগ্রহী পাঠকগণ ‘শায’-কে খন্ডন করার উদাহরণ ‘যঈফা’ (১০/৭৫৮) গ্রন্থে দেখতে পারেন।
হাদীছের তাছহীহ[10] ও তাযঈফের[11] ব্যাপারে এই কথাটিও লক্ষণীয় যে, শায়খ আলবানী (রহঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, যখন আমাদের সামনে একজন রাবী ছিক্বাহ হবে এবং কোন ইল্লাতও জানা যাবে না, কিন্তু কোন ইমাম বা অধিকাংশ হাদীছের সমালোচক সেটাকে মুনকার বলেছেন; তাহ’লে কি বাহ্যিকভাবে সনদের বিরোধী এই হুকুম গ্রহণ করা যাবে? এর জবাবে তিনি বলেছেন, الأصل هو التسليم للعلماء المتقدمين إلا إذا ترجح أمران اثنان ‘মূলনীতি এটাই যে, পূর্ববর্তী ইমামদের কথাকে গ্রহণ করতে হবে। নতুবা দু’টি বিষয়কেই প্রাধান্য দিতে হবে’।
আপনারা চিন্তা করুন যে, আল্লামা
আলবানীর নিকটে পূর্ববর্তী ইমামদের উক্তি কতটুকু গুরুত্ববহ ছিল। উক্ত
প্রশ্নের জবাবে পরিশেষে তিনি বলেছেন,إذا كان هناك حديث اسناده صحيح لا نقول
مقتصرين فقط علي ان رجاله ثقات، لانه لا بد عن تأمل لا بد عن التدقيق فيه،
لعل في هذا الإسناد علة، فاذا ما اجتهد مجتهد فتبين له سلامة الاسناد من
علة قادحة وحينئذ يصح له أن يقول اسناده صحيح ولن يبقي امامه فيما يعكر علي
هذا التصحيح إلا قول ذاك الامام، حينئذ ينظر في قوله، فان بدا وجه اتبعه،
وإلا ظل علي التصحيح هذا الذي يبدو لي في هذا الموضوع، وهذا الذي نجري عليه
في كثير من الأحاديث- ‘যখন কোন হাদীছের সনদ ছহীহ হবে, তখন আমরা স্রেফ তার
বর্ণনারীদের ছিক্বাহ হওয়ার কারণে সেটাকে (ছহীহ) বলব না। কারণ এতে চিন্তা ও
সূক্ষ্ম গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে যে, হয়ত এই সনদের কোথাও কোন ত্রুটি থাকতে
পারে। যদি কোন প্রচেষ্টাকারীর প্রচেষ্টা করার পর তার নিকট স্পষ্ট হয়ে যায়
যে, এতে মারাত্মক ত্রুটি নেই, তখন তার জন্য এ কথা বলা সঠিক হবে যে, এর সনদ
ছহীহ। এই তাছহীহ-এর পর তার সামনে তার বিরোধী সেই ইমামের উক্তি থেকে যায়।
এমতাবস্থায় তার বক্তব্যের ব্যাপারে ভাবতে হবে। যদি তার কোন কারণ প্রতীয়মান
হয় তাহ’লে সেই ইমামের উক্তি গ্রহণ করা যাবে। নতুবা তাছহীহ-এর উপর ক্বায়েম
থাকবে। এ বিষয়ে এটাই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। আর অধিকাংশ হাদীছ সম্পর্কে
আমাদের কর্মপন্থা এটাই’।[12]
শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর এই সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারাও হাদীছের বিশুদ্ধতার জন্য ‘শায ও ‘ইল্লাত’ না থাকার শর্তের ব্যাপারে কোন অসঙ্গতি থাকে না। এজন্য শায়খ শু‘আইব তাঁর দিকে যে কথার সম্বন্ধ করেছেন, তা তাঁর ব্যাখ্যার একেবারেই উল্টো।
শায়খ
শু‘আইব এটাও অভিযোগ করেছেন যে, আল্লামা আলবানী (রহঃ) হাদীছের সমালোচনার
ক্ষেত্রে হাদীছের মতনের প্রতি গুরুত্ব দিতেন না। তিনি এমন অসংখ্য হাদীছকে
ছহীহ বলেছেন যেগুলির মতনের ব্যাপারে আলেমগণ সমালোচনা করেছেন।[13]
ঐগুলি কোন হাদীছ? এ ব্যাপারে তিনি মিশকাতুল মাছাবীহ (হা/১১২) ও ছহীহুল জামে‘ আছ-ছগীর (হা/৭১৪২) হ’তে বর্ণনা করেছেন। যার শব্দগুলি হ’ল- الْوَائِدَةُ وَالْمَوْءُودَةُ فِي النَّارِ ‘সন্তানকে জীবিত দাফনকারী মহিলা ও প্রোথিত কন্যা উভয়েই জাহান্নামে যাবে’।
বলা হয়েছে যে, এই হাদীছটি কুরআনের আয়াতوَإِذَا
الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ ‘যেদিন জীবন্ত প্রোথিত কন্যা জিজ্ঞাসিত হবে’
(তাকবীর ৮১/৮)-এর স্পষ্ট বিরোধী। যদিও শায়খ এর অপসন্দনীয় তাবীল করতে চেষ্টা
করেছেন।[14]
নিবেদন হ’ল, প্রথমে এটা দেখুন যে, আল্লামা আলবানী (রহঃ) কি উক্ত হাদীছটিকে একাই ছহীহ বলেছেন? এই হাদীছটি হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) থেকে আবূদাঊদ (হা/৪৭১৭), ছহীহ ইবনু হিববান (হা/৭৪৩৭), ত্বাবারানী ও ইমাম বুখারীর আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম ইবনু হিববান (রহঃ)-এর ‘আছ-ছহীহ’[15] গ্রন্থে উল্লেখ করা এর দলীল যে, এই হাদীছটি তাঁর নিকটে ছহীহ। ইমাম আবূদাঊদ ও আল্লামা মুনযিরী (রহঃ) এ ব্যাপারে নীরব থেকেছেন। আল্লামা আযীযীও বলেছেন, إسناده صحيح ‘এর সনদ ছহীহ’।[16] আল্লামা সুয়ূত্বী ‘আল-জামেউছ ছগীর’ গ্রন্থে একে হাসান বলেছেন। আল্লামা মুনাবী ‘ফায়যুল ক্বাদীর’ (৬/৩৭১) গ্রন্থে বলেছেন, رمز المصنف لحسنه وهو كما قال أو أعلى ‘লেখক অর্থাৎ আল্লামা সুয়ূত্বী (রহঃ) হাদীছ হাসান হওয়ার দিকে ইশারা করেছেন। তিনি যেমনটি বলেছেন ব্যাপারটা তাই বা তার চাইতে উঁচু স্তরের’।
পক্ষান্তরে ‘আত-তায়সীর বি-শারহিল জামি আছ-ছগীর’ গ্রন্থে আল্লামা মুনাবী (রহঃ) বলেছেন,واسناده صَحِيح فرمز الْمُؤلف لحسنه تَقْصِير ‘এর সনদ ছহীহ। আর লেখকের হাসান হওয়ার আলামত লাগানো ত্রুটিযুক্ত’ (২/৮৫)।
উপরন্তু এই বর্ণনাটি মাসলামা বিন ইয়াযীদ জু‘ফী (রাঃ) থেকে মুসনাদে আহমাদ (৩/৪৭৮), নাসাঈর আস-সুনানুল কুবরা (হা/১১৬৪৯), ত্বাবারানী (হা/৬৩১৯)
ইত্যাদি গ্রন্থসমূহেও বর্ণিত আছে। আল্লামা ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) বলেছেন
যে, لَيْسَ لِهَذَا الْحَدِيثِ إِسْنَادٌ أَقْوَى وَأَحْسَنُ مِنْ هَذَا
الْإِسْنَاد ‘এই সনদের চেয়ে এ হাদীছের অধিক উত্তম ও অধিক শক্তিশালী সনদ আর
নেই’।[17]
আল্লামা হায়ছামী এ সম্পর্কে বলেছেন, رجاله رجال الصحيح ‘এর রাবীগণ ছহীহ গ্রন্থের রাবী’।[18]
বরং
স্বয়ং শায়খ শু‘আইবও মুসনাদে আহমাদ-এর তাহক্বীক্বে বলেছেন যে, ‘এই হাদীছের
রাবী ছিক্বাহ (বিশ্বস্ত) ও শায়খায়নের (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের) রাবী,
দাঊদ বিন আবী হিন্দ ব্যতীত। তিনি শুধু ছহীহ মুসলিমের রাবী।[19]
এ আলোচনার মাধ্যমে এ কথাটি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সনদের দিক থেকে এই বর্ণনাটি ছহীহ। আর আল্লামা আলবানী একাই একে ছহীহ বলেননি। অবশ্য শায়খ শু‘আইব হাদীছের মতনের মধ্যে নাকারাত[20] অবগত হয়েছেন। কারণ যেসব হাদীছে জীবন্ত দাফনকৃত কন্যার জান্নাতী হওয়ার উল্লেখ রয়েছে, সেগুলি এর বিপরীত। আর এই হাদীছটি কুরআনের আয়াতوَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ এরও বিরোধী। মুসনাদে আহমাদের তাহক্বীক্বে এজন্য হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িমের طريق الهجرتين وباب السعادتين গ্রন্থটি অধ্যয়ন করার প্রতিও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এই অভিযোগটি মূলতঃ হানাফী মূলনীতির আলোকে করা হয়েছে যে, দু’টি পরস্পর বিরোধী বর্ণনার মধ্যে প্রথমত: এই শর্তে রহিত হয় যে, উভয়ের মধ্যে কোন্টি পূর্বের ও কোন্টি পরের তা প্রতীয়মান হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত: তারজীহ[21] দেওয়া। যদি দু’টি ব্যাখ্যার মধ্যে তারজীহ দেওয়ার কোন পথ না থাকে তবে তৃতীয়ত: উভয়ের মধ্যে সমতা বিধান করা হবে। যদি সমতা বিধানেরও কোন পথ না থাকে তবে চতুর্থত: উভয়ের হুকুম বাতিল হয়ে যাবে। শায়খ শু‘আইব এখানেও দু’টি বর্ণনার মধ্যে পরস্পর বৈপরীত্যের ভিত্তিতে তারজীহ-কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং প্রোথিত কন্যার জান্নাতী হওয়ার বর্ণনাগুলিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
কিন্তু এটি
মুহাদ্দিছীনে কেরামের মূলনীতি নয়। তাঁরা প্রথমে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন।
যদি সমন্বয় সাধন সম্ভব না হয় তবে দ্বিতীয় পন্থা হিসাবে উভয়টির মধ্যে শেষ
বর্ণনা কোনটি তা জানা গেলে সর্বশেষ বর্ণনাটিকে নাসেখ (রহিতকারী) আখ্যা দেন।
আর যদি এটাও জানা না যায় তবে তৃতীয় অবস্থা ‘রাজেহ’ ও ‘মারজূহ’ (অবশিষ্ট)
থাকে। যদি তারজীহ বা প্রাধান্য দেওয়ারও কোন পথ না থাকে তবে সিদ্ধান্ত
প্রদান থেকে বিরত থাকেন। যেমনটি হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) শরহে নুখবাতুল
ফিকার গ্রন্থে (পৃঃ ৫৮, ৫৯) স্পষ্টভাবে বলেছেন। শায়খ আলবানী (রহঃ)
মুহাদ্দিছীনে কেরামের অবস্থানেরই যিম্মাদার। তিনি প্রথমত: দু’টি ছহীহ
হাদীছের মধ্যে সমতা বিধানেরই প্রবক্তা। তার বক্তব্যগুলি নিম্নরূপ-لا يجوز
رد الحديث الصحيح بمعارضته لما هو أصح منه، بل يجب الجمع والتوفيق بينهما
‘ছহীহ হাদীছকে তার চাইতে অধিক বিশুদ্ধ হাদীছের সাথে পরস্পর বিরোধী হওয়ার
ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করা জায়েয নয়। বরং উভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করা
যরূরী’।[22]
এই মূলনীতি অনুসরণ করতে গিয়ে আল্লামা আলবানী (রহঃ) উভয় হাদীছ-যেগুলিকে পরস্পর সাংঘর্ষিক বলা হচ্ছে-এর মধ্যে সমতা বিধানের চেষ্টা করেছেন এবং বলেছেন,
ثم إن ظاهر الحديث ان الْمَوْءُودَةَ في النار ولو لم تكن بالغة، وهذا خلاف ما ةقةضيه نصوص الشريعة أنه لا تكليف قبل البلوغ وقد أجيبت عن هذا الحديث بأجوبة اقربها عندي الي الصواب ان الحديث خاص بمَوْءُودَة معينة، وحينئذ الও في الْمَوْءُودَة ليست لاستغراق بل للعهد، ويؤيده قصة ابني مليكة، وعليه فجائز ان تلك الْمَوْءُودَة كانت بالغة فلا إشكال، والله اعلم.
‘এই
হাদীছটির বাহ্যিক দাবী এই যে, প্রোথিত কন্যা জাহান্নামে যাবে। যদিও সে
বালেগা না হয়। কিন্তু এই বাহ্যিক মর্ম শরী‘আতের দলীল বিরোধী যে, বালেগা
হওয়ার পূর্বে কেউ শরী‘আতের বিধান মানতে আদিষ্ট নয়। আর এই হাদীছটির বিভিন্ন
জবাব প্রদান করা হয়েছে। তন্মধ্যে আমার নিকটে সর্বাধিক বিশুদ্ধ জবাব হ’ল এই
হাদীছটি একজন নির্দিষ্ট প্রোথিত কন্যা সম্পর্কে প্রযোজ্য। আর তখন
الْمَوْءُودَة এর মধ্যে ال ইসতিগরাক্ব (সমষ্টিবাচক)-এর জন্য নয়। বরং আহদে
যিহনীর (নির্ধারিত একজনের) জন্য। মুলায়কার পুত্রদের ঘটনার হাদীছটি দ্বারা
এর সমর্থন পাওয়া যায় (যা সালামাহ বিন ইয়াযীদ জু‘ফী হ’তে বর্ণিত)। এজন্য এ
কথা বলা সিদ্ধ যে, সেই প্রোথিত কন্যাটি বালেগা তথা প্রাপ্তবয়স্কা ছিল। আর
এভাবেই এই হাদীছটির উপর উত্থাপিত অভিযোগ দূরীভূত হয়ে যায়। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’।[23]
শায়খ শু‘আইব আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর এই সমন্বয় সাধনের সাথে একমত নন। তিনি একে ‘অপসন্দনীয় তাবীল’ আখ্যা দিয়েছেন। আমরা আরয করেছি যে, শায়খ শু‘আইব ‘তারজীহ’-এর মূলনীতি জানার কারণে এসব কথা বলেছেন। পক্ষান্তরে মুহাদ্দিছ আলবানী (রহঃ) মুহাদ্দিছদের পন্থায় সমতা বিধানের চেষ্টা করেছেন। শায়খ শু‘আইব যদি এই সমতা বিধানের সাথে একমত না হন, তাহ’লে এর পরিবর্তে হাদীছের ব্যাখ্যাকারগণ এর আরো অনেকগুলি ব্যাখ্যাও উল্লেখ করেছেন। যেমন একটি ব্যাখ্যা এই যে, وائدة দ্বারা دائيه উদ্দেশ্য; যে দাফনকারী। আর اَلْمَوْءُودَة দ্বারা অর্থাৎ তার মা উদ্দেশ্য। আর لها اَلْمَوْءُودَة -এর উহ্য ছেলাহ।
আরো একটি ব্যাখ্যা এটাও রয়েছে যে, اَلْمَوْءُودَة দ্বারা নির্দিষ্ট দাফনকৃত কন্যা উদ্দেশ্য। সে বালেগা হোক বা নাবালেগা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহীর মাধ্যমে তার সম্পর্কে আল্লাহর নির্ধারিত ফায়ছালা ও তাক্বদীরের সংবাদ দিয়েছেন। আর اَلْمَوْءُودَة-এর اَلْ সমষ্টিবাচকের জন্য নয়। (বরং) নির্দিষ্ট দাফনকৃত কন্যা সম্পর্কে। এই ব্যাখ্যাগুলির বিস্তারিত আলোচনা মিরক্বাত (১/১৮২, ১৮৩), মির‘আতুল মাফাতীহ (১/২০০), ‘আওনুল মা‘বূদ (৪/৩৬৬), ছান‘আনীর আত-তানবীর শরহে জামে ছগীর (১১/১১০), ফায়যুল ক্বাদীর (৬/৩৭১), শরহে ত্বীবী (১/২৬৩, ২৬৪), ইবনুল মালেক রূমীর শরহে মাছাবীহুস সুন্নাহ (১/১২৯), বায়যাবীর তুহফাতুল আবরার শরহে মাছাবীহুস সুন্নাহ (১/১১০), আল-মাফাতীহ ফী শরহে মাছাবীহ (১/২১৮), লুম‘আতুত তানক্বীহ (১/১৭৯), আশি‘আতুল লুম‘আত (১/১০৬) ইত্যাদি গ্রন্থসমূহ দেখা যেতে পারে।
এর দ্বারা এ কথাটিও প্রতীয়মান হয়ে যায় যে, এ সকল আলেমগণও اَلْمَوْءُودَة-এর সাথে সম্পর্কিত বর্ণনাগুলির ক্ষেত্রে জমাকরণ ও সমন্বয় সাধনের পন্থাটি-ই অবলম্বন করেছেন। আর এই অবস্থানটিই আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর। এ ক্ষেত্রেও তিনি একক নন। যেমনটি শায়খ শু‘আইবের উক্তি দ্বারা বুঝা যায়।
আমরা তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী ইবনুল ক্বাইয়িমেরطريق الهجرتين গ্রন্থটিও দেখেছি, যেখানে তিনি মুশরিকদের সন্তানদের ব্যাপারে আটটি মাসলাক উল্লেখ করেছেন। যেখানে শায়খ শু‘আইবের অবস্থানের বিপরীতে তিনি এই মাসলাক ও অবস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যে, ক্বিয়ামতের দিনে তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। বরং اَلْمَوْءُودَة (জীবন্ত দাফনকৃত কন্যা) এবং যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি তাদের সকলের পরীক্ষা নেওয়া হবে। তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করা হবে। যে তাঁর আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে যাবে। আর যে নাফারমানী করবে সে জাহান্নামে যাবে। তিনি আরো বলেছেন, وبهذا يتألف شمل الأدلة كلها وتتوافق الأحاديث ‘এভাবে সকল দলীল পরস্পর মিলে যায় এবং হাদীছগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয় যায়’ (পৃঃ ৫২১)।
নিন
জনাব! শায়খ শু‘আইব প্রদত্ত পরামর্শের ফলাফলের ভিতরেও সমতা বিধানের ছুরত
বের হ’ল। ত্বরীকুল হিজরাতায়ন গ্রন্থটি-ই নয়, তাহযীবুস সুনান গ্রন্থেও (৭/৮৭)
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) এই অবস্থাকে সঠিক ও ‘সর্বাধিক ন্যায়সংগত
মতামত’ আখ্যা দিয়েছেন। আর হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)-এর হাদীছকে সকল
প্রোথিতকারী কন্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য গণ্য করেননি। তিনি স্বীয় পসন্দকৃত
ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলেছেন, هى فى النار ما لم يوجد سبب يمنع من دخولها
النار ‘জীবিত প্রোথিত কন্যা জাহান্নামে যাবে। যতক্ষণ না তার জাহান্নামে
যেতে বারণকারী কোন কারণ পাওয়া যাবে’।[24]
আর আখেরাতে তার পরীক্ষা নেওয়াটাই হ’ল সেই কারণ। উপরন্তু তিনি বলেছেন, ‘যখন জীবিত প্রোথিতকারীকে প্রশ্ন করা হবে যে, কোন্ অধিকারে তুমি এরূপ করেছ? তাকে এই পাপের কারণে আযাব দেয়া হবে। তাহ’লে প্রোথিতকে গুনাহ ব্যতীত কেন আযাব দেওয়া হবে? তার গুনাহ তার পরীক্ষায় রাসূলের নাফরমানীর ফলস্বরূপ হবে’।
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম-ই নন; বরং হাফেয ইবনু হাজারও এটাই বলেছেন যে, তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। যেমনভাবে ছহীহ হাদীছসমূহে পাগল ও নবী আসার বিরতিকালীন সময়ে মৃত্যুবরণকারীদের সম্পর্কে পরীক্ষা করার কথা উল্লেখ আছে। অতঃপর ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,انه المذهب الصحيح ‘এটাই ছহীহ মাযহাব’।
আল্লামা নববী (রহঃ)ও বলেছেন যে, ‘এটাই ছহীহ মত। মুহাক্কিক্ব আলেমগণ এই মতই গ্রহণ করেছেন’।[25]
আমাদের এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুহাক্কিক্ব আলেমগণও এই হাদীছগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের পদ্ধতিকেই গ্রহণ করেছেন। আর এটা শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর অবস্থান। যদিও পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং শায়খ শু‘আইব যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন তা মুহাদ্দিছদের মূলনীতি মোতাবেক নয়। আর তিনি শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর উপর যে অপবাদ আরোপ করেছেন সেটাও নিশ্চিতরূপে সঠিক নয়।
(চলবে)
[1]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩০,৩১।
[2]. ঐ, পৃঃ ৩১, ৩২।
[3]. আস-সিয়ার ৮/৯৩।
[4]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩১।
[5]. আছ-ছামারুল মুসতাত্বাব ২/৬২৮।
[6]. জুহূদুল ইমাম আলবানী ৩/২৪৩।
[7]. ইল্লাত বলা হয় এমন গোপন ত্রুটিকে যা হাদীছকে দুর্বল করে দেয়। যা বাহ্যিকভাবে পরিদৃষ্ট হয় না। বরং লুক্কায়িত থাকে। দক্ষ মুহাক্কিক্ব ব্যতীত যা অন্যরা বুঝতে সক্ষম নন। যে হাদীছের মধ্যে ইল্লাত (ত্রুটি) বিদ্যমান তাকে ‘মুআল্লাল’ (ত্রুটিযুক্ত) বলা হয়।-অনুবাদক।
[8]. শায-এর বহুবচন হ’ল শুযূয। শায-এর আভিধানিক অর্থ হ’ল- জমহূর তথা অধিকাংশের বিরোধী হওয়া। পরিভাষায়- কম আস্থাভাজন রাবী যদি তার চাইতে বেশী আস্থাভাজন রাবীর বিপরীত বর্ণনা করেন তবে তুলনামূলক কম আস্থাভজন রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীছটিকে শায বলা হয়।-অনুবাদক।
[9]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩৩।
[10]. হাদীছকে ছহীহ হিসাবে আখ্যায়িত করাকে তাছহীহ বলা হয়।-অনুবাদক।
[11]. হাদীছকে যঈফ হিসাবে আখ্যা দেওয়াকে তাযঈফ বলা হয়।-অনুবাদক।
[12]. সুওয়ালাত লিল-আল্লামা আলবানী সাআলাহা আবূ আব্দুল্লাহ আল-আয়নাইন, পৃঃ ১৫১।
[13]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩২।
[14]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩২।
[15]. এই গ্রন্থটি ছহীহ ইবনু হিববান নামে প্রসিদ্ধ। এতে ৭৪৯১টি হাদীছ রয়েছে।-অনুবাদক।
[16]. মির‘আতুল মাফাতীহ ১/২০০।
[17]. আত-তামহীদ ১৮/১২০।
[18]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১/১১৯।
[19]. মুসনাদে আহমাদ ২৫/২৬৮।
[20]. যঈফ হাদীছ ছহীহ হাদীছের বিরুদ্ধে যাওয়াকে নাকারাত বলা হয়। সেক্ষেত্রে যঈফ হাদীছটিকে ‘মুনকার’ ও ছহীহ হাদীছটিকে ‘মারূফ’ বলা হয়।-অনুবাদক
[21]. তারজীহ অর্থাৎ অগ্রাধিকার দেওয়া। যখন দু’টি গ্রহণযোগ্য হাদীছ পরস্পর বিরোধী অবস্থানে থাকে তখন উভয়ের মধ্য হতে কোন একটিকে অগ্রাধিকার প্রদান করাকে ‘তারজীহ’ বলা হয়। যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে তাকে ‘রাজেহ’। আর যার উপরে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তাকে ‘মারজূহ’ বলা হয়।-অনুবাদক।
[22]. ছহীহা হা/৪৬০।
[23]. হাশিয়াতুল মিশকাত নং ৪০
[24]. তরীকুল হিজরাতইন, পৃঃ ৫১৯।
[25]. ফাৎহুল বারী, ৩/২৪৬, ২৪৭।