পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকের কথা। গোবিন্দগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। ইতিমধ্যে অজ মফঃস্বলেও ভাষা আন্দোলনের ঢেউ লেগেছে। আন্দোলনমুখী আজকের এই মানুষটি আমিও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায়। মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে কয়েকজন সহপাঠী বন্ধুসহ থানা হাজতেও কিছু সময় কাটাতে হয়েছে। যাক, সে অনেক কথা। কথা বললে ভুল হবে। সেটা সেদিনের অজপল­ী (আজকের আলোকিত) গোবিন্দগঞ্জের অতীত। প্রসঙ্গ সেটা নয়।

কিন্তু শিরোনামে উলে­খিত প্রসঙ্গে কিছু লিখতে যাওয়ার আগে সে সময়ের জনৈক কবি বরের দু’টি ছত্র উলে­খ না করে স্বস্তি পাচ্ছি না। কবি আক্ষেপ করে নিজেকে নিয়ে ব্যাঙ্গোক্তি করে বলেছেন,

ভেবেছিলাম আমি হবো মস্ত বড় কবি,

কিন্তু লিখতে বসলেই অক্ষরগুলো এলোমেলা হয় সবই।

কবির দশা আমার চলি­শা। এই অক্ষরগুলো এলোমেলো হয়ে যাওয়ার চাইতেও আমার জন্য আরও একটি বড় প্রতিবন্ধক হ’ল লেখা-লেখিতে আলসেমির দারুণ প্রভাব আমার উপর কার্যকর। আমার স্কুলের স্বনামধন্য শ্রদ্ধাভাজন প্রাক্তন শিক্ষক বাবু সত্য নারায়ণ কর আমাকেসহ আমার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহপাঠীকে বড় নির্মম সত্য উচ্চারণে আখ্যায়িত করতেন, ‘আলসের জাসু আর কুঁড়ের বাথান’ হিসাবে। পরবর্তীতে কর্মজীবনে প্রবেশ করে দীর্ঘদিন ইউরোপ ও এশিয়ার কয়েকটি দেশ ভ্রমণের সুযোগ পাই। ফলশ্রুতিতে দেশে-বিদেশে অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবেরও সৃষ্টি হয়। দেশে ফিরে আসার পর সেই সকল বন্ধুরা আমাকে স্মরণ করে একের পর এক পত্রাঘাত করতে থাকে। পত্র প্রাপ্তির পর বন্ধুদের স্মৃতি চরচর করে অন্তরের গহীনে মাথাচাড়া দেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি সেই রাতেই বন্ধুর পত্রের জবাবটা লিখে ফেলবো। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আলসেমিই আমার উপর প্রবল প্রভাব বিস্তারে পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করে। ফলে কিছুদিন একতরফা ভালোবাসা বিতরণের পর বন্ধুরা সর্ব প্রকার পত্রালাপ একদম বন্ধ করে দেয়। বিষয়টা জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় অন্তরে বেজায় বাজছে।

কিন্তু না, মাসিক আত-তাহরীক প্রসঙ্গে হিজিবিজি হ’লেও কিছু একটা লিখতেই প্রাণটা বেজায় তাগাদা দিচ্ছে। আমি পাঠক হিসাবে নাকি একনিষ্ঠ। অনেক বন্ধু, অনেক গুরুজনকেই এমনটা বলতে শুনেছি আড়ালে-আবডালে। এমনকি সমালোচকও নাকি আমি কঠোর। তবে ওরা জানে না যে আমি সমালোচনায় মুখর হ’লেও লেখা-লেখীতে অথর্ব। আমাকে কথা বলতে বলুন, ঘন্টার পর ঘন্টা এমনকি দিনের পর দিন বকবক করেও আমার কথা শেষ হ’তে চায় না। আবার সেই রম্য কবির ভাষায়ই বলতে হয়,

হ’তে পারতাম মস্তবড় বীর

কিন্তু গোলাগুলির মাঝে গেলেই মাথা রয়না স্থির।

অতএব উপায় নেই গোলাম হোসেন, আমাকে দু’কলম লিখতেই হবে। তবে একটি ধ্রুব সত্য কথা বলে রাখি ‘যা কেবল সত্য ও সুন্দর, যা কেবলই ভালো আর ভালো, তা নিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক বড় অবয়বে লেখা আসলেই খুব কঠিন’। মানবকূল শ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে ৮ম শ্রেণীতে পড়াকালীন হেড মাওলানা নাযীর হোসাইন ছাহেব আমাকে রচনা লিখতে দিয়েছিলেন। শুধু আমাকে নয় আরও অনেক সহপাঠীকেও এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল ঘোষিত ২০ নম্বরের সবটুকু আমিই পাবো। হ্যাঁ, আমি সবার চেয়ে বেশী অর্থাৎ ১৫ নম্বর পেয়েছিলাম। মাওলানা ছাহেব বললেন, কীরে ‘নূরু’ (আমার ডাক নাম) তুই ইসলামী কেতাব এতো পড়িস অথচ হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে মাত্র এই এক পৃষ্ঠার রচনা তোর কাছে আশা করিনি। তুই আমাকে নিরাশ করেছিস। কিন্তু কেন? শিক্ষকের কাছে এ ‘কেন’ এর কি জবাব দেব ভেবে পাচ্ছি না। হঠাৎ একটি দারুণ মুখরোচক জবাব আমার ছোট্ট মাথায় এসে গেলো। বললাম, অন্যরাওতো আমার চাইতে বেশী লিখেনি। তিনি বললেন, ওরাতো কেউই ৮ নম্বরের বেশী পায়নি। তবে হ্যাঁ, লেখাটা তোর ছোট হ’লেও রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্রের সবচেয়ে উলে­খযোগ্য, অনুসরণীয়, অনুকরণীয় এবং অতি মূল্যবান বিষয়গুলো কিন্তু তোর লেখায় উঠে এসেছে। স্যারের মন্তব্যে গদগদ হয়ে নিজেরও অজান্তে একটি মন্তব্য করেছিলাম। ‘স্যার! খারাপ লোকের তথা নষ্ট চরিত্রের লোকদের সম্পর্কে অনেক কথা লিখে কাগজের পাতা ভরপুর করা যায় বটে, কিন্তু নির্ভেজাল নিষ্কলংক ভালো মানুষের ক্ষেত্রে একটিই মাত্র কথা উচ্চারণ উপযুক্ত তা হ’ল, ভালো, খুউব ভালো, অতি উত্তম। মাওলানা ছাহেব সেদিন আমার এই মন্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে আমাকে করেছিলেন গর্বিত, আনন্দিত। কিন্তু আজ! পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই আমি নির্ধারিত পাঠ্য তালিকার বাইরের বই বেশী বেশী পড়তে আকৃষ্ট আর অভ্যস্ত হয়ে উঠি। এর পেছনে যে কারণটি তা হ’ল তৎকালীন সময়ে স্বনামধন্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক নাসিরুদ্দিন সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘মাসিক মোহাম্মদী’ এবং অপর চৌকষ ও ন্যায়বাদী আলেমে দ্বীন আব্দুল­াহেল কাফী আল-কোরায়েশী সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘মাসিক তর্জুমানুল হাদীছ’-এর নিয়মিত পাঠাভ্যাস।

এরপর দীর্ঘ প্রায় ৪/৫ দশক পেরিয়ে গেল। এ সময়ে বিদেশী কিছু নামী-দামী পত্র-পত্রিকা, জার্নাল পাঠের সুযোগ হ’লেও দেশীয় তেমন কোন মননশীল সাহিত্য সমৃদ্ধ পত্র-পত্রিকা হাতে পাইনি। দীর্ঘ খরার পর পঞ্চাশের দশকে নিজের মধ্যে যে উদ্যমী সুপাঠকের সৃষ্টি হয়েছিল তার যখন মুমূর্ষু দশা, ঠিক সেই সংকটকালে এক শুভ মুহূর্তে আমার হাতে আসে মাসিক আত-তাহরীক। প্রথম পাঠ শুরু করেই পর পর দু’বার এপার ওপার পাঠ করলাম এর সম্পাদকীয়। তারপর রুদ্ধশ্বাস পাঠে প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত যাকে বলে এ টু জেড পড়া শেষ করে মনে হ’ল এ যেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞায়িত কোন ছোট গল্প। যেমন বিশ্বকবি বলেছেন,

ছোট প্রাণ ছোট কথা

ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা,

নাহি বর্ণনার ছটা,

নাহি ঘটনার ঘনঘটা,

নাহি তথ্য নাহি উপদেশ,

অন্তরে অতৃপ্তি রবে,

সাংগ করে মনে হবে,

শেষ হয়েও হইল না শেষ।

এক্ষেত্রে বিষয়বস্ত্তর ভিন্নতা থাকলেও আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের আলোকে সাহিত্যরসের ক্ষেত্রে এক কাতারে বিচার করা যায়। আমার বরাবরের লালিত ধ্যান-ধারণা আমূল পাল্টে গেল আত-তাহরীকের সম্পাদকীয় পাঠে। কারণ আরবী ভাষায় বা সাহিত্যে শিক্ষিত ব্যক্তি তথা মাওলানা ছাহেবদের বাংলা ভাষা প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠযোগ্য প্রতীয়মান হয় না। ভাষা সংগ্রামের সূচনা লগ্নে গোবিন্দগঞ্জের মত একটি অজপল­ী এলাকায় ভাষা সংগ্রামে ক্ষুদে সংগ্রামীদের নেতৃত্বও দিয়েছি। কিন্তু জীবনের পড়ন্ত বেলায় সেই বাংলা ভাষাটি নিজেই শুদ্ধ ও সঠিক উচ্চারণে বলতে ও লিখতে প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছি। এটা বড়ই লজ্জার, বড়ই কলংকের। এখন এক এক করে মাসের পর মাস যায় আর তৃষ্ণাকাতর চাতকের ন্যায় অপেক্ষায় থাকি আত-তাহরীকের পরবর্তী সংখ্যাটি হাতে পাওয়ার জন্য। পাওয়া মাত্র রুদ্ধশ্বাসে প্রথমেই পাঠ করি সম্পাদকীয়। এক সংখ্যার সম্পাদকীয়ের সাথে অন্য সংখ্যার সম্পাদকীয়ের বিপুল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গুণে-মানে, সাহিত্যরসে, বাচনভংগির উৎকর্ষতায় মনে প্রশ্ন জাগলো ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল­াহ আল-গালিব কি তাহ’লে বাংলা ভাষা-সাহিত্যে ডক্টরেট করেছেন? না, বরং তিনি আহলেহাদীছ আন্দোলন বিশারদ হয়ে এর উপর বিশাল মাপের থিসিস করেছেন। অথচ বাংলা ভাষা-সাহিত্যে এই অভূতপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব ব্যুৎপত্তির উৎস কোথায়? উপলব্ধিতে কষ্ট হয় না যে এর উৎস পরম করুণাময় আল­াহ তা‘আলা প্রদত্ত মেধা। স্বভাব নিন্দুকেরা আবার সোচ্চার হয়ে না উঠে যে, আমি মুহতারাম ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল­াহ আল-গালিবের ব্যক্তি বন্দনায় তোষামোদকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। কখনই তা নয়। তবে সত্যকে সত্য বলা, মিথ্যাকে মিথ্যা বলার অধিকার সব মানুষেরই জন্মগত। সেই অধিকার ব্যবহারে আমি এই গোনাহগার বান্দা শৈশব থেকেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমার আদর্শবাদী পিতা স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন শহীদ আমিরুদ্দীন প্রধানের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠার ফলে। আল­াহ তা‘আলা আমার মরহুম পিতাকে পরকালে শহীদের মর্যাদা দান করুন- আমীন!

পরিশেষে আলোচ্য প্রবন্ধের অবয়ব না বাড়িয়ে এখানেই ক্যাঙ্গারু ক্লোজার (সংক্ষেপ সমাপ্তি) টানতে চাচ্ছি এই বলে যে, আত-তাহরীক এমন একটি স্বনামধন্য মাসিক পত্রিকা, যা বাংলাদেশ সরকারের সদ্য ঘোষিত ও জারীকৃত আইনের ধারায় আজও কৈশোর উত্তীর্ণ হয়নি। কৈশোরেই যার পদচারণায় চারিপাশ উচ্চকিত। আশা করি যৌবনে, প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে সে আরও বেশী পরিপূর্ণতা আর পরিপক্কতায় সমৃদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে আরও দীপ্ত পদক্ষেপে সাফল্যের শিখরে আরোহণ করবে ইনশাআল­াহ।

সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই দীপ্ত পদচারণা রয়েছে গবেষণাধর্মী এই মাসিক পত্রিকাটির। যার মধ্যে উলে­খযোগ্য শিরোনাম সমূহ যথা- সমসাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতির উপর আলোচিত ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ যেমন, সম্প্রতিক কালের রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ, ইসলামের সাথে পশ্চিমাদের গলদে ভরা গণতন্ত্রের সমালোচনা মূলক নিবন্ধ, সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত পরাক্রমশালীদের ভ্রান্তনীতির নির্মোহ-নির্ভীক পর্যালোচনান্তে যথার্থ সদুপদেশ প্রদান ইত্যাদি। এ ছাড়াও দরসে কুরআন, দরসে হাদীছ, প্রশ্নোত্তরের পাতায় ছহীহ সুন্নাহর উপস্থাপনায় সমৃদ্ধ সঠিক জবাবের কড়চা, ইসলামী জীবন বিধান, বিশ্বরাজনীতির উলে­যোগ্য পর্যালোচনা মূলক নিবন্ধ, সকল ক্ষেত্রেই আত-তাহরীক-এর তুলনা কেবল আত-তাহরীকই। যথার্থই আত-তাহরীক একটি সঠিক আন্দোলনের সফলতার পথে বজ্রকঠিন পদক্ষেপে অকুতোভয়ে ধাবমান একটি আন্দোলনের নাম। এর মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সকল বিধান বাতিল কর, অহি-র বিধান কায়েম কর।’ পরিশেষে পরম দয়াময় সর্বশক্তিমান সাহায্যকারী আল­াহ তাবারাক ওয়া তা‘আলার দরবারে সবিনয় নিবেদন আত-তাহরীক-এর যাত্রাপথকে সহজ করে দিন, মসৃণ করুন, পৌঁছে দিন একে মনযিলে মাকছূদে- আমীন! ছুম্মা আমীন!!

মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম প্রধান

মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত সমবায় কর্মকর্তা, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা।






দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আল-কুরআনে বিজ্ঞানের নিদর্শন (৪র্থ কিস্তি) - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
মুসলিম শিশুর জন্ম পরবর্তী করণীয় - মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (২য় কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
নারী-পুরুষের ছালাতের পার্থক্য : বিভ্রান্তি নিরসন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা (শেষ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
শারঈ ইমারত - ড. নূরুল ইসলাম
রোগ-ব্যাধির উপকারিতা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অধিকার - মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম
হতাশার দোলাচলে ঘেরা জীবন : মুক্তির পথ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (২য় কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
আরও
আরও
.