আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াত অপরিহার্য। কারণ দাওয়াত ব্যতীত দ্বীন প্রতিষ্ঠা আদৌ সম্ভব নয়। সমাজ সংস্কারে এবং মানুষের আক্বীদা-আমল সংশোধনে দাওয়াতের কোন বিকল্প নেই। নবী-রাসূলগণ স্বীয় উম্মতকে দ্বীনে হকের দিকে ফিরিয়ে আনতে এবং হকের উপরে টিকিয়ে রাখতে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের মিশনকে সফল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের পথ ধরেই বর্তমানে ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনে এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) দাওয়াতের ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ নিবন্ধে দাওয়াতী ময়দানে সংগঠনের ভূমিকা আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
দাওয়াত ও সংগঠনের সংজ্ঞা :
‘দাওয়াত’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ আহবান করা, ডাকা, আমন্ত্রণ করা, দো‘আ বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। এখানে দাওয়াত বলতে বুঝায় আল্লাহর দিকে দাওয়াত। পারিভাষিক অর্থে দাওয়াতের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,الدعوة إلى الله : هي الدعوة إلى الإيمان به، وبما جاءت به رسله، بتصديقهم فيما أخبروا به، وطاعتهم فيما أمروا. ‘আল্লাহর দিকে দাওয়াত অর্থ হচ্ছে তাঁর প্রতি এবং তাঁর রাসূল যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনা এবং তিনি যেসব বিষয় খবর দিয়েছেন সেসব সত্য বলে স্বীকার করা, আর তাঁরা যেসব আদেশ দিয়েছেন তা মান্য করা’।[1]
‘সংগঠন’-এর আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে জামা‘আত (الجماعة)। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একত্রিত হওয়া, ঐক্যবদ্ধ হওয়া, সমবেত হওয়া ইত্যাদি। এটা বিচ্ছিন্নতার বিপরীত। পারিভাষিক অর্থে-اَلْجَمَاعَةُ مَا اجْتَمَعَ مِنَ النَّاسِ عَلَى هَدَفٍ تَحْتَ إِمَارَةٍ، ‘নির্দিষ্ট লক্ষ্যে একজন নেতার অধীনে সংঘবদ্ধ জনতাকে জামা‘আত বলা হয়’।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, اَلْجَمَاعَةُ هِيَ الْاِجْتِمَاعُ وَضِدُّهَا الْفُرْقَةُ وَإِنْ كَانَ لَفْظُ الْجَمَاعَةِ قَدْ صَارَ إِسْمًا لِنَفْسِ الْقَوْمِ الْمُجْتَمِعِيْنَ، ‘জামা‘আত হচ্ছে একত্রিত হওয়া। এটি বিচ্ছিন্নতার বিপরীত। যদিও জামা‘আত শব্দটি যেকোন ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়’।[2]
দাওয়াতের গুরুত্ব ও ফযীলত :
দাওয়াতের গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআনে বিস্তর বিবরণ এসেছে। তন্মধ্যে এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হ’ল। আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوْا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوْا فِي الدِّيْنِ وَلِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوْا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَ، ‘আর মুমিনদের এটা সঙ্গত নয় যে, সবাই একত্রে (জিহাদে) বের হবে। অতএব তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং ফিরে এসে নিজ কওমকে (আল্লাহর নাফরমানী হ’তে) ভয় প্রদর্শন করে, যাতে তারা সতর্ক হয়’ (তওবা ৯/১২২)। অন্যত্র তিনি বলেন,يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ، ‘হে রাসূল! তোমার প্রতি তোমার প্রভুর পক্ষ হ’তে যা নাযিল হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন), তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। যদি না দাও, তাহ’লে তুমি তাঁর রিসালাত পৌঁছে দিলে না। আল্লাহ তোমাকে শত্রুদের হামলা থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)। অন্যত্র তিনি বলেন,ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ، ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর উত্তম পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক ভালভাবেই জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালভাবেই জানেন কে সুপথপ্রাপ্ত হয়েছে’ (নাহল ১৬/১২৫)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,بَلِّغُوْا عَنِّى وَلَوْ آيَةً، وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِى إِسْرَائِيْلَ وَلاَ حَرَجَ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হ’লেও পৌঁছে দাও। আর বনী ইসরাঈলের কাহিনী বর্ণনা কর, তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি আমার উপর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যারোপ করে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে প্রস্ত্তত করে নেয়’।[3]
শায়খ বিন বায (রহঃ) বলেন,
دلت الأدلة من الكتاب والسنة على وجوب الدعوة إلى الله عز وجل، وأنها من الفرائض، وصرح العلماء أن الدعوة إلى الله عز وجل فرض كفاية، بالنسبة إلى الأقطار التي يقوم فيها الدعاة، فإن كل قطر وكل إقليم يحتاج إلى الدعوة وإلى النشاط فيها، فهي فرض كفاية إذا قام بها من يكفي سقط عن الباقين ذلك الواجب، وصارت الدعوة في حق الباقين سنة مؤكدة،
‘কিতাব ও সুন্নাতের দলীলসমূহ প্রমাণ করে যে, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া ওয়াজিব ও ফরয। বিদ্বানগণ আরো সুস্পষ্ট করেছেন যে, দাঈদের দাওয়াত প্রদানের অঞ্চলভেদে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া ফরযে কিফায়া। কারণ প্রত্যেক দেশ ও অঞ্চল দাওয়াতী কর্মতৎপরতার মুখাপেক্ষী। সুতরাং দাওয়াতী কাজে নিযুক্ত লোক পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে অন্যদের উপর থেকে এর ফরযিয়াত রহিত হয়ে যাবে। তখন অন্যদের ক্ষেত্রে এটা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদায় পরিণত হবে’।[4] তিনি আরো বলেন,
الدعوة إلى الله تعالى من أهم الواجبات الإسلامية، وهي سبيل الرسل وأتباعهم إلى يوم القيامة، وقد أمر الله بها في كتابه الكريم وأثنى على أهلها غاية الثناء.
‘আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব সমূহের অন্তর্গত। এটা রাসূল (ছাঃ) ও ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর অনুসারীদের পথ। এ বিষয়ে আল্লাহ তাঁর কিতাবে নির্দেশ দিয়েছেন এবং দাঈদের খুব প্রশংসা করেছেন’।[5]
সংগঠনের গুরুত্ব :
পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে জামা‘আতবদ্ধ থাকার ব্যাপারে মুমিনদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং উৎসাহিত করা হয়েছে। আর কুরআনে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, মুসলিম উম্মাহ একটি জাতি। তারা সর্বদা ঐক্যবদ্ধ থাকবে। আল্লাহ বলেন, وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا، وَلاَ تَفَرَّقُوْا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। তিনি আরো বলেন,وَلاَ تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِن بَعْدِ مَا جَاءهُمُ الْبَيِّنَاتُ، ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও তাতে মতভেদ করেছে। এদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি’ (আলে ইমরান ৩/২০৫)। তিনি আরো বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ، ‘নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং নিজেরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই’ (আন‘আম ৬/১৫৯)।
এসব আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ বিচ্ছিন্নতাকে নিষেধ করেছেন। বরং ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামকে অাঁকড়ে ধরতে বলেছেন। জামা‘আতবদ্ধ থাকার ব্যাপারে হাদীছেও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেমন-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللهَ يَرْضَى لَكُمْ ثَلاَثًا وَيَكْرَهُ لَكُمْ ثَلاَثًا فَيَرْضَى لَكُمْ أَنْ تَعْبُدُوْهُ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا وَأَنْ تَعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلاَ تَفَرَّقُوْا، وَيَكْرَهُ لَكُمْ قِيْلَ وَقَالَ وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তিনটি জিনিস পসন্দ করেন এবং তিনটি জিনিস অপসন্দ করেন। তিনি তোমাদের জন্য পসন্দ করেন যে, ১. তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে। ২. তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। ৩. তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করবে এবং পরস্পর বিভক্ত হবে না। আর তিনি তোমাদের জন্য অপসন্দ করেন ১. ভিত্তিহীন বাজে কথা বলা (বা জনরবে থাকা), ২. অধিক প্রশ্ন করা এবং ৩. সম্পদ বিনষ্ট করা’ (সম্পদের অপব্যবহার ও অপচয় করা)।[6]
হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রয়েছে,
فَمَا تَأْمُرُنِىْ إِنْ أَدْرَكَنِىْ ذَلِكَ؟ قَالَ: تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ. قُلْتُ : فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ؟ قَالَ: فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا، وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ، حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ، وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ-
‘যদি এমন অবস্থা আমাকে পেয়ে বসে তাহ’লে আমাকে কী করার নির্দেশ দেন? তিনি বললেন, তুমি মুসলমানদের জামা‘আত ও তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, তখন যদি মুসলমানদের কোন জামা‘আত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, ‘তখন সকল ভ্রান্ত দল পরিত্যাগ করে সম্ভব হ’লে কোন গাছের শিকড় কামড়িয়ে পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না সে অবস্থায় তোমার মৃত্যু উপস্থিত হয়’।[7] আরেকটি হাদীছে এসেছে,
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لاَ يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ إِلاَّ بِإِحْدَى ثَلاَثٍ: النَّفْسُ بِالنَّفْسِ، وَالثَّيِّبُ الزَّانِي، وَالْمَارِقُ مِنَ الدِّينِ التَّارِكُ الْجَمَاعَةَ،
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তিনটি কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা বৈধ নয়। (যথা) জানের বদলে জান, বিবাহিত ব্যভিচারী এবং নিজের দ্বীন ত্যাগকারী মুসলিম জামা‘আত থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া ব্যক্তি’।[8] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,الرَّاكِبُ شيطانٌ، والرَّاكِبان شيطانان، والثلاثةُ رَكبٌ، ‘একাকী সফরকারী হচ্ছে একটি শয়তান, আর একত্রে দু’জন সফরকারী দু’টি শয়তান। তবে একত্রে তিনজন সফরকারীই হচ্ছে প্রকৃত কাফেলা’।[9] অন্যত্র তিনি আরো বলেন,عَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ، وَإِيَّاكُمْ وَالْفُرْقَةَ؛ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الْوَاحِدِ، وَهُوَ مِنَ الاثْنَيْنِ أَبْعَدُ، مَنْ أَرَادَ بُحْبُوحَةَ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمِ الْجَمَاعَةَ، ‘তোমাদের জন্য আবশ্যিক হ’ল জামা‘আতবদ্ধ থাকা। আর তোমরা বিচ্ছিনণতা হ’তে সাবধান থেকো। কেননা শয়তান বিচ্ছিন্নজনের সাথে থাকে এবং সে দু’জন হ’তে অনেক দূরে অবস্থান করে। যে লোক জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন জামা‘আতকে আবশ্যক করে নেয়’।[10]
এসব হাদীছ দ্বারা জামা‘আতবদ্ধ থাকার আবশ্যকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে সাবধান করা হয়েছে। মুসলমানরা সংগঠনকে অাঁকড়ে ধরে থাকলে এবং তার হক সমূহ যথাযথভাবে আদায় করলে তারাও ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম ও তাদের অনুসারীদের ন্যায় কল্যাণ লাভ করবে।
জামা‘আত দুই প্রকার। ১. জামা‘আতে আম্মাহ তথা ব্যাপক ভিত্তিক সংগঠন ও ২. জামা‘আতে খাছছাহ তথা বিশেষ সংগঠন। রাষ্ট্রীয় সংগঠন জামা‘আতে আম্মাহর পর্যায়ভুক্ত। স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানই এ সংগঠনের আমীর। ইসলামী শরী‘আতে তিনি ‘আমীরুল মুমিনীন’ হিসাবে অভিহিত হবেন। তিনি ইসলামী আইনের আলোকে প্রজাপালন ও শারঈ হুদূদ কায়েম করবেন। এই ইমারতকে ‘ইমারতে মুলকী’ও বলা হয়। ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া ইমারতে মুলকী কায়েম করা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রীয় সংগঠনের বাইরে অন্যান্য সকল সংগঠনই জামা‘আতে খাছছার পর্যায়ভুক্ত। এ সংগঠন মুসলিম-অমুসলিম সকল রাষ্ট্রে কায়েম করা সম্ভব। ইসলামী শরী‘আত মতে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে কোন স্থানে যদি তিনজন মুমিনও থাকেন, তবে সেখানে একজনকে আমীর করে জামা‘আত বা সংগঠন কায়েম করা অপরিহার্য। এ জামা‘আত যত বড় হবে ততই ভাল। একে ‘ইমারতে শারঈ’ বলা হয়। তিনি শারঈ হুদূদ কায়েম করবেন না, কিন্তু অবশ্যই তাঁর অনুসারীদের মধ্যে শারঈ অনুশাসন কায়েম করবেন।
জামা‘আতে খাছছাহ বা নির্দিষ্ট সংগঠন কায়েমের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে নানাভাবে নিদের্শ এসেছে (আলে ইমরান ৩/১০৩-১০৪, ১১০)।
নবী করীম (ছাঃ)ও এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। (১) জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপন করা (২) আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করা (৩) তাঁর আনুগত্য করা (৪) প্রয়োজনে হিজরত করা ও (৫) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। যে ব্যক্তি জামা‘আত হ’তে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়ে গেল তার গর্দান হ’তে ইসলামের গন্ডী ছিন্ন হ’ল, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দাওয়াত দ্বারা আহবান করে, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত হবে। যদিও সে ছিয়াম পালন করে, ছালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে সে একজন মুসলিম’।[11]
সাংগঠনিক জীবনের উপকারিতা :
১. আল্লাহর রহমত লাভ :
জামা‘আত বা সংগঠনের উপরে আল্লাহর রহমত থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَدُ اللهِ مَعَ الْجَمَاعَةِ، ‘জামা‘আতের উপরে আল্লাহর হাত রয়েছে’।[12] অন্যত্র তিনি বলেন,اَلْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ ‘জামা‘আতবদ্ধ থাকা রহমত এবং বিচ্ছিন্নতা আযাব’।[13]
২. শক্তি বৃদ্ধি করা :
পার্থিব জীবনে সংগঠন একটি বিশাল শক্তি। ঐক্যবদ্ধ জনবল না থাকলে অস্ত্রশক্তিও কোন কাজে আসে না। এজন্য আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে,وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ ‘কাফিরদের মুকাবিলার জন্য তোমরা সাধ্যমত শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখো, যা দিয়ে তোমরা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের ভীত করবে’ (আনফাল ৮/৬০)। ফলে সংগঠনের কারণে আল্লাহ বিরোধীরা সমীহ করে।
জামা‘আতবদ্ধ জীবনের আরেকটি উপকার হ’ল, এর মাধ্যমে সমাজে অনেক যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়। সকলে মিলে কাজ করার মধ্যে এক অসাধারণ আনন্দ ও উৎসাহ পাওয়া যায়। একে অপরের দুঃখে-বিপদে এগিয়ে আসার মানসিকতা তৈরী হয়। সংগঠন না থাকলে এসব গুণাবলী মানুষের মধ্যে বিকাশ লাভ করে না। অতএব সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা।
৩. সুসম্পর্ক বৃদ্ধি :
সংগঠনভুক্ত কর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেমন আল্লাহ বলেন,مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ، ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর যারা তার সাথী, তারা অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর ও নিজেদের মধ্যে রহমদিল’ (ফাতহ ৪৯/২৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْمُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ، يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا، ‘একজন মুমিন আরেকজন মুমিনের জন্যে প্রাসাদস্বরূপ, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে থাকে। এ বলে তিনি তার হাতের আঙ্গুলগুলো একটার মধ্যে আরেকটা প্রবেশ করালেন’।[14] সুতরাং সংগঠন একে অপরের সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করে।
৪. শয়তানের কবল থেকে রক্ষা :
শয়তান মানুষকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়। কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ হ’লে শক্তিতে পরিণত হবে। এটা সে চায় না। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ أَنْ يَعْبُدَهُ الْمُصَلُّونَ فِى جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَلَكِنْ فِى التَّحْرِيشِ بَيْنَهُمْ، ‘শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে যে, আরব উপদ্বীপে মুছল্লীরা তার ইবাদত করবে। তবে সে তাদের পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির ব্যাপারে নিরাশ হয়নি’।[15] আর একাকী থাকলে শয়তান সঙ্গী হয় এবং সংঘবদ্ধ থাকলে শয়তান দূরে থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,عَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ وَإِيَّاكُمْ وَالْفُرْقَةَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الْوَاحِدِ وَهُوَ مِنَ الاِثْنَيْنِ أَبْعَدُ، ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা হ’তে সাবধান থাক। কেননা শয়তান একক ব্যক্তির (বিচ্ছিন্নজনের) সাথে থাকে এবং সে দু’জন হ’তে অনেক দূরে অবস্থান করে’।[16]
৫. সামাজিক শৃংখলা :
সংগঠন সমাজজীবনে শৃখংলা শেখায়। স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করে। মানুষের জন্য ভাবতে শেখায়। আত্মকেন্দ্রিক না করে বহুকেন্দ্রিক করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,ثَلاَثٌ لاَ يُغِلُّ عَلَيْهِنَّ صَدْرُ مُسْلِمٍ إِخْلاَصُ الْعَمَلِ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَمُنَاصَحَةُ أُولِى الأَمْرِ وَلُزُوْمُ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِيْنَ فَإِنَّ دَعْوَتَهُمْ تُحِيْطُ مِنْ وَرَائِهِمْ، ‘কোন মুসলিম ব্যক্তির অন্তর তিনটি বিষয়ে খিয়ানত করে না- ১. একমাত্র আল্লাহর জন্য আমলকে খালেছ করা, ২. মুসলিমদের নেতৃবৃন্দকে সদুপদেশ দান, ৩. মুসলিমগণের জামা‘আতকে আঁকড়ে থাকা। কেননা তাদের দো‘আ তাদের পেছনের সকলকে বেষ্টন করে নেয়’।[17]
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,وَهَذِهِ الثَّلَاثُ تَجْمَعُ أُصُولَ الدِّينِ وَقَوَاعِدَهُ وَتَجْمَعُ الْحُقُوقَ الَّتِي لِلَّهِ وَلِعِبَادِهِ، وَتَنْتَظِمُ مَصَالِحَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ. ‘এ তিনটি বিষয় দ্বীনের মূলনীতি ও বিধানকে একত্রিত করেছে এবং আল্লাহ ও তাঁর বান্দার হক সমূহকে জমা করেছে। আর এতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে’।[18]
৭. দ্বীনের হেফাযত :
সংগঠন ছাড়া বা জামা‘আতবদ্ধ জীবন ব্যতিরেকে ইসলামের অস্তিত্ব কল্পনাই করা সম্ভব নয়। ইসলামী আদর্শের প্রথম ও প্রধান উৎস মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং দ্বিতীয় উৎস সুন্নাতে রাসূল। এতদুভয়ের শিক্ষা ও দর্শন আলোচনা করলে কোথাও ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী জীবন যাপনের সুযোগ দেখা যায় না। কুরআন-সুন্নাহর আহবান হয় গোটা মানবজাতির জন্যে, আর না হয় মানুষের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে তাদের সকলের জন্যে। কেবলমাত্র আখেরাতের হিসাব-নিকাশ ও জবাবদিহিতা হবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কিন্তু সেই জবাবদিহিতা থেকে বাঁচতে হ’লেও এই দুনিয়াতে সামষ্টিকভাবে দ্বীন মেনে চলার ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন আছে। এছাড়া শিরক ও বিদ‘আত থেকে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রকে বাঁচাবার জন্য ইসলামী সংগঠনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এর থেকে দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘ঈমানদার নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক। তাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হ’ল সৎকাজে আদেশ দান এবং অসৎকাজে বাধা প্রদান। তারা ছালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। তাদের প্রতি সত্বর আল্লাহপাক অনুগ্রহ করবেন। মহান আল্লাহ পরাক্রমশালী ও মহিমান্বিত’ (তওবা ৯/৭১)। এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হ’ল ভালো কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজের প্রতিরোধ করা। এর থেকে দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই। আর এ কাজ করতে গেলেই সংগঠনের প্রয়োজন। কাজেই ইসলামী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া আবশ্যক।
৮. অহির বিধান প্রতিষ্ঠা :
সমাজে অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠার জন্যই সংগঠন প্রয়োজন। কেননা শুধু প্রচারের জন্য বরং বাস্তব জীবনে অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠার জন্যই নবীগণের আগমন হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)। [ক্রমশঃ]
[1]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/১৫৭।
[2]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৫৭।
[3]. বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮।
[4]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে বায, ১/৩৩০, ৮/৪০৯, ২৭/৬৭।
[5]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে বায, ২/২৪১, ২৭/১৭০।
[6]. আহমাদ হা/৮৭৮৫; মুসলিম হা/১৭১৫; ছহীহাহ হা/৬৮৫।
[7]. বুখারী হা/৩৬০৬,৭০৮৪; মুসলিম হা/১৮৪৭; মিশকাত হা/৫৩৮২।
[8]. বুখারী হা/৬৮৭৮; মুসলিম হা/১৬৭৬।
[9]. আবুদাউদ হা/২৬০৭; তিরমিযী হা/১৬৭৪; মিশকাত হা/৩৯১০।
[10]. তিরমিযী হা/২১৬৫; ছহীহাহ হা/৪৩০।
[11]. আহমাদ হা/১৭২০৯; তিরমিযী হা/২৮৬৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪।
[12]. তিরমিযী হা/২১৬৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৫০; ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৪৮; মিশকাত হা/১৭৩, হাদীছ ছহীহ।
[13]. ছহীহাহ হা/৬৬৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৩১০৯।
[14]. বুখারী হা/৪৮১; মুসলিম হা/২৫৮৫; মিশকাত হা/৪৯৫৫।
[15]. মুসলিম হা/২৮১২; আবূদাঊদ হা/৩৩৭৪; আহমাদ হা/১৪৩৬৮; ছহীহাহ হা/১৬০৮; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬৫১।
[16]. তিরমিযী হা/২১৬৫; ইবনু মাজাহ হা/২৩৬৩; ছহীহাহ হা/৪৩০।
[17]. আহমাদ হা/১৩৩৭৪; তিরমিযী হা/২৬৫৮; ছহীহাহ হা/৪০৪।
[18]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১/১৮।