তাওয়াক্কুলের আলোচিত ক্ষেত্র সমূহ :
যেসব ক্ষেত্রে তাওয়াক্কুল আবশ্যক তা আলোচনার দাবী রাখে। এরূপ ক্ষেত্র অনেক রয়েছে। নিম্নে তার কিছু তুলে ধরা হ’ল :
১. ইবাদতে তাওয়াক্কুলের আদেশ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاعْبُدْهُ وَتَوَكَّلْ عَلَيْهِ ‘অতএব তুমি তাঁর ইবাদত কর ও তাঁর উপরেই ভরসা কর’ (হূদ ১১/১২৩)। এখানে আল্লাহ তা‘আলা একই জায়গায় তাঁর রাসূল ও মুমিনদের ইবাদত ও তাওয়াক্কুলের হুকুম দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে সম্বোধন করে আরো বলেছেন,وَاتَّبِعْ مَا يُوْحَى إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ إِنَّ اللهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرًا، وَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ وَكَفَى بِاللهِ وَكِيلاً- ‘তোমার পালনকর্তার পক্ষ হ’তে তোমার নিকট যা অহী করা হয়, তুমি তার অনুসরণ কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, আল্লাহ সেসব বিষয়ে সম্যক অবহিত। আর তুমি আল্লাহর উপর ভরসা কর। (কেননা) তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (আহযাব ৩৩/২-৩)।
দেখুন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে তাঁর ইবাদত এবং তার রব প্রদত্ত অহীর অনুসরণের পরক্ষণেই তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করার হুকুম দিয়েছেন। এই হুকুম যেমন নবীর জন্য, তেমনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী তাঁর সকল উম্মতের জন্য। কেননা এক্ষেত্রে মূলনীতি হ’ল নবী করীম (ছাঃ)-কে কোন বিষয়ে সম্বোধন করা হ’লে সম্বোধনের সে বিষয় তাঁর উম্মতের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে বিষয়টি কোন দলীল-প্রমাণ দ্বারা তাঁর জন্য খাছ হ’লে অন্য কথা।
২. দাওয়াত বা প্রচারের ক্ষেত্রে তাওয়াক্কুলের আদেশ :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ- ‘এসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তার উপরেই আমি ভরসা করি। আর তিনিই হচ্ছেন মহান আরশের মালিক’ (তওবা ৯/১২৯)। আল্লাহর কাছে এসেই তো সকল শক্তি, রাষ্ট্রক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব, পদ-পদবী শেষ হয়ে যায়। যে তাঁর আশ্রয় নেয় তিনি তার জন্য যথেষ্ট। তাঁর শরণ গ্রহণকারীর জন্য দ্বিতীয় কারো লাগে না। সকল ক্ষয়-ক্ষতি দূর করে তিনি তাকে রক্ষা করেন।
নবী নূহ (আঃ) দাওয়াতী কাজে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ نُوْحٍ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكُمْ مَقَامِيْ وَتَذْكِيْرِيْ بِآيَاتِ اللهِ فَعَلَى اللهِ تَوَكَّلْتُ فَأَجْمِعُوْا أَمْرَكُمْ وَشُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ لاَ يَكُنْ أَمْرُكُمْ عَلَيْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُوْا إِلَيَّ وَلاَ تُنْظِرُوْنِ- ‘আর তুমি তাদেরকে নূহের বৃত্তান্ত পাঠ করে শুনাও। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমাদের কাছে আমার অবস্থান ও আল্লাহর আয়াত সমূহ দ্বারা উপদেশ দান ভারী মনে হয়, তাহ’লে আমি আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। এখন তোমরা তোমাদের সকল শক্তি এবং তোমাদের শরীকদের একত্রিত কর। যাতে তোমাদের সেই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তোমাদের কারু কাছে কোনরূপ গোপনীয়তা না থাকে। অতঃপর আমার ব্যাপারে তোমরা একটা ফায়ছালা করে ফেল এবং আমাকে মোটেই অবকাশ দিয়ো না’ (ইউনুস ১০/৭১)।
হযরত নূহ (আঃ) দীর্ঘদিন ধরে তার জাতিকে দাওয়াত দিয়েছেন, দাওয়াতী কাজে তিনি দীর্ঘকাল তাদের মাঝে অবস্থান করেছেন, তারপরও তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলেছে। তখন তিনি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার সাথে তার কাজ আল্লাহর নিকট ন্যস্ত করেন এবং দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
একজন মুসলিম প্রচারকের বৈশিষ্ট্য তো এমনিতর হওয়া উচিত। দাওয়াতের পথে সকল কষ্টে সে ধৈর্য ধারণ করবে এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে চলবে।
৩. বিচার-ফায়ছালায় তাওয়াক্কুল :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيْهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللهِ ذَلِكُمُ اللهُ رَبِّي عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ- ‘(হে মানুষ)! তোমরা যে বিষয়ে মতবিরোধ কর, তার ফায়ছালা তো আল্লাহ তা‘আলারই হাতে। জেনে রাখ, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ, তিনিই আমার প্রতিপালক। আমি তাঁর উপরই তাওয়াক্কুল করি এবং তার দিকেই রুজূ হই’ (শূরা ৪২/১০)।
এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, বিচারক কিংবা শাসক আল্লাহর উপর ভরসা করে বিচার কিংবা শাসন কাজ চালালে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তারা সাহায্য-সহযোগিতা পাবেন এবং তারা সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের উপর থাকতে পারবেন।
৪. জিহাদ ও শত্রুর সাথে যুদ্ধে তাওয়াক্কুল :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِذْ غَدَوْتَ مِنْ أَهْلِكَ تُبَوِّئُ الْمُؤْمِنِيْنَ مَقَاعِدَ لِلْقِتَالِ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ- إِذْ هَمَّتْ طَائِفَتَانِ مِنْكُمْ أَنْ تَفْشَلَا وَاللهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ- ‘আর তুমি স্মরণ কর সেদিনের কথা, যেদিন (ওহোদের দিন) তুমি মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য ঘাঁটিতে সন্নিবেশ করার উদ্দেশ্যে স্বীয় পরিবার থেকে প্রভাতকালে বের হয়েছিলে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন’। ‘যখন তোমাদের মধ্যকার দু’টি দল ভীরুতা প্রকাশের সংকল্প করছিল। অথচ আল্লাহ তাদের অভিভাবক ছিলেন। আর আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (আলে ইমরান ৩/১২১-১২২)।
মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম, অস্ত্র-শস্ত্র সব কিছুই প্রস্ত্তত করেছিল তারা সৈন্য সমাবেশও করেছিল, তারপরও আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করতে বলেছেন। কেননা তিনিই সাহায্যকারী এবং বিজয় দানকারী। এ তথ্য স্পষ্ট করা হয়েছে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে-إِنْ يَنْصُرْكُمُ اللهُ فَلاَ غَالِبَ لَكُمْ وَإِنْ يَخْذُلْكُمْ فَمَنْ ذَا الَّذِيْ يَنْصُرُكُمْ مِنْ بَعْدِهِ وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ- ‘যদি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেন, তবে কেউই তোমাদের উপর জয়লাভ করবে না। আর যদি তিনি তোমাদের পরিত্যাগ করেন, তবে তাঁর পরে কে আছে যে তোমাদের সাহায্য করবে? অতএব মুমিনদের উচিত আল্লাহর উপরেই ভরসা করা’ (আলে ইমরান ৩/১৬০)।
দুর্বল অবস্থাতে মহান আল্লাহই সাহায্যকারী। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ هَمَّ قَوْمٌ أَنْ يَبْسُطُوْا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ فَكَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর। যখন একটি সম্প্রদায় (ইহুদীগণ) তোমাদের প্রতি হস্ত প্রসারিত করার সংকল্প করেছিল। তখন তিনি তাদের হাতকে তোমাদের থেকে প্রতিহত করেন। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (মায়েদাহ ৫/১১)।
আবার সবল শক্তিশালী অবস্থাতেও তিনিই সাহায্যকারী। আল্লাহ বলেন,وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا- ‘(বিশেষ করে) হুনায়েন-এর দিনে। যেদিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে প্রফুল্ল করেছিল। কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি’ (তওবা ৯/২৫)।
মূসা (আঃ)-এর কাহিনীতেও শক্তিমানদের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,قَالُوا يَا مُوسَى إِنَّ فِيْهَا قَوْمًا جَبَّارِيْنَ وَإِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا حَتَّى يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنْ يَخْرُجُوْا مِنْهَا فَإِنَّا دَاخِلُوْنَ- قَالَ رَجُلاَنِ مِنَ الَّذِيْنَ يَخَافُوْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمَا ادْخُلُوْا عَلَيْهِمُ الْبَابَ فَإِذَا دَخَلْتُمُوْهُ فَإِنَّكُمْ غَالِبُوْنَ وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ- ‘তারা বলল, হে মূসা! সেখানে পরাক্রমশালী একটি সম্প্রদায় রয়েছে। অতএব আমরা সেখানে কখনো প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। যদি তারা বের হয়ে যায়, তাহ’লে আমরা প্রবেশ করব। তখন দুই ব্যক্তি বলল, যারা আল্লাহকে ভয় করত এবং আল্লাহ যাদের উপর অনুগ্রহ করেছিলেন, তোমরা তাদের উপর হামলা চালিয়ে শহরের প্রধান ফটক পর্যন্ত যাও। ফলে যখনই তোমরা সেখানে পৌঁছবে, তখনই তোমরা জয়লাভ করবে। আর আল্লাহর উপরে তোমরা ভরসা কর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (মায়েদাহ ৫/২২-২৩)।
৫. সন্ধিস্থলে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِنْ جَنَحُوْا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ- ‘যদি তারা সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে তুমিও সেদিকে ঝুঁকে পড় এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিঃসন্দেহে তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আনফাল ৮/৬১)।
অনেকে সন্ধির সময়ে তাওয়াক্কুলকে অনর্থক মনে করে। তাদের কথা যুদ্ধই যখন বন্ধ, মুসলমানদের উপর শত্রু পক্ষের হস্তক্ষেপও যখন বন্ধ তখন তাওয়াক্কুলের আবশ্যকতা কী?
আসলে এমন ক্ষেত্রেও তাওয়াক্কুলের বহুবিধ উপকারিতা আছে। যেমন কুরাইশ কাফির ও নবী করীম (ছাঃ)-এর মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধি হয়েছিল। এই সন্ধির পর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের প্রেক্ষিতে আরব উপদ্বীপের অসংখ্য লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। মুসলমানদের জন্য এ সন্ধি বিজয়ের দ্বার খুলে দিয়েছিল।
৬. পরামর্শের ক্ষেত্রে তাওয়াক্কুলের আদেশ :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ- ‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
এ আয়াতে ইঙ্গিত মেলে যে, পরামর্শ গ্রহণ মাধ্যম অবলম্বনের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সংকল্প পূরণের প্রকৃত মাধ্যম যা তা হ’ল আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল।
পাঠক! আপনি বড় বড় শাসক ও পদাধিকারীদের দেখুন-কিভাবে তারা তাদের পাশে শত শত পরামর্শক ও তথ্যাভিজ্ঞদের জমা করে এবং তাদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে। কিন্তু পরে দেখা যায়, তাদের পরামর্শ ভুল ছিল। সুতরাং পরামর্শ গ্রহণ ও মাধ্যম অবলম্বনের পরও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা একান্ত প্রয়োজন।
৭. জীবিকার সন্ধানে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا- وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا- ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার জন্য বেরোনোর উপায় করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে জীবিকা দেন যা সে ভাবতেও পারে না। আর যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট হন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার কাজ চূড়ান্তকারী। অবশ্যই আল্লাহ প্রত্যেক কাজের জন্য একটা পরিমাণ ঠিক করে রেখেছেন’ (তালাক্ব ৬৫/২-৩)।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, দায়ভার সমর্পণের দিক দিয়ে নিশ্চয়ই কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত হ’ল وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا- وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ- ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার জন্য বেরোনোর উপায় করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে জীবিকা দেন যা সে ভাবতেও পারে না’।[1] জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوْتَ حَتَّى تَسْتَوْفِىَ رِزْقَهَا وَإِنْ أَبْطَأَ عَنْهَا فَاتَّقُوْا اللهَ وَأَجْمِلُوْا فِى الطَّلَبِ خُذُوْا مَا حَلَّ وَدَعُوْا مَا حَرُمَ- ‘নিশ্চয়ই কোন প্রাণী তার জন্য বরাদ্দ রূযী ভোগ শেষ না করা পর্যন্ত কখনো মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও তা পেতে দেরি হয়। সুতরাং তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করো এবং জীবিকা অনুসন্ধানে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। যা হালাল তা গ্রহণ করো এবং যা হারাম তা বর্জন করো’।[2]
৮. প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতিতে তাওয়াক্কুল :
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ইয়াকূব (আঃ)-এর তাওয়াক্কুলের কথা বলেছেন, তাঁকে তাঁর সন্তানেরা বলেছিল, فَأَرْسِلْ مَعَنَا أَخَانَا ‘আপনি আমাদের সাথে আমাদের ভাইকে প্রেরণ করুন’ (ইউসুফ ১২/৬৩)। তখন তিনি তাদের বলেছিলেন,لَنْ أُرْسِلَهُ مَعَكُمْ حَتَّى تُؤْتُوْنِ مَوْثِقًا مِنَ اللهِ لَتَأْتُنَّنِي بِهِ إِلاَّ أَنْ يُحَاطَ بِكُمْ فَلَمَّا آتَوْهُ مَوْثِقَهُمْ قَالَ اللهُ عَلَى مَا نَقُوْلُ وَكِيْلٌ- ‘তাকে তোমাদের সাথে পাঠাব না, যতক্ষণ না তোমরা আমার নিকটে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার কর যে, তাকে অবশ্যই আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে। অবশ্য যদি তোমরা একান্তভাবেই অসহায় হয়ে পড় (তবে সেকথা আলাদা)। অতঃপর যখন সবাই তাঁকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিল, তখন তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে যে কথা হ’ল, সে ব্যাপারে আল্লাহ মধ্যস্থ রইলেন’ (ইউসুফ ১২/৬৬)।
আরবী مَوْثِقٌ শব্দের অর্থ প্রতিজ্ঞা ও কঠোর শপথ। ইয়াকূব (আঃ) আরো বলেছিলেন,وَقَالَ يَا بَنِيَّ لاَ تَدْخُلُوْا مِنْ بَابٍ وَاحِدٍ وَادْخُلُوْا مِنْ أَبْوَابٍ مُتَفَرِّقَةٍ وَمَا أُغْنِيْ عَنْكُمْ مِنَ اللهِ مِنْ شَيْءٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلَّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُوْنَ- ‘ইয়াকূব বলল, হে আমার সন্তানেরা! তোমরা সবাই এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না। বরং পৃথক পৃথক দরজা দিয়ে প্রবেশ কর। তবে আল্লাহ থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারি না। আল্লাহ ব্যতীত কারু হুকুম চলে না। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি এবং তাঁর উপরেই ভরসা করা উচিত সকল ভরসাকারীর’ (ইউসুফ ১২/৬৭)।
৯. আল্লাহর পথে হিজরতে তাওয়াক্কুল :
হিজরত বা আপন বাসগৃহ ও সমাজ ছেড়ে অচেনা অপরিচিত সমাজে গমন খুবই বেদনা-বিধুর বিষয়। নিজের আশ্রয়, ঘর-বাড়ী ও সহায়-সম্পদ ছেড়ে বাইরের দেশে চলে যাওয়া মোটেও কোন সহজ কাজ নয়। হিজরতকারীকে এজন্য নিজের সমাজ ও প্রিয় স্মৃতিগুলো কুরবানী দিতে হয়। এমন ক্ষেত্রেও আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে তাঁর উপর তাওয়াক্কুলকারী গুণে গুণান্বিত করেছেন। হিজরত যতই কষ্টকর ও বেদনাময় হোক না কেন, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের ফলে তা সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَالَّذِيْنَ هَاجَرُوْا فِي اللهِ مِنْ بَعْدِ مَا ظُلِمُوْا لَنُبَوِّئَنَّهُمْ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَلَأَجْرُ الْآخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ- الَّذِيْنَ صَبَرُوْا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ- ‘যারা অত্যাচারিত হওয়ার পর আল্লাহর পথে হিজরত করেছে, আমরা অবশ্যই তাদেরকে দুনিয়ার উত্তম আবাস দান করব এবং আখেরাতের পুরস্কারই তো শ্রেষ্ঠ, যদি তারা জানত। যারা ধৈর্য ধারণ করে ও তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (নাহল ১৬/৪১-৪২)।
হিজরতের পথে নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর সাথী আবুবকর (রাঃ)-এর তাওয়াক্কুল লক্ষ্য করুন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রসঙ্গে বলেছেন,
إِلاَّ تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُوْلُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللهُ سَكِيْنَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُوْدٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ-
‘যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখ আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন তাকে কাফেররা বের করে দিয়েছিল এবং (ছওর) গিরিগুহার মধ্যে সে ছিল দু’জনের একজন। যখন সে তার সাথীকে বলল, চিন্তান্বিত হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার উপর স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন ও তাকে এমন সেনাদল দিয়ে সাহায্য করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের (শিরকের) ঝান্ডা অবনত করে দিলেন ও আল্লাহর (তাওহীদের) ঝান্ডা সমুন্নত রাখলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)।
১০. বেচা-কেনা, শ্রম ও বিবাহ চুক্তিতে অটল-অবিচল থাকতে তাওয়াক্কুল :
হযরত মূসা (আঃ) এমন তাওয়াক্কুলের পরিচয় দিয়েছিলেন। ফেরাউনের গ্রেপ্তার থেকে বাঁচার জন্য তিনি মিসর ছেড়ে মাদইয়ান যাত্রা করেন। সেখানে ঘটনাক্রমে এক নেককার লোকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যায়। তিনি সেই নেককার লোক যার বাড়িতে মূসা (আঃ) আট বছর এবং সম্ভব হলে দশ বছর মযদুরী করলে নিজের মেয়েকে তাঁর সাথে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
قَالَ إِنِّيْ أُرِيْدُ أَنْ أُنْكِحَكَ إِحْدَى ابْنَتَيَّ هَاتَيْنِ عَلَى أَنْ تَأْجُرَنِيْ ثَمَانِيَ حِجَجٍ فَإِنْ أَتْمَمْتَ عَشْرًا فَمِنْ عِنْدِكَ وَمَا أُرِيْدُ أَنْ أَشُقَّ عَلَيْكَ سَتَجِدُنِيْ إِنْ شَاءَ اللهُ مِنَ الصَّالِحِيْنَ- قَالَ ذَلِكَ بَيْنِيْ وَبَيْنَكَ أَيَّمَا الْأَجَلَيْنِ قَضَيْتُ فَلَا عُدْوَانَ عَلَيَّ وَاللهُ عَلَى مَا نَقُوْلُ وَكِيْلٌ-
‘তখন পিতা মূসাকে বললেন, আমি আমার এই মেয়ে দু’টির একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার (বাড়ীতে) কর্মচারী থাকবে। তবে যদি দশ বছর পূর্ণ কর, সেটা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাহেন তো তুমি আমাকে সদাচারী হিসাবে পাবে। মূসা বলল, আমার ও আপনার মধ্যে উক্ত চুক্তিই স্থির হ’ল। দু’টি মেয়াদের মধ্যে যেকোন একটি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আর আমরা যা বলছি, আল্লাহ তার উপরে তত্ত্বাবধায়ক’ (ক্বাছাছ ২৮/২৭-২৮)।
হযরত মূসা (আঃ) প্রতিশ্রুতি মত পুরোপুরি দশ বছরই ঐ নেককার বান্দার বাড়ীতে মযদুরী করেছিলেন।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,قَضَى أَكْثَرَهُمَا وَأَطْيَبَهُمَا، إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا قَالَ فَعَلَ- ‘তিনি দুই মুদ্দতের বেশী ও উত্তমটাই পূরণ করেছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যখন যা বলেন তখন তা বাস্তবায়নও করেন’।[3] পরিপূর্ণরূপে কার্যসাধনই নবীর জন্য শোভনীয়।
১১. আখিরাতে সুফল লাভের আশায় তাওয়াক্কুল :
এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,فَمَا أُوتِيْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ وَأَبْقَى لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ- ‘অনন্তর তোমাদেরকে (এ জীবনে) যা দেওয়া হচ্ছে তা তো পার্থিব জীবনের উপভোগ্য সামগ্রী। কিন্তু আল্লাহর নিকট যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী। তা কেবল তাদের জন্য যারা ঈমান রাখে এবং তাদের মালিকের উপরই তাওয়াক্কুল করে’ (শূরা ৪২/৩৬)।
আখেরাতের এই স্থান থেকে দামী আর কোন স্থান আছে কি? কেননা আখেরাতই তো চূড়ান্ত লক্ষ্য। মুমিনের কামনার ধনই তো আখেরাত। সুতরাং সেই পরকালীন আবাসের তালাশে মুমিনরা যেন তাদের মালিক আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে কোনই কছূর না করে।
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের উপকারিতা
১. যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট : আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا، وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا- ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার জন্য বেরোনোর পথ বের করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে জীবিকা দেন যা সে ভাবতেও পারে না। আর যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট হন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার কাজ চূড়ান্তকারী। অবশ্যই আল্লাহ প্রত্যেক কাজের জন্য একটা পরিমাপ ঠিক করে রেখেছেন’ (তালাক্ব ৬৫/২-৩)।
আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেকটি কাজের সমজাতীয় প্রতিফল নির্ধারণ করে রেখেছেন। তিনি তাওয়াক্কুলের প্রতিদান নির্ধারণ করেছেন প্রাচুর্যতা। সুতরাং যে আল্লাহকে যথেষ্ট জানবে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হবেন। আর আল্লাহ যার তত্ত্বাবধান করবেন তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। কবি বলেন,
وإذا دجا ليل الخطوب وأظلمت + سبل الخلاص وخاب فيها الآمل
وأيست من وجه النجاة فما لها + سبب ولا يدنو لها متناول
يأتيك من ألطافه الفرج الذي + لم تحتسبه وأنت عنه غافل-
অাঁধার যখন জমায় খেলা আশার পরে
মুক্তি যখন নাগাল থেকে অনেক দূরে
হতাশ হয়ে থমকে দাঁড়ায় আশাবাদী
তুমিও যখন নাজাত লাভে হতাশাবাদী
আশীষ তখন আসেরে ভাই এমন পথে
ধারণা তার পাওনি কভু, ভাবনি যা কোন কালে।[4]
যেহেতু নবী করীম (ছাঃ) ছিলেন আল্লাহর উপর সবচেয়ে বড় তাওয়াক্কুলকারী তাই আল্লাহও তাকে যথোপযুক্ত প্রতিফল দিয়েছেন। তিনি তার জন্য যথেষ্ট হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ- ‘হে নবী! তোমার ও তোমার অনুসারী মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’ (আনফাল ৮/৬৪)। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনার জন্য যথেষ্ট, আর সেই মুমিনরাও আপনার জন্য যথেষ্ট যারা আল্লাহর নিকটে তাদের তাওয়াক্কুলকে সত্য প্রমাণ করতে পেরেছে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,وَإِنْ يُرِيْدُوْا أَنْ يَخْدَعُوْكَ فَإِنَّ حَسْبَكَ اللهُ هُوَ الَّذِيْ أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِ وَبِالْمُؤْمِنِيْنَ- ‘আর যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায়, তবে তোমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। তিনিই তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন স্বীয় সাহায্য দিয়ে ও মুমিনদের মাধ্যমে’ (আনফাল ৮/৬২)।
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) حَسْبُكَ اللهُ এর অর্থ প্রসঙ্গে বলেন, অর্থাৎ তিনি তাঁর জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ যার জন্য যথেষ্ট এবং আল্লাহ যার রক্ষাকারী তার শত্রু তাকে হেনস্তা করার আদৌ কোন সুযোগ পায় না। সে তার কোনই ক্ষতি করতে পারে না, তবে যে কষ্টটুকু তার নছীবে আছে তা থেকে অবশ্য তার নিষ্কৃতি মিলবে না। যেমন আল্লাহ বলেছেন, لَنْ يَضُرُّوكُمْ إِلاَّ أَذًى ‘তারা তোমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না কিছু কষ্ট দেওয়া ব্যতীত’ (আলে ইমরান ৩/১১১)।
এ কষ্ট যেমন শীত, গ্রীষ্ম, ক্ষুধা, পিপাসা ইত্যাদি। তবে তার ইচ্ছা পূরণের মাধ্যমে মুমিনদের যে ক্ষতি করবে তা সম্ভব হবে না।[5]
লেখক ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন, হজ্জের মওসুমে আমাকে জনৈক চেচেন (شيشانى) এই ঘটনাটি ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেন, রুশবাহিনী আমার বাড়ী ঘেরাও করে। বাড়ীর সকল লোক পালিয়ে যায়, কিন্তু আমি পালাতে পারিনি। এমন সংকটাপন্ন মুহূর্তে আমি বাড়ীর পাশে একটা গর্তের দিকে যাই। সেখানে আমি কিছু আলুর উপজাত মরা গাছ ইত্যাদি জড়ো করি এবং নিজেকে গর্তের মাঝে সঁপে দেই। আমার কাছে না আত্মরক্ষা করার মত কোন অস্ত্র ছিল, না পালানোর কোন সামর্থ্য ছিল। সৈন্যরা যখন গর্তের নিকটে এসে গেল তখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর ছিল না। আমি তখন এই আয়াত পড়ছিলাম- وَجَعَلْنَا مِنْ بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُوْنَ- ‘আর আমরা তাদের সামনে ও পিছনে (হঠকারিতার) দেওয়াল স্থাপন করেছি। অতঃপর তাদেরকে (মিথ্যার অন্ধকারে) ঢেকে ফেলেছি। ফলে তারা (সত্য) দেখতে পায় না’ (ইয়াসীন ৩৬/৯)।
একজন সৈনিক গর্তের মধ্যে কেউ আছে কি-না তার অনুসন্ধান করতে আসে। সে সরাসরি আমার চোখে চোখ রাখে; কিন্তু তারপরও তার সঙ্গীদের বলে ওঠে- চলো যাই, এখানে কেউ নেই। তারা তখন বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল এবং আমাকে ছেড়ে গেল’। এটি আল্লাহর উপর প্রকৃত তাওয়াক্কুলের একটি নমুনা।
২. আল্লাহ সঙ্গে থাকার অনুভূতি :
মানুষ যখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, তার উপর যত ভরসা করে ততই সে অনুভব করে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সাথে আছে। তার ইচ্ছা পূরণে তিনি অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। এ ধরনের চিন্তা-চেতনাই সর্বদা আল্লাহ সাথে থাকার অনুভূতি।
৩. মালিকের ভালবাসা লাভ :
যে আল্লাহর উপর যথাযথ তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন। কেননা এই তাওয়াক্কুলকারী আল্লাহর হুকুম মত কাজ করেছে; যেসব উপায়-উপকরণ আল্লাহ বৈধ করেছেন সে তা গ্রহণ করেছে; তার মনটা তার প্রভুর সাথে সর্বদা জুড়ে রয়েছে। সুতরাং মালিকের সাথে তার ভালবাসা তো অবশ্যই তৈরী হবে। তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে বান্দা তার রব ও খালেকের সঙ্গে মহববত বৃদ্ধি করে থাকে। কেননা সে জানে আল্লাহ তার হেফাযতকারী, সাহায্যকারী, তাকে ঐশ্বর্য দানকারী এবং তার জীবিকা দানকারী।
৪. শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য :
যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তাকে তার শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে সাহায্য করেন, তাদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভের উপকরণ যুগিয়ে দেন এবং তার সামনে তাদেরকে অপদস্থ করেন। ছাহাবীগণ একথা ভালমত জানতেন এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতেন বলেই তারা বলেছিলেন,حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ، فَانْقَلَبُوْا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوْءٌ وَاتَّبَعُوْا رِضْوَانَ اللهِ وَاللهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ- ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’! ‘অতঃপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ সহ ফিরে এল। কোনরূপ অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি। তারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল’ (আলে ইমরান ৩/১৭৩-৭৪)।
আহযাব (খন্দক) যুদ্ধে মুমিনদের অবস্থা বর্ণনায় আল্লাহ বলেন,
وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُوْنَ الْأَحْزَابَ قَالُوْا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَصَدَقَ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلاَّ إِيْمَانًا وَتَسْلِيْمًا- ‘অতঃপর যখন মুমিনগণ শত্রুদল সমূহকে দেখল, তখন তারা বলল, এটা তো তাই, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন। আর এটি তাদের ঈমান ও আনুগত্যকে আরও বৃদ্ধি করল’ (আহযাব ৩৩/২২)।
৫. বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ :
হাদীছে এসেছে উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্য থেকে সত্তর হাযার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। তারা ঐ সকল লোক যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করত। ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
عُرِضَتْ عَلَىَّ الأُمَمُ، فَجَعَلَ النَّبِىُّ وَالنَّبِيَّانِ يَمُرُّوْنَ مَعَهُمُ الرَّهْطُ، وَالنَّبِىُّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ، حَتَّى رُفِعَ لِىْ سَوَادٌ عَظِيْمٌ، قُلْتُ مَا هَذَا؟ أُمَّتِى هَذِهِ؟ قِيْلَ هَذَا مُوْسَى وَقَوْمُهُ. قِيْلَ انْظُرْ إِلَى الأُفُقِ. فَإِذَا سَوَادٌ يَمْلأُ الأُفُقَ، ثُمَّ قِيْلَ لِىْ انْظُرْ هَا هُنَا وَهَا هُنَا فِىْ آفَاقِ السَّمَاءِ فَإِذَا سَوَادٌ قَدْ مَلأَ الأُفُقَ قِيْلَ هَذِهِ أُمَّتُكَ وَيَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْ هَؤُلاَءِ سَبْعُوْنَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ، ثُمَّ دَخَلَ وَلَمْ يُبَيِّنْ لَهُمْ فَأَفَاضَ الْقَوْمُ وَقَالُوْا نَحْنُ الَّذِيْنَ آمَنَّا بِاللهِ، وَاتَّبَعْنَا رَسُوْلَهُ، فَنَحْنُ هُمْ أَوْ أَوْلاَدُنَا الَّذِيْنَ وُلِدُوْا فِى الإِسْلاَمِ فَإِنَّا وُلِدْنَا فِى الْجَاهِلِيَّةِ. فَبَلَغَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَخَرَجَ فَقَالَ هُمُ الَّذِيْنَ لاَ يَسْتَرْقُوْنَ، وَلاَ يَتَطَيَّرُوْنَ، وَلاَ يَكْتَوُوْنَ وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ. فَقَالَ عُكَّاشَةُ بْنُ مِحْصَنٍ أَمِنْهُمْ أَنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ : نَعَمْ. فَقَامَ آخَرُ فَقَالَ أَمِنْهُمْ أَنَا؟ قَالَ : سَبَقَكَ عُكَّاشَةُ-
‘আমার সামনে (বিভিন্ন নবীর) উম্মাতকে তুলে ধরা হ’ল। এক এক করে একজন বা দু’জন নবী অতিক্রম করলেন; তাদের সাথে ছিল একটি (ক্ষুদ্র) দল। আবার কোন নবীর সাথে একজনও ছিল না। এমন করতে করতে আমার সামনে একটা বড়সড় দল তুলে ধরা হ’ল। আমি বললাম, এরা কারা? এরা কি আমার উম্মাত? বলা হ’ল, এরা মূসা ও তাঁর উম্মাত। আমাকে বলা হ’ল, আপনি দিগন্তের দিকে তাকান। দেখলাম, একটা দলে দিগন্ত ভরে গেছে। আবার বলা হ’ল, আপনি আকাশের এদিকে ওদিকে তাকান। তখন দেখলাম, আকাশের সবগুলো কোণ লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। আমাকে বলা হ’ল, এরাই আপনার উম্মাত। এদের মধ্য থেকে সত্তর হাযার লোক কোন হিসাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিছুক্ষণ পর তিনি লোকগুলোর বৈশিষ্ট্য ছাহাবীদের নিকট না বলেই বাড়ীর ভেতর চলে গেলেন। তখন উপস্থিত লোকেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল- আমরাই তো তারা, যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি এবং তাঁর রাসূলের অনুসরণ করেছি; সুতরাং আমরাই তারা। কিংবা আমাদের সন্তানেরা হবে, যারা ইসলামের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে। আর আমরা জাহেলিয়াতের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি। নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট বলাবলির এ কথা পৌঁছলে পরে তিনি বাইরে এসে বললেন, তারা ঐ সকল লোক যারা (রোগ-ব্যাধিতে) মন্ত্র-তন্ত্রের ধার ধারে না, কুলক্ষণে বিশ্বাস করে না, আগুন দিয়ে দাগ দেয় না (আগুনের দাগ দিয়ে চিকিৎসা করে না) এবং তাদের মালিকের উপরই কেবল তাওয়াক্কুল করে। তখন উক্কাশা ইবনু মিহছান নামক এক ছাহাবী বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি তাদের একজন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অন্য আরেকজন দাঁড়িয়ে বললেন, আমিও কি তাদের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন, এ বিষয়ে উক্কাশা তোমার থেকে এগিয়ে’।[6]
৬. জীবিকা লাভ :
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَوَكَّلُونَ عَلَى اللهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرُزِقْتُمْ كَمَا تُرْزَقُ الطَّيْرُ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوْحُ بِطَانًا- ‘যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথার্থভাবে তাওয়াক্কুল করতে তাহ’লে পাখপাখালির মতই তোমরা জীবিকা পেতে। তারা ভোরবেলায় ওঠে ক্ষুধার্ত অবস্থায়, আর সন্ধ্যায় ভরা পেটে নীড়ে ফেরে’।[7]
৭. নিজ জীবন, পরিবার ও সন্তান-সন্ততির হেফাযত :
হযরত ইয়াকূব (আঃ) তাঁর পুত্রদের মিসর গমনকালে আত্মরক্ষামূলক কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি নিজের বিষয়-আশয়কে আল্লাহর যিম্মায় সোপর্দ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلَّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُوْنَ- ‘আল্লাহ ব্যতীত কারু হুকুম চলে না। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি এবং তাঁর উপরেই ভরসা করা উচিত সকল ভরসাকারীর’ (ইউসুফ ১২/৬৭)।
আল্লাহর উপর ভরসা এজন্যই করতে হবে যে, তিনিই হেফাযতকারী। নিজের জীবন, পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততি রক্ষায় তাঁর উপরই নির্ভর করা কর্তব্য।
৮. শয়তান থেকে রক্ষা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا النَّجْوَى مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَلَيْسَ بِضَارِّهِمْ شَيْئًا إِلاَّ بِإِذْنِ اللهِ وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ- ‘গোপন সলাপরামর্শ তো কেবল শয়তানের পক্ষ থেকে হয়, যাতে মুমিনরা কষ্ট পায়। কিন্তু আল্লাহর হুকুম না হ’লে সে তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আর মুমিনদের কর্তব্য তো আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা’ (মুজাদালাহ ৫৮/১০)।
এ আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন যে, তার অনুমোদন ব্যতীত শয়তান তাঁর বান্দাদের ক্ষতি করতে পারে না। তারপর তিনি তার বান্দাদেরকে শয়তানের হাত থেকে নিরাপদে থাকার জন্য তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করতে বলেছেন।
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ قَالَ : يَعْنِىْ إِذَا خَرَجَ مِنْ بَيْتِهِ- بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ. يُقَالُ لَهُ كُفِيتَ وَوُقِيتَ. وَتَنَحَّى عَنْهُ الشَّيْطَانُ- ‘যখন কোন ব্যক্তি নিজ বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় বলে ‘বিসমিল্লা-হি তাওয়াক্কালতু আলাল্লা-হি লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লা-হ’ (আল্লাহর নামে বের হ’লাম, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করলাম, আল্লাহ ছাড়া পাপ থেকে বাঁচা এবং পুণ্য কাজ করার কোনই উপায় নেই’)। তাকে লক্ষ্য করে বলা হয়, তোমার জন্য এটা যথেষ্ট হয়েছে এবং তোমার নিরাপত্তা মিলেছে। আর শয়তান তখন তার থেকে দূরে সরে যায়।[8]
৯. মানসিক প্রশান্তি :
মানুষ তার লক্ষ্য পূরণে যত প্রকারের উপকরণই ব্যবহার করুক না কেন তাতে এমন কিছু ফাঁক-ফোঁকর থেকেই যাবে যা সে বন্ধ করতে পারেনি। যে কারণে তার ভয় থাকে- হয়তো ব্যর্থতা এসে তাকে ঘিরে ধরবে এবং তার আশা পূরণ হবে না।
কিন্তু যখনই সে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে এবং বিশ্বাস করবে যে, তার যাবতীয় কাজে আল্লাহই তার পক্ষে যথেষ্ট তখন আর তার ঐ সকল ফাঁক-ফোঁকরের ভয় থাকবে না। তখন সে এক ধরনের আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি ও আরাম উপভোগ করবে। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে মানুষ মানসিক ও স্নায়ুবিক দুর্বলতা থেকে নিরাপদ থাকতে পারে।
মনোরোগ চিকিৎসকগণ যদি তাওয়াক্কুলের গুরুত্ব ও উপকারিতা বুঝতেন তাহ’লে তাওয়াক্কুলকে তারা তাদের চিকিৎসার প্রথম কাতারে রাখতেন। আর যদি যথার্থভাবে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করত তাহ’লে তারা আত্মহত্যা করত না; বরং আল্লাহর উপর কাজ সোপর্দ করে তারা তার ফায়ছালা ও তাকদীরে রাযী-খুশী থাকত।
১০. কাজের প্রতি দৃঢ়তা :
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ব্যক্তির মনে কাজের প্রতি দৃঢ়তা ও প্রগাঢ় নিষ্ঠা জন্মিয়ে দেয়। কেননা তাওয়াক্কুলের ফলে বৈধ উপায়ের দ্বার খুলে যায়। মানুষ যখন এই তাওয়াক্কুলের বুঝ সঠিকভাবে লাভ করতে পারে তখন সে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে উৎপাদনে মনোবল বেড়ে যায়।
১১. সম্মান ও মানসিক ঐশ্বর্য লাভ :
একজন মুসলিম যখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তার কাজ-কর্ম আল্লাহর হাতে সপে দেয় তখন সে নিজের মাঝে ইয্যত ও সম্মান অনুভব করতে পারে। কেননা সে তো মহাসম্মানিত পরাক্রমশালী আল্লাহর উপর নির্ভর করেছে। একইভাবে মানুষের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকেও সে বেঁচে যায়; কেননা সে ঐশ্বর্যময় আল্লাহ গনীর ধনে ধনী। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَإِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে (আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট)। কেননা আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৪৯)।
তাওয়াক্কুল শব্দ বলার পর আল্লাহ তা‘আলা আযীয (عَزِيزٌ) শব্দ ব্যবহার করে একথাই বুঝিয়েছেন যে, যে তার উপর তাওয়াক্কুল করে সে তার থেকে ইযযত ও পরাক্রম লাভ করে, তার মযদুরী বৃথা যায় না।
[চলবে
[1]. আল-মু‘জামুল কাবীর ৯/১৩৩।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/২১৪৪, হাদীছ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/২৫৩৮।
[4]. কামালুদ্দীন দামীরী, হায়াতুল হায়ওয়ান আল-কুবরা ২/১৭।
[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ ২/৪৬৫।
[6]. বুখারী হা/৫৭০৫; মুসলিম হা/২২০।
[7]. তিরমিযী হা/২৩৪৪, হাকিম এটিকে ছহীহ বলেছেন। আহমাদ হা/৩৭৩।
[8]. তিরমিযী হা/৩৪২৬, আলবানী এটিকে ছহীহ গণ্য বলেছেন।