ইসলামে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। এ গুরুত্বের কারণেই আল্লাহ তা‘আলা প্রথম মানুষ আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সর্বপ্রথম শিক্ষাদান করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلاَئِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُوْنِيْ بِأَسْمَاءِ هَـؤُلاَءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ- ‘আর আল্লাহ আদমকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দোন। তারপর সেসমস্ত বস্ত্ত ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। অতঃপর আল্লাহ বলেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ (বাক্বারাহ ৩১)। জ্ঞানই সবকিছুর ভিত্তিমূল। জ্ঞানের আলোকেই মানুষ ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। জ্ঞান তথা শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় জাতিসত্তা। কোন জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হ’ল শিক্ষা। জাতীয় আশা-আকাঙ্খা পূরণ, জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে চরিত্র গঠন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী ব্যক্তিত্ব তৈরি করা কেবলমাত্র উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রধান উপকরণও শিক্ষা।
কোন জাতিকে একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হ’লে সেই জাতির লোকদেরকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। যখন তারা সেই আদর্শ অনুযায়ী তৈরি হবে তখনই একটি সফল সামাজিক বিপ্লব সাধন সম্ভব। মহানবী (ছাঃ) মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে জাহেলিয়াতের গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জাতিকে একটি বিশ্ববিজয়ী জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। আর এজন্য তিনি হেরা পর্বতের চূড়া থেকে নেমে আসা ইসলামের সর্বপ্রথম বাণী ‘ইক্বরা’র পথ ধরেই সামনে অগ্রসর হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ- خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ- ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। পড় এবং তোমার প্রতিপালক মহা সম্মানিত। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না’ (আলাক্ব ১-৫)। হেরা পর্বতের নির্জন স্থানে নবী করীম (ছাঃ) যখন স্রষ্টার ধ্যানে গভীরভাবে নিমগ্ন, ইসলামের সেই ঊষালগ্নে মহান আল্লাহ উপরোক্ত ৫টি আয়াত জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে প্রেরণ করে অহির শুভ সূচনা করেন। এ ৫টি আয়াত মূলতঃ তাওহীদ ভিত্তিক জ্ঞান বিকাশের আহবান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি সফল সমাজ বিপ্লব সাধনের জন্য ছাফা-মারওয়া পাহাড়ে দাঁড়িয়ে, কা‘বা ঘরের চত্বরে দাঁড়িয়ে, উকাযের মেলা ঘুরে ঘুরে ‘ইক্বরা’ তথা পড়ার সবক দিয়েছিলেন। আল্লাহর নবী হিসাবে তিনি ভাল করেই জানতেন সমাজের মানুষকে সুশিক্ষিত করতে না পারলে, তাদের নৈতিক চরিত্রের সংশোধন ও উন্নতি বিধান করতে না পারলে সমাজের মধ্যে বন্যার স্রোতের ন্যায় সম্পদের প্রবাহ সৃষ্টি হ’লেও তাতে মানুষের কোন কল্যাণ সাধিত হবে না। সঠিক বিদ্যার্জন না করলে জ্ঞানের গভীরতা, ব্যাপকতা ও পরিপক্কতা আসবে না। তাই তো কুরআন ও হাদীছে জ্ঞান চর্চার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, فَلَوْلاَ نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوْا فِي الدِّيْنِ وَلِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوْا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَ- ‘তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হ’ল না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে?’ (তওবা ১২২)।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বৃহদাংশ জুড়ে রয়েছে জ্ঞানার্জনের তাকীদ। রাসূল (ছাঃ) এ তাকীদের পরিপ্রেক্ষিতেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন জ্ঞানার্জনের উপর। মহানবী (ছাঃ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ- ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয’।[1] আল্লাহকে জানা বা চেনার এটিই একমাত্র পথ। ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা অনুশীলন কোনটিই জ্ঞান ব্যতীত সুষ্ঠুভাবে সম্ভব নয়। আল্লাহ এবং ঈমানের অন্যান্য বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হ’লে এ সকল বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ কোন বিশ্বাসই অজ্ঞতার উপর স্থাপিত হ’তে পারে না, হ’লেও তা হয় ভঙ্গুর। তাই ধর্মের গভীরতা, ব্যাপকতা ও বিস্তৃতির জন্য জ্ঞানের ব্যাপকতা ও গভীরতার প্রয়োজন রয়েছে। মহানবী (ছাঃ) বলেন, إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِيْنٌ فَانْظُرُوْا عَمَّنْ تَأْخُذُوْنَ دِيْنَكُمْ ‘নিশ্চয়ই এ জ্ঞান ধর্ম স্বরূপ। সুতরাং তোমরা লক্ষ্য রাখবে কার নিকট হ’তে তোমাদের ধর্ম গ্রহণ করছ’।[2] এ হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, জ্ঞান কার নিকট হ’তে গ্রহণ করা হচ্ছে, তা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা জ্ঞানের যুক্তির সাহায্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করা অধিকতর সহজ। তবে পার্থিব জীবনে দেশ ও জাতির উন্নয়নমূলক জ্ঞান যার সাথে ঈমান ও আক্বীদার কোন বিরোধ নেই, তা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের নিকট হ’তে গ্রহণ করা যায়।
জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে ইসলামে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِداً وَقَائِماً يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُوْ رَحْمَةَ رَبِّهِ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ- ‘যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালের ভয় করে এবং তার পালনকর্তার রহমতের প্রত্যাশা করে, সে কি সমান, যে এরূপ করে না। বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হ’তে পারে? কেবলমাত্র বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে’ (যুমার ৯)। প্রকৃত জ্ঞানই মানব সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারে। জ্ঞান চর্চা প্রতিটি মানুষকে অপার মহিমায় আলোকিত করে তোলে। পবিত্র কুরআনে জ্ঞানকে আলোর সাথে তুলনা করা হয়েছে। অন্যদিকে অজ্ঞতাকে অন্ধকারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيْرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّوْرُ- ‘বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান অথবা অন্ধকার ও আলো কি এক?’ (রা‘দ ১৬)। এ আয়াত থেকে বুঝা যায় অন্ধ ও চক্ষুষ্মান ব্যক্তির মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি জ্ঞানী ও জ্ঞানহীন ব্যক্তির মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক তফাৎ। মহানবী (ছাঃ) বলেন, فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِىْ عَلَى أَدْنَى مِنْ أُمَّتِىْ ‘আবেদের উপরে আলেমের মর্যাদা হচ্ছে তোমাদের মধ্যে নিম্নতমের উপরে যেমন আমার মর্যাদা’।[3] তিনি আরো বলেন, مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَلْتَمِسُ فِيْهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيْقًا إِلَى الْجَنَّةِ وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِيْ بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُوْنَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِيْنَةُ وَغَشِيَتْهُمْ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمْ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمْ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ فِيْمَنْ عِنْدَهُ- ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের কোন পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। যখন কিছু লোক একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাদের উপর নেমে আসে প্রশান্তি, ঢেকে রাখে তাদেরকে আল্লাহর রহমত, পরিবেষ্টিত করে তাদেরকে ফেরেশতাগণ এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ফেরেশতাদের নিকট আলোচনা করেন’।[4]
জ্ঞানার্জন ও বিতরণের মধ্যেই জাতির কল্যাণ নিহিত। মহানবী (ছাঃ) বলেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে কুরআন শিখে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়’।[5] রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ عَلِمَهُ ثُمَّ كَتَمَهُ أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ- ‘কোন ব্যক্তির কাছে ইলম তথা জ্ঞান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হ’লে অতঃপর সে তা গোপন করলে ক্বিয়ামতের দিন তাকে জাহান্নামের একটি লাগাম পরিয়ে দেওয়া হবে’।[6]
জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকতে হবে। অধিক জান্তার ভান না দেখিয়ে প্রয়োজনবোধে জ্ঞানী ব্যক্তির শরণাপন্ন হ’তে হবে। নবী-রাসূলদের জীবনী থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (রাঃ) বলেন, ‘একদিন মূসা (আঃ) বনী ইসরাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, সব মানুষের মধ্যে অধিক জ্ঞানী কে? মূসা (আঃ)-এর জানামতে তার চাইতে অধিক জ্ঞানী আর কেউ ছিল না। তাই বললেন, আমিই সবার চাইতে অধিক জ্ঞানী। আল্লাহ তা‘আলা তার নৈকট্যশীল বান্দাদেরকে বিশেষভাবে গড়ে তোলেন। তাই এ জওয়াব তিনি পসন্দ করলেন না। এখানে বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়াই ছিল আদব। অর্থাৎ একথা বলা উচিত ছিল যে, আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন, কে অধিক জ্ঞানী। এ জওয়াবের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে মূসা (আঃ)-কে তিরস্কার করে অহী নাযিল হ’ল যে, দু’সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আপনার চাইতে অধিক জ্ঞানী। একথা শুনে মূসা (আঃ) প্রার্থনা জানালেন যে, তিনি অধিক জ্ঞানী হ’লে তার কাছ থেকে জ্ঞান লাভের জন্য আমার সফর করা উচিত। তাই বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে তার ঠিকানা বলে দিন। আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নিন এবং দু’সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের দিকে সফর করুন। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেখানেই আমার এ বান্দার সাক্ষাৎ পাবেন। মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ মত থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তার সাথে তার খাদেম ইউশা ইবনে নূনও ছিল। পথিমধ্যে একটি প্রস্তরখন্ডের উপর মাথা রেখে তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। এখানে হঠাৎ মাছটি নড়াচড়া করতে লাগল এবং থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে চলে গেল। মাছটি সমুদ্রের যে পথ দিয়ে চলে গেল, আল্লাহ তা‘আলা সে পথে পানির স্রোত বন্ধ করে দিলেন। ফলে সেখানে পানির মধ্যে একটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। ইউশা ইবনে নূন এ আশ্চর্যজনক ঘটনা নিরীক্ষণ করছিলেন। মূসা (আঃ) নিদ্রিত ছিলেন। যখন জাগ্রত হ’লেন, তখন ইউশা ইবনে নূন মাছের এ আশ্চর্যজনক ঘটনা তার কাছে বলতে ভুলে গেলেন এবং সেখান থেকে সামনে রওয়ানা হয়ে গেলেন। পূর্ণ একদিন একরাত সফর করার পর সকাল বেলায় মূসা (আঃ) খাদেমকে বললেন, আমাদের নাশতা আন। এ সফরে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। নাশতা চাওয়ার পর ইউশা ইবনে নূন-এর মাছের ঘটনা মনে পড়ল। তিনি ভুলে যাওয়ার ওযর পেশ করে বললেন, শয়তান আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর বললেন, মৃত মাছটি জীবিত হয়ে আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে চলে গেছে। তখন মূসা (আঃ) বললেন, সে স্থানটিই তো আমাদের লক্ষ্য ছিল।
সেমতে তৎক্ষণাৎ তারা ফিরে চললেন এবং স্থানটি পাওয়ার জন্য পূর্বের পথ ধরেই চললেন। প্রস্তরখন্ডের নিকট পেঁŠছে দেখলেন, এক ব্যক্তি আপাদমস্তক চাদরে আবৃত হয়ে শুয়ে আছে। মূসা (আঃ) তদবস্থায়ই সালাম করলে খিযির (আঃ) বললেন, এ প্রান্তরে সালাম কোথা থেকে এল? মূসা (আঃ) বললেন, আমি মূসা। খিযির প্রশ্ন করলেন, বনী ইসরাঈলের মূসা? তিনি জওয়াব দিলেন, জি হ্যাঁ। আমি আপনার কাছ থেকে ঐ বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন।
খিযির (আঃ) বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না হে মূসা! আমাকে আল্লাহ এমন জ্ঞান দান করেছেন, যা আপনার কাছে নেই; পক্ষান্তরে আপনাকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা আমি জানি না। মূসা (আঃ) বললেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। আমি কোন কাজে আপনার বিরোধিতা করব না। খিযির (আঃ) বললেন, যদি আপনি আমার সাথে থাকতেই চান, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে তার স্বরূপ বলে দেই।
একথা বলার পর উভয়ে সমুদ্রের পাড় ধরে চলতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে একটি নৌযান এসে গেলে তারা নৌকায় আরোহণের ব্যাপারে কথাবার্তা বললেন। মাঝিরা খিযির (আঃ)-কে চিনে ফেলল এবং কোন রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদেরকে নৌকায় তুলে নিল। নৌকায় চড়েই খিযির কুড়ালের সাহায্যে নৌকার একটি তক্তা তুলে ফেললেন। এতে মূসা (আঃ) বললেন, তারা কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিয়েছে। আপনি কি এরই প্রতিদানে তাদের নৌকা ভেঙ্গে দিলেন যাতে সবাই ডুবে যায়? এতে আপনি অতি মন্দ কাজ করলেন। খিযির বললেন, আমি পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। তখন মূসা (আঃ) ওযর পেশ করে বললেন, আমি আমার ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না।
রাসূল (ছাঃ) এ ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, মূসা (আঃ)-এর প্রথম আপত্তি ভুলক্রমে, দ্বিতীয় আপত্তি শর্ত হিসাবে এবং তৃতীয় আপত্তি ইচ্ছাক্রমে হয়েছিল। ইতিমধ্যে একটি পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র হ’তে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। খিযির (আঃ) মূসা (আঃ)-কে বললেন, আমার জ্ঞান এবং আপনার জ্ঞান উভয়ে মিলে আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানের মোকাবেলায় এমন তুলনাও হয় না, যেমনটি এ পাখির চঞ্চুর পানির সাথে রয়েছে সমুদ্রের পানি।
অতঃপর তারা নৌকা থেকে নেমে সমুদ্রের কূল ধরে চলতে লাগলেন। হঠাৎ খিযির একটি বালককে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলা করতে দেখলেন। খিযির স্বহস্তে বালকটির মস্তক তার দেহ হ’তে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। বালকটি মরে গেল। মূসা (আঃ) বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ প্রাণকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছেন। এ যে বিরাট গোনাহের কাজ করলেন। খিযির বললেন, আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। মূসা (আঃ) দেখলেন, এ ব্যাপারটি পূর্বাপেক্ষা গুরুতর। তাই বললেন, এরপর যদি কোন প্রশ্ন করি, তবে আপনি আমাকে পৃথক করে দেবেন। আমার ওযর-আপত্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
অতঃপর তাঁরা আবার চলতে লাগলেন। এক গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। তারা খাবার দিতে অস্বীকার করল। খিযির এ গ্রামে একটি প্রাচীরকে পতনোন্মুখ দেখতে পেলেন। তিনি নিজ হাতে প্রাচীরটি সোজা করে দিলেন। মূসা (আঃ) বিস্মিত হয়ে বললেন, আমরা তাদের কাছে খাবার চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করল অথচ আপনি তাদের এত বড় কাজ করে দিলেন; ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। খিযির বললেন, এখন শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। এটাই আমার ও আপনার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়। এরপর খিযির ঘটনাত্রয়ের স্বরূপ মূসা (আঃ)-এর কাছে বর্ণনা করে বললেন, এ হচ্ছে সেসব ঘটনার স্বরূপ; যেগুলো দেখে আপনি ধৈর্য ধরতে পারেননি। রাসূল (ছাঃ) সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, মূসা (আঃ) যদি আরও কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আরও কিছু জানা যেত।[7]
আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘নৌকার ব্যাপার হ’ল, সেটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি ইচ্ছা করলাম যে, সেটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দেই। তাদের অপরদিকে ছিল এক বাদশাহ। সে বল প্রয়োগে প্রত্যেকটি নৌকা ছিনিয়ে নিত। বালকটির ব্যাপার হ’ল, তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম যে, সে অবাধ্যতা ও কুফর দ্বারা তাদেরকে প্রভাবিত করবে। অতঃপর আমি ইচ্ছা করলাম যে, তাদের পালনকর্তা তাদেরকে মহত্তর, তার চাইতে পবিত্রতায় ও ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুক। প্রাচীরের ব্যাপার হ’ল, সেটি ছিল নগরের দু’জন পিতৃহীন বালকের। এর নীচে ছিল তাদের গুপ্তধন এবং তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং আপনার পালনকর্তা দয়াবশত ইচছা করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পণ করুক এবং নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক। আমি নিজ মতে এটি করিনি। আপনি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করতে অক্ষম হয়েছিলেন, এ হ’ল তার ব্যাখা’ (কাহাফ ৭৯-৮২)।
জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَطْلُبُ فِيْهِ عِلْمًا سَلَكَ اللهُ بِهِ طَرِيْقًا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّهُ لَيَسْتَغْفِرُ لِلْعَالِمِ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ حَتَّى الْحِيْتَانُ فِي الْمَاءِ وَفَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ إِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ لَمْ يَرِثُوا دِيْنَارًا وَلَا دِرْهَمًا وَإِنَّمَا وَرِثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ-
‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনে কোন পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। ফেরেশতাগণ জানার্জনকারীর জন্য দো‘আ করে। জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা, এমনকি পানির নীচের মাছও। জ্ঞানহীন ইবাদত গোযারের তুলনায় জ্ঞানী ব্যক্তি ঠিক সেরকম, যেমন পূর্ণিমার রাতের চাঁদ তারকারাজীর উপর দীপ্তিমান। আর জ্ঞানীগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। তারা টাকা-পয়সার উত্তরাধিকারী করেননি। বরং জ্ঞানের উত্তরাধিকারী করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেছে সে ঐ উত্তরাধিকার পূর্ণ মাত্রায় লাভ করেছে’।[8]
জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে ইসলামের উদার দৃষ্টিভঙ্গির অনন্য উদাহরণ পাওয়া যায় যুদ্ধ বন্দীদের ব্যাপারে মহানবী (ছাঃ)-এর মহানুভবতা থেকে। হিজরতের দেড় বছর পর বদর যুদ্ধে প্রায় ৭০ জন মুশরিক বন্দী হয়। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোকের মুক্তিপণ দানের সামর্থ্য ছিল না। রাসূল (ছাঃ) মদীনার ১০ জন করে ছেলেমেয়েকে শিক্ষাদানের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্ত করে দেন।[9]
মানুষ হিসাবে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সাধনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা, তাঁর প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করা, পার্থিব সুখ-শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং আখেরাতে চিরন্তন শান্তি লাভ করার জন্য জ্ঞান চর্চা করা অত্যাবশ্যক। প্রকৃত মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে মুক্ত রেখে সুন্দর মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য জ্ঞান চর্চার কোন বিকল্প নেই। তবে এ জ্ঞানার্জনের জন্য স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেই হবে এমনটি নয়। কুরআন-হাদীছ চর্চার মাধ্যমে সেটি সম্ভব। আদম থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত এমনকি আববাসীয় যুগের পতন পর্যন্ত কুরআন ও হাদীছই ছিল সবার জন্য আবশ্যকীয় পাঠ্যসূচী। ইমাম চতুষ্টয় ও মুহাদ্দিছগণও প্রাথমিক জীবনে কুরআন ও হাদীছ অধ্যয়ন করেছেন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হয়েছেন। ফলে তাঁদের শিক্ষা ও দৃষ্টিকোণ কুরআন-হাদীছের জ্ঞান প্রভাব দ্বারা বিপুলভাবে নিয়ন্ত্রিত ও বিশুদ্ধকৃত। এমনকি বিশ্বের বহু প্রখ্যাত দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষাবিদ শ্রেণীকক্ষ পাশের সার্টিফিকেট ছাড়াই শিক্ষালাভ করেছেন। আর তাঁদের মত মনীষীরাই বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার বা শিক্ষার জগতে মৌলিক অবদান রেখে গেছেন।
[চলবে]
ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, বারিধারা ক্যাম্পাস, ঢাকা।
[1]. মিশকাতুল মাছাবীহ, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/২১৮।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৩।
[3]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২১৩, ২১৪।
[4]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২১২।
[5]. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল বুখারী, বুখারী, (রিয়ায: দারুস সালাম, ১৯৯৯), পৃ. ৯০১; মিশকাত হা/২১০৯।
[6]. তিরমিযী, ‘কিতাবুল ইলম’, মিশকাত হা/২২৩।
[7]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী, ২য় খন্ড, (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম সংস্করণ, ফেব্রুয়ারী ’১১), পৃঃ ১০২-১০৮।
[8]. ছহীহুল জামে‘ হা/৬২৯৭।
[9]. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, অগ্রপথিক, ১৭বর্ষ, সংখ্যা ১০, অক্টোবর (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০২), পৃঃ ৬৯।