[প্রফেসর হাফেয আব্দুল্লাহ বাহাওয়ালপুরী পাকিস্তানের একজন খ্যাতিমান আলেম, মাসলাকে আহলেহাদীছ-এর অনেক বড় দাঈ ও মুবাল্লিগ ছিলেন। তিনি ১৯২৪ সালের দিকে পূর্ব পাঞ্জাবের আম্বালা যেলার রোপাড় তহসিলের ডুগরী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী নূর মুহাম্মাদ অত্যন্ত সৎ ও আল্লাহভীরু ব্যক্তি ছিলেন। দেশ বিভাগের অনেক আগেই বাহাওয়ালপুরী ‘জামে‘আ তা‘লীমুল ইসলাম’ (মামূকাঞ্জন)-এর খ্যাতিমান শিক্ষকদের নিকট থেকে ইলমে দ্বীন হাছিল করেন। হাফেয আব্দুল্লাহ রোপড়ী এবং মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন রোপড়ী তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদগণের অন্যতম ছিলেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজে এম.এ. করেন। তিনি ইংরেজী, আরবী, উর্দূ ও ফার্সী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। দেশ বিভাগের সময় তিনি ৯০ হাযার লোকের বিশাল কাফেলা নিয়ে পাকিস্তানে হিজরত করেন। এ সময় তিনি একশ’ গ্রামের আমীর ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বাহাওয়ালপুরের এস.ই. কলেজে লেকচারার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি হিজরত করে পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে এসে মুহাজির কলোনীতে তার বাড়ীর একটা অংশকে মসজিদের জন্য ওয়াকফ করে দেন এবং সেখানে জুম‘আ ও জামা‘আত কায়েম করেন। এভাবে যেখানেই গেছেন আহলেহাদীছ মসজিদ তৈরী করেছেন এবং জামা‘আত কায়েম করেছেন। তিনি মন-মেযাজে, মেধা-মননে, চিন্তা-চেতনায়, গোপনে-প্রকাশ্যে একজন সাচ্চা আহলেহাদীছ ছিলেন। বাহাওয়ালপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে তিনি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তাঁর দাওয়াতে হাযার হাযার মানুষ সঠিক পথের দিশা খুঁজে পেয়েছে। বহু মানুষ তাক্বলীদের বন্ধন ছিন্ন করে কুরআন ও হাদীছের অনুসারী হয়েছে। পাকিস্তানের প্রফেসর যাফর ইকবাল সালাফী তাঁর দাওয়াতেই ব্রেলভী ও নকশবন্দী তরীকা ছেড়ে আহলেহাদীছ হন। আহলেহাদীছ মাসলাকের প্রচার-প্রসারের জন্য তিনি সরকারী কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ অবলীলায় হাতছাড়া করেন।

অত্যন্ত সাধাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত প্রফেসর আব্দুল্লাহ বাহাওয়ালপুরী ১৪১১ হিজরীর ৬ই শাওয়াল মোতাবেক ১৯৯১ সালের ২১শে এপ্রিল রবিবার দুপুর ১২-টার দিকে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানের খ্যাতিমান আহলেহাদীছ আলেম ও মুহাক্কিক মাওলানা এরশাদুল হক আছারী তাঁর জানাযার ছালাতে ইমামতি করেন। বহু মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। বাহাওয়ালপুরে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫০টি। তন্মধ্যে তাক্বলীদ কে খওফনাক নাতায়েজ, আহলেহাদীছ কে লিয়ে দাওয়াতে ফিকর ওয়া আমল, হাম নামায মে রাফঊল ইয়াদায়েন কিঁউ করতে হ্যাঁয়, খুতবাতে বাহাওয়ালপুরী (৫ খন্ড), রাসাইলে বাহাওয়ালপুরী অন্যতম।][1]

ইসলামী সমাজে আমীর থাকা দ্বীনের ওয়াজিব বিষয় সমূহের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, يَجِبُ أَنْ يُعْرَفَ أَنَّ وِلَايَةَ أَمْرِ النَّاسِ مِنْ أَعْظَمِ وَاجِبَاتِ الدِّينِ؛ بَلْ لَا قِيَامَ لِلدِّيْنِ وَلَا لِلدُّنْيَا إِلَّا بِهَا- ‘জানা আবশ্যক যে, আমীর নির্ধারণ করা দ্বীনের বড় ওয়াজিব সমূহের অন্যতম। বরং ইমারত ছাড়া দ্বীন ও দুনিয়ার কোন অস্তিত্বই নেই’।[2] আর ইক্বামতে দ্বীন ব্যতীত মুসলমান মুসলমান নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেছেন,

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ-

‘বলে দাও, হে আহলে কিতাবগণ! মূলতঃ তোমরা কোন কিছুর উপরেই প্রতিষ্ঠিত নও, যে পর্যন্ত না তোমরা তাওরাত, ইনজীল ও যে কিতাব তোমাদের প্রভুর পক্ষ হতে তোমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে তার যথার্থ অনুসারী হবে’ (মায়েদাহ ৫/৬৮)। অর্থাৎ তোমাদের কোন দ্বীন ঈমান নয়, যতক্ষণ না তোমরা দ্বীন কায়েম করবে।

মানুষ স্বভাবগতভাবে সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া তার জীবন যাপন করা কঠিন। আর মানুষের সংঘবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই সমাজ গড়ে ওঠে। যেখানেই কিছু মানুষ একত্রিত হবে, সেখানে তাদের একজনের আরেকজনের নিকটে প্রয়োজন পড়বে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে। যার জন্য ইমারতের নিয়ম-নীতি যরূরী। এজন্যই তিনজন ব্যক্তি যখন সফরে থাকবে তখনও তাদের মধ্যে আমীর নির্ধারণের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। বরং মুসনাদে আহমাদে তো একথা পর্যন্ত বর্ণিত আছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَحِلُّ لِثَلاَثَةِ نَفَرٍ يَكُونُونَ بِأَرْضِ فَلاَةٍ إِلاَّ أَمَّرُوا عَلَيْهِمْ أَحَدَهُمْ-

আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘কোন তিনজন ব্যক্তির জন্যেও কোন নির্জন ভূমিতে অবস্থান করা হালাল নয় তাদের মধ্যে একজনকে ‘আমীর’ নিযুক্ত না করা পর্যন্ত’।[3] অর্থাৎ সফরেও তিনজন ব্যক্তির আমীর বিহীন থাকা হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তিনজন ব্যক্তির মধ্য থেকেও একজনকে আমীর নির্ধারণ করাকে ওয়াজিব আখ্যা দেয়া প্রমাণ করে যে, যেখানেই কিছু মুসলমান থাকবে তারা অবশ্যই তাদের আমীর নির্ধারণ করবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ যেটি দ্বীনের অন্যতম ওয়াজিব বিষয় সমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, সেটাও আমীর ব্যতীত হতে পারে না। জিহাদ যেটা ইসলামের রূহ বা প্রাণ, এটাও আমীর ব্যতীত সম্ভব নয়। মোটকথা আমীর মুসলিম সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমীর ব্যতীত সঠিক ইসলামী সমাজ কায়েমই হতে পারে না। যে জামা‘আতে আমীর নেই সেই জামা‘আতের উদাহরণ হল ঐ লাশের মতো যার মাথা নেই। মাথা ছাড়া যেমন দেহ থাকে, সেরূপই অবস্থা আমীর বিহীন জামা‘আতের। ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী তো মুসলমানদের একদিনও আমীর বিহীন অতিবাহিত করা উচিত নয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যু হ’লে সর্বাগ্রে খলীফা নির্বাচন করা হয়। এরপর অন্য কাজ হয়। এমনকি তাঁর কাফন-দাফনও হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পরে হয়। এদিকে ছাহাবীদের যারা আমাদের পূর্বসূরি ও প্রথম আহলেহাদীছ তাদের অবস্থা এই যে, তাঁরা আমীর বিহীন এক রাতও অতিবাহিত করতেন না। অন্যদিকে আমাদের অবস্থা এই যে, আমরা আমীর নির্ধারণ ছাড়াই সারা জীবন অতিবাহিত করছি। এজন্যই তো বলা হয়, আহলেহাদীছ তো ছাহাবীগণ ছিলেন। যাদের প্রত্যেকটা আমল হাদীছ অনুযায়ী ছিল। যাদের নিকটে ইমারতের নিয়ম-নীতি এত যরূরী ছিল যে, আমীর ব্যতীত একদিন অতিবাহিত করাকে তারা হারাম মনে করতেন। এজন্য আমার ভাই যদি আমরা আহলেহাদীছ হতে চাই তাহলে আমাদেরকেও ছাহাবীগণের আদর্শের উপর চলে যেখানেই আমরা থাকি দ্রুত আমাদের আমীর নির্ধারণ করা উচিত। যাতে আমাদের জীবন হারাম না হয়ে আমীরের অধীনে অতিবাহিত হয়। যেমনটা শরী‘আতের নির্দেশ।

আমীর নির্ধারণ করা যেমন ফরয। আমীর ব্যতীত কোন জামা‘আতী যিন্দেগী নেই। তদ্রুপই আমীরের আনুগত্যও ফরয। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অত্যন্ত তাকীদ করেছেন। তিনি বলেছেন, مَنْ يُطِعِ الأَمِيْرَ فَقَدْ أَطَاعَنِى، وَمَنْ يَعْصِ الأَمِيْرَ فَقَدْ عََصَانِى-  ‘যে আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল’।[4] তিনি আমীরের আনুগত্যকে নিজের আনুগত্য এবং আমীরের অবাধ্যতাকে নিজের অবাধ্যতা আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে,إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوْا لَهُ وَأَطِيعُوْا-  ‘যদি তোমাদের উপর একজন নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামকেও আমীর নিযুক্ত করা হয়, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালনা করেন, তোমরা তার কথা শোন এবং আনুগত্য কর’।[5]

তিনি আরো বলেছেন,

اَلسَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيْمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ، مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ، فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ-

‘প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপর পসন্দনীয় ও অপসন্দনীয় সব বিষয়ে (নেতার নির্দেশ) শ্রবণ করা ও তার আনুগত্য করা অপরিহার্য। যতক্ষণ না আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ দেয়া হয়। যখন আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ দেয়া হবে, তখন আমীরের কথা শ্রবণ ও তার কোন আনুগত্য নেই’।[6]

لاَ طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةٍ، إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوْفِ- ‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবল ভাল কাজে’।[7]

হাদীছে এসেছে, لاَ طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِى مَعْصِيَةِ الخَالِقِِ ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই’।[8]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমীরের আনুগত্যের উপর জোর দিতে গিয়ে বলেছেন,مَنْ رَأىَ مِنْ أَمِيْرِهِ شَيْئًا يَكْرَهُهُ فَلْيَصْبِرْ فَإِنَّهُ لَيْسَ أَحَدٌ يُفَارِقُ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَيَمُوْتُ إِلاَّ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً- ‘যে ব্যক্তি তার আমীরের মধ্যে এমন কিছু দেখে যা সে অপসন্দ করে, তখন সে যেন ধৈর্য ধারণ করে। কেননা যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল অতঃপর মৃত্যুবরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল’।[9]

এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً- ‘যে ব্যক্তি (আমীরের) আনুগত্য হতে বেরিয়ে যায় ও জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, অতঃপর মারা যায়, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করে’।[10]

আমীরের আনুগত্য এত যরূরী যে, তিনি বলেছেন, أَلاَ مَنْ وَلِىَ عَلَيْهِ وَالٍ، فَرَآهُ يَأْتِى شَيْئًا مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ فَلْيَكْرَهْ مَا يَأْتِى مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ، وَلاَ يَنْزِعَنَّ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ- ‘সাবধান! কারো উপর যদি কোন শাসক নিযুক্ত হয়। অতঃপর সে যদি শাসককে আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কোন কাজ করতে দেখে, তখন সে যেন তার আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজকে ঘৃণা করে এবং অবশ্যই আনুগত্যের হাত গুটিয়ে না নেয়’।[11] এর দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, আমীর যদি খারাপও হয় তবুও প্রত্যেক নেকীর কাজে তার নির্দেশ মানতে হবে। অবশ্যই তার গোনাহকে খারাপ জানতে হবে এবং গোনাহের কাজ সমূহে তার আনুগত্য করা যাবে না। এছাড়া তার সব নির্দেশ মেনে নিতে হবে।

আফসোস তো এই যে, গণতন্ত্রপন্থী আহলেহাদীছরাও নিজেদের সংগঠনে সভাপতিকে আমীরের নাম দিয়ে দিয়েছে। যেটা সরাসরি ধোঁকা। আসলে সে আমীর হয় না। কোথায় শারঈ সংগঠনের আমীর আর কোথায় গণতন্ত্রের সভাপতি। কোথায় আল্লাহ প্রদত্ত ইমারত আর কোথায় দুনিয়াবী সভাপতি। শারঈ সংগঠনের আমীরের আনুগত্যকে তো কুরআন মাজীদও ফরয আখ্যা দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ  ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর’ (নিসা ৪/৫৯)। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সভাপতির আনুগত্যকে স্বয়ং গণতন্ত্র এবং তার সভাপতি যরূরী আখ্যা দেয় না। গণতন্ত্রের সভাপতির সম্পর্ক স্রেফ দল বা রাজনীতির সাথে হয়। তিনি শুধু রাজনীতির ময়দানেই আমীর হন। জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু শারঈ আমীর পুরা জীবনের তত্ত্বাবধায়ক হন। তার জন্য ফরয হ’ল, ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী নিজের জামা‘আতের এমন চরিত্র গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে তাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই ঠিক হয়ে যায়।

গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাসম্পন্ন হন না। কেননা তার দলের সকল সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন। ফলে তারা প্রেসিডেন্টের অনুগত হন না। তারা সর্বদা প্রেসিডেন্টের জন্য মাথাব্যথা হয়ে থাকেন। বরং সকল ক্ষমতা সেক্রেটারী অথবা প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকে। প্রেসিডেন্ট বেচারা তো একজন অক্ষম সদস্যের মতো হয়ে থাকেন।

পক্ষান্তরে শারঈ আমীর সম্পূর্ণরূপে নিজেই কর্তৃত্বশীল হন। তিনি পরামর্শ করে যাকে ইচ্ছা পদ দেন। এ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকেন। কারো অনুগত হন না। হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব ও হযরত ওমর (রাঃ) খলীফা হ’লে কেউ তাদের সেক্রেটারী বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। তারা যাকে ইচ্ছা নেতা বানাতেন। যাকে ইচ্ছা সরিয়ে দিতেন। শারঈ আমীরের পরে কারো কোন মতামত থাকত না। সব পদাধিকারী তার নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তার অনুসারী হয়। এজন্য আহলেহাদীছদের বর্তমান আমীরদেরকে শারঈ আমীর বলতে পারি না। আর না তাদের আনুগত্য ফরয। কেননা তারা কুফরী গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অধীনে আমীর হয়েছেন। তাদের সংগঠনও শরী‘আতসম্মত নয়, গঠনতন্ত্রও শরী‘আতসম্মত নয়। যেটা একজন প্রকৃত আহলেহাদীছের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

হে আহলেহাদীছগণ! এটা কি আফসোসের বিষয় নয় যে, ছাহাবীগণও আহলেহাদীছ ছিলেন এবং আমরাও আহলেহাদীছ। কিন্তু আমাদের ও তাদের মাঝে পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্ব। ছাহাবীগণের মাঝে আত্মসম্মানবোধ ছিল, দ্বীনী আগ্রহ ছিল। আমরা এসকল গুণ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। ছাহাবায়ে কেরাম দ্বীনী জোশে পাগলপারা ছিলেন। তারা ইসলামের জন্য জীবন দিতেন। আমরা দুনিয়াদার। আমরা গদির জন্য মরি এবং বাতিলের কাছে মাথা নত করি। এ সকল পার্থক্য স্রেফ এ কারণে যে, ছাহাবায়ে কেরাম ইসলামের ফসল ছিলেন। আমরা গণতন্ত্রের ফসল।

এখন হিজরী চতুর্দশ শতক শেষ হয়ে গেছে। অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে। ইসলাম বিকশিত হচ্ছে এবং শেষাবধি তাকে বিকাশমান থাকতে হবে। আমরা যদি এখনো না জাগি এবং নিজেদের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ না রাখি, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের অপেক্ষা করবেন না। আল্লাহ এই কাজ অন্য কারো দ্বারা নিবেন। আর আমরা আফসোস করতে থাকব। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ ‘যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এরপর তারা তোমাদের মত হবে না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৮)

বাগদাদের পতনের পর আল্লাহ ইসলামকে নিশ্চিহ্নকারীদের দ্বারাই ইসলামের কাজ নিয়েছেন। তাতার যারা ইসলামের দুশমন ছিল তারাই ইসলামের পাহারাদার হয়ে গেছে। এজন্য হে আমার ভাই! উঠো। নিজের মর্যাদাকে বুঝ। নিজের দায়িত্বকে পুরা কর। আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে তোমার মর্যাদা হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতিনিধি হওয়া। তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর উত্তরাধিকারী। নিজের আমল দ্বারা প্রমাণ করো যে, আহলেহাদীছরাই প্রকৃতপক্ষে রাসূল (ছাঃ)-এর উত্তরাধিকারী। এরাই বিশুদ্ধভাবে ইসলামের উপর আমলকারী।

ইক্বামতে দ্বীন আমাদের কাজ। এজন্য তাবলীগও করো এবং জিহাদও করো। এটাই আহলেহাদীছদের ফরয দায়িত্ব। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে প্রকৃত আহলেহাদীছ হওয়ার তাওফীক দিন এবং কুফরীর ফিতনা সমূহ থেকে বাঁচান। -আমীন ইয়া রববাল ‘আলামীন!

\ অমা ‘আলায়না ইল্লাল বালাগ \


[1]. প্রফেসর হাফেয আব্দুল্লাহ বাহাওয়ালপুরী, খুতবাতে বাহাওয়ালপুরী (ফায়ছালাবাদ, পাকিস্তান : মাকতাবায়ে ইসলামিয়াহ, ৩য় সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭), পৃঃ ১২-৩০

[2]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৮/৩৮০

[3]. আহমাদ হা/৬৬৪৭, হাদীছ হাসান।

[4]. বুখারী হা/২৯৫৭; মিশকাত হা/৩৬৬১

[5]. মুসলিম হা/১৮৩৮মিশকাত হা/৩৬৬২। 

[6]. বুখারী হা/৭১৪৪; মুসলিম হা/১৮৩৯; মিশকাত হা/৩৬৬৪

[7]. বুখারী হা/৭২৫৭; মুসলিম হা/১৮৪০; মিশকাত হা/৩৬৬৫

[8]. শারহুস সুন্নাহ; আহমাদ হা/১০৯৫; আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৩৮১; মিশকাত হা/৩৬৯৬

[9]. বুখারী হা/৭০৫৪; মুসলিম হা/১৮৪৯; মিশকাত হা/৩৬৬৮

[10]. মুসলিম হা/১৮৪৮; মিশকাত হা/৩৬৬৯।

[11]. মুসলিম হা/১৮৫৫; মিশকাত হা/৩৬৭০।





জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মুসলিম উম্মাহর বর্তমান বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
হাদীছ অনুসরণে পরবর্তী মুসলিম বিদ্বানদের সীমাবদ্ধতা ও তার মৌলিক কারণসমূহ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ওযূর আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
অভ্যাসগত বিশ্বাস থেকে চিন্তাশীল বিশ্বাসের পথে যাত্রা - মুহাম্মাদ আনওয়ারুল কারীম
উত্তম মৃত্যুর কিছু নিদর্শন ও আমাদের করণীয় - ইহসান ইলাহী যহীর
মরণ বাঁধ ফারাক্কা
ঈছালে ছওয়াব : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু শয়তান - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (১ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.