ওযূ হচ্ছে পবিত্র পানি দ্বারা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। যার মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গের পাপ সমূহ মুছে যায়। ছালাত আদায়ের জন্য ওযূ হচ্ছে শর্ত। ওযূ ব্যতীত ছালাত কবুল হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ، ‘পবিত্রতা (ওযূ) ব্যতীত ছালাত কবুল হয় না’।[1] এজন্য ছালাত আদায়ের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা ওযূ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوْا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوْا وُجُوْهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوْا بِرُءُوْسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ، ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা ছালাতে দন্ডায়মান হবে, তখন (ওযূ করার জন্য) তোমাদের মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় কনুই সমেত ধৌত কর এবং মাথা মাসাহ কর ও পদযুগল টাখনু সমেত ধৌত কর’ (মায়েদাহ ৫/৬)। আলোচ্য নিবন্ধে ওযূর গুরুত্বসহ ওযূর আদব সমূহ তুলে ধরা হ’ল।-

ওযূর গুরুত্ব :

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আল্লাহর জনৈক বান্দাকে কবরে একশত কশাঘাতের আদেশ দেওয়া হ’ল। তখন সে তা কমানোর জন্য বার বার আবেদন-নিবেদন করতে থাকল। শেষ পর্যন্ত একটি কশাঘাত অবশিষ্ট থাকল। তাকে একটি মাত্র কশাঘাতই করা হ’ল। তাতেই তার কবর আগুনে ভরে গেল। তারপর যখন আঘাতের প্রভাব দূর হ’ল এবং সে হুঁশ ফিরে পেল তখন বলল, তোমরা আমাকে কেন কশাঘাত করলে? তারা বলল, তুমি এক ওয়াক্ত ছালাত বিনা ওযূতে আদায় করেছিলে আর এক মযলূম বান্দার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলে। কিন্তু তাকে তুমি সাহায্য করনি’।[2]

জনৈক বিদ্বান বলেন, জেনে রাখ যে, যখন তুমি ওযূ করছ, তখন তুমি শীঘ্রই তোমার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে। সুতরাং তোমার উপরে আবশ্যক হ’ল যে, তুমি তওবা করে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। কেননা আল্লাহ পানি দ্বারা ধৌত করাকে গোনাহ থেকে ধুয়ে-মুছে পবিত্র হওয়ার জন্য সূচনা স্বরূপ করেছেন। অতএব যখন তুমি কুলি করবে তখন তোমার জিহবাকে মিথ্যা কথা, গীবত-তোহমত, চোগলখুরী ইত্যাদি থেকে পবিত্র কর। কারণ তোমার জিহবাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, আল্লাহর যিকর, কুরআন তেলাওয়াত, সৃষ্টিকে সঠিক পথ প্রদর্শন এবং নিজের দুনিয়াবী ও দ্বীনী প্রয়োজন প্রকাশ করার জন্য। আর যখন তুমি একে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পরিপন্থী কাজে ব্যবহার করলে তখন তুমি নে‘মতকে অস্বীকার করলে। কেননা তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নে‘মত। আর আল্লাহর নে‘মতকে তাঁর অবাধ্যতায় ব্যবহার চূড়ান্ত কুফরী।

যখন তুমি নাকে পানি দিবে তখন হারাম ঘ্রাণ শোকা থেকে তুমি তোমার নাককে পবিত্র রাখবে। যখন তুমি মুখমন্ডল ধৌত করবে তখন তুমি তোমার দৃষ্টিকে তিনটি বিষয় থেকে পবিত্র করবে। নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি তাকাবে না, ঘৃণা বা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে কোন মুসলমানের প্রতি তাকাবে না এবং কারো দোষ-ত্রুটির দিকে তাকাবে না। কেননা চক্ষুদ্বয়কে সৃষ্টি করা হয়েছে অন্ধকারে তোমার পথ দেখার জন্য, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তার দ্বারা সাহায্য নেওয়ার জন্য এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিসমূহ দেখে তা থেকে শিক্ষা লাভের জন্য। আর যখন তুমি তোমার দু’টি হাত পানি দ্বারা পবিত্র করবে তখন তুমি সেই দু’টিকে পবিত্র করবে মুসলমানকে কষ্ট দেওয়া থেকে, হারাম সম্পদ গ্রহণ করা থেকে অথবা এমন বিষয় লেখা থেকে, যা বৈধ নয়। কেননা কলম ভাব ও ভাষা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং যেসব জিনিস থেকে জিহবাকে হেফাযত করতে হয়, কলমকেও সেসব বিষয় থেকে হেফাযত করা যরূরী। যখন তুমি তোমার মাথা মাসাহ করবে, তখন জানবে যে, এই মাসাহ করা আল্লাহর নির্দেশের প্রতিপালন এবং তাঁর বড়তেবর প্রতি বিনয় প্রকাশ, তাঁর সামনে নম্রতা প্রকাশ এবং তাঁর সম্মানের প্রকাশ। আর যখন তুমি তোমার পদদ্বয়কে ধৌত করবে, তখন তুমি হারামের দিকে পদচারণা থেকে তোমার পা কে পবিত্র করবে। এটাই হবে উত্তম ওযূ। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدِهِ حَتَّى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِهِ، ‘যে ব্যক্তি ওযূ করে এবং উত্তমভাবে ওযূ করে, তার শরীর হ’তে তার সকল গুনাহ বের হয়ে যায়, এমনকি তার নখের নীচ হ’তেও তা বের হয়ে যায়’।[3]

গুরুত্বপূর্ণ এই আমলটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য কিছু আদব রয়েছে, সেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. বিসমিল্লাহ বলে ওযূ শুরু করা :

ওযূর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَلاَ وُضُوْءَ لِمَنْ لَمْ يَذْكُرِ اسْمَ اللهِ تَعَالَى عَلَيْهِ. ‘ঐ ব্যক্তির ওযূ হয় না যে তাতে আল্লাহর নাম নেয় না’।[4] অর্থাৎ ওযূর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে।

২. মিসওয়াক করা :

ওযূ করার পূর্বে মিসওয়াক করা মুস্তাহাব। কেননা এটা মুখের পরিচ্ছন্নতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ ‘মেসওয়াক মুখের পবিত্রতা অর্জনের উপায় ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের মাধ্যম’।[5] তিনি আরো বলেছেন,لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِى لأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ عِنْدَ كُلِّ صَلاَةٍ ‘আমার উম্মাতের উপর কষ্টকর না হ’লে অবশ্যই আমি তাদেরকে প্রত্যেক ছালাতের পূর্বে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম’।[6]

৩. পূর্ণরূপে ওযূ করা :

সঠিকভাবে ও পূর্ণাঙ্গরূপে ওযূ করা যরূরী। কেননা ওযূর উপরেই ছালাত নির্ভর করে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ نُعَيْمِ بْنِ عَبْدِ اللهِ الْمُجْمِرِ قَالَ رَأَيْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ يَتَوَضَّأُ فَغَسَلَ وَجْهَهُ فَأَسْبَغَ الْوُضُوءَ ثُمَّ غَسَلَ يَدَهُ الْيُمْنَى حَتَّى أَشْرَعَ فِى الْعَضُدِ ثُمَّ يَدَهُ الْيُسْرَى حَتَّى أَشْرَعَ فِى الْعَضُدِ ثُمَّ مَسَحَ رَأْسَهُ ثُمَّ غَسَلَ رِجْلَهُ الْيُمْنَى حَتَّى أَشْرَعَ فِى السَّاقِ ثُمَّ غَسَلَ رِجْلَهُ الْيُسْرَى حَتَّى أَشْرَعَ فِى السَّاقِ ثُمَّ قَالَ هَكَذَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَتَوَضَّأُ. وَقَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْتُمُ الْغُرُّ الْمُحَجَّلُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ إِسْبَاغِ الْوُضُوءِ فَمَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ فَلْيُطِلْ غُرَّتَهُ وَتَحْجِيلَهُ.

নু‘আয়ম ইবনু আব্দুল্লাহ আল-মুজমির (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ হুরায়রাহ (রাঃ)-কে ওযূ করতে দেখেছি। তিনি মুখমন্ডল ধেŠত করলেন এবং উত্তমরূপে ওযূ করলেন। এরপর তিনি ডান হাত বাহুর কিছু অংশ সহ ধেŠত করলেন। পরে বাম হাত ও বাহুর কিছু অংশসহ ধেŠত করলেন। এরপর মাথা মাসাহ করলেন। অতঃপর ডান পায়ের নলার কিছু অংশসহ ধেŠত করলেন, এরপর বাম পায়ের নলার কিছু অংশসহ ধেŠত করলেন। অতঃপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এভাবে ওযূ করতে দেখেছি। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পূর্ণাঙ্গরূপে ওযূ করার কারণে ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের মুখমন্ডল, হাত ও পায়ের ওযূর স্থান সমূহ উজ্জ্বল হবে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা সক্ষম তারা যেন নিজ নিজ মুখমন্ডল, হাত ও পায়ের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে নেয়’।[7]

তিনি আরো বলেন,أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ قَالُوْا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ إِسْبَاغُ الْوُضُوْءِ عَلَى الْمَكَارِهِ وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ- ‘আমি কি তোমাদেরকে বলব না, আল্লাহ তা‘আলা কি দিয়ে গুনাহ মুছে দেন এবং মর্যাদা বাড়িয়ে দেন? ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! হ্যাঁ (বলে দিন)। তিনি বললেন, কষ্ট সত্ত্বেও ভালভাবে ওযূ করা, মসজিদের দিকে বেশী বেশী যাতায়াত করা এবং এক ছালাত শেষ করে পরবর্তী ছালাতের জন্য অপেক্ষায় থাকা। আর এটাই হ’ল ‘রিবাত (প্রস্তুতি)’।[8]

৪. পানি অপচয় না করা :

ওযূ করার জন্য প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি তাঁর পুত্রকে দো‘আ করতে শুনলেন,

اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ الْقَصْرَ الأَبْيَضَ عَنْ يَمِينِ الْجَنَّةِ إِذَا دَخَلْتُهَا. فَقَالَ أَىْ بُنَىَّ سَلِ اللهَ الْجَنَّةَ وَتَعَوَّذْ بِهِ مِنَ النَّارِ فَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ إِنَّهُ سَيَكُونُ فِى هَذِهِ الأُمَّةِ قَوْمٌ يَعْتَدُونَ فِى الطُّهُورِ وَالدُّعَاءِ،

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট জান্নাতের ডান দিকের সাদা অট্টালিকা প্রার্থনা করি, যখন আমি তাতে প্রবেশ করব। (একথা শুনে) আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, হে বৎস! আল্লাহর নিকট জান্নাত প্রার্থনা কর এবং জাহান্নামের আগুন থেকে আশ্রয় চাও। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, শিঘ্রই এই উম্মতের মধ্যে এমন একদল লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা পবিত্রতা অর্জন (ওযূ) ও দো‘আর ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে’।[9]

আনাস (রাঃ) বলেন,كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَتَوَضَّأُ بِالْمُدِّ، ‘নবী করীম (ছাঃ) সাধারণতঃ এক ‘মুদ্দ’ বা ৬২৫ গ্রাম পানি দিয়ে ওযূ করতেন’।[10] অন্য হাদীছে পানি অপচয় করতে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَرَّ بِسَعْدٍ وَهُوَ يَتَوَضَّأُ فَقَالَ مَا هَذَا السَّرَفُ. فَقَالَ أَفِى الْوُضُوءِ إِسْرَافٌ قَالَ نَعَمْ وَإِنْ كُنْتَ عَلَى نَهَرٍ جَارٍ،

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সা‘দ (রাঃ)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি ওযূ করছিলেন। তিনি বলেন, এই অপচয় কেন? সা‘দ (রাঃ) বলেন, ওযূতেও কি অপচয় আছে? তিনি বলেন, হ্যাঁ যদিও তুমি প্রবহমান নদীতে থাক’।[11]

৫. কব্জিসহ দু’হাত ধৌত করা :

ওযূর পূর্বে দু’হাত কব্জিসহ ধৌত করা সুন্নাত। আমর ইবনু আবূ হাসান (রহঃ) হ’তে বর্ণিত,

سَأَلَ َعَبْدَ اللهِ بْنَ زَيْدٍ عَنْ وُضُوْءِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَدَعَا بِتَوْرٍ مِنْ مَاءٍ، فَتَوَضَّأَ لَهُمْ وُضُوْءَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَأَكْفَأَ عَلَى يَدِهِ مِنَ التَّوْرِ، فَغَسَلَ يَدَيْهِ ثَلاَثًا،

‘তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু যায়েদ (রাঃ)-কে নবী করীম (ছাঃ)-এর ওযূ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি এক পাত্র পানি আনলেন এবং তাঁদের (দেখাবার) জন্য নবী করীম (ছাঃ)-এর মত ওযূ করলেন। তিনি পাত্র থেকে দু’হাতে পানি ঢাললেন। তা দিয়ে হাত দু’টি তিনবার ধৌত করলেন’।[12]

৬. এক হাতে পানি নিয়ে কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া :

এক কোষ পানি নিয়ে কুলি করা ও নাকে পানি দিয়ে নাক ঝাড়া সুন্নাত। আব্দুল্লাহ ইবনু যায়েদ (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর ওযূ সম্পর্কে বলেন,ثُمَّ أَدْخَلَ يَدَهُ فِى التَّوْرِ، فَمَضْمَضَ وَاسْتَنْشَقَ وَاسْتَنْثَرَ ثَلاَثَ غَرَفَاتٍ، ‘অতঃপর পাত্রের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তিন কোষ পানি নিয়ে কুলি করলেন এবং নাকে পানি দিয়ে নাক ঝাড়লেন’।[13] তবে প্রয়োজনে নতুন পানি নিয়ে নাকে দিয়ে বাম হাতে ভালভাবে নাক ঝাড়া যাবে।[14]

৭. হাত ও পায়ের আঙ্গুলগুলি খিলাল করা :

হাত-পায়ের আঙ্গুলগুলি খিলাল করা সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِذَا تَوَضَّأْتَ فَخَلِّلِ الأَصَابِعَ ‘যখন তুমি ওযূ করবে তখন আঙ্গুলগুলো খিলাল করবে’।[15] অন্যত্র তিনি বলেন,إذَا تَوَضَّأتَ فَخَلِّلْ أّصَابِعَ يَدَيْكَ وَرِجْلَيْكَ، ‘যখন তুমি ওযূ করবে, তখন তোমার হাত ও পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করবে’।[16]

৮. নাকে পূর্ণরূপে পানি পৌঁছানো :

ওযূ করার সময় নাকে পূর্ণরূপে পানি প্রবেশ করানো সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَسْبِغِ الْوُضُوْءَ وَخَلِّلْ بَيْنَ الأَصَابِعِ وَبَالِغْ فِى الاِسْتِنْشَاقِ إِلاَّ أَنْ تَكُوْنَ صَائِمًا، ‘ভালোভাবে ওযূ কর, আঙ্গুলগুলোর মাঝে খিলাল কর এবং ছিয়ামপালনকারী না হ’লে নাকের গভীরে পানি পেঁŠছাও’।[17]

৯. ঘন দাড়ি খিলাল করা :

কারো দাড়ি ঘন থাকলে খিলাল করে সেখানে পানি প্রবেশ করানো যরূরী। আনাস (রাঃ) বলেন,كَانَ إِذَا تَوَضَّأَ أَخَذَ كَفًّا مِنْ مَاءٍ فَأَدْخَلَهُ تَحْتَ حَنَكِهِ فَخَلَّلَ بِهِ لِحْيَتَهُ وَقَالَ هَكَذَا أَمَرَنِى رَبِّى عَزَّ وَجَلَّ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওযূ করার সময় হাতে এক কোষ পানি নিতেন। তারপর ঐ পানি চোয়ালের নিম্নদেশে (থুতনির নীচে) লাগিয়ে দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন’।[18] ওছমান (রাঃ) বলেন, كَانَ يُخَلِّلُ لِحْيَتَهُ ‘নবী করীম (ছাঃ) দাড়ি খিলাল করতেন’।[19]

১০. ওযূ শেষে লজ্জাস্থান বরাবর পানি ছিটানো :

ওযূ করার পরে লজ্জাস্থান বরাবর পানি ছিটিয়ে দেওয়া মুস্তাহাব। হাকাম অথবা ইবনু হাকাম হ’তে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَالَ ثُمَّ تَوَضَّأَ وَنَضَحَ فَرْجَهُ. ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পেশাব করলেন। অতঃপর ওযূ করে স্বীয় লজ্জাস্থানে পানি ছিটিয়ে দিলেন’।[20]

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَنَّ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ أَتَاهُ فِى أَوَّلِ مَا أُوحِىَ إِلَيْهِ فَعَلَّمَهُ الْوُضُوءَ وَالصَّلاَةَ فَلَمَّا فَرَغَ مِنَ الْوُضُوءِ أَخَذَ غُرْفَةً مِنْ مَاءٍ فَنَضَحَ بِهَا فَرْجَهُ. ‘অহী নাযিলের প্রাথমিক পর্যায়ে জিবরীল (আঃ) আসলেন। তিনি নবী করীম (ছাঃ)-কে ওযূ ও ছালাত শিক্ষা দিলেন। আর তিনি ওযূ শেষ করে এককোষ পানি (হাতে উঠিয়ে) নিলেন এবং স্বীয় লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দিলেন।[21]

১১. ওযূর হেফাযত করা :

পরিপূর্ণরূপে ওযূ করার মাধ্যমে ওযূর হেফাযত করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اسْتَقِيمُوْا وَلَنْ تُحْصُوْا وَاعْلَمُوْا أَنَّ خَيْرَ أَعْمَالِكُمُ الصَّلاَةُ وَلاَ يُحَافِظُ عَلَى الْوُضُوْءِ إِلاَّ مُؤْمِنٌ. ‘তোমরা (দ্বীনের উপর) অবিচল থাকো, যদিও তোমরা আয়ত্তে রাখতে পারবে না। জেনে রাখো, তোমাদের আমল সমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হ’ল ছালাত। কেবল মুমিন ব্যক্তিই যত্ন সহকারে ওযূ করে’।[22]

১২. ওযূর পরে দো‘আ করা :

ওযূ করার পরে দো‘আ করা সুন্নাত। ওযূর পরে দো‘আ করলে জান্নাতের আটটি দরজার যে কোনটি দিয়ে প্রবেশ করা যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ الْوُضُوءَ ثُمَّ يَقُولُ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ إِلاَّ فُتِحَتْ لَهُ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ. ‘পরিপূর্ণরূপে ওযূ করে যে ব্যক্তি এই দো‘আ পাঠ করবে, ‘আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’। অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে, যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা তাতে প্রবেশ করবে’।[23] অন্যত্র তিনি বলেন,مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ قَالَ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ اللَّهُمَّ اجْعَلْنِىْ مِنَ التَّوَّابِيْنَ وَاجْعَلْنِى مِنَ الْمُتَطَهِّرِيْنَ فُتِحَتْ لَهُ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ. ‘যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযূ করার পর বলে, ‘আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহূ লা-শারীকা লাহূ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহূ ওয়া রাসূলুহু। আল্লা-হুম্মাজ্‘আল্নী মিনাত্ তাউয়াবীনা ওয়াজ্‘আল্নী মিনাল মুতাত্বাহ্হিরীন’। অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই; আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দাহ ও রাসূল। হে আল্লাহ! আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর। তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে’।[24]

১৩. ওযূর পরে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা :

ওযূ করার পর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা মুস্তাহাব।[25] রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ وُضُوْءَهُ ثُمَّ يَقُوْمُ فَيُصَلِّى رَكْعَتَيْنِ مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِهِ وَوَجْهِهِ إِلاَّ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ- ‘যে কোন মুসলিম যখনই সুন্দরভাবে ওযূ করে দাঁড়িয়ে একাগ্রতার সাথে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়’।[26]

এ ছালাতের ফযীলত সম্পর্কে আরো এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) একদা ফজর ছালাতের পর বেলাল (রাঃ)-কে বললেন,

يَا بِلاَلُ، حَدِّثْنِيْ بِأَرْجَى عَمَلٍ عَمِلْتَهُ فِيْ الإِسْلاَمِ، فَإنِّيْ سَمِعْتُ دَفَّ نَعْلَيْكَ بَيْنَ يَدَيَّ في الجَنَّةِ، قَالَ : مَا عَمِلْتُ عَمَلاً أرْجَى عِنْديْ مِنْ أَنِّيْ لَمْ أَتَطَهَّرْ طُهُوْرًا فِيْ سَاعَةٍ مِنْ لَيْلٍ أَوْ نَهَارٍ إِلاَّ صَلَّيْتُ بِذَلِكَ الطُّهُوْرِ مَا كُتِبَ لِيْ أنْ أُصَلِّيَ-

‘হে বেলাল! বল দেখি তুমি মুসলমান হওয়ার পর এমন কি আমল কর, যার নেকীর আশা তুমি অধিক পরিমাণে কর? কেননা আমি জান্নাতে তোমার জুতার শব্দ আমার সম্মুখে শুনতে পেয়েছি। তখন বেলাল (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি এছাড়া কোন আমল করি না যা আমার নিকট অধিক নেকীর কারণ হ’তে পারে। আমি রাতে বা দিনে যখনই ওযূ করি তখনই সে ওযূ দ্বারা (দু’রাক‘আত) ছালাত আদায় করি, যা আদায় করার তাওফীক আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন’।[27]

পরিশেষে বলব, উত্তমরূপে ওযূ করে ছালাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের সবাইকে পাপমুক্ত হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!


[1]. মুসলিম হা/২২৪; মিশকাত হা/৩০১।

[2]. শারহু মুশকিলিল আছার হা/৩১৮৫,২৬৯০; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২২৩৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৭৪

[3]. মুসলিম হা/২৪৫; মিশকাত হা/২৮৪।

[4]. আবূদাঊদ হা/১০১; তিরমিযী হা/২৫; মিশকাত হা/৪০২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৫১৪।

[5]. নাসাঈ হা/৫; মিশকাত হা/৩৮১; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৬৯৫।

[6]. আবূদাঊদ হা/৪৭; তিরমিযী হা/২২; ইবনে মাজাহ হা/২৮৭; মিশকাত হা/৩৯০; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩১৫।

[7]. মুসলিম হা/২৪৬।

[8]. মুসলিম হা/২৫১; ইবনু মাজাহ হা/৪২৮।

[9]. আবূদাঊদ হা/৯৬; মিশকাত হা/৪১৮।

[10]. মুসলিম হা/৩২৫; ইবনু মাজাহ হা/২৬৭; মিশকাত হা/৪৩৯ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, ‘গোসল’ অনুচ্ছেদ।

[11]. আহমাদ হা/৭০৬৫; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫; ছহীহাহ হা/৩২৯২; মিশকাত হা/৪২৭।

[12]. বুখারী হা/১৮৬।

[13]. বুখারী হা/১৮৬।

[14]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪, ৪১১; মিরক্বাত ২/১৪ পৃঃ; মাজমূ‘ ফাতাওয়া উছায়মীন ১২/২৫৭ পৃঃ ।

[15]. তিরমিযী হা/৩৮; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫৩।

[16]. তিরমিযী হা/৩৯; মিশকাত হা/৪০৬; ছহীহাহ হা/১৩০৬।

[17]. তিরমিযী হা/৭৮৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০৭; মিশকাত হা/৪০৫।

[18]. আবূদাঊদ হা/১৪৫; মিশকাত হা/৪০৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৬৯৬।

[19]. তিরমিযী হা/৩১; ইবনু মাজাহ হা/৪৩০; মিশকাত হা/৪০৯।

[20]. আবূদাঊদ হা/১৬৮; নাসাঈ হা/১৩৫; মিশকাত হা/৩৬১।

[21]. আহমাদ হা/২১৮১৯; মিশকাত হা/৩৬৬; ছহীহাহ হা/৮৪১।

[22]. ইবনু মাজাহ হা/২৭৭; মিশকাত হা/২৯২।

[23]. মুসলিম হা/২৩৪; ইবনু মাজাহ হা/৪৭০;  ইরওয়া হা/৯৬; মিশকাত হা/২৮৯।

[24]. তিরমিযী হা/৫৫; ইবনু মাজাহ হা/৪৭০; ছহীহুল জামে‘ হা/৬১৬৭।

[25]. নববী, আল-মাজমূ‘ ৩/৫৪৫; ফাতাওয়াল কুবরা ৫/৩৪৫।

[26]. মুসলিম হা/২৩৪; আবু দাঊদ হা/৯০৬; তিরমিযী হা/১০৫৯।

[27]. বুখারী হা/১১৪৯; মুসলিম হা/২৪৫৮; মিশকাত হা/১৩২২।






নফল ছিয়াম সমূহ - আত-তাহরীক ডেস্ক
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
সঠিক আক্বীদাই পরকালীন জীবনে মুক্তির উপায় - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
পরকীয়া : কারণ ও প্রতিকার (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
চিন্তার ইবাদত (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
জামা‘আতে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত ও হিকমত (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.