পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। 

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে এর সুন্দর দিক নির্দেশনা রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ইসলাম যথাযথ দিক নির্দেশনা দিয়েছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই ইসলাম রোগ প্রতিরোধের কতিপয় উত্তম ব্যবস্থাপনা দিয়েছে। যেগুলো মেনে চললে মানুষ সুস্থ থাকতে পারবে ইনশাআল্লাহ। এখানে তন্মধ্যে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হ’ল।-

পানপাত্রে মাছি পড়লে তা ডুবিয়ে দেয়া : মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হ’তে পারে এমন সব বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সতর্ক করেছেন। এমনই একটি বিষয় হ’ল পান পাত্রে মাছি পতিত হওয়া। মাছির এক ডানায় রয়েছে রোগ-জীবাণু, অন্য ডানায় রয়েছে তার প্রতিষেধক। আর মাছি যখন কোন পাত্রে পতিত হয় তখন রোগ-জীবাণু বিশিষ্ট ডানা ভারী হওয়ায় তা নিচে থাকে এবং প্রতিষেধক বিশিষ্ট ডানা উপরে থাকে। এমতাবস্থায় মাছিটিকে পানপাত্রে না ডুবিয়ে তুলে ফেলে দিলে ঐ পানীয় পান করার কারণে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হ’তে পারে। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا وَقَعَ الذُّبَابُ فِى شَرَابِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْمِسْهُ، ثُمَّ لِيَنْزِعْهُ، فَإِنَّ فِىْ إِحْدَى جَنَاحَيْهِ دَاءً وَالأُخْرَى شِفَاءً، ‘তোমাদের কারো পানীতে মাছি পতিত হ’লে সেটাকে তাতে ডুবিয়ে দিবে। অতঃপর তা উঠিয়ে ফেলবে। কেননা তার এক ডানায় রয়েছে রোগ-জীবাণু আর অপর ডানায় রয়েছে তার প্রতিষেধক’।[1]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,فِى أَحَدِ جَنَاحَىِ الذُّبَابِ سُمٌّ وَفِى الْآخَرِ شِفَاءٌ، فَإِذَا وَقَعَ فِى الطَّعَامِ فَامْقُلُوْهُ فِيهِ فَإِنَّهُ يُقَدِّمُ السُّمَّ وَيُؤَخِّرُ الشِّفَاءَ، ‘মাছির দু’টি ডানার একটিতে বিষ এবং অন্যটিতে প্রতিষেধক রয়েছে। অতএব খাদ্যদ্রব্যে মাছি পড়লে সেটিকে তাতে ডুবিয়ে দাও। কেননা মাছি বিষের ডানাকে প্রতিষেধকের ডানার আগে লাগায়’।[2]

কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ওয়াজীহ বায়েশরী এই হাদীছের আলোকে মাছিকে নিয়ে কয়েকটি পরীক্ষা চালান। জীবাণুমুক্ত কিছু পাত্রের মাধ্যমে মাছের বাযার থেকে কয়েকটি মাছি ধরে নিয়ে জীবাণুমুক্ত টেস্ট টিউবের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেন। তারপর নলটি একটি পানির গ্লাসে উপুড় করেন। মাছিগুলো পানিতে পতিত হওয়ার পর উক্ত পানি থেকে কয়েক ফোঁটা পানি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে, সেই পানিতে অসংখ্য জীবাণু রয়েছে। তারপর জীবাণুমুক্ত একটি সূঁচ দিয়ে মাছিকে ঐ পানিতেই ডুবিয়ে দেন। তারপর কয়েক ফোঁটা পানি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে, সেই পানিতে আগের মত আর জীবাণু নেই, বরং কম। তারপর আবার ডুবিয়ে দেন। তারপর কয়েক ফোঁটা পানি নিয়ে আবার পরীক্ষা করেন। এমনিভাবে কয়েক বার পরীক্ষা করে দেখেন যে, যত বার মাছিকে ডুবিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন, ততই জীবাণু কমেছে। অর্থাৎ ড. ওয়াজীহ এটা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, মাছির একটি ডানায় রোগ-জীবাণু রয়েছে এবং অপরটিতে রোগনাশক ঔষধ রয়েছে।[3]

ছোট্ট মাছির পাতলা ফিনফিনে ডানার একটাতে থাকে বিষ বা রোগ-জীবাণু আর অপরটাতে থাকে তার প্রতিষেধক এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দিয়েছেন আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে। যখন মানুষের রোগ-জীবাণু, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না, ছিল না এগুলো দেখার জন্য কোন অণুবীক্ষণ যন্ত্র। সুবহানাল্লাহ

কুকুরে মুখ দেয়া পাত্র মাটি দিয়ে মাজার নির্দেশ : কুকুর অপবিত্র প্রাণী। মল থেকে শুরু করে এমন বস্ত্ত নেই যা, সে ভক্ষণ করে না। এ থেকে শত-সহস্র রোগ-জীবাণু সৃষ্টি হয়। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুকুরে মুখ দেয়া পাত্রকে ৭ বার উত্তম রূপে ধৌত করতে বলেছেন এবং একবার মাটি দ্বারা মাজতে বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا وَلَغَ الْكَلْبُ فِى الإِنَاءِ فَاغْسِلُوْهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ وَعَفِّرُوهُ الثَّامِنَةَ فِى التُّرَابِ، ‘যখন কুকুর কোন পাত্রে মুখ দিবে তখন পাত্রটিকে সাতবার ধৌত করবে এবং অষ্টমবার মাটি দিয়ে মাজবে’।[4]

এই হাদীছকে সামনে রেখে লন্ডনের এক ব্যক্তি কিছু দিন পূর্বে পরীক্ষা চালিয়েছেন। তার কল্পনা ছিল, এই হাদীছ থেকে কিছু ত্রুটি বের করবেন। প্রযুক্তির উন্নতির এ যুগে অত্যাধুনিক কিছু কিছু জিনিস রয়েছে যা দিয়ে পরিস্কার করলে হয়তো মাটির প্রয়োজন হবে না। তিনি একটি পাত্রে কিছু খাদ্য রেখে তা কুকুরকে দিলেন। কুকুরটি তা খাওয়ার পর অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে, ঐ পাত্রটির মধ্যে অসংখ্য বিষাক্ত জীবাণু রয়েছে। তারপর সাবানসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে ভাল করে পরিস্কার করার পর আবার উক্ত যন্ত্র দিয়ে দেখেন যে, তাতে জীবাণু রয়েই গেছে। এমনিভাবে বহু বার পরিস্কার করার পরও উক্ত পাত্রটি জীবাণুমুক্ত হয়নি। অবশেষে রাসূল (ছাঃ)-এর বাৎলে দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী মাটি দিয়ে পরিস্কার করার পর দেখেন যে, উক্ত পাত্রটি সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয় প্রশস্ত হয়ে গেল। তিনি বললেন, এই তত্ত্ব একজন লেখাপড়া না জানা ব্যক্তি থেকে ১৪০০ বছর পূর্বে প্রকাশ পাওয়া এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি তার নিজেরলব্ধ জ্ঞান থেকে বর্ণনা করেননি, বরং মহান করুণাময় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে অহী-র মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এই দ্বীন সত্য, এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি স্বপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করলেন। প্রকাশ থাকে যে, মাটির মাঝে এমন একটি পদার্থ রয়েছে, যা কুকুরের লালার বিষাক্ত ক্ষুদ্র জীবাণুকে সমূলে ধ্বংস করতে পারে। কুকুরের লালায় মানব জাতির জন্য ক্ষতিকারক জীবাণু রয়েছে। এই মাটি সেই জীবাণুও ধ্বংস করতে সক্ষম।[5]

মাদকদ্রব্য পরিহারের নির্দেশ : কম হোক বা বেশী হোক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রত্যেক নেশাদার ও মাদকদ্রব্য সেবন করা থেকে কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন। কেননা এটা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও সকল ধরনের অনিষ্টের মূল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تَشْرَبِ الْخَمْرَ فَإِنَّهَا مِفْتَاحُ كُلِّ شَرٍّ ‘মদ পান করো না। কেননা এটা সকল অনিষ্টের চাবিকাঠি’।[6] অন্যত্র তিনি বলেন, كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَكُلُّ خَمْرٍ حَرَامٌ ‘সকল নেশাদার দ্রব্যই মদ আর সকল প্রকার মাদকদ্রব্য হারাম’।[7]

বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেছেন, মস্তিষ্কে এমন একটি স্নায়ুতন্ত্রী স্তর রয়েছে যাকে উত্তেজিত করার মতো প্রবল ক্ষমতা এ্যালকোহল তথা নেশাদার দ্রব্যের মধ্যে আছে। এ স্নায়ুতন্ত্রীর নাম হচ্ছে ‘ডোপামিন’। যদি ডোপামিন তন্ত্রীতে কম্পন সৃষ্টি হয় তাহ’লে পারকিনসন রোগের পঙ্গুত্ব এসে যাবেই। সাধারণত মাদকদ্রব্য ব্যবহারের কারণে মানুষের জ্ঞান ও বিবেক লুপ্ত হয়ে মগজে প্রাথমিক পর্যায়ে বিষের মতো কাজ করে। ফলে প্রতিটি বস্ত্ত থেকে তার অনুভূতি কমে যায়। মনুষ্যত্ববোধ ও অন্তর শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জীবনীশক্তি লোপ পায়। স্মরণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে। তখন তাদের হাত-পা কাঁপে, কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়ে যায়, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী কথা বলে। চেহারায় ধূসর মলিন ছাপ পড়ে। অবশেষে পাকস্থলী কিংবা লিভারে ক্যান্সার সৃষ্টি করে।[8]

মাদকাসক্তদের শরীরে মাদক মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে। দীর্ঘদিন ড্রাগ ব্যবহারের ফলে আসক্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, স্নায়ুর বিভিন্ন রোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, ব্রঙ্কাইটিস, অন্ত্রের ঘা, যৌন দুর্বলতা, সন্তান উৎপাদনে অক্ষমতা, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হ’তে পারে। এছাড়া ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ নিলে এইডস, হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘বি’ সহ বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্রমাগত হারে এদের রোগ-ব্যাধি বাড়তেই থাকে। এদের রোগ-ব্যাধি বেশী হয় ও স্বাস্থ্যহানি ঘটে।[9]

বিশ্বের প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিম্নোক্ত তথ্য পেশ করেছেন।

* মাদকদ্রব্য মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ সেল ধ্বংস করে দেয়, যা কোনভাবেই সারানো সম্ভব নয়। * মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে দেহের ত্বকের ইলাস্টিসিটি ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে যায়। * অনেক সময় মদ্যপায়ীরা আইকেমিক হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। * অতিরিক্ত মদ্যপায়ী ব্যক্তি পেপটিক আলসারে আক্রান্ত হয়। * মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে হজমশক্তি হ্রাস পায় এবং খাদ্য স্পৃহা কমে যায়। * মাদকদ্রব্য সেবনকারী লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়, যার চিকিৎসা দুরূহ। * অতিরিক্ত মদ পান করলে হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া মন্থর হয় এবং রক্তের চাপ বেড়ে যায়।[10] * মাদকাসক্তদের স্নায়ুতন্ত্র, মুখগহবর, গলা, স্বরতন্ত্র (Voice Box) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। * মদের সাথে সাথে যারা ধূমপান করে তাদের পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হ’তে পারে। * মাদক একটি ধীরগতি সম্পন্ন বিষক্রিয়া (Slow poison), যা মাদকসেবীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে।

ধূমপান এবং তামাক, জর্দা, গুল সেবন : বলা হয়, Smoking is the first step of intoxicant. ‘নেশার জগতে যাওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে ধূমপান’। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সামান্য নেশাদার দ্রব্যও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, مَا أَسْكَرَ كَثِيْرُهُ فَقَلِيْلُهُ حَرَامٌ ‘যে জিনিসে অতিমাত্রায় নেশা আনয়ন করে, তার সামান্য পরিমাণও হারাম’।[11] ধূমপায়ী নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ ضَرَرَ وَلاَ ضِرَارَ ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না এবং অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করো না’।[12]

ধূমপানের জন্য বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় (২০১২-এর হিসাব অনুযায়ী)। বিশ্বে ধূমপান ও তামাকের কারণে প্রতি বছর মৃত্যু হয় ১০ হাযার লোকের। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর মাদকদ্রব্য, খুন, রাহাজানি, আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য কারণে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী মৃত্যু হয় ধূমপানের কারণে।[13]

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বিশ্বের ৩৫ লক্ষ লোক প্রতি বছর মারা যায় শুধু ধূমপানের কারণে। ১৯৫০-২০০০ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ধূমপানের জন্য মারা যায় ৬ কোটি মানুষ। আন্তর্জাতিক সংস্থার এক রিপোর্টে জানা যায়, ধূমপানের জন্য বছরে শুধু আমেরিকাতে মারা যায় ৩ লক্ষ ৪৬ হাযার। বৃটেনে ৫৫ হাযার, সুইডেনে ৮ হাযার এবং সারা বিশ্বে ধূমপানের জন্য মারা যায় ২৫ লক্ষ।[14]

বিশেষজ্ঞদের মতে মাদক ও ভেজাল খাদ্যের জন্য যতটুকু ক্ষতি হয় তার থেকে বেশী ভয় ধূমপানের কারণে। যদি কেউ ২০টি সিগারেট টানে তাহ’লেই তার ক্যান্সারের ঝুঁকি ২০ গুণ বেড়ে যায়। জাতিসংঘ স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO)মতে, ‘ধূমপান করার কারণে প্রতি ৬ সেকেন্ডে ১ জন মানুষ মারা যায়’।[15]

ধূমপান একটি নেতিবাচক অভ্যাস। যার মধ্যে কোন উপকারিতা নেই বরং রয়েছে ১০০% ক্ষতি। আর ধূমপান মানে বিষ পান। কেননা ধূমপানের ধোঁয়াতে ৪০০০-এর মত রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে। যার কারণে ফুসফুস ও মুখগহবরে ক্যান্সারসহ ২৫ প্রকার রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য বিশেষ করে ধূমপানে সৃষ্ট ‘নিকোটিন’কে খুনী বলা হয়। ধূমপান মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মানুষ জানা সত্ত্বেও ধূমপান করে মৃত্যুবরণ করলে সেটি হয় আত্মহত্যার শামিল। ধূমপানের কারণে যে ধরনের মারাত্মক রোগের সম্মুখীন হ’তে হয় তার কয়েকটি নিম্নে দেওয়া হ’ল-

১. নতুন ধূমপায়ীদের মধ্যে বমি বমি ভাব, হতোদ্যম, মাথা ঘোরা, আবার কখনও বমিও হ’তে পারে। ২. অল্প পরিশ্রমেই অনেক ক্লান্ত হয়ে যায়। ধূমপানের ধোঁয়ার কারণে দৃষ্টিশক্তিও হ্রাস পেতে পারে। ৩. রক্তস্বল্পতা দেখা যায়, ধীরে ধীরে কিডনী অকেজো হয়ে পড়ে। ৪. গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা থেকে আলসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ৫. প্রাপ্ত বা অপ্রাপ্ত ধূমপায়ীদের যক্ষ্মা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার কাঁশি থেকে হাপানি রোগ দেখা দেয়। ৬. অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মৃত্যুর মুখেও উপনীত হ’তে পারে। ৭. ধূমপানের কারণে শারীরিক তাপ-প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। যার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ৮. ধূমপানের ফলে যৌনশক্তিও লোপ পেতে থাকে। ৯. হজমশক্তি কমে যায়, ধারণক্ষমতা লোপ পায় এবং শরীর ঢিলে হয়ে যায়। ১০. ধূমপানের ফলে পাকস্থলীতে ক্ষত হ’তে থাকে এবং যকৃৎ (Liver) শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ১২. ধূমপানের জন্য অনেক সময় মস্তিষ্কে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।[16]

ধূমপানে তামাক সরাসরি খাওয়া বা সেবন করা হয় না। কিন্তু তামাক পুড়িয়ে তার ধোঁয়া সেবন করা হয়। কিন্তু জর্দা-গুলখোরেরা তামাক সরাসরি খেয়ে ফেলে, যা ধূমপানের চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই ডাক্তারগণ ধূমপায়ী ও জর্দা-গুলখোরদেরকে বারবার তাকীদ দেন এগুলো পরিহারের জন্য। কারণ এগুলো পরিহার না করলে ঔষধও ভালোভাবে কাজ করে না।

যেনা-ব্যভিচার নিষিদ্ধ : বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রাণীকুলের আকর্ষণ চিরন্তন। এ আকর্ষণ থেকে মানব জাতিও মুক্ত নয়। যৌন শক্তি সম্পন্ন প্রতিটি নারী-পুরুষই পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অবাধ মেলামেশার সুযোগে তাদের মধ্যে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং অনেক সময় তা যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত করে। যেনা-ব্যভিচার তথা বহুগামিতার মাধ্যমে প্রাণঘাতী বিভিন্ন যৌনরোগ সৃষ্টি হয়। তন্মধ্যে রয়েছে মরণঘাতী এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, মেহ-প্রমেহ, ক্ষয়রোগ ইত্যাদি। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيْلاً ‘আর তোমরা যেনার ধারে-কাছেও যেও না। এটি অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩২)। অর্থাৎ যেনা-ব্যভিচারের দিকে ধাবিত হ’তে পারে এমন কোন পরিবেশ, পথ ও পন্থার নিকটবর্তী হওয়া নিষেধ। যেনা-ব্যভিচারের নিকটবর্তী হওয়া সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلاَّ كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ، ‘কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হ’লে তৃতীয় জন হবে শয়তান’।[17] অর্থাৎ শয়তান তাদেরকে যেনা-ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করবে। তাই এভাবে নির্জনে একত্রিত হওয়া নিষিদ্ধ।

যবেহ ব্যতীত অন্য কোন পন্থায় প্রাণী হত্যা করে তার গোশত ভক্ষণ করা : পশু-পাখি যবেহ ব্যতীত অন্য কোন পন্থায় হত্যা করে তার গোশত ভক্ষণ করা হালাল ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এমনকি যবেহ করার অস্ত্রটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অত্যন্ত ধারালো করে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ فَلْيُرِحْ ذَبِيْحَتَهُ، ‘তোমরা (পশু-পাখি) যবেহ কালে উত্তমরূপে সহানুভূতির সাথে যবেহ করবে। তোমাদের যে কেউ তার ছুরিটি যেন উত্তম রূপে ধারালো করে নেয় এবং তার পশুকে আরাম (নিস্তেজ হ’তে) দেয়’।[18]

গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা প্রাণীর গোশত খাওয়া যাবে না। কারণ যখন কোন পশুকে গলা টিপে ধরা হয় তখন সেটি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এর ফলে অতিরিক্ত Co2 (কার্বন-ডাই-অক্সাইড) রক্তে জমে যায় এবং এর দ্বারা ক্ষতিকর যৌগিক উপাদান গঠিত হয়। এছাড়া রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় মারাত্মক টক্সিন সৃষ্টি হয় এবং ব্যাকটেরিয়া থেকে যায়। যে গোশতে টক্সিন ও ব্যাকটেরিয়া থাকে তা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করাও যায় না, পচন ধরে। আর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা পশুর শরীর থেকে পরবর্তী পর্যায়ে রক্তক্ষরণ করাও সম্ভব হয় না। তাই এভাবে হত্যা করা প্রাণীর গোশত স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।[19]

ইলেকট্রিক শক, লৌহদন্ড কিংবা লাঠি দিয়ে আঘাত করে প্রাণী হত্যা করা একটি নিষ্ঠুর পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ায় পশুকে হত্যা করা হ’লে তার মধ্য থেকে প্রবহমান রক্ত বের হ’তে পারে না। কারণ রক্ত তখনই বের হয়ে আসে যখন হৃদ স্পন্দন সচল থাকে, পশু অবচেতন অবস্থায় থাকে এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। এ শর্তগুলো যবেহ হওয়া পশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়। পৃথিবীর বহু দেশে ইলেকট্রিক শক দিয়ে পশু হত্যা করে এর গোশত পরিবেশন করা হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এভাবে হত্যা করা পশুর গোশত স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। কারণ ইলেকট্রিক শকে বধ করা প্রাণীর গোশত ফুলে ওঠে, অন্ত্র রক্তাভ হয়ে যায় এবং মেরুদন্ডের হাড় ও কাঁধের দু’দিকের হাড় ফেটে যায়। এ অবস্থায় গোশতের সাথে যে রক্ত থাকে তার দরুন গোশতে পচন ধরে এবং গোশতের স্বাদ নষ্ট হয়। ইলেকট্রিক শকে হত্যা করা পশুর গোশতে পচন ধরার কারণ হ’ল, রক্ত নির্গত হওয়া ব্যতিরেকে ইলেকট্রিক শকের দরুন ল্যাকটিক এসিডের উচ্চ লেভেলে উত্তরণ। Lactic Acid উচ্চ পর্যায়ে উত্তরণের কারণে গোশতের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আবার জোরালো আঘাতে যদি মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহ’লে Voluntary muscles প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর তরল পদার্থ শরীর থেকে বের করে দেয় এবং হৃদ স্পন্দন থেমে গেলে মাথা বিচ্ছন্ন হ’লেও অধিক পরিমাণ রক্তক্ষরণ হবে না। অথচ নিরাপদ গোশতের জন্য রক্তক্ষরণ খুবই প্রয়োজনীয়।[20]

অনেক ইসলাম বিদ্বেষী যবেহ পদ্ধতিকে নিষ্ঠুর পদ্ধতি বলেছে। কিন্তু অন্যান্য পদ্ধতিতে প্রাণী বধ করার চেয়ে এ পদ্ধতি পশু-পাখির প্রাণবায়ু বের হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সহজ, আরামদায়ক ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কেননা যবহের সময় পশুর ঘাড়ের সব রক্তনালী, শ্বাসনালী ও অন্ননালীসহ শির-দাঁড়ার হাড়ের আগ পর্যন্ত সব নরম গঠন কেটে ফেলা হয়। ফলে মগজ রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। মগজ যখন রক্তশূন্য হয়ে পড়ে তখন মগজ থেকে হৃদপিন্ডে বার্তা পাঠিয়ে দেয় যে, আমি মহা বিপদে আছি, আমার রক্ত কমে গেছে, তোমরা রক্ত পাঠাও। এমনিভাবে নাড়ী-ভুড়ি, অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ ও সমস্ত শরীরে বার্তা পাঠিয়ে রক্ত পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এ খবর পাঠায় যে, রক্তের অভাবে মগজের কর্মক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে, তোমরা রক্ত পাঠাও। অতঃপর উক্ত প্রাণীটি নড়াচড়া করতে থাকে এবং যে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত রয়েছে তা এই নড়া-চড়ার মাধ্যমে হৃদপিন্ড উক্ত রক্তগুলো পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তা সেখানে পৌঁছতে পারে না বরং সেই কাটা রগ দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে। এমনি ভাবে শরীরের সমস্ত রক্ত বাইরে বের হয়ে গোশত রক্তমুক্ত হয়ে যায় এবং পরিস্কার ও পবিত্র হয়ে যায়। যা ভিতরে থাকলে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হ’ত। এই রক্ত ভিতরে থাকলে জীবাণু সম্প্রসারণে সাহায্য করত।[21]

মৃত প্রাণীর গোশত হারাম হওয়ার রহস্য : জাহিলী যুগের আরবগণ বৈধ মনে করে মৃত পশু-পাখীর গোশত ভক্ষণ করত। আল্লাহ তা‘আলা যখন তা হারাম করলেন তখন আরবের মুশরিকরা এ বিষয়ে বিতর্ক শুরু করল। তারা বলল, নিজেরা কতল করে যেটা খাওয়ার চেয়ে আল্লাহ যা কতল করেছেন সেটা খাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু তাদের এ যুক্তি বাস্তবতা পরিপন্থী এবং মৃত পশু-পাখি মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে মৃত মাছ ও টিড্ডি খাওয়া জায়েয। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أُحِلَّتْ لَكُمْ مَيْتَتَانِ وَدَمَانِ فَأَمَّا الْمَيْتَتَانِ فَالْحُوتُ وَالْجَرَادُ وَأَمَّا الدَّمَانِ فَالْكَبِدُ وَالطِّحَالُ، ‘আমাদের দু’ধরনের মৃত জীব ও দু’ধরনের রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত জীব দু’টি হ’ল মাছ ও টিড্ডি এবং দু’ধরনের রক্ত হ’ল কলিজা ও প্লীহা’।[22]

ড. হায়াত মুহাম্মাদ আলী খাফাজী বলেন, মৃত জীব-জন্তুর দেহে অনেক ক্ষতিকারক রোগজীবাণু থাকায় তা ভক্ষণকারীর দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এমন অনেক মারাত্মক রোগ আছে যা সাধারণত পশুদের আক্রান্ত করে এবং পরে তা মানুষের মাঝে সংক্রমিত হয়। যেমন মৃত প্রাণীর গোশত, কেননা তাতে রক্ত মিশ্রিত হয়ে যায়। ফলে গোশত নষ্ট হয়ে যায় এবং বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ঐ মৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণকারীর হজমে খুব বিঘ্ন ঘটে এবং পাকস্থলীতে গোলযোগ দেখা দেয়। ফলে মারাত্মক পেটের পীড়ায় সে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যে সকল ঘাতক ব্যাধিতে জীবজন্তু মারা যায় এবং ঐ মৃতের গোশত ভক্ষণের কারণে মানুষের মধ্যে মারাত্মক রোগের সংক্রমণ ঘটে, তন্মধ্যে মহামারী আকারে কলিজা ফুলে যাওয়া রোগটি অন্যতম। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি তড়িৎ চিকিৎসা গ্রহণ না করে এবং অন্তত চার-ছয় মাস সম্পূর্ণ বিশ্রামে না থাকে, তবে সে মরণাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়’।[23]

বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, প্রাণীর শরীর হ’ল একটা দুর্গ। যতক্ষণ জীবন থাকে ততক্ষণ জীবনীশক্তি ক্ষুদ্র জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে এবং জীবাণুর প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা এ ধরনের যে কোন শত্রুকে প্রতিহত করে পরাজিত করতে থাকে। তাই ভিতরে তার গোশত ও রক্ত ভাল থাকে এবং সে ভাল অবস্থায় থাকে। কিন্তু যদি মারা যায়, শুধুমাত্র এ জীবন শেষ হওয়ার কারণে পাঁচ ছয় ঘণ্টা পরই এই মৃত প্রাণীটির শরীর ক্ষুদ্র জীবাণুর একটা গুদামে পরিণত হয়।

যখন কোন প্রাণী মারা যায়, তার আর জীবন থাকে না, তখন তার এই প্রাচীরের প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে যায়। ফলে এই ধংসাত্মক ক্ষুদ্র জীবাণু শরীরের অভ্যন্তর থেকে সেইসব পর্দা ও প্রাচীর ভেদ করে শরীরের সর্বস্থলে প্রবেশ করে। রক্তের স্থানে মিলিত হয়, সব শরীর দখল করে। অসংখ্য জীবাণুর জন্ম দেয় যা মানুষের স্বাস্থ্যের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে।[24]

নিয়মিত মিসওয়াক করা :

মিসওয়াক করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بتأخير العشاء وبالسواك عند كل صلاة، ‘আমি আমার উম্মাতের জন্য যদি কষ্টকর মনে না করতাম তাহ’লে তাদেরকে এশার ছালাত বিলম্বে আদায় করতে এবং প্রত্যেক ছালাতের সময় মিসওয়াক করতে নির্দেশ দিতাম’।[25]

প্রখ্যাত তাবেঈ শুরায়হ ইবনু হানী (রহঃ) বলেন,سَأَلْتُ عَائِشَةَ قُلْتُ بِأَىِّ شَىْءٍ كَانَ يَبْدَأُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ قَالَتْ بِالسِّوَاكِ. ‘একবার আমি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে কোন কাজটি করতেন? তিনি বললেন, মিসওয়াক করতেন’।[26]

হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ إِذَا قَامَ لِلتَّهَجُّدِ مِنَ اللَّيْلِ يَشُوصُ فَاهُ بِالسِّوَاكِ، ‘নবী করীম (ছাঃ) তাহাজ্জুদ ছালাত আদায়ের জন্য ঘুম থেকে উঠেই মিসওয়াক দ্বারা ঘষে মুখ পরিষ্কার করে নিতেন’।[27] আয়েশা (রাঃ) বলেন,أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ لاَ يَرْقُدُ مِنْ لَيْلٍ وَلاَ نَهَارٍ فَيَسْتَيْقِظُ إِلاَّ تَسَوَّكَ قَبْلَ أَنْ يَتَوَضَّأَ. ‘নবী করীম (ছাঃ) দিনে ও রাতে যখনই ঘুম থেকে উঠতেন, অযূ করার পূর্বে মিসওয়াক করতেন’।[28]

উল্লিখিত হাদীছ সমূহ থেকে মিসওয়াকের গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। মিসওয়াকের এত গুরুত্ব দেয়ার বহুবিদ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল স্বাস্থ্যগত কারণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও নির্দেশ মত যদি কেউ প্রত্যেক ছালাতের পূর্বে এবং ঘুম থেকে উঠে নিয়মিত মিসওয়াক করে তাহ’লে তার দাঁত ঝকঝকে থাকবে এবং সে যাবতীয় দন্ত রোগ থেকে মুক্ত থাকবে। কথায় বলে দাঁতের সাথে আঁতের সম্পর্ক। দাঁত ভালো তো অাঁত ভালো, আর অাঁত ভালো তো সব ভালো।

অভিজ্ঞ ডাক্তারগণের রিচার্স ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, পাকস্থলীর ৮০% রোগ দন্তরোগের কারণেই হয়ে থাকে। পাকস্থলীর রোগ বর্তমানে বিশ্বের এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাঁতের মাড়ীর ক্ষত নিঃসৃত পুঁজ যখন খাদ্য-পানীয় সাথে মিলিত হয় অথবা লালার সংমিশ্রণে পাকস্থলীতে প্রবেশ করে, তখন ঐ পুঁজ রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা সমস্ত খাদ্যসমূহকে দূষিত ও দুর্গন্ধময় করে তোলে। পাকস্থলী ও যকৃতের রোগের চিকিৎসার পূর্বে দাঁতের চিকিৎসার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত। এভাবেই পাকস্থলী বা পেটের পীড়ার তড়িৎ ও স্থায়ী চিকিৎসা সম্ভব।

অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধময় পুঁজযুক্ত দাঁত মস্তিষ্ক রোগের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আভ্যন্তরীণ রোগ যেমন : উম্মাদনা, মস্তিষ্ক-বিকৃতিসহ আরও অনেক রোগ-ব্যাধিও এর থেকে জন্ম নেয়।

দন্তরোগের সাথে রয়েছে চক্ষুরোগের গভীর সম্পর্ক। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে যখন খাবারের ছোট ছোট অংশ জমে থেকে দুর্গন্ধময় হয়ে পড়ে, তখন চক্ষুরোগ, দৃষ্টিশক্তি দুর্বল এবং অন্ধত্বের শিকার হয়ে পড়ে। চক্ষুরোগের আরও যত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, তন্মধ্যে দাঁতের যত্নের প্রতি অমনোযোগই এর প্রধান কারণ বলে বিবেচিত হয়েছে।[29]

তিনটি গাছের ডাল মিসওয়াকের জন্য উপযোগী। যথা- (১) পীলু বা যয়তুন গাছ (২) নীম গাছ (৩) বাবলা গাছ। তবে এগুলোর মধ্যে পীলু গাছ সবচেয়ে উপকারী।

মিসওয়াক দ্বারা মস্তিষ্ক সতেজ হয়। প্রকৃতপক্ষে মিসওয়াকের মধ্যে থাকে ফসফোরাস জাতীয় পদার্থ। গবেষণা ও অনুসন্ধানে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে, যেই জমিতে ক্যালসিয়াম ও ফসফোরাস অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে, সেখানেই পীলু বৃক্ষ বেশী জন্মে। কবরস্থানের মাটিতে মানুষের হাড় বিগলিত হওয়ার ফলে ক্যালসিয়াম ও ফসফোরাস বেশী হয়ে থাকে, তাই সেখানে যয়তুন গাছও অধিক পরিমাণে জন্ম নিয়ে থাকে। দাঁতের প্রধান খাদ্যই হ’ল ক্যালসিয়াম ও ফসফোরাস। আর বিশেষ করে পীলু বৃক্ষের জড়ে এ উপাদানগুলো সাধারণত বেশী পাওয়া যায়। অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, পীলু বৃক্ষের মিসওয়াক তাজা ও নরম অবস্থায় চাবালে তার মধ্য হ’তে বেরিয়ে আসে তিক্ত ও তেজস্ক্রীয় এক প্রকার পদার্থ। এ পদার্থ মিসওয়াকের মধ্যে রোগ জীবাণুর বিস্তারকে প্রতিহত করে এবং দাঁতসমূহকে রোগের হাত থেকে রক্ষা করে।[30]

অনেকের মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। ফলে লোক সমাজে সে বিব্রতকর ও লজ্জাকর পরিস্থিতির শিকার হয়। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর কারোর এ রোগ থাকলে তো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় চিকিৎসার জন্য অজস্র টাকা-পয়সা খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশনা মেনে প্রত্যেক ছালাতের পূর্বে মিসওয়াক করলে বিনা খরচে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়। নিয়মিত মিসওয়াক মুখের দুর্গন্ধ দূরীকরণের অব্যর্থ মহৌষধ। এছাড়াও নিয়মিত মিসওয়াকের মাধ্যমে ঘাড় ব্যথা, গলা ব্যথা ও জ্বালাপোড়া, গলার স্বর হ্রাস পাওয়া, মস্তিষ্ক ও স্মরণশক্তি হ্রাস পাওয়া, মাথা ঘুরানো, থাইরয়েড গ্ল্যান্ড প্রভৃতি রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।

[ক্রমশঃ]

ক্বামারুযযামান বিন আব্দুল বারী

মুহাদ্দিছ, বেলটিয়া কামিল মাদ্রাসা, জামালপুর।

[1]. বুখারী হা/৩৩২০, ৫৭৮২; ইবনু মাজাহ হা/৩৫০৫।

[2]. ইবনু মাজাহ হা/৩৫০৪, সনদ ছহীহ।

[3]. ইসলামী বিধান ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ১৩২-১৩৩।

[4]. মুসলিম হা/২৭৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৫; তিরমিযী হা/৯১।

[5]. ইসলামী বিধান ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ১৩৮-১৩০।

[6]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭১, ছহীহুল জামে‘ হা/৭৩৩৪, সনদ ছহীহ।

[7]. মুসলিম হা/৫১১৪, ৫১১৬।

[8]. মুহাম্মদ আবু তালেব, AL-QURAN IS ALL SCIENCE (ঢাকা: ইডেন প্রকাশনী, ২য় সংস্করণ, ২০০১), পৃঃ ২৪৪-২৪৫।

[9]. মোঃ রেজাউল ইসলাম, বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে মাদকাসক্তি : একটি আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, অক্টোবর ২০০০, পৃঃ ১৮৬।

[10]. মুহাম্মাদ গোলাম মোস্তফা, কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সাঃ) (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৫), পৃঃ ১০১-১০২।

[11]. নাসাঈ হা/৫৬৬৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩১২।

[12]. ইবনু মাজাহ হা/২৩৪১; ছহীহাহ হা/২৫০।

[13]. মাসিক আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর ২০১২।

[14]. মাসিক কারেন্ট নিউজ, জুলাই-২০০৪, পৃঃ ৫১।

[15]. মাসিক আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর ২০১২।

[16]. ধূমপান ও মাদকের পরিণতি : মুক্তির উপায়, পৃঃ ১২।

[17]. তিরমিযী হা/১১৭১; মিশকাত হা/৩১১৭।

[18]. মুসলিম হা/১৯৫৫; তিরমিযী হা/১৪০৯; আবূদাঊদ হা/২৮১৫; নাসাঈ হা/৪৪১৭; ইবনু মাজাহ হা/৩১৭০।

[19]. আফীফ আব্দুল ফাত্তাহ তাববারা, ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, অনুঃ রিজাউল করিম ইসলামাবাদী (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৫), পৃঃ ৪২।

[20]. AL-QURAN 1S ALL SCIENCE, পৃঃ ২৪৭; ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭, পৃঃ ৪২।

[21]. ইসলামী বিধান ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ৫৯।

[22]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩১৪; আহমাদ হা/৫৬৯০; ছহীহাহ হা/১১১৮।

[23]. হায়াত মুহাম্মাদ আলী খাফাজী, লামাহাত মিনাত তিবিবল ইসলামী, পৃঃ ৫৮।

[24]. ইসলামী বিধান ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ৫৪-৫৫।

[25]. বুখারী হা/৮৮৭; মুসলিম হা/২৫২; আবূদাঊদ হা/৪৬; মিশকাত হা/৩৭৬।

[26]. মুসলিম হা/২৫৩; মিশকাত হা/৩৭৭।

[27]. বুখারী হা/২৪৬; মুসলিম হা/২৫৫; মিশকাত হা/৩৭৮।

[28]. আবূদাঊদ হা/৫৭; মিশকাত হা/৩৮৩, সনদ ছহীহ।

[29]. সুন্নাতে রাসূল (ছাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান ১/৪০-৪১।

[30]. প্রাগুক্ত ৩১/৩৯ পৃঃ।






যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
ঈমানের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (শেষ কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
হিজামা : নবী (ছাঃ)-এর চিকিৎসা - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
সুন্নাত আঁকড়ে ধরার ফযীলত (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৭ম কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ কি চায়, কেন চায় ও কিভাবে চায়? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
পলাশী ট্রাজেডি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বাস্তবতা - ড. ইফতিখারুল আলম মাসঊদ
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আরও
আরও
.