পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।
পথে কয়েকবার বিশ্রাম নিয়ে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে মদীনার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। চির প্রশান্তির নগরী মাদীনাতুন্নবীর স্নিগ্ধ পরশে আরো একবার আসার সুযোগ দিলেন আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন। মনটা ভীষণ আলোড়িত হয়ে ওঠে। রবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে। অশ্রুসজল চোখ ওহোদ পাহাড় ঘেরা মদীনা শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায়। অনুভবের গভীর প্রদেশে যেন শুনতে পাই রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের সুদূরাগত পদধ্বনি। ঐ তো দূরে দেখা যায় মসজিদে নববীর তীক্ষণশির মিনার। প্রশান্ত সবুজ গম্বুজ।
আমাদের গাড়ি ভগ্নপ্রায় বাঙালী মার্কেটের দিক থেকে ঘুরে এসে মসজিদে নববীর উত্তরপ্রান্তের ‘কারাম আয-যাহাব’ হোটেলের সামনে দাঁড়ায়। ভাগ্যক্রমে আল-আমীন মুন্সী পার্কিংও পেয়ে গেল, যা কিনা এখানে দুর্লভ ব্যাপার। ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসাবে বাঙালী মার্কেট এলাকা প্রশাসন থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মক্কার নাক্কাছা বাজারের মত হারিয়ে যেতে বসেছে মদীনার ঐতিহ্যবাহী বাঙালী মার্কেটও। কালের বিবর্তনে একদিন হয়ত কেউ জানবেও না যে এখানে বাঙালী মার্কেট নামে এক রমরমা বাজার ছিল।
রামাযানের প্রথম দশকেই মদীনায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই অবস্থা। এক-দেড়শ’ রিয়ালের হোটেলকক্ষের ভাড়া ছুঁয়েছে পাঁচশত রিয়াল। তবুও মেলা ভার। আগেই রুম বুকিং দেয়ার পরও চাবি হাতে পেতে বেশ দেরি হয়। রুমে গিয়ে ক্ষণিকের বিশ্রাম নিতে গিয়ে বিপত্তির শুরু। দীর্ঘ সফরের শেষ দিকে এসে হঠাৎ সদলবলে জ্বর, সর্দি-কাশির আগমন। সম্পাদক মহোদয় একদমই কাহিল হয়ে পড়লেন। আমারও বেশ জ্বর এল। মাগরিব পর্যন্ত রুমেই থাকলাম। ইফতারও রুমে হ’ল। মদীনায় এসে হারাম চত্বরে বসে লক্ষ ছায়েমের সাথে ইফতারের সৌভাগ্যটা তাই আজ হাতছাড়া হয়ে গেল। মাগরিব পর রুমে এলেন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-চবিবশ পরগণা যেলার ঘোড়ারাস সালাফিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক এবং জমঈয়তে আহলেহাদীছ উত্তর-চবিবশ পরগণা যেলা সেক্রেটারী মাওলানা আব্দুল হামীদ ফাইযী। তিনি ওমরাহ সফরে ছিলেন। ফেসবুকের কল্যাণে আমাদের আসার খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছেন। সাদাসিধে অথচ মুখলিছ ও কর্মতৎপর এই উদীয়মান তরুণ ব্যক্তিত্ব ইতিমধ্যে নিজ কর্মগুণে পশ্চিম বাংলায় সুপরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। পশ্চিম বাংলায় যখন সালাফী মানহাজের মাদ্রাসাগুলো যোগ্য আলেম ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে ভুগছে, ভাল দাঈ ইলাল্লাহর খোঁজ পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে গোটা রাজ্যে, তখন সেই শূন্যতা পূরণে যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছে ঘোড়ারাস সালাফিয়া মাদ্রাসা। সম্প্রতি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মু‘আদালাও সম্পন্ন হয়েছে।
মাওলানা আব্দুল হামীদ জানালেন তারা শিক্ষা ও দাওয়াতী ময়দানে ‘আহেলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-কে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমাদেরকে সেখানে সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আববার নানা বাড়ি ঘোড়ারাস। সেখানে তাঁর পুরানো আত্মীয়-স্বজনরা এখনও আছেন। সেই ঘোড়ারাসে এমন একটি মাদ্রাসা হয়েছে-এটা খুব খুশীর সংবাদ। মনে মনে সেখানে সফরের একটা নিয়তও করে ফেললাম। ঘণ্টাখানেক পর তিনি বিদায় নিলেন। পরপরই উপস্থিত হ’ল মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী ও ‘যুবসংঘ’ সভাপতি মীযানুর রহমান এবং মা‘হাদের ছাত্র হাবীবুর রহমান। তাদের সাথে তারাবীহ আদায় করলাম কোলাহলমুখর মসজিদে নববীর বহির্চত্বরে।
ছালাতের পর হাবীব নিজের বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে হাযির হ’ল অনেক কষ্ট স্বীকার করে। ফিস ফ্রাইসহ বিভিন্ন পদের খাবার। খুব তৃপ্তি সহকারে খেলেও পরিমাণ এত বেশী যে খেয়ে শেষ করা গেল না। আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন! রাতে পার্শ্ববর্তী হোটেলে গিয়ে আমার শ্বশুর-শাশুড়ীর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তাঁরা ওমরাহ সফরে এসে মক্কা থেকে আজই মদীনায় এলেন। ফলে ভাগ্যক্রমে তাদের সাথে দেখা হয়ে গেল। তাদেরকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে দিয়ে আবার হোটেলে ফিরে আসলাম।
ফজরের ছালাতের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারত করলাম। নানা অপ্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধের বেড়াজালে অনুভূতিগুলো শুষ্ক হয়ে আসলেও রাসূল (ছাঃ)-এর সরাসরি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আবেগ ধরে রাখা কঠিন। দিবা-রাত্রি যার নামে দরূদ পাঠ করা হয়, তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে অনুভূতি হঠাৎ অসাড় হয়ে যায়। কেমন যেন ঘোরলাগা আচ্ছন্নতা জাপটে ধরে। জান্নাতীদের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত কেন মহান আল্লাহর দীদারের ক্ষণটি হবে, তা বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হয় না।
বিকেলের দিকে সম্পাদক মহোদয়ের জ্বর ছেড়ে গেল। আমরা মসজিদে নববীর চত্বরে ইফতার করতে বসলাম। নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষ। ধনী-গরীব ভেদাভেদ নেই। সবাই এক দস্তরখানে। নির্দিষ্ট সময়ে ইফতারের সামগ্রী নির্বিঘ্নে উপস্থিত হচ্ছে। লক্ষ মানুষের আয়োজন। অথচ কোথাও কোন তাড়া নেই। নেই কোন হৈ চৈ। ইফতারের সাথে চা, কফিও বিতরণ করা হচ্ছে খুব সন্তর্পণে। অল্পবয়সী স্বেচ্ছাসেবীদের এমন সুশৃংখল সেবাদান মুগ্ধ না করে পারে না।
ইফতারের পর আমরা মীযানুর রহমানের আহবানে বাকী‘ কবরস্থানের কাছে অবস্থিত মসজিদে নববীর এ্যাডমিন অফিসে গেলাম। সেখানে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলের সাথে সাক্ষাৎ হ’ল। তারা আমাদের উষ্ণ আতিথেয়তা দিলেন। নানা বিষয়ে কথা হ’ল। বাংলাদেশে আসার জন্য আমরা তাঁদেরকে দাওয়াত দিলাম। পরিশেষে কিছু বইপত্র হাদিয়া দিলেন। সেখান থেকে ফিরে তারাবীর ছালাত আদায় করে আমরা হোটেলে ফিরলাম। রাতে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রোগ্রাম। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ‘যুবসংঘ’ বিশেষতঃ সাবেক মারকায ছাত্রদের উদ্যোগে এই আয়োজন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়ার পিছনে পার্কের মত সুসজ্জিত এক স্থানে আমরা বসলাম। রাত ১২-টার দিকে প্রোগ্রাম শুরু হ’ল। প্রায় দু’ঘন্টা ধরে নানা বিষয়ে মতবিনিময় চলল। তাদের কাছে বিশেষতঃ জ্ঞানার্জনের নৈতিক দিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। কেননা এখনকার জ্ঞানার্জন হয়ে উঠছে ক্যারিয়ারনির্ভর। চাকুরী বা আর্থিক উপার্জনের বাজারকে সামনে রেখে পড়াশোনা বা ডিগ্রি নেয়ার প্রবণতা আমাদের জ্ঞানার্জনের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ফলে ডিগ্রিধারী পন্ডিতের সংখ্যা বাড়ছে বটে; কিন্তু নৈতিক দৃঢ়তা আর আদব-আখলাকের বন্ধন দিনকে দিন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অধিক উপার্জন আর অধিক পাওয়ার নেশা আমাদের এমনই দিকদিশাহীন করে তুলছে যে এর শেষ কোথায়- নিজেরাই জানি না। জানি এসব উপদেশের কোন বস্ত্তগত মূল্য নেই। তবুও কিছুটা হ’লেও যেন নওজোয়ান প্রজন্মের অন্তরে সচেতনতা জাগ্রত করা যায়, এটাই ছিল প্রচেষ্টা। কেননা পরবর্তী প্রজন্মের ছোট একটা অংশও যদি আদর্শিকভাবে জাগ্রত না হয়, তবে জাতির হাল ধরার মত আপোষহীন, দূরদর্শী ও আত্মমর্যাদাশীল আগামীর রাহবার পাওয়া ভীষণ দুষ্কর হয়ে উঠবে। আল্লাহ আমাদের তরুণদের ঈমান ও আমল হেফাযত করুন- আমীন!
রাত্রি দ্বিপ্রহর গড়ালে সাহারী এল। মেন্যু সঊদী আরবের প্রসিদ্ধ ফুডচেইন রোমানসিয়ার সুস্বাদু বিরিয়ানী। গতরাতের মত আজও মেহমানদারী করল প্রিয় ছোটভাই হাবীব। এই কর্মবীর তরুণের মধ্যে যে স্পৃহা ও চিন্তার গভীরতা দেখেছি, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। যদি সে গন্তব্যপাণে এমন সুদৃঢ় লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে অটুট থাকতে পারে, তবে তার মাধ্যমে আমরা অনেক ভাল কিছুর প্রত্যাশা করতে পারি। আল্লাহ তাকে কবুল করুন- আমীন!
সাহারীর পর উপহার বিনিময় শেষে আমরা ছাত্রভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। মসজিদে নববীতে ফজরের ছালাত আদায় করে বেলা দশটা পর্যন্ত হোটেলে বিশ্রাম নেয়ার পর মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম এক বাঙালী ড্রাইভারের সাথে। সঊদীতে চলাচলের জন্য আমরা সাধারণতঃ বাঙালী বা পাকিস্তানী ড্রাইভারদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কারণ আর যাই হোক তাদের একটা আন্তরিকতা টের পাওয়া যায়। বিপরীতে সঊদী বা মিসরীয় ড্রাইভারদের ব্যবহার প্রায়শঃই শুষ্ক ও কাটখোট্টা পেয়েছি। তাড়াহুড়া করা তাদের জন্য মজ্জাগত অভ্যাস। যুল-হুলায়ফা থেকে ইহরামের শুভ্র পোষাক পরার সৌভাগ্য হ’ল। আল্লাহর ঘরের মেহমানের চেয়ে সম্মানজনক পরিচয় আর কী হ’তে পারে! পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের পুনরাবৃত্তি যেমন প্রতিবারই হৃদয়ে নতুন ভাবাবেগ জাগায়, তেমনি কা‘বার পথের যাত্রীর পরিচয়ও প্রতিবার নতুন আবেগে উদ্বেলিত করে। এই আবেগ কখনই যেন পুরোনো হওয়ার নয়।
বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে মদীনা-মক্কার পাহাড়গুলো চমৎকার রূপ ধারণ করেছে। পাথুরে পাহাড়ের বুক ছেদ করে বেরিয়ে এসেছে সবুজ নব কিশলয়। কুরআনের ভাষ্যটা হঠাৎ মনে হয়। পাথরের মধ্যে এমনও পাথর আছে যা ভেদ করে পানির নহর প্রবাহিত হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের অন্তর পাথরের মত শক্ত কিংবা তার চাইতেও বেশী। তাদের অন্তরে নেই করুণার আলোড়ন, নেই বিবেকের মাঝে স্নীগ্ধতার সমীরণ। মানুষকে বিপদে-দুর্দশায় কাঁদে না যাদের হৃদয়। পাশবিক নিষ্ঠুরতায় আপন ক্ষমতাবল আর স্বার্থ চরিতার্থই তাদের মূল ভাবনা। আল্লাহ তাদের হেদায়াত করুন। স্বীয় রহমতের সুমিষ্ট বারিধারায় তাদের হৃদয়জগত পরিচ্ছন্ন করুন- আমীন!
আছরের পরপরই আমরা পৌঁছে যাই বিশ্বজাহানের সর্বপ্রাচীন বৈশ্বিক মিলনকেন্দ্র পবিত্র মক্কাতুল মুকাররমায়। হিজরা রোডের এক হোটেলে কাযী হারূণ চাচা ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ইফতার পর্যন্ত বিশ্রাম নিয়ে মাগরিবের ছালাতের পর ওমরাহর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। আজ ২৭শে মার্চ। রামাযানের কেবল ৪র্থ দিন। তবুও প্রচুর ভিড়। রামাযানের শেষ দশক আসতে আসতে যে তিল ধারণেরও ঠাঁই থাকবে না, তা অনুমান করা যায়। হারাম চত্বরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে তারাবীর ছালাত আদায় করলাম। করোনার সময় থেকে তারাবী ১০ রাক‘আত পড়া হচ্ছে। শায়খ ইয়াসির আদ-দাওসারী, শায়খ আব্দুল্লাহ আল-জুহানী, শায়খ বান্দার বালীলার দরাজ কণ্ঠের তেলাওয়াত মক্কার আকাশ-বাতাসে ভেসে ভেসে অন্তরের গভীর প্রদেশে যেন ঘুরে ফিরল। অপেক্ষায় ছিলাম কিংবদন্তী ক্বারী শায়খ আব্দুর রহমান আস-সুদাইসের। তিনি এলেন না। গত তিন বারের সফরেও তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম। একবার মাত্র পেয়েছিলাম মাগরিবের ছালাতে। তারপর অপেক্ষার প্রহর আর ফুরোয় না। ভয় হয় শায়খ সঊদ আশ-শুরাইমের মত হঠাৎ তাঁকেও আবার হারাতে হয় কি-না। আল্লাহ হেফাযত করুন- আমীন!
তারাবীর পর কা‘বা চত্বরে প্রবেশ করলাম ওমরার জন্য। প্রায় ঘন্টাখানিকের মধ্যে তাওয়াফ শেষ হ’ল। ইতিমধ্যে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেছি। সম্পাদক মহোদয়, ‘যুবসংঘ’ সভাপতি; আমি ও মুজাহিদ ভাই। কা‘বার সামনে দাঁড়িয়ে তাওয়াফের এই মনোমুগ্ধকর অনুভূতি নতুন করে বর্ণনার কিছু নেই। এতটুকুই বলতে পারি, কা‘বায় আসলে সত্যিকার অর্থেই আপনজনকে ফিরে পাওয়া পরম ভালাবাসা অনুরণিত হয়। কা‘বা ঘর, কা‘বার গিলাফ, কা‘বার দরজার নীচে মুলতাযাম ছুঁয়ে থাকার সময়গুলোতে কেবল সেই ভাললাগার প্রবল অনুভূতিই আচ্ছন্ন করে রাখে। কোনভাবে ফিরতে মন চায় না। দু’রাক‘আত ছালাত পড়ে অনেকক্ষণ কা‘বাকে সামনে রেখে বসে থাকি। উঠতেই মন চায় না। গতবার হজ্জে বিদায়ী তাওয়াফ শেষ করে যে বিচ্ছেদের বেদনা অনুভূত হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছিল এ বেদনা স্বজনহারার বেদনার চেয়ে কম নয়। তখন অনেকের চোখেই দেখেছিলাম বেদনাশ্রু। বের হ’তে হ’তে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কা‘বা যতক্ষণ নযরে আসে, আবেগাপ্লুত হয়ে বার বার সেদিকে তাকাচ্ছেন তারা। পরে আবিষ্কার করলাম আমিও যে তাদের দলে।
দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, করোনার পর থেকে এখন আর ওমরা ছাড়া কেউ মাতাফে নফল তাওয়াফ করতে পারে না। মসজিদের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় করতে হয়। আবার সেখানেও এমনভাবে ব্যারিকেড দেয়া যে, মনভরে কা‘বা দেখারও সুযোগ পাওয়া যায় না। জানি না আবার কবে স্বাভাবিকভাবে ইচ্ছামত তাওয়াফের সুযোগ মিলবে। আল্লাহ কবুল করুন-আমীন! শুধু তা-ই নয়, হারামে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি, অপ্রয়োজনীয় কঠোর নিয়ম-কানূন, যখন-তখন হারামের প্রবেশমুখগুলো বন্ধ করা, মুছল্লীদের প্রতি পুলিশের আগ্রাসী ও অমানবিক আচরণ হারামের স্বাভাবিক আবেগের চিত্র আর স্বতঃস্ফূর্ততাকে যথেষ্ট মলান করেছে। দৃশ্যগুলো সত্যিই কষ্টের। আইনের ঊর্ধ্বে যে মানবতার স্থান, তা তো এই যান্ত্রিক যুগে এমনিতেই অচল কথা; তবুও হারামের মত ‘বালাদান আমেনা’ তথা নিরাপত্তার শহরে এসে এই দৃশ্য মোটেও কাম্য ছিল না। যাহোক যমযম পানি পান করে আবার রওয়ানা হ’লাম সাঈ’র উদ্দেশ্যে। সাঈ শেষ হবে এমন সময় হঠাৎ সম্পাদক মহোদয়দেরকে খুঁজে পেলাম। তারপর বাকী কাজ সারতে রাত ৩-টা বেজে গেল। হোটেলে ফিরে গোসল সেরে সাহারী করলাম। ফজরের ছালাতের পর ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়লাম।
***
পরদিন ২৮শে মার্চ যোহরের ছালাতের পর তায়েফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। পাহাড়ী পথ মাড়িয়ে সুন্দর এই সবুজালয়ে পৌঁছাতে আছর হয়ে গেল। শহরের এক প্রান্তে ছানাইয়া এলাকায় দ্বীনী ভাইদের সাথে প্রোগ্রাম ছিল। জনাব সাইফুল ইসলাম (চাঁদপুর) এবং খোরশেদ আলম (কুমিল্লা) ভাইয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তায়েফে অবস্থানরত দ্বীনী ভাইয়েরা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। ইফতার ও রাতের খাবার সেরে আমরা আবার মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। তারাবীর ছালাত ধরলাম হারামে। তাওয়াফ সেরে শেষ রাতে সাফা টাওয়ারে সাহারী সারলাম দ্বীনী ভাইদের সাথে। ফজরের ছালাত শেষে হোটেলে ফিরলাম। মুজাহিদ ভাই আজ দুবাই ফিরে যাবেন। কিছু কেনাকাটা সেরে তিনি জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। আমরা দিনের বেলা কিছু কেনাকাটা সেরে এবং দ্বীনী ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করে রিয়াদের উদ্দেশ্যে রওয়ানার প্রস্ত্ততি নিলাম। আজ ইফতার করলাম হারামের ছাদে। ইফতারের কিছুক্ষণ পূর্ব পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবকদের কোন তৎপরতা না দেখে ভাবলাম পানি খেয়েই বোধ হয় ইফতার সারতে হবে। ইফতারের দশ মিনিট বাকী নেই, ঠিক এমন সময় কিছু স্বেচ্ছাসেবকের দেখা মিলল। মদীনার মত সেই একই দৃশ্য। কোন তাড়াহুড়া ছাড়াই নির্বিঘ্নে সময়মত ইফতার সামগ্রী বণ্টন হয়ে গেল।
তারাবীর পর আমরা মিসফালাহ কুবরীর নীচ থেকে গাড়িতে উঠলাম রিয়াদের উদ্দেশ্যে। ততক্ষণে রাত ১২-টা বেজে গেছে। ড্রাইভার অল্প বয়সী খুব আন্তরিক এক বাঙালী যুবক। অতি শীঘ্রই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে বলে অপেক্ষার তর সইছে না তার। দেশে ফেরার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। তার আনন্দমাখা অনুভূতি আমাদেরও ছুঁয়ে যায়। মক্কা শহর পার হ’লে গতির ঝড় ওঠে গাড়িতে। মক্কা থেকে রিয়াদ প্রায় সাড়ে আটশ’ কি. মি. দীর্ঘ রাস্তা। সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। রাতের সঊদী আরব কেবলই গভীর আঁধারময়। কোথাও আলো নেই। কোন দোকানপাটও চোখে পড়ে না। তবুও গল্পে গল্পে চমৎকার সময় কাটলো। মাঝে এক ফুয়েল স্টেশনে সাহারী করে নিলাম। শেষ বেলায় খাবার প্রায় ফুরিয়ে গেছে। শুধু খাবছা পাওয়া গেল। তাতেই মনটা ভরে গেল। এত অসাধারণ খাবছা সঊদীতে এসে কমই খাওয়া হয়েছে। যদিও পাঁচ বছর আগে মক্কার নাক্কাছা বাজারের রোহিঙ্গা হোটেলে খাওয়া সেই খাবছার স্বাদ আজও ভুলতে পারি না।
পরদিন ৩১শে মার্চ ভোরের আলো ফোটার পর দীর্ঘক্ষণ কোন ফুয়েল স্টেশন না পেয়ে আমরা রাস্তার পার্শ্বে মরুভূমির উপরই গামছা বিছিয়ে ছালাত আদায় করলাম। ঠান্ডা বাতাসে দাঁতে দাঁত লেগে যায়। তবুও এক প্রশান্তির ছালাত আদায় করার সৌভাগ্য হ’ল আলহামদুলিল্লাহ। গাড়ি আবার অগ্রসর হয়। দীর্ঘ পথে পরিচিত কোন শহরের দেখা মেলে না। চারিদিকে শুধু মরুভূমি আর মরুভূমি। রিয়াদের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর হঠাৎই দৃষ্টপটে ছন্দপতন ঘটে। দিগন্ত রেখায় গ্রান্ড ক্যানিয়নের মত লাল পাহাড়ের সারি। রিয়াদ থেকে প্রায় ১০০ কি. মি. উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত তুওয়াইক পর্বতের অন্তর্গত জাবালে ফিহরাইন নামক এই অঞ্চলটি মধ্যআরবে নজদের প্রবেশমুখ। এটি সঊদী আরবের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময় হিসাবে গণ্য করা হয়। ইংরেজীতে বলে The Edge of the World। প্রাচীন আরব উপদ্বীপ থেকে ইয়েমেন ও পারস্য যাওয়ার পথ ছিল এই গিরিপথ। বর্তমানে এই হাযার মিটার উচ্চতার পাহাড়টি রিয়াদের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ পর্যটন স্পট। সূর্যাস্তের সময় পাহাড়ের ছাদে বহু মানুষ জমা হয়। সান্ধ্য সূর্যের আলোকচ্ছটায় সেসময় অপরূপ দৃশ্যপট ধারণ করে আরবের এই গ্রান্ড ক্যানিয়ন উপত্যাকা।
গিরিখাত অতিক্রম করে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা রিয়াদ শহরে প্রবেশ করলাম। বেলা ১০-টার দিকে গতবারের অবস্থানস্থল মালাযের এক হোটেলে পৌঁছাতে ‘আন্দোলন’-এর সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব রিয়াযুল ইসলাম মধু ভাই আমাদের স্বাগত জানালেন। আছর পর্যন্ত রেস্ট নিয়ে আমরা আবার রওয়ানা হ’লাম হাই আশ-শিফার দিকে। সেখানে আত-তাহরীক পাঠক ফোরাম সঊদী আরব শাখার উদ্যোগে ক্বাছর আল-আমরী অডিটোরিয়ামে এক বিরাট ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় পাঁচ শতাধিক লোকের আয়োজন, যেখানে রিয়াদের বিশিষ্ট সুধীজনরাসহ ‘আন্দোলন’-এর দায়িত্বশীল, কর্মী এবং পর্দার আড়ালে মহিলারাও অংশগ্রহণ করেন। চমৎকার এই আয়োজন শেষে তারাবীর পর আমরা ‘আন্দোলন’-এর হারা শাখা কার্যালয়ে এক দায়িত্বশীল মতবিনিময় বৈঠকে যোগদান করলাম। রিয়াদের বিভিন্ন শাখা থেকে দায়িত্বশীলগণ একত্রিত হ’লেন। কিভাবে দ্বীনের বিশুদ্ধ দাওয়াতকে মানুষের দুয়ারে পৌঁছানো যায় এটাই সবার ফিকির। সেই ফিকির তাদেরকে বিদেশের মাটিতে বসেও দ্বীনের জন্য সময় ব্যয় করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন! বলা বাহুল্য, হারা, বাথা এলাকাগুলো অনেকটা বাঙ্গালীদের দখলে। রিয়াদের গুলিস্তান নামে পরিচিত এই হারা মূলতঃ হাইউল অযারাত-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। যার অর্থ মন্ত্রণালয় পাড়া। রিয়াদের মধ্যস্থলে এই এলাকাটি এখন বাঙালী ও পাকিস্তানী শ্রমিকদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।
হারাতে প্রোগ্রাম সেরে মধ্যরাতে পশ্চিম রিয়াদের ছানাইয়া আছেমা শাখার দাওয়াতে যোগদানের জন্য রওয়ানা হ’লাম। গন্তব্য আবুল হোসাইন ভাইয়ের ‘ইমতিয়ায ওয়ার্কশপ’ কাম সাংগঠনিক অফিস। রিয়াদের ‘আন্দোলন’-এর সবচেয়ে শক্তিশালী শাখা এটি। আবুল হোসাইন ভাই, মুনীর ভাইয়ের মত নিবেদিতপ্রাণ ও কর্মতৎপর ভাইদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এখানকার কর্মীরা নিয়মিত দাওয়াতী প্রোগ্রাম করে থাকেন। সাহারীর জন্য তারা যে বিশাল আয়োজন করেছেন তা অকল্পনীয়। জনা বিশেক মানুষের জন্য বড় বড় কয়েকটা ডিশ হাযির। খাসীর রান ও সীনার আস্ত রোস্টসহ বিভিন্ন পদের এই আয়োজন করতে তাদের কত সময় ও অর্থ ব্যয় হয়েছে, তা আল্লাহই জানেন। আমাদের সকল অনুযোগভরা মন্তব্য উবে গেল তাদের আন্তরিক ভালবাসাপূর্ণ সুমিষ্ট বার্তায়- আপনারা কেন্দ্র থেকে এসেছেন, এটুকু না করে পারি! আল্লাহ তাদের চেহারাগুলো দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বদা উজ্জ্বল রাখুন। কাল হাশরের ময়দানে আমাদের সবাইকে জান্নাতে একত্রিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন। আমীন!
***
পরদিন ১লা এপ্রিল’২৩। দেখতে দেখতে আমাদের সফর প্রায় শেষ লগ্নে চলে এসেছে। আগামীকাল দেশের পথে যাত্রা। সাহারীর পর হোটেলে দীর্ঘ বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের পর বের হ’লাম মধু ভাইয়ের গাড়িতে। সুবিশাল রিয়াদ শহরের উত্তরাঞ্চল ঘুরতে নিয়ে গেলেন তিনি আজ। গন্তব্য সমকালীন পৃথিবীতে ইসলামের বিশুদ্ধ রূপ পুনরুদ্ধারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত হুরায়মিলা নগরী। পথিমধ্যে বিখ্যাত কিং সঊদ বিশ্ববিদ্যালয় বাইরে থেকে দেখা হল। রিয়াদের এই দিকটা তেমন জনবহুল নয়। যদিও নতুন নতুন আবাসিক ও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে সম্প্রতি। পথে হাই হিত্তীন জামে মসজিদে আছরের ছালাত আদায় করলাম। প্রথমে ভাবলাম সেই ক্রসেডের চূড়ান্ত যুদ্ধস্থল হিট্টিন নাকি? পরে খেয়াল হ’ল ফিলিস্তীনের সেই হিট্টিন এখানে কেন আসবে? হয়ত সেই শহরের নামেই এর নামকরণ। আমরা শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের স্মৃতিবিজড়িত আধুনিক সঊদী আরবের কেন্দ্রভূমি উয়ায়না, দিরঈয়াহ প্রভৃতি প্রাচীন নগরী অতিক্রম করলাম। প্রায় ৯০ কি. মি. পথ পাড়ি দিয়ে হুরায়মিলা শহরে পৌঁছলাম বিকাল ৪টার দিকে। উয়ায়নায় শায়খের জন্মস্থল হ’লেও হুরায়মিলাই ছিল তাঁর আন্দোলনের মূলকেন্দ্র। এখানেই তিনি তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম প্রথম শুরু করেন। আজ থেকে তিন শত বছর পূর্বে ১৭২৬ থেকে ১৭৩৯ সাল পর্যন্ত একটানা ১৫ বছর তিনি এই অঞ্চলে কাটান। ভারত উপমহাদেশের খ্যাতনামা বিদ্বান আল্লামা হায়াত সিন্ধী (মৃ. ১৭৫০খৃ.)-এর কাছে শিরক-বিদ‘আত এবং তাক্বলীদের বিরুদ্ধে দীক্ষা নিয়ে যে ময়দানী আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন, এক সাগরসম বাধা-বিপত্তি, ত্যাগ-তিতিক্ষা আর যুদ্ধ-বিগ্রহ ঠেলে আরবের বুকে যে নতুন দিনের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন, তা-ই পূর্ণতা লাভ করে একসময় সমগ্র আরব ভুখন্ডকে শিরক-বিদআ‘ত থেকে পবিত্র করেছে। আধুনিক বিশ্বে মুসলিম সমাজে যত সংস্কার আন্দোলন চলমান রয়েছে, তার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের এই মহান আন্দোলন। আল্লাহ রাববুল আলামীন ইতিহাসের এই মহানায়কের উপর রহম করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাঊসের অধিকারী করুন। আমীন!
হুরায়মিলাতে এখন বিশেষ কিছু দেখার নেই। শায়খের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে তাঁর যে বাড়িঘর ছিল, তাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একবার সঊদী সরকার সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে শায়খ বিন বাযের পরামর্শে তা প্রত্যাহার করা হয়। কবর-মাযারকেন্দ্রিক বিদ‘আতের বিরুদ্ধে ছিল যার আজীবন সংগ্রাম, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জন্য বিশেষ স্মরণগাহ তৈরী হোক, সেটা আল্লাহ রাববুল আলামীন চাননি। শান্ত শহরটির একপ্রান্তে অবশ্য হুরায়মিলা ন্যাশনাল পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজায়ন কার্যক্রম চলমান। দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা মরুর বুকে এই সবুজ জঙ্গলের সমারোহ দেখতে আসেন। আমরা কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে ফিরতি পথ ধরি। পথিমধ্যে দিরঈয়াহ শহরের জুবাইলিয়া গ্রামে উপস্থিত হ’লাম। রিয়াদ থেকে প্রায় ৩০ কি. মি. দূরে এর অবস্থান। এখানে একটি কবরস্থান প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, যার অভ্যন্তরে রয়েছে ভন্ড নবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে পরিচালিত ইয়ামামার যুদ্ধে নিহত অনেক ছাহাবীর কবর। বিশেষ করে উমার (রা.)-এর ভ্রাতা যায়েদ বিন খাত্তাব (রা.)-এর কবরও এখানে বর্তমান, যার উপর একসময় গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছিল। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের এক পর্যায়ে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহ.) তাঁর সাথীদের নিয়ে সেই গম্বুজ ভেঙ্গে ফেলেন। এই কবরস্থানে আরো প্রায় ১৩০০ ছাহাবীর কবর রয়েছে। ফলে বাকী গোরস্থানের পর এটিই ছাহাবীদের সবচেয়ে বড় কবরস্থান হিসাবে পরিগণিত।
মাগরিবের সময় ঘনিয়ে আসছে। আমরা রিয়াদের পথ ধরি। ছানাইয়া ক্বাদীমায় আত-তাহরীক পাঠক ফোরাম, রিয়াদের সম্মানিত সেক্রেটারী জনাব মীযানুর রহমানের বাসায় ইফতারের দাওয়াত। সেখানে ‘আন্দোলন’ সভাপতি শায়খ মুশফিকুর রহমান মাদানী, সাধারণ সম্পাদক শায়খ আব্দুল হাই মাদানীসহ অন্যান্য দ্বীনী ভাইরা উপস্থিত হ’লেন। মীযান ভাই নিজের হাতেই ইফতার বানিয়েছেন মাশাআল্লাহ। ইফতারের পর রিয়াদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী মসজিদ আল-রাজেহী জামে মসজিদে এশা ও তারাবীর ছালাত আদায়ের জন্য গেলাম আলী হায়দার ভাইয়ের গাড়িতে। সঊদী আরবের অন্যান্য মসজিদের মতই চমৎকার ব্যবস্থাপনা। খুব ভাল লাগল।
ছালাত শেষে আমরা বাথা বাজারে এসে কিছু কেনাকাটা সেরে আর যিয়াউদ্দীন বাবলু ভাইয়ের আনা সুপ্রসিদ্ধ আল-বাইক ফুডচেইনের ফিশ ফ্রাই খেয়ে আবার ছানাইয়া কাদীমার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সেখানে ফুড হাউস নামে এক রেস্টুরেন্টে আমাদের এই সফরের শেষ সাংগঠনিক প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছে। সঊদী আরব ‘আন্দোলন’-এর মূল দায়িত্বশীলরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিভাবে ‘আন্দোলন’-এর কার্যক্রমকে সঊদী আরবে অগ্রসর করা যায়, সে বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও মতবিনিময় হ’ল বৈঠকে। আলহামদুলিল্লাহ প্রবাসে সীমিত সুযোগ ও সামর্থের মধ্য দিয়েও তাঁরা যে সাধ্যমত দ্বীনী দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, সেজন্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমরা আন্তরিক মোবারকবাদ জানালাম। বর্তমানে আহলেহাদীছ আক্বীদা ও মানহাজের প্রচার-প্রসারে মিডিয়ার ভূমিকা যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনি প্রবাসী ভাইদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রবাসী সাংগঠনিক শাখাগুলোকে আরো বেশী শক্তিশালী করা এবং দক্ষ কর্মী ও জনশক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে বৈঠক শেষ হ’ল। বৈঠক শেষে সাহারীর আয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে আতিথেয়তা করলেন ছানাইয়া ক্বাদীমাহ শাখা দায়িত্বশীল, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ঢাকার মাসঊদ আলম ভাই। আববার ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) পড়ার মাধ্যমে তিনি হেদায়াত পেয়েছেন বলে আমাদের প্রতি তাঁর বিশেষ আবেগ। আর সে কারণেই বোধহয় এবারের মধ্যপ্রাচ্য সফরের শেষ লগ্নে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আতিথেয়তার আয়োজনটা করলেন তিনি। সুবহানাল্লাহ! বাংলাদেশী, ইন্ডিয়ান, তুর্কি, সঊদী কত ধরণের খাবারের আয়োজন! আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন!
***
পরদিন দুপুরে বাথা বাজার থেকে আরো কিছু কেনাকাটা সেরে প্রস্ত্ততি নিয়ে ফেললাম। রাত দশটায় ফ্লাইট। সিলেটের আলী হায়দার ভাইয়ের বাসায় শেষদিন ইফতারের দাওয়াত। সেখানে সংগঠনের বেশ কিছু ভাই হাযির হয়েছেন বিদায় জানাতে। ইফতারের পর আমরা রওয়ানা হ’লাম এয়ারপোর্টের পথে। আলী হায়দার ভাই, আল-ইমরান ভাই ও আবুল হোসাইন ভাই আমাদের সঙ্গী হ’লেন। আলী হায়দার ভাই এমন একজন মানুষ যার অব্যক্ত ভালোবাসা হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। সোজাসাপ্টা হক্ব কথা বলা এই মানুষটা নেপথ্যে থেকে কাজ করতে ভালোবাসেন। তাঁর মাধ্যমে আত-তাহরীক, ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) কত মানুষের কাছে পৌঁছেছে, তার ইয়ত্তা নেই। ইমরান ভাইয়ের মত কিছুটা অভিমানীও তিনি। যার অন্তরে ভালোবাসার গভীরতা বেশী, তার অভিমানটাও একটু বেশী থাকবে-এটাই বোধহয় জগতের নিয়ম। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন। আমীন!
রিয়াদ শহর থেকে বেশ দূরে কিং খালেদ এয়ারপোর্ট। ভিতরে প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশী সময় লাগে না। ঢাকা এয়ারপোর্টের মত এত চেকিং-এর সম্মুখীন হ’তে হয় না। ওযনের অতিরিক্ত বইগুলো হাতে বহন করছিলাম। দায়িত্বশীল অফিসার খুব ভদ্রভাবে হাসি দিয়ে নির্বিঘ্নে পার করে দিলেন। বিদায় মানেই বেদনা। একদিকে দেশে ফেরার আনন্দ অন্যদিকে প্রিয় সাথীদের অশ্রুসজল বিমর্ষ চেহারাগুলোর হাতছানি- এই অম্লমধুর অভিজ্ঞতা দুনিয়াবী জীবনের এক অবশ্যম্ভবী নিয়তি। ছোট্ট জীবনে বার বার আমাদের যেতে হয় এই ভালোবাসা-বেদনার বিভ্রমের মধ্য দিয়ে। এসব ভাবতে ভাবতেই উড়োজাহায উড়াল দেয় দেশের পথে। পরদিন ভোরে কলম্বোর বন্দরনায়েকে এয়ারপোর্টে যাত্রাবিরতি হয় ঘন্টাদুয়েক। তারপর ঢাকায় এসে পৌঁঁছায় দুপুর নাগাদ। এভাবেই শেষ হয় আমাদের ২০ দিনের মধ্যপ্রাচ্য সফর।
এই সফরে মধ্যপ্রাচ্যের ১২টি বড় শহরসহ দেখা হয়েছে অনেক মফস্বল শহর, গ্রাম, পল্লী। অতিক্রম করা হয়েছে কত পাহাড়, মরুভূমি, সমুদ্র, নদী। জীবনের অভিজ্ঞতার ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছে বহু নতুন পর্ব। উন্মোচিত হয়েছে হাযারো অদেখাকে দেখার, অজানাকে জানার দুয়ার। ঋদ্ধ হয়েছি দ্বীনী ভাইদের তুলনারহিত ভালোবাসার পরশে, যে ভালোবাসার প্রতিদান আরশের মালিক ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। সড়কপথে ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে এমন এক দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত সুদীর্ঘ প্রায় ১৬০০ কি.মি. রাস্তা, যে দেশের প্রতিটি বালুকণায় মিশে আছে উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষদের পদচিহ্ন। এ সফর জীবনের খাতায় এক অমলিন অধ্যায় হিসাবে থেকে যাবে। জানার ও শেখার যে কোন শেষ নেই, তা এই সফর আমাদের গভীরভাবে শিখিয়েছে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখলে কিভাবে তিনি সাহায্য করেন, তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিয়েছে। পূর্বকালে বিদ্বানদের জ্ঞানার্জনের অন্যতম মাধ্যম কেন ছিল বিশ্বসফর, তা অনুভব করেছি প্রতিটি পরতে পরতে। ভবিষ্যতে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে হয়ত আবারো কখনও মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলো সফরের সুযোগ হবে, তবে পথপ্রদর্শক থাকবে এবারের এই সফর। আল্লাহ যেন আমাদের এই দাওয়াতী সফরকে কবুল করে নেন। এই সফরে যত মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে, যতজনের কাছে দাওয়াত পৌছানোর সুযোগ হয়েছে, তাদের কোন একজনকেও যদি আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করে নেন, সেটাই হবে আমাদের স্বার্থকতা। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে তাঁর সুমহান দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আমাদেরকে সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারী করুন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কেবল তাঁরই বারগাহে আত্মসমর্পণের অনুভূতি জাগ্রত রাখুন। আমাদেরকে পরিপূর্ণ মুসলিম হিসাবে মৃত্যু দান করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন!