৪ঠা
জুলাই ২০১৭। লাহোরে পঞ্চমবারের মত পা রাখা। ইসলামাবাদ থেকে ইসলামাবাদ
এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে রওনা হয়েছিলাম বিকেলে। রাত ১০-টার দিকে নামলাম লাহোর
রেলস্টেশনে। মোঘল আমলের ক্যাসল কিংবা দুর্গের আদলে নির্মিত স্টেশনটির ধুসর
লাল কাঠামো এক লহমায় দর্শককে ইতিহাসের পাতায় টেনে নিয়ে যায়। ১৮৫৭ সালের
সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পরপরই এটি নির্মিত হয়েছিল। সেই হিসাবে এর বয়স
১৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। তবে এর আভিজাত্য ও আকর্ষণ কমেনি
এতটুকু। ট্রেন থেকে নেমে লম্বা ওভারব্রীজ অতিক্রম করে প্রধান ফটকের সামনে
আসলাম। ভীড়ের মধ্যে ছোট ভাই শু‘আইবুর রহমানকে খুঁজে পেতে সমস্যা হ’ল না। সে
রাজশাহীর পবা উপযেলার ছেলে। লাহোর ইউইটি (ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং
এন্ড টেকনোলজি)-তে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করছে। ওর
ব্যাকগ্রাউন্ড মাদরাসার এবং রাজশাহীর রাণীবাজার আহলেহাদীছ মাদরাসা থেকে
দাওরায়ে হাদীছ ফারেগ হয়েছে। তবুও স্রোতের বিপরীতে এসে মাশাআল্লাহ যথেষ্ট
সাফল্যের সাথে পাকিস্তানের অন্যতম সেরা এই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা
করছে। ওর আমন্ত্রণেই দুই দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে লাহোর আসা। পূর্বে আরো
কয়েকবার বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এলেও লাহোর সিটি বিশেষ ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি।
তাই এবার কেবল ইতিহাস-ঐতিহ্যের লাহোর দেখার উদ্দেশ্যেই আসা।
রাতে ইউইটি ক্যাম্পাসের আল্লামা ইক্ববাল হোস্টেলে শু‘আইবের রুমে থাকলাম। পরদিন সকাল সকাল আমরা বের হ’লাম। সারাদিনের জন্য একটি সিএনজি ভাড়া করা হ’ল। প্রথম গন্তব্য পাকিস্তানী জাতির প্রাণস্পন্দন আল্লামা ইক্ববালের বাসভবন জাভেদ মনযিল। লাহোর রেলস্টেশনের নিকটেই তাঁর নামে নামকরণকৃত রোডে বাসভবনটি অবস্থিত। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু ৩ বছর তিনি এই ভবনে বসবাস করেন। ১৯৮৪ সালে পাকিস্তান সরকার এটিকে যাদুঘরে পরিণত করেছে। প্রায় ৭ কাঠা জায়গার ওপর ইউরোপীয় আদলে দীর্ঘ জানালা বিশিষ্ট অনাড়ম্বর ভবন। সম্মুখভাবে লম্বা খিলান বসানো পোর্চ। তার সামনে এক চিলতে সবুজ মাঠ আর ছোট্ট ফুলের বাগান। আমরা কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। কিন্তু বাড়ীতে ঢোকার সুযোগ পেলাম না। রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অন্যদিকে ভবনের উন্নয়নেরও কাজ চলছে। বাইরে আসবাব-পত্র সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সুতরাং উর্দূ কবিতার রাজাধিরাজের চরণস্পর্শে ধন্য সম্মুখ বারান্দার অংশটুকুতে কিছুক্ষণ পায়চারী করেই সন্তুষ্ট থাকতে হ’ল।
সেখান থেকে বের হয়ে আমরা লাহোরের সুপ্রসিদ্ধ মল রোডে অবস্থিত বাগ-ই-জিন্নাহ এবং কায়েদে আযম লাইব্রেরীতে এলাম। ধবধবে সাদা বিশাল লাইব্রেরী ভবনটি ১৮৬৬ সনে নির্মিত। এতে বিভিন্ন ভাষার প্রায় দেড় লক্ষ গ্রন্থ রয়েছে। নির্মাণশৈলী পুরোপুরি ইউরোপীয় ধাঁচের। জিন্নাহ গার্ডেনের বিশাল সবুজ চত্বরের প্রান্তভাগে এমন শ্বেত-শুভ্র লাইব্রেরীর সগৌরব অবস্থান মনে করিয়ে দেয় শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোর স্বাধীনতা স্কয়ারের কথা। প্রায় একই রকম দৃশ্যপট। আমি পার্কের বেঞ্চে বসে থাকি। একপাশে লাইব্রেরী, অপরপাশে বাগ-ই-জিন্নাহের সুবিস্তৃত সবুজ মাঠ। মধুর আবেশে দেহমন জুড়িয়ে যায়। লাইব্রেরীর অফিস থেকে ঘুরে এসে শু‘আইব জানালো এখানেও রবিবারের ফাঁড়া। সাপ্তাহিক ছুটি। সুতরাং বহির্সৌন্দর্য দেখেই তৃপ্ত থাকতে হ’ল।
অতঃপর ফিরোযপুর রোডে ইচরা বাযার এলাকায় হানাফীদের একটি বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেআ আশরাফিয়াতে আসলাম। ১৯৪৭ সালে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্রসংখ্যা দুই হাযারের মত। একটি বড় মসজিদ এবং সুদৃশ্য আয়তাকার ভবন মিলিয়ে মাদরাসার মূল ভবন। মধ্যভাগে ফুলের বাগান ঘেরা দীর্ঘ সবুজ মাঠ। মজার ব্যাপার এই দৃষ্টিনন্দন সবুজ মাঠের নীচে আন্ডারগ্রাউন্ডে একতলা ভবন রয়েছে যেখানে হিফযখানা অবস্থিত। ওপর থেকে তা বোঝার উপায় নেই। চমৎকার এই স্থাপত্য পরিকল্পনাটি মুগ্ধ করার মত। স্থানীয় ছাত্রদের পাশাপাশি বিদেশী ছাত্রদের জন্যও একটি আলাদা আবাসিক ভবন রয়েছে। যদিও বিগত পারভেয মুশাররফ সরকারের অগ্রহণযোগ্য নীতির কারণে এখন কোন বিদেশী ছাত্র আর নেই। আমরা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ফযলুর রহীম ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি অত্র মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতী মুহাম্মাদ হাসান অমৃতসরী (মৃ. ১৯৬১খ্রি.)-এর দ্বিতীয় সন্তান। অন্যান্য অনেক মেহমান ছিল তাঁর কক্ষে। তবুও ব্যস্ততার ফাঁকে আমাদেরকে আন্তরিকভাবে সময় দিলেন এবং বাংলাদেশী জেনে বিশেষ সমাদর করলেন। হাটহাজারীসহ বাংলাদেশের কয়েকটি মাদরাসা ভ্রমণ করেছেন বলে জানালেন। আমরা তাঁর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে মাদরাসার লাইব্রেরীসহ অন্যান্য ভবনগুলো পরিদর্শন করলাম। সঊদী অর্থায়নে নির্মিত লাইব্রেরী কক্ষটি খুবই সমৃদ্ধ। তাতে অনুপম স্থাপত্যকলার সমাবেশ ঘটানো হয়েছে, যা পাঠককে সুদূর অতীতে নিয়ে যায়। এর মধ্যে প্রাচীন পান্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য একটি আলাদা আর্কাইভস্ কক্ষও রয়েছে। সবমিলিয়ে শিক্ষার পরিবেশ যথেষ্ট সন্তোষজনক।
পরের গন্তব্য ইচরা বাযার থেকে একটু ভেতরে অবস্থিত জামা‘আতে ইসলামী পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মাওদূদীর বাসভবন। আল্লামা ইক্ববালের বাসভবনের মতই ধবধবে সাদা অভিজাত চেহারার সেমি ডুপ্লেক্স বাড়ি। সামনে পামগাছ ঘেরা ছোট্ট চত্ত্বর। সেখানে একপাশে মাওলানা মাওদূদীর সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখা বোর্ড। অপরপাশে তাঁর চিন্তাধারার সহগামী কয়েকজনের ছবি। যাদের মধ্যে রয়েছেন কিং ফয়ছাল, হাসানুল বান্না, ড. ইউসূফ আল-কারযাভী, মুহাম্মাদ মুরসী, খালিদ মিশ‘আল, রেসিপ তাইয়েপ এরদোগান, রশীদ ঘানুশী, সাইয়েদ আলী গিলানী প্রমুখ। এক কোণে টিনের ছাদে ঘেরা অনাড়ম্বর কবরস্থান, যেখানে পাশাপাশি দু’টি কবরে শুয়ে আছেন মাওলানা মাওদূদী এবং সম্ভবত তাঁর সহধর্মীনী। বাড়িটি এখন মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়েছে। পাশে রয়েছে একটি লাইব্রেরীও। কিন্তু রোববারের ফাঁড়া এখানেও। সবই বন্ধ।
সেখান থেকে বের হয়ে আমরা লাহোর সিটির এক প্রান্তেশাহদারা বাগে অবস্থিত ৪র্থ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭খ্রি.)-এর সমাধিক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা হ’লাম। রাভী নদী অতিক্রম করে সমাধিক্ষেত্রে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। মোঘল নির্মাণশৈলীর বিরাট ফটক পার হয়ে ভেতরে ঢোকার পর প্রথমেই পড়ে আকবরী সরাইখানা। স্টেডিয়াম সদৃশ বিশাল আয়তাকার মাঠের চারিদিকে খোপ খোপ আকারে ১৮০টি ঘর, যেগুলো সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধিক্ষেত্র রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত কর্মচারী এবং বহিরাগত দর্শনার্থীদের জন্য নির্মিত হয়েছিল। সরাইখানার পশ্চিমপ্রান্তে একটি মসজিদ। সেখানে যোহরের ছালাত আদায় করে আমরা খানিক বিশ্রাম নেই। সুরী যুগে নির্মিত এই মসজিদের সুউচ্চ ছাদের নীচে বসে সরাইখানার দীর্ঘ সারির দিকে তাকিয়ে রাজকীয় ভাবের উদয় ঘটে। মনে হয় হাক দিলে এই বুঝি রাজপ্রহরীরা জী হুজুর করে শশব্যস্তভাবে এগিয়ে আসবে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপ বইছে। ভরদুপুরে দর্শনার্থীর সংখ্যা প্রায় শূন্য। নির্জনতার এই হাহাকার প্রহরে অতীত-বর্তমানের মোসাবিদা নিয়ে বসতে তাই আমাদের বেশ সুবিধেই হয়। ১৬৩৭ সাল তথা প্রায় চার শত বছর পূর্বে এই সরাইখানা নির্মিত। এর মাঝে কত বছর চলে গেছে আর কত কী ঘটে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। শিখ রাজা রণজিৎ সিং (১৭৮০-১৮৩৯খ্রি.) তো একে সেনানীবাসই বানিয়ে ফেলেন। পরে বৃটিশরা এসে রেলওয়ের জন্য ব্যবহৃত কয়লার গুদাম বানায়। বর্তমানে সরকার কর্তৃক ঐতিহ্য সংরক্ষণের পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ায় সরাইখানা আবার আপন চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে বটে; তবে এখন তাতে মানবসন্তানের বদলে স্থান পেয়েছে ইতর প্রাণীকূল। খোপগুলোতে ইদুর, বিড়াল কিংবা পক্ষীকুলের অবাধ আনাগোনা সেই ইঙ্গিতই দিল।
আমরা সরাইখানার চওড়া অলিন্দের প্রান্ত ধরে ছায়ার সন্ধান করতে করতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মূল সমাধিক্ষেত্রের পানে এগিয়ে চলি। সরাইয়ের উত্তরপ্রান্তীয় ফটকে পৌঁছানোর পর ততোধিক দূরের নীলিমায় নযরে এল চারটি মিনার বিশিষ্ট লোহিত বর্ণের একতলা মনুমেন্ট। ফটক থেকে মনুমেন্ট পর্যন্ত সুবিশাল চত্বরে দীর্ঘ পায়ে চলা পথ। মাঝখানে সরু হাউজ/পুকুর আর দু’ধারে চমৎকার ফুলবাগান। জান্নাতের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে বাগ-বাগিচা ও পানির নহর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এ কারণে মোঘল স্থাপত্যসমূহে ফুলবাগান, লেক এবং জলাধার প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মনুমেন্টের প্রবেশপথে একটি উঁচু খোলা চাতোয়ান, যার মাঝে রয়েছে কৃত্রিম পানির ঝর্ণা। আমরা চাতোয়নটি পার হয়ে ভূমি থেকে বেশ উঁচু মনুমেন্টে প্রবেশ করি। মনুমেন্টের চারিদিকে অর্ধ গোলাকৃতির খিলান বিশিষ্ট ট্রাডিশনাল খোলা বারান্দা। এর অভ্যন্তরভাগে কয়েকটি দরজা অতিক্রম করে একটি সুরক্ষিত গোলাকার কক্ষে নকশাদার শ্বেতপাথরে বাঁধানো বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সমাধি। তাতে আরবীতে লেখা বাদশাহ জাহাঙ্গীরের নাম এবং মৃত্যুসন ১০৩৩ হিজরী। কবরের গায়ে অংকিত রয়েছে আল্লাহর ৯৯টি নাম। সমাধিক্ষেত্রে বসানো পাথরের গায়ে জেল্লাদার নকশা আর দেয়ালে অংকিত জ্যামিতিক ও ফুলেল মোটিফগুলো খুবই আকর্ষণীয়। দেখলেই বোঝা যায় কত শত মানুষের পরিশ্রম ও মেধা ব্যায়িত হয়েছে এর পিছনে। ইসলামে প্রাণীর অবয়ব চিত্রায়ন নিষিদ্ধ হওয়ায় মুসলিম শিল্পীরা জ্যামিতিক চিত্রকলা এবং ক্যালিগ্রাফী তথা লিপিকলার প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছিলেন এবং তা এতটাই শিল্পমন্ডিত করে তুলেছিলেন যে তাতে নিষ্প্রাণ বস্ত্তও অভূতপূর্ব প্রাণশক্তিতে ভরপুর উঠেছিল।
ফলকে লেখা ইতিহাসের টুকরো অংশ থেকে জানা যায়, সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয়েছিল কাশ্মীরে। কিন্তু রাভী নদীর কিনারে এই স্থানটি ছিল তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী নূরজাহানের অতি প্রিয় স্থান। তাই পরবর্তী মোঘল শাসক ও তাঁর সন্তান সম্রাট শাহজাহান পিতার সম্মানে এই জাকজমকপূর্ণ সমাধিক্ষেত্রটি নির্মাণ করেন। যদিও ইতিহাসে পাওয়া যায়, বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাঁর কবরকে এমন জমকালো করতে নিষেধই করেছিলেন।
আমরা বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সমাধিক্ষেত্র থেকে বের হই। পশ্চিমপ্রান্তের ফটক অতিক্রম করে আরও একটি সুবিস্তৃত বাগিচার মধ্যখানে মধ্যএশীয় প্যাটার্নের সুউচ্চ গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিক্ষেত্র দেখা গেল। এটি বাদশাহ জাহাঙ্গীরের মন্ত্রী ও লাহোর গভর্নর আসিফ খান (মৃ. ১৬৪১খ্রি.)-এর সমাধি। ইনি ছিলেন জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূর জাহানের বড় ভাই। এই সমাধিক্ষেত্রও এককালে সমান জৌলুসপূর্ণ ছিল, যা ভগ্নাংশের কারুকাজ দেখেই অনুমান করা যায়। তবে কালের বিবর্তনে এটি এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে কিছুটা দূরত্বে একমাত্র মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান (১৫৭৭-১৬৪৫খ্রি.)-এর সমাধিক্ষেত্র। সেটিও যথারীতি বিশাল জায়গাজুড়ে বিস্তৃত বাগিচার মধ্যস্থলে একটি লাল মনুমেন্টে ঘেরা। আমরা সেদিকে আর না গিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
(ক্রমশঃ)