৭ই মার্চ বৃহস্পতিবার ২০১৯। সফরকারীদের প্রায় সকলে মাগরিবের পূর্বেই দেশের বিভিন্ন যেলা থেকে এসে সদরঘাট পৌঁছে গিয়েছেন। আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব পৌঁছেছেন আছরের পরপরই। এটা ছিল আমীরে জামা‘আতকে সাথে নিয়ে ৫ম সাংগঠনিক ও দাওয়াতী শিক্ষা সফর।
প্রথমটি ছিল ১৯৯৭ সালের ১৫ হ’তে ২২শে নভেম্বর আটদিন ব্যাপী মোমিনডাঙ্গা (খুলনা), চটেরহাট-ঢালিরখন্ড (মোংলা, বাগেরহাট), সুন্দরবন, কুয়াকাটা ও সোহাগদল (পিরোজপুর) সফর। এসময় মোট ১৩টি যেলায় দাওয়াতী সফর করা হয়। এই সফরে ছিলেন ১৪টি যেলা থেকে ২৭ জন (দ্র. আত-তাহরীক ১/৪ সংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৯৭)।
দ্বিতীয়টি ছিল ২০১২ সালের ২৮ হতে ৩০শে নভেম্বর তিনদিন ব্যাপী দেশের উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর ও পঞ্চগড় সফর। এই সফরে ৮টি মাইক্রো যোগে ৪টি যেলা থেকে মোট ৮১ জন অংশগ্রহণ করেন। (দ্র. আত-তাহরীক ১৬/৪ সংখ্যা, জানুয়ারী ২০১৩)।
তৃতীয়টি ২০১৪ সালের ২২ থেকে ২৮শে মার্চ কক্সবাজার, বান্দরবান, সেন্ট মার্টিন, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে সপ্তাহ ব্যাপী দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ সফর। এই সফরে ছিলেন রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, মেহেরপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ঢাকা সহ ৭টি যেলা থেকে ৩০ জন।
চতুর্থটি ছিল ২০১৭ সালের ২৪ থেকে ২৮শে নভেম্বর পাঁচ দিনের সুন্দরবন সফর। এই সফরে ছিলেন ২০টি যেলা থেকে ১৩৮ জন।
পঞ্চমটি ছিল ২০১৮ সালের ১৫ হ’তে ১৯ মার্চ পাঁচদিন ব্যাপী চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সফর। এই সফরে ছিলেন ২২টি যেলা থেকে ৯৭ জন।
এবার ষষ্ঠ সফরে ৭ হ’তে ১০ই মার্চ চারদিন ব্যাপী হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ ও মনপুরায় ২৫টি যেলা থেকে মোট ১৭০ জন সাথী।
সফর শুরু :
সদরঘাটের লালকুঠি ঘাটে নোঙ্গর করে আছে সফরের বাহন ৫০০ যাত্রী ধারণ ক্ষমতার বিশালায়তন ত্রিতল লঞ্চ ‘গাজী সালাউদ্দিন’। তিনতলার সামনের ও পিছনের ফাঁকা অংশ বাদে পুরাটা কেবিন। দোতলায় অর্ধেক কেবিন ও বাকী অর্ধেক ডেক। এই ডেকেই ছালাত ও সফরের প্রোগ্রাম সমূহ অনুষ্ঠিত হয়। আমীরে জামা‘আত দোতলায় কেবিনে ছিলেন। নীচ তলায় ফাঁকা ডেকে খাওয়ার জায়গা। নীচ তলার ডেকের নীচে রয়েছে বিশাল গুদাম ঘর। যেখানে লঞ্চের খাদ্য-পানীয় ও অন্যান্য বস্ত্ত সমূহ মওজূদ থাকে। লঞ্চের মাথায় বড় ব্যানার টাঙানো হয়, শিক্ষা সফর ২০১৯। তারিখ : ৭-১০ই মার্চ, বৃহস্পতি-রবিবার। হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, মনপুরা। আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ।
সফর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রত ঢাকা যেলা ‘আন্দোলনে’র সাধারণ সম্পাদক তাসলীম সরকার ও অর্থ সম্পাদক কাযী হারূণুর রশীদ এবং ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুস্তাফীযুর রহমান সোহেল সহ কর্মীগণ শেষ মুহূর্তের প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন। সফরকারীদের ৭০ জনের থাকার ব্যবস্থা কেবিনে। বাকী সবাই দোতলার ডেকে। সফরের জন্য ক্রয়কৃত বালিশ ও কম্বল বিছিয়ে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিচতলায় খাওয়া-দাওয়ার জন্য চেয়ার-টেবিল সুন্দরভাবে সাজানো। ‘যুবসংঘে’র ভাইয়েরা স্বেচ্ছাসেবক এবং ‘আন্দোলনে’র মুরববীদের অনেকে তদারককারী ছিলেন। সব মিলিয়ে ছিমছাম পরিবেশ ও চমৎকার ব্যবস্থাপনা। পরবর্তী তিন দিন এই লঞ্চেই আমাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা। এটিই আমাদের সাময়িক বাসস্থান। উপরে নিঃসীম নীলাকাশ, নীচে অথৈ পানিরাশি, তার মাঝে আমাদের এই ছোট্ট নিবাস। যা একটি চলমান দ্বীপের ন্যায়। স্রেফ আল্লাহর রহমতের উপরে ভরসা করেই আমাদের যাত্রা।
এই দাওয়াতী ও শিক্ষা সফরের অধিকাংশ মুসাফিরই মুরববী বয়সের এবং এটাই অধিকাংশের প্রথমবারের মত দীর্ঘ লঞ্চ সফর। সবাই প্রস্ত্তত হয়ে এসেছেন দেশের সর্ব দক্ষিণের হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও মনপুরা দ্বীপাঞ্চলের প্রশান্ত নিরালায় ক’দিন কাটানোর জন্য এবং দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকার ভাইদের নিকট হক-এর দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষায়।
রাত ৮-টার মধ্যে সবাই উপস্থিত হয়ে গেলেন। এসময় ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি জনাব মুহাম্মাদ আহসান এসে সবাইকে বিদায় জানান এবং অসুস্থতার কারণে নিজে যেতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেন। অতঃপর ৮-টা ১৫ মিনিটে লঞ্চ ছাড়ল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। অতঃপর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সফরের উদ্দেশ্য এবং গন্তব্যস্থল সমূহের ব্যাপারে নাতিদীর্ঘ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। তিনি এই সফরের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির আহবায়ক, প্রশিক্ষণ সম্পাদক আলতাফ হোসাইনের অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিতির কথা স্মরণ করেন এবং তাঁর জন্য দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। ইতিপূর্বে আমীরে জামা‘আতের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ও নোয়াখালীর নতুন ভাই ইসমাঈল সফরের এলাকা সমূহ ঘুরে আসেন। অতঃপর ‘দরসে কুরআন’ শেষে আমীরে জামা‘আত সবার হাতে ‘প্রশ্নোত্তর ও কুইজ’ প্রতিযোগিতার জন্য পৃথক পৃথক প্রশ্নোত্তর শীট পৌঁছে দেন। এসময় অন্যতম কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা জনাব নূরুল ইসলাম প্রধান মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান।
সফর পরিকল্পনায় প্রথম ভোলা যাওয়ার কথা ছিল। পরে সঙ্গত কারণে ভোলার পরিবর্তে সরাসরি নোয়াখালী যেলার হাতিয়া দ্বীপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে সদরঘাট থেকে হাতিয়ার তমরুদ্দি লঞ্চঘাট পর্যন্ত একটানা প্রায় ১১ ঘন্টার দীর্ঘ সফর শুরু হ’ল। নৌপথে এটাই দেশের অন্যতম দীর্ঘতম রুট।
যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পর খবর পাওয়া গেল যে, যশোর যেলা ‘যুবসংঘে’র কিছু ভাই এবং ঢাকা যেলা ‘আন্দোলনে’র দায়িত্বশীল অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম সদরঘাটে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু লঞ্চ ঘোরানোর সুযোগ নেই। ফলে দুঃখজনকভাবে তাদেরকে ছাড়াই আমাদের সফর আব্যহত রাখতে হ’ল।
কৃষ্ণপক্ষের রাত। কুলহারা নদীতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লঞ্চের হেডলাইটও বন্ধ। আকাশের তারকারাজির মিটিমিটি আলো। দূরের লোকালয়ে মৃদু আলোর রেশ। মাঝে মাঝে বিপরীত দিক থেকে ঢেউ তুলে যাত্রীবাহী ও মালবাহী নৌযানগুলো অতিক্রম করে যায়। ইঞ্জিনের আওয়ায ও ডেকের কাঁপুনি থেকে বুঝা যায় যে, লঞ্চ চলছে বেশ দ্রুত গতিতেই। জোৎস্না রাত হ’লে যাত্রাটা নিশ্চয়ই আরও উপভোগ্য হ’ত। তবে নিকষ অাঁধারে লঞ্চের সম্মুখে ফাঁকা ডেকে দাঁড়িয়ে নদীর ভেজা বাতাসের আলিঙ্গন মন্দ লাগে না। এখানে ইঞ্জিনের শব্দ আসে না বলে নিস্তব্ধ রাতে অবারিত নদীর বুকে তাকিয়ে মনে হয়, বুঝি বসে আছি সাপের মত নিঃশব্দে ধাবমান কোন দৈত্যযানে। রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে সহযাত্রীরা শুয়ে পড়েন এক বৈচিত্র্যময় নতুন সকালের প্রত্যাশায়।
হাতিয়া :
বলা হয় যে, নয়া খাল বা নতুন খাল থেকে নোয়াখালী যেলার নামকরণ। আর এই যেলারই সর্বদক্ষিণে ‘হাতিয়া’ একটি মনোরম দ্বীপ উপযেলা। এই উপযেলার দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে তমরুদ্দি ঘাট, কমলার দীঘি পর্যটন স্পট, নিঝুম দ্বীপ, কাযীর বাযার ইত্যাদি।
দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ৭০ কি.মি. করে ২১০০ কি. মি. (৮০০ বর্গমাইল) আয়তনের এই উপযেলার জনসংখ্যা (২০১১ খৃ.) প্রায় ৫ লাখ। এর উত্তরে সুধারাম, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে সন্দ্বীপ ও ঠেঙ্গার চর এবং পশ্চিমে মনপুরা ও তজুমদ্দীন উপযেলা। এক সময় সন্দ্বীপের সঙ্গে হাতিয়ার দূরত্ব ছিল খুবই কম। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই দূরত্ব এখন ৬০ মাইল ছাড়িয়েছে। ক্রমাগত ভাঙনই এ দূরত্ব সৃষ্টির কারণ। হাতিয়ার ভাঙা-গড়ার খেলা চতুর্মুখী দোলায় দোলায়মান। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ভাঙছে, আবার দক্ষিণে গড়ছে। অন্যদিকে মূল ভূখন্ডকে কেন্দ্র করে আশপাশে ছোট-বড় অনেক চর জেগে উঠছে। হাতিয়ার বয়স সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাযার বছর বলে ধারণা করা হয়। যা আনুমানিক গড়ে প্রতি দেড়শ’ বছরে এক মাইল করে বৃদ্ধি পায়। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ১৫০০ শতাব্দীর দিকে বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার মোহনায় জেগে ওঠা এই দ্বীপটি সর্বপ্রথম মানুষের নযরে আসে।
বাংলাদেশে ‘ইসলামের প্রবেশদ্বার’ হিসাবে চট্টগ্রামকে ধরা হ’লেও হাতিয়াতেই প্রথম ইসলাম প্রবেশ করে বলে বিশ্বাস করেন দ্বীপের অধিবাসীরা। আরব বণিকগণ সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় মনোরম এই দ্বীপটির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এখানে কিছুকাল অবস্থান করেন। আর তাদেরই মাধ্যমে দ্বীপে বসবাসরত ‘কিরাত’ সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষদের মাঝে ইসলাম প্রচারিত হয়। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে এখানে একটি বৃহৎ জামে মসজিদ গড়ে ওঠে। এটিই ছিল হাতিয়ার প্রথম ঐতিহাসিক জামে মসজিদ। নির্মাণের প্রায় ৮০০ বছর পর ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ সালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মজীদের নকশায় পুরনো সেই মসজিদের আদলে মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হিসাবে এখানে আরেকটি মসজিদ গড়ে তোলা হয়। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত মসজিদটি অক্ষত ছিল।
ফজর ছালাতের ঘন্টাখানেক পূর্বেই সফরসঙ্গীরা ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করেন। অতঃপর ফজর ছালাতান্তে আমীরে জামা‘আত স্বীয় দরসে কুরআনে আসমান ও যমীনের সৃষ্টিকৌশল নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্যসমৃদ্ধ ভাষণ ও উপদেশ পেশ করেন। দরস শেষ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নিরবচ্ছিন্ন ১১ ঘন্টার যাত্রা শেষে লঞ্চ ভিড়ল হাতিয়ার তমরুদ্দি লঞ্চ ঘাটে। তখন বাজে সকাল ৭-টা। লঞ্চেই গোসল সেরে এবং ভুনা খিঁচুড়ি দিয়ে সকালের নাশতা শেষে বেলা ৯-টার দিকে আমরা দু’টি ট্রলারযোগে রওয়ানা হ’লাম পূর্ব নির্ধারিত গন্তব্য সাগরকোলের নিঝুম দ্বীপ অভিমুখে।
নিঝুম দ্বীপ :
‘নিঝুম দ্বীপ’ মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়া উপযেলার অর্ন্তগত বাংলাদেশের একটি ছোট্ট দ্বীপ। দ্বীপ বলা হ’লেও মূলতঃ এটি একটি চর। প্রায় ১৪,০৫০ একর বা ৯১ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি ১৯৫০ সালের দিকে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠে। ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত এখানে কোন লোকবসতি ছিল না। তাই দ্বীপটি নিঝুমই ছিল। হাতিয়ার ‘জাহায মারা’ ইউনিয়ন হ’তে কিছু জেলে নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় মাছ ধরতে আসে। তখন এখানে প্রচুর ইছা মাছ (চিংড়ি মাছ) ধরা পড়তো বিধায় জেলেরা এই দ্বীপের নাম দেয় ‘ইছামতির দ্বীপ’। এই দ্বীপটিতে মাঝে-মধ্যে বালির ঢিবি বা টিলার মত ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এই দ্বীপকে ‘বাইল্যার ডেইল’ বলেও ডাকতো। কালক্রমে ইছামতি দ্বীপ নামটি হারিয়ে গেলেও স্থানীয় লোকেরা এখনো এই দ্বীপকে ‘বাইল্যার ডেইল’ বলে।
ওছমান নামের জনৈক বাথানিয়া তার মহিষের বাথান নিয়ে প্রথম নিঝুম দ্বীপে বসতি গড়েন। তখন তার নামেই এর নামকরণ হয়েছিল ‘চর ওছমান’। পরে ১৯৭৩ সালে হাতিয়ার সংসদ সদস্য আমীরুল ইসলাম কালাম এই নাম বদলে ‘নিঝুম দ্বীপ’ নামকরণ করেন। মূলতঃ বল্লার চর, চর ওছমান, কামলার চর এবং চুর মুরি- এই চারটি চর মিলিয়ে ‘নিঝুম দ্বীপ’।
বাংলাদেশের বনবিভাগ ৭০-এর দশকে এখানে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০১ সালের ৮ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার পুরো দ্বীপটিকে ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসাবে ঘোষণা করে। বনবিভাগের পদক্ষেপে নতুন জেগে উঠা চরে লাগানো হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বনের জন্য লোনা পানি সহনক্ষম কেওড়া গাছের চারা। সেখানে প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চার জোড়া হরিণ ছাড়া হয়। অতঃপর ১৯৯৬ সালের হরিণশুমারী অনুযায়ী সেখানে হরিণের সংখ্যা ছিল ২২,০০০। ‘নিঝুম দ্বীপ’ এখন হরিণের অভয়ারণ্য। ৩৫ প্রজাতির পাখির কলরবে মুখর নিঝুম দ্বীপে রয়েছে ২১ প্রজাতির বৃক্ষ, শত শত গরু-মহিষ এবং এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে কেওড়া বাগান। সুন্দরবনের পরে নিঝুম দ্বীপকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘ম্যানগ্রোভ বন’ বলে দাবী করা হয়।
গুটিকয়েক জেলের বসবাস দিয়ে এই দ্বীপের অগ্রযাত্রা শুরু হ’লেও বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৫৮ হাযার। যাদের সবাই মুসলিম। এদের মধ্যে ৯০ ভাগ মানুষ মৎস্য ও কৃষিজীবী। পুরো দ্বীপে ঘন সবুজের সমারোহ, মাঝে-মধ্যে খাল-বিল। খালের ওপর গাছের সাঁকো আর বনের মাঝখানে সবুজ সমতলভূমি। বনে হরিণ আর বানরসহ নানা রকম পশুপাখির বসবাস। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার জন্য দ্বীপের দক্ষিণে বৃত্তাকারে প্রায় ১২ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে বিশাল সী-বিচ। যদিও কক্সবাজারের মত কেবল বালুর স্তর নয়, বরং পলি ও কাদায় ঢাকা।
চন্দ্রালোকে জোয়ার-ভাটায় এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা করে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের উত্তাল গর্জন, পূর্বে দমার চর, পশ্চিমে মেঘনা নদীর কলতান ও উত্তরে মোক্তারিয়া খালের দুই পাড়। শীতের সময় লাখ লাখ অতিথি পাখি এ দ্বীপে এসে আশ্রয় নেয়। এ সময় পাখিদের ডাকে পুরো দ্বীপ মুখরিত হয়ে ওঠে।
দ্বীপে যাতায়াতের জন্য জোয়ার-ভাটা মেনে চলতে হয়। সকাল ৯-টায় যখন জোয়ার শুরু হয়, তখন উভয় দিক থেকে ট্রলারগুলো ছাড়ে। ‘হাতিয়া চ্যানেল’ দিয়ে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলে। এই চ্যানেলে নদীর প্রস্থ দিগন্তছোঁয়া হ’লেও গভীরতা কম। চারিদিকে অসংখ্য মাছ ধরার জাল। চিংড়ি মাছই বেশীরভাগ ধরা পড়ে বলে জানালো মাঝিরা। রৌদ্রের খরতাপে অল্পক্ষণেই আমরা হাঁপিয়ে উঠি। তবে দূরের মনপুরা ও জাহাযমারা দ্বীপের সবুজ রেখা এবং নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে চরে বেড়ানো কৃষকায় মহিষের দল আমাদের সজীব করে রাখে। মাঝে মধ্যে ভ্রমণসঙ্গীরা তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলেন নদীবক্ষ। দীর্ঘ ৩ ঘন্টা পর আমরা নিঝুম দ্বীপের ‘নামার বাযার’ ঘাটে পৌঁছি।
অতঃপর জুম‘আর ছালাত আদায়ের জন্য আমরা নিঝুম দ্বীপের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে গমন করি। আমাদের সফর ব্যবস্থাপকগণ আমীরে জামা‘আতের খুৎবা দানের বিষয়ে মসজিদ কমিটির সভাপতির সাথে আলোচনা করলে তিনি রাযী হন এবং আমীরে জামা‘আতের নিকটে এসে সালাম করেন। পরে তিনি কমিটির লোকদের সাথে আলোচনার জন্য বাইরে যান। অতঃপর ঐদিনের জন্য আমন্ত্রিত খতীব এসে গেলে তিনি খুৎবা-পূর্ব বয়ানে মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আহলেহাদীছ একটি হক দল’। দেখলাম অধিকাংশ মুছল্লীর আগ্রহ সত্ত্বেও তরুণ মুওয়াযযিন সহ আরো দু’একজন স্থানীয় মাদ্রাসাপড়ুয়া যুবক আপত্তি জানালো। তবে মসজিদ কমিটির সভাপতি ছাহেব ছালাতের পর আমীরে জামা‘আতকে আলোচনা রাখার অনুরোধ জানান। ফলে ছালাত শেষে মিম্বরে বসে আমীরে জামা‘আত উপস্থিত মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে ১১ মিনিট বক্তব্য রাখেন এবং সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াতের আলোকে সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্মমূলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান।
ছালাত শেষে মসজিদ কমিটির সদস্যগণ সহ মুছল্লীদের মধ্যে ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), মীলাদ প্রসঙ্গ, শবেবরাত, কোরআন ও কলেমাখানী বই, মাসিক আত-তাহরীক পত্রিকা এবং যাবতীয় চরমপন্থা হ’তে বিরত থাকুন! ও ‘পরিচিতি’ লিফলেট বিতরণ করা হয়। মুছল্লীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষিত যুবক এসময় আহলেহাদীছের স্বচ্ছ দাওয়াত সম্পর্কে সুন্দর মন্তব্য করেন ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। স্থানীয় বাযারেও লোকদের সাথে মতবিনিময় করা হয় ও তাদের মধ্যে বইপত্র বিতরণ করা হয়।
পরে আমরা সমুদ্র সৈকতে গেলাম। দীর্ঘ বালুকাবেলা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালাম। না, স্রোতের কোন টান নেই। নেই কোন ঊর্মিমালা। প্রায় নিস্তরঙ্গ সাগরবক্ষ। ভ্রমণসঙ্গীরা অনেকেই নেমে গেলেন সাগরের পানিতে দাপাদাপি আর গোসল করতে। তবে অগভীর সৈকতে প্রচুর কাদার উপস্থিতি সে উৎসাহে লাগাম টেনে ধরল। আর একদল মেতে উঠলেন ফুটবল খেলতে। যা তারা আগে থেকেই সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমীরে জামা‘আতসহ আরেকটি দল সাগর তীরে গাছের ছায়ায় বসে জীবনের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আসরে বসলেন। যেখানে অনেক ভাই তাদের আক্বীদা পরিবর্তনের ঘটনা এবং এ কারণে তাদের ওপর আপতিত নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করলেন। অনেকে তাদের গায়কী প্রতিভার প্রকাশ ঘটালেন। সেখানে পাবনা যেলা সভাপতি মাওলানা বেলালুদ্দীন স্বরচিত চমৎকার জাগরণী গেয়ে পরিবেশকে উপভোগ্য করে তোলেন। তাঁর সাথে অন্যেরাও জাগরণী উপহার দেন। এভাবে সময়টি কিভাবে কাটল আঁচ করা যায়নি। ইতিমধ্যে সাগর থেকে ফেরা দলটি এসে গেলে এই আসর ভেঙ্গে যায়। অতঃপর সবাই ট্রলারের উদ্দেশ্যে পায়দল রওয়ানা হন।
আসার পথে বাযারের চেহারা খুবই মলিন মনে হ’ল। প্রায় সবই পুরানো টিনশেড। সরকারী একটি সহ মাত্র তিনটি রিসোর্ট এবং জামে মসজিদটিতে নতুনত্বের ছাপ দেখা যায়। অতঃপর বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে ‘নামার বাযার’ ঘাটে এসে পৌঁছলাম। সেখানে শাখা নদীর ধারে বসে মধ্যাহ্নভোজের অপেক্ষায় অনেকক্ষণ থাকতে হ’ল।
অপেক্ষার এই সময়ে আমরা ‘নামার বাযার’ ঘাটে জীবন্ত চেঁউয়া মাছ ও শুঁটকি মাছের ছোট চাতাল দেখলাম। এখানে মাছের উচ্ছিষ্ট অংশ শুঁকানো হয়। একটা সরু ও লম্বা লেজ ওয়ালা চওড়া ও গোল একটি ‘শাপলাপাতা’ মাছ ধরে এনে আমীরে জামা‘আতকে দেখানো হ’ল। যা দেখে রীতিমত ভয় পাওয়ার মত। কেননা এটি দেখতে ঠিক কালো বাদুড়ের মত। এটা নাকি দুর্গন্ধযুক্ত কিন্তু খুবই সুস্বাদু মাছ। এগুলি ৫ থেকে ১০ কেজি ওযনের হয়ে থাকে। যা দেশের বাযারে ছাড়াও বিদেশে রফতানী হয়। লম্বা লেজটা শুঁকিয়ে মূল্যবান ধারালো চাবুক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
হরিণের কথা অনেক শুনলেও ‘সবেধন নীলমণি’ হিসাবে মাত্র একটি হরিণ চোখে পড়ল নিঝুম দ্বীপ বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রের নীচে খালি জায়গায় দাঁড়ানো অবস্থায়। শেষ বিকেলের পড়ন্ত বেলায় মেঘনার উপকূলবর্তী নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সবুজ চারণভূমিতে দেখলাম অগণিত গরু-মহিষের বিচরণদৃশ্য সত্যিই মনোহর। তবে কোনটিরই স্বাস্থ্য সুখকর নয়। ভাটার সময় স্রোতের বিপরীতে চলায় ট্রলার দ্রুত এগুতে পারেনি। রাত নেমে এলে গতি আরও কমে আসে। ফলে হাতিয়া এসে পৌঁছতে আমাদের চার ঘন্টা লেগে যায়। মাগরিব ও এশার ছালাত জমা ও ক্বছরের সাথে আদায়ের পর রাতের খাবার খেয়ে ভ্রমণসঙ্গীরা যার যার মত বিশ্রামে চলে যান।
পরদিন ৯ই মার্চ ফজরের পর আমীরে জামা‘আতের দরস শেষে শুকনা-ভুনা খিঁচুড়ি দিয়ে সকালের নাশতা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়ি হাতিয়া উপযেলা শহর এবং সাগরপাড়ের ‘কমলার দীঘি’ পর্যটন স্পট পরিদর্শনের জন্য। ‘তমরুদ্দি লঞ্চ ঘাট’ থেকে সোজা আড়াআড়ি ১৫ কি.মি. দূরে ‘কমলার দীঘি’ পর্যন্ত যেতে পার্বত্য অঞ্চলের চাঁদের গাড়ির আদলে তৈরী ৭টি বাস ভাড়া করা হয়। সেই সাথে ৪টি মোটর সাইকেল।
পথিমধ্যে ওছখালী বাযার অতিক্রম করার সময় বেশ কিছু বইপত্র বিতরণ করা হ’ল। রাজশাহী যেলা ‘আন্দোলনে’র সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুবীনুল ইসলাম এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
‘কমলার দীঘি’ পর্যটন স্পট একটি বড় দীঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখান থেকে সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত সরকারীভাবে বনায়ন করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দনভাবে। গড়ে তোলা হয়েছে কেওড়া বাগানের বিশালায়তন ম্যানগ্রোভ বন। এই বনে রয়েছে হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী। পায়ের ছাপ দেখে বুঝা যায় এখানে হরিণের সংখ্যা কম নয়। তবে নিঝুম দ্বীপের মত এখানেও সৈকত থেকে সমুদ্রের দূরত্ব বেশী। পানিতে নেমে গোসলের কোন ব্যবস্থা নেই।
‘কমলার দীঘি’ স্পটের দোকানের সামনে সাথীদের নিয়ে আমীরে জামা‘আত একটি মনোজ্ঞ আসর জমিয়ে তোলেন। এখানে পাবনার কেরামত আলী সুন্দর জাগরণী গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। সঙ্গে কর্মীদের মুহুর্মুহু শ্লোগান ‘আন্দোলন’-এর বাণীকে এলাকাবাসীর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। প্রায় দেড় ঘন্টা সময় কাটিয়ে আমরা আবার তমরুদ্দি ঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম।
পথিমধ্যে উপযেলা বাযারে ও ওছখালী বাযারে আবারও বই বিতরণ করা হয়। বিশেষ করে ‘শবেবরাত’ বইটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মত। কর্মীদের উৎসাহ ছিল দারুণ। প্রায় ২০০ দোকানে এসময় বই ও লিফলেট বিতরণ করা হয়। আল্লাহর রহমতে কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হ’তে হয়নি।
তবে রংপুরের ভাই ইয়াকুব আলী খান তমরুদ্দি লঞ্চঘাট বাযারে একাকী ‘তাবলীগে’র লোকদের নিকট দাওয়াত দিতে গেলে তারা প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে তাকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। অতঃপর তারা তাকে বাযারের বড় ব্যবসায়ী নূরুল আবছার (নীরব) ছাহেবের কাছে নিয়ে আসে। তিনি ‘তাবলীগী’দের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করেন। তিনি আমীরে জামা‘আতের নাম শুনে আরও দু’জন ব্যবসায়ীকে সাথে নিয়ে লঞ্চে আসেন ও আমীরে জামা‘আতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা জানালেন যে, তারা আমীরে জামা‘আত ও মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈলের বক্তব্য নিয়মিত ইউটিউবে শোনেন ও তাঁদের প্রতি ভক্তি রাখেন। তাদের নিকট ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ আছে। ইন্টারনেটে ‘আত-তাহরীক’ পড়েন। তারা বললেন, আমরা আপনাদেরকে নিয়ে ভবিষ্যতে এখানে একটা বড় প্রোগ্রাম করতে চাই। এ সময় স্থানীয় গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা লঞ্চে এসে আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
বেলা ১-টার দিকে আমরা তমরুদ্দি ঘাট থেকে হাতিয়াকে বিদায় জানিয়ে মনপুরা দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। ৪৫ মিনিটের মধ্যে লঞ্চ ঘাটে ভিড়ল। অতঃপর লঞ্চেই জামা‘আত সহ যোহর ও আছর জমা ও ক্বছর করে ছালাত শেষে দুপুরের খানা সেরে নিই।
মনপুরা দ্বীপ :
বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ ভোলা যেলার মূল ভূখন্ড থেকে ৮০ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যমন্ডিত রূপালী দ্বীপ ‘মনপুরা’। এটি ভোলা যেলার অন্তর্গত একটি উপযেলার নাম। আয়তন ৩৭৩.১৯ কি.মি. (১৪৪.০৯ বর্গমাইল)। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, দ্বীপটি দৈর্ঘ্যে ৩৫ কি.মি. এবং প্রস্থে কোথাও সাড়ে ৫ ও কোথাও সাড়ে ৩ কি.মি.। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনার মোহনায় ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মনপুরা উপযেলায় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। মিয়াঁ যমীর শাহ-এর স্মৃতি বিজড়িত মনপুরা দ্বীপ অতি প্রাচীন। একসময় এ দ্বীপে পর্তুগীজদের ঘাঁটি ছিল। তারই নিদর্শন হিসাবে দেখতে পাওয়া যায় লম্বা লোমওয়ালা কুকুর।
‘মন গাযী’ নামে এখানকার একজন ব্যক্তি বাঘের আক্রমণে নিহত হন। তার নামানুসারে ‘মনপুরা’ নামকরণ করা হয় বলে কথিত আছে। তিন দিকে মেঘনা, আর একদিকে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত অপরূপ প্রাকৃতিক সাজে সজ্জিত মনপুরা দ্বীপ। মনপুরা সদর থেকে দুই কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গড়ে উঠেছে মনপুরা ফিশারিজ লিঃ। চতুর্দিকে বেড়ীবাঁধ, ধানের ক্ষেত, বিশাল ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের বাগানে সমৃদ্ধ। বর্ষাকালে প্লাবিত হয় দ্বীপের অধিকাংশ এলাকা।
ছোট বড় ১০টি চর ও বনবিভাগের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে সবুজ বিপ্লব। মাইলের পর মাইল সবুজ বৃক্ষরাজি মনপুরাকে সাজিয়েছে সবুজের সমারোহে। শীত মৌসুমে শত শত পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে চরগুলো। যেগুলির নাম চর তাযাম্মুল, চর পাতালিয়া, চর পিয়াল, চর নিযাম, চর শামসুদ্দীন, লালচর, ডাল চর, কলাতলীর চর ইত্যাদি। প্রতিটি চরই ঘনবসতিপূর্ণ। অধিবাসীরা সব মুসলিম।
শেষে সামান্য বিশ্রামের পর দুপুরের খানা সেরে আমরা মনপুরা দ্বীপ পরিদর্শনে বের হ’লাম। হাতিয়ার মত এখানেও মটরসাইকেল ভাড়া পাওয়া গেল। প্রথমে আমরা গেলাম উপযেলা শহরে। যাত্রাপথে যতগুলো বাড়ি দেখা যায় প্রায় সবগুলির সাথে পুকুর। আর প্রতিটি পুকুরের ঘাট উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ঘেরা। যেন বাড়ির মহিলারা নির্বিঘ্নে পর্দার সাথে সেখানে যেতে পারেন। দ্বীপাঞ্চলের মানুষদের বেশ ধার্মিক মনে হয়েছে। রাস্তাঘাটে মহিলাদের খুব কমই দেখা গেছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল, এখানকার মহিলারা যথেষ্ট শালীন ও পর্দানশীন। শহরে বেশ কয়েকটি বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখা গেল। যেগুলোর সামনে রয়েছে বড় বড় দীঘি। সেখান থেকে মেঘনা নদীর পাড়ে ‘গাযীরহাট ব্রীজে’ আসলাম, যেটি নদীর মধ্যে প্রায় কোয়ার্টার কি.মি. চলে গেছে। উন্মুক্ত হাওয়ায় পরিবেশটা খুব সুন্দর। সেখান থেকে বেড়ীবাঁধের ওপর দিয়ে সরকারী বনাঞ্চলে আসলাম। এই বনেও অনেক হরিণ আছে, তবে কেবল নির্দিষ্ট সময়ে দেখা যায়।
এরপর কিছু দূর গিয়ে মেঘনার একটি শাখা ‘হাজীর দোন’ খালের ওপর সাড়ে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘ভূঁইয়ার হাট ব্রীজ’। এখানে গিয়ে খালে নেমে আমরা বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। এভাবে প্রায় দু’ঘন্টা দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে আমরা ফিরে আসি লঞ্চঘাটে।
আমীরে জামা‘আত নিজেও বিল্লাহ ভাইয়ের মটরসাইকেলের পিছনে চড়ে উপযেলা শহর ঘুরে দেখেন। আত-তাহরীক সম্পাদক ড. সাখাওয়াত হুসাইনকে দেখা গেল স্বয়ং মটর সাইকেল চালিয়ে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এবং শূরা সদস্য ক্বাযী হারূণকে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছেন।
ভ্রমণসঙ্গীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গিয়েছিলেন স্থানীয় ফাযিল মাদরাসায়। সেখানে তারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দাওয়াত দিলে মাদরাসার শিক্ষকগণ খুশী হন। তাদেরকে বইপত্র প্রদান করা হয়। বিশেষ করে আমীরে জামা‘আত মনপুরা এসেছেন জেনে উক্ত ফাযিল মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল বলেন যে, আমরা আগে জানলে তাঁকে নিয়ে বড় আকারে প্রোগ্রাম করতাম। আমরা আগেই আহলেহাদীছের দাওয়াত পেয়েছি তাঁর ভায়রা ভাই ডা. রফীকুল ইসলাম (সাতক্ষীরা)-এর মাধ্যমে, যখন তিনি মনপুরা উপযেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক হিসাবে এখানে কর্মরত ছিলেন।
আমাদের একটি দল লঞ্চঘাটের সবুজ মাঠে ফুটবল খেলা শুরু করলেন। বল নদীতে ফেলাটাই ছিল গোল করা। তরুণ ও বয়স্ক মিলে বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হ’ল। বিভিন্ন যেলা থেকে আগত সংগঠনের ভাইদের পারস্পরিক ভালবাসা ও মেল-বন্ধনের এমন আন্তরিক প্রকাশ দেখে বড়ই প্রশান্তি বোধ করলাম।
লঞ্চ ছাড়ার ১০ মিনিট আগেই আমীরে জামা‘আত এসে পৌঁছেন। তিনি এসে খেলা দেখে খুশী হয়ে বললেন, আগে জানলে আমিও তোমাদের সাথে খেলতাম। কেননা কাকডাঙ্গায় ছাত্র জীবনে আমি ব্যাকে ভাল ফুটবল খেলতাম। আমাকে ডিঙ্গিয়ে গোল করা সহজ ছিলনা।
বিকাল ৫টায় লঞ্চের সারেং তীক্ষণ হুইসেল বাজান, অর্থাৎ সফরের পরিসমাপ্তি। দ্রুত সকলে উঠে গেলে লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। পরে জানা গেল যে, সাতক্ষীরার চারজন সাথী লঞ্চ পেয়ে এখান থেকে ভোলায় গেছেন। অতঃপর কুয়াকাটা ঘুরে পরদিন বাড়ী ফিরে গেছেন।
শুরু হ’ল বিস্তৃত নদীপথ। খোলা আসমানের নীচে চারিদিকে বিস্তীর্ণ মেঘনা নদীর বুক চিরে লঞ্চ এগিয়ে চলে তর তর গতিতে। নদীবক্ষে শেষ বিকাল মানেই সোনাঝরা রোদের ঝিলিমিলি আভায় রাঙানো আকাশ ও পানিরাশির ছন্দময় ক্রীড়া। সেই স্বর্ণালী দৃশ্যপট উপভোগ করতে আমীরে জামা‘আতসহ আমরা লঞ্চের ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। সুবহানাল্লাহ কি যে মনোমুগ্ধকর সেই মুহূর্তগুলি! সেই বৈকালিক আলোকবিভা-কে আরো ছন্দময় করে তোলে কবুতর জাতীয় অত্যন্ত সাহসী সমুদ্রপাখি সী-গালের ঝাঁক। লঞ্চের গতির সাথে পাললা দিয়ে উড়ে বেড়ানোই তাদের স্বভাব। আমাদের কেউ চিপ্স কেউ বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়িত করে তাদেরকে। ছুঁড়ে দেয়া উড়ন্ত খাবার ঠোঁটে ধারণ করার অদ্ভুত দক্ষতা দেখিয়ে দর্শকদের মাত করে দিল সী-গালের দল। দেখতে দেখতে একসময় সূর্য অস্তাচলে হারিয়ে গেল। মেঘনাবক্ষে দেখা মনপুরা দ্বীপে সূর্যাস্তের এই মনোহারী দৃশ্য বহু দিন মনে থাকবে।
লঞ্চের ডেকে মাগরিব ও এশার ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করে আমরা দু’দিনের সফরের খতিয়ান নিতে বসে গেলাম। আমীরে জামা‘আতের গুরুত্বপূর্ণ দরস শেষে তাঁর আবেদনক্রমে ভ্রমণসঙ্গীরা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি সমূহ ব্যক্ত করতে লাগলেন। বলা যায়, সফরের অন্যতম স্মরণীয় অনুষ্ঠান ছিল এটি। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রচার ও প্রসারে যে বিপ্লবী মিশন চালিয়ে যাচ্ছে ‘আন্দোলন’, তারই এক জীবন্ত আলেখ্য যেন ফুটে উঠল কর্মীভাইদের আবেগময় দৃপ্ত উচ্চারণে। বাদ মাগরিব থেকে রাত প্রায় ১১-টা পর্যন্ত চলল এই অনুভূতি প্রকাশের উন্মুক্ত আসর।
সর্বোপরি দেশে-বিদেশে ব্যক্তিগতভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাসফরের অভিজ্ঞতা আমার নিজেরও কম নয়। তবে এমন ভিন্নধর্মী শিক্ষাসফর আমার জন্যও নতুন। কেননা এতে কেবল ভ্রমণই উদ্দেশ্য নয়, বরং নিজের ঈমানী জাযবা বৃদ্ধি, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ় করা এবং মানুষের কাছে হক-এর দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার ঐকান্তিক আগ্রহ যেন সবার চোখে-মুখে উচ্ছ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। এমন দাওয়াতী শিক্ষাসফর নিঃসন্দেহে একটি ফলপ্রসূ উদ্যোগ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এমন সফর কিংবা দাওয়াতী ক্যাম্পিং নিয়মিত হ’লে হক-এর দাওয়াত এদেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!
রাতটি কাটিয়ে পরদিন ফজরের সময় যখন চোখ মেলছি, তখন ভোরের আলোয় বুড়িগঙ্গার আকাশ-বাতাস দৃশ্যমান হয়। ফজরের ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করার পর আমীরে জামা‘আত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায়ী নছীহত করলেন। এরই মাঝে লঞ্চ সদরঘাটে এসে নোঙর ফেলে। শেষ হ’ল দুই দিন ও তিন রাতের রূহানী, দাওয়াতী ও প্রশিক্ষণমূলক সফর। ভ্রমণসঙ্গীরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলেন অব্যক্ত বেদনার সাথে। আবার কবে কখন দেখা হবে কে জানে? তবুও নতুন কোন স্থানে, নতুন কোন উপলক্ষে সাক্ষাতের আশাবাদ রেখে আমরা স্ব স্ব গন্তব্যের পথে পা বাড়াই।
[ক্রমশঃ]