১.
চলতি বছরের জানুয়ারীতে পেশোয়ার যাওয়ার পথে ‘নওশেরা’ নামটি চোখে পড়তেই হৃদকম্পন দিয়ে কল্পনায় ভেসে উঠেছিল সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী (রহ.), শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন তথা বৃটিশ ও শিখবিরোধী ‘জিহাদ আন্দোলন’-এর অম্লান স্মৃতি। খাইবার-পাখতুনখোয়া তথা তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বড় একটা অংশ ছিল এই আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। তখন থেকেই এই জিহাদ আন্দোলনের সর্বাধিক তাৎপর্যময় অধ্যায় ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধের স্থানটি স্বচক্ষে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। মাঝখানে দেশে যাওয়া, দুই সপ্তাহ পর দেশ থেকে ফিরে এসে মিড টার্ম পরীক্ষা দেয়া ইত্যাদির কারণে বেশ ব্যস্ততা ছিল। অবশেষে পরীক্ষার পর সর্বপ্রথম পরিকল্পনাতেই বালাকোট সফরটা চূড়ান্ত করে ফেললাম।
মারদানের এক ক্লাসমেট আনওয়ারুল হককে বলে রেখেছিলাম সফরসঙ্গী হওয়ার জন্য। কিন্তু নির্ধারিত দিন ২৫ এপ্রিল’১৪ সকালে সে জানালো বিশেষ কারণবশতঃ যেতে পারছে না। ভাবলাম তাহলে অপর কোন সঙ্গী পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। এমন অপরিচিত গন্তব্যে একাকী যাওয়াটা সুবিবেচনার কাজ হবে না। ভাষাগত সমস্যাও আছে। কেননা ওদিকের লোকজন হিন্দকো ভাষী (যদিও পরে দেখলাম উর্দূ ও হিন্দকোর মধ্যে তেমন একটা তফাৎ নেই)। কিন্তু নিয়ত যখন করে ফেলেছি এবং সফরের প্রস্ত্ততিও যখন নিয়ে ফেলেছি, তখন সফর তো অর্ধেকটা হয়েই গেছে। এমতাবস্থায় পিছুটান দিতেও মনটা সায় দিচ্ছে না। তাছাড়া সত্যি বলতে একাকী সফরে আমার খুব একটা আপত্তি নেই। বরং ভালই লাগে। অনুভূতির জগতকে উজাড় করে দিয়ে নিজের মত করে সব কিছু দেখা, নিজের মত করে বোঝা, নিজের মত করে অনুভব করার মধ্যে অন্য রকম এক আনন্দ আছে। অনেকটা ধ্যানমগ্ন সাধক তার নিবিড় সাধনায় যে পরিতৃপ্তির খোঁজ পায় তেমন। তাই আর দেরী করলাম না। অন্তর্জগতের শত-সহস্র অধরা অনুভবকে সঙ্গী করে বেশ প্রসন্নচিত্তে একাকীই রওনা হলাম। পেশোয়ার অভিমুখী জিটি রোড ধরে টাক্সিলা ওয়াহ ক্যান্টনমেন্ট, তারপর হাসান আবদাল থেকে রাইট টার্ন নিয়ে কারাকোরাম হাইওয়ে (এন-৩৫) ধরে হরিপুর যেলায় ঢোকার পর হায়েস মাইক্রোবাসটি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তারপর আবার রওনা হয় এ্যাবোটাবাদের পথে। রাস্তার দু’ধারে বেশ দূরে বৃক্ষহীন অথচ সবুজ ঘাস, লতাগুল্মে ভরা পাহাড়ের দীর্ঘ সারি। সমভূমি ছেড়ে ঐসব পাহাড়ে বহু মানুষের বসবাস। গাড়ি এগিয়ে যায় একের পর এক পাহাড়ী জনপদ পেরিয়ে। বিশাল সরীসৃপের মত পাহাড়ের সারিও ধীরলয়ে পিছুপথে হারিয়ে যায়। শূন্য বোবা দৃষ্টি সেদিকে লেগে থাকে আঠার মত। ইত্যবসরে স্মৃতির মণিকোঠায় ডানা ঝাপটা দিয়ে উড়ে বেড়ায় নানান রঙে রঙিন মুক্ত বিহঙ্গরা। দেশের বাইরে আসার পর থেকে একটু অবসর মিললেই এই কাল্পনিক বিহঙ্গদের সাথে দেশের মাটি এক ঝলক ছুঁয়ে আসতে খুব তৃপ্তিবোধ হয়।
বেলা ১১টার দিকে ওরাশ উপত্যকার প্রাণকেন্দ্র এ্যাবোটাবাদ শহরে পৌঁছলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২০০ ফুট উচ্চতায় অনিন্দ্য সুন্দর একটি পাহাড়ী শহর এ্যাবোটাবাদ। অফিস-আদালত ও আবাসিক বাড়িঘরে জমজমাট পাহাড়গুলো। শহরে ঢোকার মুখে ‘ফোয়ারা চক’ থেকে ডানদিকে টার্ন নেয়ার পর নজরে আসে ঝকঝকে সাজানো-গোছানো এ্যাবোটাবাদ শহর। গত বছর ডিসেম্বরে একবার এসেছিলাম এ্যাবোটাবাদে। কিন্তু শহরে ঢোকা হয়নি। গলফ ক্লাব থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে গালিয়াত ও মারীর পথে যাত্রা করেছিলাম। এবার শহরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমী এরিয়া সেজন্য কি না জানি না, পুরো শহরটা খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন মনে হল। মেইন রোড থেকে এক-দেড় কিলোমিটার পূর্বে আবাসিক এলাকা বিলাল টাউন। এখানেই পাকিস্তান মিলিটারী বাহিনীর নাকের ডগায় ‘ওয়াযিরিস্তান হ্যাভেলী’ নামক একটি বাড়ীতে নাকি ওসামা বিন লাদেন প্রায় ৫ বছর বসবাস করেছিলেন। ৩ বছর আগে ২০১১ সালে ২রা মে রাত ১ টায় মার্কিন বাহিনী চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে একজন মহিলাসহ বাড়ির ৫ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। যাদের মধ্যে একজন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয় ওসামা বিন লাদেন হিসাবে। সত্যিই তিনি ওসামা বিন লাদেন ছিলেন কি না এ নিয়ে প্রবল বিতর্ক থাকলেও সেসময় এ্যাবোটাবাদ শহরটির নাম বিশ্বব্যাপী প্রচার পায়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারীতে পাক সরকার ঐ বাড়িটি ধ্বংস করে ফেলে এবং সম্প্রতি নাকি সেখানে বিনোদন পার্ক বানানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ৩ বছর আগের সেই রহস্যময় ঘটনাটি মনে পড়তে নিঃশ্বাসটা হঠাৎ ভারী হয়ে আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের অত্যাচার-নিপীড়নের সকরুণ চিত্র। দেহ-মন জুড়ে হঠাৎ প্রবল বিদ্রোহ জেগে উঠে আবার ব্যর্থতার হতাশায় নিস্তেজ হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে বদ্ধমুষ্ঠিতে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করি।
আধাঘণ্টা বাদেই গাড়ি আরেক পাহাড়ী শহর মানসেহরায় প্রবেশ করে। শহরে ঢোকার পূর্বেই দিগন্তের প্রান্ত রেখাজুড়ে অদ্ভুত ধরনের শুভ্র মেঘের রাজ্য দেখে দ্বিধান্বিত হলাম। একটু পরেই বোঝা গেল ওগুলো মেঘ নয়, বরফের টুপি পরিহিত সুউচ্চ পর্বতমালা। বরফঢাকা পাহাড় এর আগেও দেখেছিলাম ইসলামাবাদের নিকটস্থ শহর মারীতে, দেখেছিলাম সেখানে বরফবারী অর্থাৎ তুষারপাতের অপরূপ দৃশ্য। কিন্তু দিগন্তের প্রান্তসীমা ঘিরে এমন সুউচ্চ সফেদ পাহাড় দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। শহরের উঁচু অংশে মূল শহরটা গড়ে উঠেছে। আর নীচ অংশে সমতলের বিস্তীর্ণ উপত্যকায় লক্ষ মানুষের বসতি। উপর থেকে সেদিকে তাকালে সবুজে সবুজে চোখ ভরে যায়। সাদা পাহাড়ের নীচে সবুজের নয়নাভিরাম কারুকার্য সেখানে এক নিদারুণ নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়েছে। আয়তন ও জনসংখ্যায় বেশ বড় শহর এই মানসেহরা উপত্যকা হাযারা ডিভিশনের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে।
মটরস্টান্ডে নেমে আশপাশের লোকজনের সাহায্য নিয়ে সোজা বালাকোটগামী মাইক্রোর স্টপেজে চলে আসলাম। বিশাল এই মটরস্টান্ডে বাসের সংখ্যা খুবই কম। চারিদিকে কেবল মাইক্রোর সারি। সাড়ে বারোটার দিকে নির্ধারিত মাইক্রোটি ছাড়ল বালাকোটের উদ্দেশ্যে। মানসেহরা থেকে উত্তরের পথে দু’টি হাইওয়ে চলে গেছে। একটি উত্তর-পূর্বে বালাকোট এবং কাগান-নারান উপত্যকার দিকে। পর্বতময় এই রাস্তাটি ভারী তুষারপাত এবং ল্যান্ডস্লাইডিং-এর কারণে বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। অপরটি উত্তর-পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত সমতল কারাকোরাম হাইওয়ে ধরে বাট্টাগ্রাম ও বেশামের দিকে। উভয়টি ফের মিলিত হয়েছে চিলাস ট্রানজিট পয়েন্টে। উত্তরাঞ্চলে তথা গিলগিট, স্কার্ডু বা চীন যাওয়ার জন্য এই চিলাস পয়েন্ট অতিক্রম করা আবশ্যক।
আমরা রওনা হলাম উত্তর-পূর্বমুখী নারান-কাগান রোড ধরে। মানসেহরা থেকে বালাকোটের দূরত্ব প্রায় ৪০ কি.মি.। সময়ও লাগে ৪০ মিনিটের মত। উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সুপরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি হাইওয়েটি সর্পিলভাবে এগিয়ে গেছে। ডানদিকের সমতলে বহু নীচে ক্ষীণকায় ফিতের মত নজরে আসে কুনাহার নদী। তার ওপাশে আবার উঁচু আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সারি। তার পিছনেই আযাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুযাফফরাবাদ। আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। এ পথে যত এগোনো যায় প্রতিটি মুহূর্তে ততই মুখোমুখি হতে হয় রুদ্ধশ্বাস সৌন্দর্যের। যা কেবল চোখেই দেখা যায়, কেবল অনুভবই করা যায়, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে ইসলামাবাদ থেকে শুরু করে চিত্রাল, গিলগিত-বালতিস্তান ও কাশ্মীরের দিকে প্রতিটি ভ্যালিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই বিপুল পসরা পরস্পরের সাথে পাল্লা করে চলেছে। প্রায় আধাঘণ্টা পর ত্রিভুজাকৃতির তুষারাচ্ছাদিত পর্বতচূড়াকে ব্যাকগ্রাউন্ডে ধরে রাখা নয়নাভিরাম ছোট্ট বালাকোট শহরে প্রবেশ করি। মেইন রাস্তাটা কুনহার নদীর একেবারে কিনার ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে। আবেগের ব্যাপারগুলোতে আমি বরাবরই কঠোর রক্ষণশীল। কিন্তু প্রবল খরস্রো্তা কুনহার নদীকে এত কাছ থেকে দেখে আবেগ আর ধরে রাখা গেল না। শেষপর্যন্ত জিহাদী রণাঙ্গন বালাকোটের সীমানায় পা রেখেছি..!! ঐতিহাসিক কুনহার নদীর কলধ্বনি সরাসরি এসে কানে বাজছে..!! এ যেন বাস্তব নয়, কোন অলীক স্বপ্ন!!
স্বপ্নঘোরে ছেদ পড়ল শহরের প্রবেশমুখে রাস্তার ধারেই মসজিদ থেকে ভেসে আসা খুৎবার আওয়াযে। সেদিকে তাকাতেই দেখলাম বড় করে লেখা ‘জামে মসজিদ উম্মুল ক্বুরা আহলেহাদীছ’। যাত্রার আগে তাহের ভাইয়ের কাছে ফোন দিয়েছিলাম বালাকোটে আহলেহাদীছদের অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য। উনি এটুকুই জানাতে পেরেছিলেন যে, বাযারে একটা আহলেহাদীছ মসজিদ আছে। কিন্তু এটা তো বাযার মনে হচ্ছে না! এখানেই নামব নাকি সামনে নামব এই ভাবনার মধ্যেই গাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে বালাকোট বাযারে এসে থেমে গেল। জুম‘আর ছালাতের সময় প্রায় হয়ে গেছে। তাই বাযারে নামার পর কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা পিছনে ফেলে আসা মসজিদের দিকে হাঁটা ধরলাম। সরকারী মোটেলটি (পিটিডিসি) পার হয়ে পেট্রোল পাম্পের সাথে লাগোয়া মসজিদটি। মসজিদে ঢুকে ওযূ শেষ করতেই ইক্বামত শুরু হয়ে গেল। ছালাত শেষ হওয়ার পর বাইরে খত্বীব ছাহেবের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম খত্বীব ছাহেব বেরিয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। তার কাছেই জানতে চাইলাম এখানে কোন আহলেহাদীছ মারকায আছে কি না। উনি উত্তর না দিয়ে আমার আপাদমস্তক পরখ করে দেখার চেষ্টা করলেন। আমার উর্দূ বলার ভাঁজ শুনেই উনি যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। তাই বিস্তারিত কিছু আর বলার প্রয়োজন হ’ল না। সোজা নিয়ে গেলেন মসজিদ সংলগ্ন ‘ফালাহে ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশন পাকিস্তান’ পরিচালিত ফিল্ড হসপিটালে। ২০০৫ সালে ভূমিকম্পের পর অস্থায়ী হাসপাতালটি স্থাপিত হয়েছিল। ভিতরে ঢোকার পর মসজিদের খত্বীব জনাব ইউসুফ ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ এবং পরিচয় হল। উনার বাড়ী মুযাফ্ফরাবাদে। সেখানে এক আহলেহাদীছ মাদরাসার মুহতামিম। প্রতি শুক্রবার এখানে এসে খুৎবা দিয়ে যান। আমার বালাকোট সফরের উদ্দেশ্য জানার পর উনি যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখালেন এবং হাসপাতালের দায়িত্বশীল ভাইদেরকে সার্বিক ব্যবস্থা করতে বললেন। ফিরে যাওয়ার সময় মুযাফ্ফরাবাদে উনার মাদরাসা সফরের জন্য দাওয়াত দিলেন এবং ঠিকানা লিখে দিলেন। দুপুরে সবাই একসাথে খেলাম। তারপর একে একে স্টাফদের সাথে পরিচয় হ’ল। সবাই স্থানীয়। কেবল ডাক্তার আব্দুল্লাহ ছাহেব বহিরাগত। উনি কোয়েটার খারান মরুভূমি অঞ্চলের মানুষ, তবে অন্তরটা মরুদ্যানের মতই সজীব। হাসপাতালের পরিচালক দীর্ঘ শ্মশ্রুধারী জনাব সাজ্জাদ দুররানী এখানকার দ্বিতীয় প্রজন্মের আহলেহাদীছ। উনার বাবা বালাকোটে প্রথম আহলেহাদীছ আক্বীদা গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন। এছাড়া তাজ মুহাম্মাদ, এহসান এলাহী যহীর, যাহেদুর রহমান, নাদীম মালিক, শাহেদুর রহমান, দিলদার প্রমুখ আরও যারা স্টাফ ছিলেন তারা সবাই নব আহলেহাদীছ। খাওয়ার পর ওনাদের সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হ’ল। সত্যি বলতে পাকিস্তান আসা পর্যন্ত একটানা এতক্ষণ যাবৎ উর্দূতে কথা বলার সুযোগ হয়নি। এই মফস্বলের পরিবেশে অকৃত্রিম মাটির মানুষদের সঙ্গ পেয়ে সে সুযোগটা মিলল। সামান্য ভুল-ভ্রান্তি হলেও জড়তা বেশ কেটে যাচ্ছে তা অনুভব করতে পারলাম। ওদিকে বাইরে প্রবল বর্ষণ শুরু হ’ল। পাহাড়ের ঘেরাটোপের উপর আকাশের এক চিলতে উন্মুক্ত ছাদে জমাট কালো মেঘ প্রায় আঁধারই নামিয়ে দিয়েছে উপত্যকায়। আছরের পরও বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। দারুণ উপভোগ্য সে বৃষ্টি। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহ.) এবং শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর কবর আজই যিয়ারত করতে চাই। অবশেষে মাগরিবের একটু আগে বৃষ্টি থেমে গেলে যাহেদ ভাইয়ের সাথে মটর সাইকেলে রওয়ানা হলাম সাতবানে ঝর্ণার উদ্দেশ্যে।
২.
বালাকোট শহরটা খুব ছোট্ট ও ছিমছাম। কোলাহল নেই একেবারেই। দু’দিকে আকাশছোঁয়া কালুখান আর মেট্টিকোট পর্বত আর মধ্যখানে সশব্দে বহমান কুনহার নদী। উত্তরদিকের ‘মূসা কা মুছাল্লা’ পর্বতের বরফঢাকা চূড়া উপত্যকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। নদীর দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে শহর। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস এই উপত্যকায়। কাগান ভ্যালির লুলুসার ঝিলের বরফগলা পানি থেকে উৎপত্তি লাভ করা কুনহার নদী অবশেষে আযাদ কাশ্মীরের ঝিলাম নদীতে গিয়ে মিশেছে। বড় বড় পাথরে ভরা নদীটি অসাধারণ সুন্দর। ভয়ংকর স্রোত আর বরফশীতল পানি। পাথরের ফাঁক গলিয়ে সগর্জনে যে তীব্রতায় পানির স্রোত ধেয়ে আসে তাতে এটি নদী নয় বরং শক্তিশালী পাহাড়ী ঝরণা ভেবে ভ্রম হয়। সব মিলিয়ে বালাকোট এখন একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য কুনহার নদীর দুকূল ঘিরে গড়ে উঠেছে বহু আবাসিক হোটেল। এলাকার জনগণের আয়ের অন্যতম উৎস এই পর্যটন খাত। মেইন রোডটা বাযারের মধ্য দিয়ে বালাকোট ব্রীজ অতিক্রম করে ফের ঊর্ধ্বগামী হয়ে উঠে গেছে ছবির মত সুন্দর অপর এক পাহাড়ী উপত্যকা কাগান-নারানের দিকে। ২০০৫ সালের ৮ই অক্টোবর এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে বালাকোট শহর প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। নিহত হয়েছিল প্রায় ২০ হাযার মানুষ। পরবর্তীতে সঊদী আরব ও আরব আমিরাত সরকারের সহযোগিতায় শহরটি আবার নতুন করে গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ বাড়িঘর রিলিফের লাল নীল বর্ণের টিন দিয়ে তৈরী। শহরের সর্বত্রই লাল-নীলের বাড়তি আধিপত্যটা চোখে পড়ে। ভূমিকম্পের সেই স্মৃতি স্থানীয় অধিবাসীদের নিকট আজও খুবই টাটকা। অধিকাংশই স্বজনহারা হয়েছিলেন সেদিন। পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল সেদিন কাশ্মীর ও খাইবার-পাখতুনখোয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। বর্তমানে গোটা বালাকোট শহর স্থানান্তর করে নিউ বালাকোট সিটি নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে ২৫ কি.মি. দূরবর্তী বিকরাল এলাকায়। কেননা বর্তমান বালাকোট শহরটি ভূমিকম্পের দু’টি মারাত্মক ফল্ট লাইনের উপর সরাসরি পড়েছে। তাই যেকোন সময় এখানে আবার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীরা বাপ-দাদার ভূখন্ড ছাড়তে একদম রাযী হচ্ছে না। সরকারীভাবে শহরটিকে ‘রেড জোন’ হিসাবে ঘোষণা করা হলেও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। তবে সরকার ঘোষণা মোতাবেক নিউ বালাকোট সিটির নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছে।
১৮৩১ সালের ৬ই মে তারিখে এই পাহাড়ঘেরা বালাকোটের প্রান্তরে ইসলামের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক অধ্যায় রচিত হয়। শিখ ও বৃটিশবিরোধী ঐতিহাসিক জিহাদ আন্দোলন তথা উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান দুই সিপাহসালার সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহ.) এবং শাহ ইসমাঈল (রহ.) শক্রপক্ষের হাতে নিহত হন এই ভূখন্ডে সংঘটিত যুদ্ধে।
১৮৩০ সালের ডিসেম্বর মাস। পেশোয়ার সীমান্ত ঘাঁটি পাঞ্জতার থেকে কাশ্মীর গমনের সিদ্ধান্ত নেন সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহ.)। মুনাফিক পাঠান সর্দারদের বারংবার বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। মুজাহিদ বাহিনীও নানা বিপর্যয়ের শিকার হয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনি বর্তমান হাযারা ডিভিশনের উচ্চভূমি অতিক্রম করে মুযাফফরাবাদের পথে রওয়ানা হন এবং কাশ্মীর প্রবেশের প্রস্ত্ততি গ্রহণের জন্য পর্বতঘেরা বালাকোট উপত্যকায় এসে শিবির স্থাপন করেন। এ খবর মুনাফিকরা শিখদের কাছে পাচার করে দিয়েছিল। ফলে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিং-এর পুত্র শের সিং একটি বিরাট বাহিনী নিয়ে মুজাহিদ বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করল। সাইয়েদ আহমাদ শক্রদের গতিবিধি লক্ষ্য করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্ত্ততি গ্রহণ করলেন। মূল যুদ্ধক্ষেত্রটি ছিল বালাকোট শহরের পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণমুখী একটি কৌশলগত অবস্থানে। যার দক্ষিণে রয়েছে বালাকোট জনপদ থেকে সাতবানে ঝরণার পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ নিম্নভূমি, আর উত্তরে মেট্টিকোট টিলার উন্মুক্ত পাদদেশ। আত্মবিশ্বাসী সাইয়েদ আহমাদ শহীদ বিচক্ষণতার সাথে পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন এবং মেট্টিকোট টিলার পাদদেশে ও সাতবানে ঝর্ণার আশপাশে মুজাহিদ বাহিনী মোতায়েন করলেন। কিন্তু মুজাহিদদের তীব্র প্রতিরোধ সত্ত্বে্ও ৫ই মে তারিখে বিপরীত দিক থেকে বিপুল সংখ্যক শিখ মেট্টিকোট পর্বত শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। ফলে নিম্নাঞ্চলে শিবির স্থাপনকারী মুজাহিদগণ তাদের আয়ত্বের মধ্যে চলে আসে। পরদিন ৬ই মে শুক্রবার শুরু হয় ১০,০০০ শিখ সেনার বিরুদ্ধে ৭০০ মুজাহিদের অসম যুদ্ধ। প্রায় ২ ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে শক্রদের সুবিধাজনক অবস্থান, মুজাহিদদের সংখ্যাল্পতা, রসদপত্রের স্বল্পতা, মুনাফিকদের বিশ্বাসঘাতকতাসহ নানা কারণে মুজাহিদ বাহিনী সুবিধা করে উঠতে পারল না। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অকস্মাৎ সাতবানে ঝর্ণার মধ্যে মুজাহিদ নেতা সাইয়েদ আহমাদ এবং শাহ ইসমাঈল শত্রুর হাতে নিহত হন। নিহত হন আরো বহুসংখ্যক মুজাহিদ। এভাবে পরাজয় ঘটল ক্ষুদ্র অথচ অমিত সাহসী এই মুজাহিদ বাহিনীর। সেই সাথে পরিসমাপ্তি ঘটল উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পরিচালিত বৃটিশবিরোধী শক্তিশালী আন্দোলনটির। শিখরা সেদিন তাদের অভ্যাস মোতাবেক যুদ্ধ শেষে বালাকোটের বাড়িঘর পুড়িয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সবচেয়ে ক্ষতি হয় সাইয়েদ আহমাদ শহীদ ও সাইয়েদ ইসমাঈল শহীদের রচিত ও সংগৃহীত বহু কিতাবের পান্ডুলিপি, যার প্রায় সবই ধ্বংস হয়ে যায়। যার মধ্যে ছিল সাইয়েদ আহমাদ শহীদের রচিত রোজনামচা ‘নূরে মুহাম্মাদী’ও।
বালাকোট উপমহাদেশের অন্যান্য সকল স্থানের তুলনায় অধিকতর গুরুত্ব লাভ করেছে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের মাইলফলক হিসাবে। ঘটনাক্রমে বালাকোটের এই মর্মান্তিক স্মৃতিই উপমহাদেশের সর্বপ্রথম এই সুসংবদ্ধ ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের প্রতীক হয়ে এতদঞ্চলের মুসলমানদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন দখল করে আছে। বালাকোটের এই জিহাদে জয়লাভ করলে উপমহাদেশের ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লেখা হ’ত। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ চেয়েছিলেন বালাকোটের এই যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে ঝিলাম নদীর তীরবর্তী সমস্ত ভূখন্ড এবং কাশ্মীর রাজ্যকে পূর্ণভাবে করায়ত্ত করতে। চেয়েছিলেন বৃটিশ বিরোধী জিহাদের একটি শক্ত ঘাঁটি গড়তে। শেষ পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছা পূরণ না হলেও পরবর্তীকালের ইতিহাসে বালাকোটের আত্মত্যাগের মহিমা যেভাবে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং উপমহাদেশের মুসলমানদের হৃদয়ে যে আবেগ নিয়ে তা চিরজাগরুক হয়ে রয়েছে, তা যুদ্ধজয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বালাকোট জিহাদে বাঙ্গালীদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ঐতিহাসিক গোলাম রাসূল মেহের ৫ জন বাঙ্গালী শহীদের নাম উল্লেখ করেছেন (আহলেহাদীছ আন্দোলন, থিসিস পৃ. ২৮৪)। এছাড়া মাওলানা ইমামুদ্দীন বাঙ্গালীসহ প্রায় ৪০ জন আহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়, যারা যুদ্ধ শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
৩.
বৃষ্টিভেজা রাস্তা দিয়ে বাযারের মধ্যে ঢুকলাম। বাযারের সবচেয়ে বড় মার্কেট মাদানী প্লাজা থেকে বামদিকে একটি গলিপথ চলে গেছে। তার প্রবেশমুখে ছোট্ট সাইনবোর্ডে তীরচিহ্ন দিয়ে লেখা ‘শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর মাযার’। এই গলিপথ দিয়ে সামান্য এগুলেই রাস্তা দু’ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে দক্ষিণে মেট্টিকোটের দিকে, অপরটি উত্তরে আংগ্রাইয়ের দিকে। আংগ্রাইয়ের দিকে কিছুদূর যাত্রার পর পাহাড়ের বাঁক থেকে বেরিয়ে আসতেই নজরে আসল সাতবানে ঝরণা। সবুজ ঘাসের যমীন আর বড় বড় পাথরে ভরা অনেকটা চওড়াকৃতির ঝরণা। দেখতে অনেকটা নদীর মতই মনে হয়, তবে বিভিন্ন পাহাড় থেকে নেমে আসা শীর্ণ কয়েকটি জলধারা ব্যতীত আর সব শুকনো। ঝরণাগুলো মিলিত হয়েছে বেইলী ব্রীজটির কাছাকাছি এলাকায়। এই বেইলী ব্রীজ পার হলেই নীচ থেকে অনেক উঁচু করে বাঁধানো শাহ ইসমাঈল শহীদ এবং অপরাপর শহীদানের কবরস্থান। ব্রীজের মুখে বিশালাকার কিছু পাথরের স্ত্তপ। তার মধ্যে একটির গায়ে লেখা, ‘সাইয়েদ আহমাদ শহীদের শাহাদাতলাভের স্থান’। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর ব্রীজ পার হয়ে কবরস্থানের গেটে আসলাম। কবরস্থানের বিপরীত দিকে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে, ‘জামে মসজিদ শাহ ইসমাঈল শহীদ (র.)’। যুদ্ধকালীন সময়ে এটিই মসজিদে জেরিন ছিল কিনা, কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করেও নিশ্চিত হওয়া গেল না। আমরা প্রাচীরঘেরা কবরস্থানের ভিতরে ঢুকলাম। সারিবদ্ধভাবে ১৫/২০টি কবর। কেবল পূর্বকোণে শাহ ইসমাঈল শহীদের কবর ছাড়া অন্য কোন কবরে নামকরণ করা নেই। নাম না জানা বিস্তৃত ডালপালার একটি সুন্দর গাছের নীচে শাহ ইসমাঈল শহীদের অনাড়ম্বর কবরটি। পাশের দেয়ালে লম্বা পরিচিতি ফলক লাগানো। কবরের দু’ধারে হালকা করে পাথর দিয়ে বাঁধানো থাকলেও উপরাংশ খোলা। কবরপূজারীরা এমন একজন মহান মানুষের কবরকে কমপক্ষে মাযার বানানোর হাত থেকে রেহাই দিয়েছে- এটাই অনেক বড় কথা। কবরের নিকটবর্তী হতে শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠল। প্রাতঃস্মরণীয় একজন মহামনীষীর এত নিকটতম সান্নিধ্যে এসে নিজেকে অপ্রস্ত্তত মনে হয়। একটা আবেগঘন মুহূর্ত। অশ্রুর উত্তাপে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। প্রায় দু’শ বছর পূর্বে গত হওয়া এই মহান বীর মুজাহিদ, বিপ্লবী আলেমে দ্বীনের কবরটা হঠাৎই মনে হয় জীবন্ত। যেন জিহাদের ময়দানে দাঁড়িয়ে এখনই কোন দিকনির্দেশনা দেবেন, যে নির্দেশ পালনে স্নায়ুতন্ত্র আপনা আপনিই প্রস্ত্তত হয়ে যায়। কবর যিয়ারত শেষে আনমনে আওড়ালাম, হে মহান বীর! আপনাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। শিরক ও বিদ‘আতবিরোধী যে মহান আন্দোলন আপনারা শুরু করেছিলেন, বাতিলের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে রুখে দাঁড়ানোর যে পথ আপনারা দেখিয়েছিলেন, তা কেবল উপমহাদেশেই নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই হকপন্থী মুসলমানদের আন্দোলনকে বেগবান করেছে। কিছুক্ষণ থাকার পর ধীরপায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম। কেমন যেন একটা অপরাধবোধ চেপে বসতে থাকে, তাঁদের ইলমী ও জিহাদী উত্তরাধিকার যথার্থভাবে বহন করতে না পারার।
ফিরতি পথে মটরসাইকেলে যেতে যেতেই যাহেদ ভাই যথাসম্ভব যুদ্ধের স্থানগুলো দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। আসার সময় অবশ্য ‘তাওহীদের ডাক’-এ প্রকাশিত শিহাবুদ্দীন আহমাদ ভাইয়ের বালাকোট যুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গের লেখাটি পড়ে এসেছিলাম, যেন যুদ্ধক্ষেত্রটি চিনতে সুবিধা হয়। প্রায় দু’শো বছর আগের ভূমিগঠন কতদূর অবিকৃত আছে আল্লাহ মা‘লূম, তবে বর্ণনার সাথে প্রায়ই মিলে গেল। পরিবেশটা দেখে কেবলই মনে হতে লাগল, এত বড় বড় পাহাড়, টিলা, পাথুরে খাড়ি আর দুর্গম পথ অতিক্রম করে কিভাবে তাঁরা এসব এলাকায় জিহাদ করেছিলেন!
বালাকোট বাযারে আবার ফিরে আসলাম। সেখান থেকে কাঁচাবাজারের একটু ভিতরে কুনহার নদীর নিকটেই সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (র.)-এর কবর। কবরস্থানের গা ঘেঁষে জামে মসজিদ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (র.)। প্রাচীরঘেরা কবরস্থানটি খুব বেশী জায়গা নিয়ে নয়। সেখানে অনেকগুলো কবরের মাঝে সাইয়েদ আহমাদ শহীদের কবরটি সবুজ রঙ করে বেশ উঁচু করে বাঁধানো। তেমন কোন আড়ম্বর নেই। স্রেফ একটি ফলকে তাঁর নাম-পরিচয় উর্দূতে লেখা। এই কবরটিকেও মাযারাকৃতি দেয়া হয়নি আল-হামদুলিল্লাহ। তবে ব্রেলভীদের প্রথা মোতাবেক আর সব কবরের মত হালকা জরির মালা জড়ানো আছে। যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তাঁর দ্বি-খন্ডিত শরীর প্রথমে কুনহার নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে কারো মতে তাঁর মস্তকটি এখানে দাফন করা হয়েছিল। কারো মতে, কয়েক মাইল ভাটিতে তাঁর লাশ ভেসে যায় এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। এ বিষয়ে নিশ্চিত কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও শুরু থেকে এটিই তাঁর কবর হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
তাঁর কবরের পার্শ্বেই সাধারণ একটি কবর, যেখানে শুয়ে আছেন জিহাদ আন্দোলনের পরবর্তী এক মুজাহিদ মাওলানা ফযলে হক ওয়াযীরাবাদী। লাহোরের নিকটবর্তী ওয়াযীরাবাদের অধিবাসী এই আহলেহাদীছ মুজাহিদ নেতা গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁকে এখানে সাইয়েদ আহমাদ শহীদের পার্শ্বে দাফন করার জন্য অছিয়ত করে যান। আসার সময় সাজ্জাদ দুররানী ভাই বলছিলেন উনার কবরটা অবশ্যই যিয়ারত করে আসতে। কারণ লোকজন অধিকাংশই উনার সম্পর্কে জানেনা, ফলে যিয়ারতও করে না।
কবর যিয়ারতের পর বাইরে বের হতেই মাগরিবের আযান দিল। ফিরে এসে মসজিদে মাগরিব পড়ার পর হাসপাতালে ছোট্ট অতিথিকক্ষে ঢুকলাম। জাহাযের পণ্যবাহী ৬টি কন্টেইনার একত্রিত করে হাসপাতালটি বানানো, যার মধ্যে রয়েছে একটি অপারেশন রুম, ল্যাব, কেবিন, অফিস, অতিথিকক্ষ আর কিচেন। অস্থায়ী হলেও মোটামুটি সাজানো-গোছানো। সন্ধ্যার পর স্থানীয় কিছু ভাই এসেছিলেন। ওনাদের সাথে কথাবার্তা ও নাশতা-পানি হ’ল। এশার ছালাতের পর সবাই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম। বাযার থেকে আসার সময় কিছু ফলমূল ও মিষ্টান্ন এনেছিলাম। সেটা বিলি করার জন্য অফিস পিয়ন নাদীম ভাইকে দিতেই সেকি রাগ। অতিথিকে কেবল অতিথি হিসাবেই দেখতে ইচ্ছুক তারা। আমি হাসতে হাসতে বললাম, চিন্তার কারণ নেই, এটা কেবল একজন দ্বীনী ভাইয়ের পক্ষ থেকে উপহার মনে করুন, মেহমান হয়ে মেযবান সাজার কোন সাধ আমার নেই! খাওয়া-দাওয়া শেষে পরিচালক সাজ্জাদ ভাই থাকলেন আমার সাথে এবং তাদের কার্যক্রমের বিভিন্ন ভিডিও দেখালেন।
সন্ধ্যার পর শহরের কোলাহল থেমে এলে কুনহার নদীর গর্জনটা বেশ জোরেই কানে আসছিল। তাই এক ফাঁকে রাতের কুনহার নদী দেখতে গেলাম একাকীই। বাযারে এসে ব্রীজের উপর উঠতে সেকি বাতাস আর গর্জন। কানে তালা লাগার জোগাড়। অন্ধকার থেকে ভেসে আসা সেই তুমুল গর্জনের শব্দে আর ঝড়ো বাতাসে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। মনে হয় হঠাৎ উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। রেলিংটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। ভীতিকর অভিজ্ঞতা হলেও প্রকৃতির অকৃত্রিমতায় মিশে যাওয়া, অবিরাম ছুটে চলা স্রোতের দুর্বার বন্যতা নীরবে উপভোগ করার একটা দারুণ মওকা মিলল। আসার সময় কাউকে বলে আসিনি। তাই হাসপাতালে ঢোকার পর দেখি সাজ্জাদ ভাইরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন একাকী কোথায় গেলাম সেই চিন্তায়। চোর-দস্যুর ভয় না থাকলেও নিরাপত্তাবাহিনী নিয়ে শংকাটা কিছুটা কাজ করে সবার মধ্যেই। উনাদের আশ্বস্ত করে অতিথিকক্ষে ঢুকে দেখি ঘুমানোর সব আয়োজন করে রেখেছে নাদীম ভাই। একটু আগেভাগেই শুয়ে পড়তে হলো, অফিসসহ গোটা বালাকোট ঘুমিয়ে পড়ায়। রাত দশটা মানে যে এখানে গভীর রাত।
(চলবে)