৮ই আগস্ট, ২০১৬। বেলা ১০টার দিকে ফোন এল আব্দুর রহমান ভাইয়ের। ‘আমি নাথিয়াগলি আছি। আসতে পারবে এখানে? বালাকোট জিহাদের স্মৃতিবাহী যে পতাকার খোঁজ করছিলে, তার সন্ধান পাওয়া গেছে’। সোমবার। সুতরাং লাইব্রেরী খোলা। কি কারণে যেন যাইনি সেদিন। রুমেই ছিলাম। একটু আমতা আমতা করলেও রাযী হয়ে গেলাম শেষতক। ইসলামাবাদের ফায়যাবাদ থেকে নিকটবর্তী বিভিন্ন গন্তব্যে নির্দিষ্ট সময় পর পর ছেড়ে যায় মাইক্রোবাস। এর একটিতে চড়ে বসলাম এ্যাবোটাবাদ যেলার নাথিয়াগলি হিল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। টানা ২ ঘন্টা চলার পর বিখ্যাত পর্যটন শহর মারী এবং আইয়ুবিয়া ন্যাশনাল পার্ক অতিক্রম করে নাথিয়াগলির কাছাকাছি এক স্টেশনে পৌঁছলাম। স্থানটির নাম ‘তাওহীদাবাদ’। এলাকার লোকজন বলে ‘তোহিদাবাদ’। যদি শুদ্ধ উচ্চারণে তাওহীদাবাদ বলা হয়, তাহলে একেকজন যেন আকাশ থেকে পড়বে। এই ব্যারামটা পাকিস্তানীদের মধ্যে ভাল রকম ছড়িয়ে রয়েছে। সামান্য উচ্চারণের হেরফেরে তারা কোন স্থান বা ব্যক্তির নাম ঠাওরাতে এত হিমশিম খায় যে, তাদের কমনসেন্স নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন জাগে। কন্ট্রাক্টর ছেলেটাকে কোনক্রমেই আমার গন্তব্য ‘তাওহীদাবাদ’ চেনাতে পারিনা। ঘটনা বুঝতে আমার বড় বেগ পেতে হয়। ভুলটা হচ্ছে কোথায়? খানিকবাদে সে জানালো ‘তোহিদাবাদ’ নামে একটা জায়গা আছে সামনে। এতক্ষণে আমি আমার ভুল ধরতে পারি; সন্তুষ্টচিত্তে বলি তথাস্ত্ত বেটা, বিলকুল ওহি পে উতারো। এ পথে আগেও বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছি। কিন্তু কখনও ‘তাওহীদাবাদ’ নামটি চোখে পড়েনি, রাস্তার সাথে লাগোয়া বড় দুই তলা দৃষ্টিনন্দন আহলেহাদীছ মসজিদটাও চোখে পড়েনি। কেন পড়েনি, নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করলাম। কোন জবাব পেলাম না।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। যথেষ্ট ঠান্ডা এখানে। যদিও ইসলামাবাদে ঘাম ঝরানো গরম ছিল। ফ্যানের প্রয়োজন তো সারাবছর হয় না; কিন্তু তাই বলে এই গ্রীষ্মে এসে কম্বল গায়ে দিতে হবে? হ্যাঁ মারী, গালিয়াতের বিস্তীর্ণ পার্বত্যাঞ্চলগুলো এমনই। মসজিদটা মেইন রোড থেকে বেশ উঁচুতে। তার পার্শ্ব দিয়ে গেস্ট হাউজ বানানো হয়েছে। আব্দুর রহমান ভাই এখানেই অপেক্ষা করছিলেন। একসাথে দুপুরের খাবার খেলাম। মেহমানদারী করলেন এই মসজিদ কমপ্লেক্সের দায়িত্বশীল ইয়াসির ভাই। পার্শ্ববতী পাসালা গ্রাম নিবাসী। খাওয়ার পর তার সাথে বসলাম মসজিদের ইতিহাস জানার জন্য।
পূর্বে এই স্থানের নাম ছিল ঘোড়া গলি। ১৯৬৮ সালে আল্লাহর ফযল ও করমে মিয়া ফযলে হক্ব নামীয় এক আহলেহাদীছ ব্যবসায়ী ভদ্রলোক এই অঞ্চলে আসেন এবং তিনিই এই স্থানের নামকরণ করেন তাওহীদাবাদ। অত্র এলাকার আহলেহাদীছ
* পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বুযুর্গ মাওলানা আব্দুর রাযযাক (মিয়াজান), হাজী আব্দুর রহমান ওরফে সুমন্দর খান (মৃত ১৯৯০খৃঃ) প্রমুখের উদ্যোগে সর্বপ্রথম এই মসজিদটি নির্মিত হয়। ১৯৬৮ সালে মিয়া ফযলে হক এখানে আসার পর মসজিদটি নতুনভাবে নির্মাণ করেন এবং এখানকার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে নিজের বসবাসের জন্যও একটি বাড়ি করেন। লাহোরে তার কয়লা, লোহা এবং টেক্সটাইলের বিরাট ব্যবসা ছিল। তবে তিনি সময় পেলেই এখানে আসতেন এবং আলেম-ওলামাদের দাওয়াত করতেন। আল্লামা এহসান এলাহী যহীরের পিতা যহুর এলাহী রামাযানের শেষ দশকে এ‘তেকাফের জন্য এই মসজিদে আসতেন। ১৯৯৪ সালে মিয়া ফযলে হক্ব মারা যান। পরে ১৯৯৭ সালে তার বাড়িটি হিফযখানায় পরিণত করা হয়। ২০০৪ সালে মিয়া ফযলে হক্বের ছেলে মিয়া নাঈমুর রহমান মসজিদের সাথে এই গেস্ট হাউজ নির্মাণ করেন। এর জাকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলীর ডেপুটি স্পিকার সরদার ইয়াকুব সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। সেই থেকে মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই মসজিদ ও মাদরাসাটি। কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামও এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে কখনও। অত্র অঞ্চলে যে সকল আলেম-ওলামা আসেন তারা এই গেস্ট হাইজেই আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। পর্যটন মৌসুমে বরফঢাকা নাথিয়াগলির সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের নেতৃবৃন্দ। এভাবে আহলেহাদীছদের একটি প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে তাওহীদাবাদ মসজিদ।
তাওহীদাবাদ ঘিরে রয়েছে বাগান, পাসালা, কেরী, রাইকী প্রভৃতি আহলেহাদীছ গ্রাম। কেবল তাওহীদাবাদ ও পাসালাতেই রয়েছে ১৫টি আহলেহাদীছ মসজিদ। আর পুরো গালিয়াত উপত্যকায় রয়েছে আরও প্রায় ১৫০টির মত। রয়েছে বেশ কয়েকটি মাদরাসাও।
আছরের ছালাত শেষে আমরা গেস্ট হাউজের সামনে খোলা চত্বরে এসে দাঁড়াই। হিল স্টেশনের উপর এমন কৌনিক ক্ষেত্রে এর অবস্থান, যেখান থেকে সারি সারি পাহাড়ের ফাঁক গলিয়ে নাথিয়াগলি উপত্যকার একটা বড় অংশ নযরে আসে। পাহাড় গহবরে শত-সহস্র ঘরবাড়ির লাল-নীল চালা চকচক করে। রাতের বেলা সেসব বাড়িতে যখন লাইট জ্বলে ওঠে, তখন আসমানের ঝিকিমিকি তারাগুলো যেন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। মনে হয় তারাভরা আসমান গোটাটাই বুঝি মর্তে নেমে আসে, কিংবা উর্ধ্বলোক আর মর্তলোকের মিতালীতে সমগ্র দৃশ্যপটই পরিণত হয় এক তারাভরা আসমানে। শীতের সময় বরফে ঢেকে যায় পাহাড়গুলো। গেস্ট হাউজের বারান্দায় জমে ওঠে কয়েক ফুট পুরু বরফ।
আমরা খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাইনগাছে ঢেকে থাকা সবুজ পাহাড়গুলো ছুয়ে মেঘের ভেলাদের অবিশ্রান্তু ছুটে চলা দেখি। বাতাসের গতির সাথে সেগুলো ক্ষণে ক্ষণে আমাদেরও অতিক্রম করে যেতে থাকে। ভারি মনোমুগ্ধকর সে দৃশ্য। আমার মুগ্ধতা বোধ হয় স্পর্শ করল ইয়াসির ভাইকে। তিনি আমন্ত্রণ জানান নিয়মিত এখানে আসার জন্য। আমিও কথা দেই, অন্ততঃপক্ষে শীত মৌসুমে বরফ পড়া শুরু হ’লে কয়েকদিন থেকে যাব এখানে। কথাগুলো বড় আপন সুরে বের হয়। মনে হয় এ যেন আমার একান্ত অধিকারের স্থান। পৈত্রিক সূত্রে না হলেও আক্বীদার সূত্রে তো বটেই। পবিত্রতায় মাখা এই প্রগাঢ় বন্ধনের আর্দ্রতা অন্তরের কোন এক কুঠুরীতে যেন বারি বর্ষণ করে গেল। প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্যই, যিনি আমাদের অন্তরগুলোকে এভাবে ভ্রাতৃত্বের মায়াবী সুতোয় বেঁধে দিয়েছেন চীর কল্যাণের পথে। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহি সুবহা-নাল্লা-হিল আযীম।
আকাশছোঁয়া পাহাড়গুলো দেখে হঠাৎ মনে হয় এ আর তেমন কী! গতবছর তথা ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী এই নাথিয়াগলিরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মুকশপুরী (২৮০০ মিটার/৯২০০ ফুট) জয় করেছিলাম। সুবহানাল্লাহ সে ছিল এক তুষার বর্ষণ মুখর দিন। সঙ্গী ছিল টাঙ্গাইলের হাবীব ভাই ও সাতক্ষীরার নাঈম। পেজা তুলোর মত অবিরাম উড়তে থাকা তুষারপাতের মধ্য দিয়ে যখন আমরা মারী থেকে ডুঙ্গাগলি আসছিলাম, কেবলই ভাবছিলাম আল্লাহর সৃষ্টি কীভাবে এত অপরূপ হ’তে পারে! পটভূমিকায় সমস্ত পাহাড়, রাস্তাঘাট, গাড়িঘোড়ার গায়ে প্রকৃতি মেলে দিয়েছে শুভ্র বিছানা। কখনও তাতে যোগ দেয় স্বপ্নালু কুয়াশার মেঘ। রাস্তার দু’ধারে তুষারমাখা সারি সারি পাইনগাছগুলো যেন শুভ্র বসনে হিরার নেকলেস পরা দুলহান। পাথরের গায়ে জমে ওঠা বরফ যেন সুকোমল মাখন। মনে হয় সবার অলক্ষ্যে কোন এক মহান শিল্পী যেন এক নাগাড়ে জলরঙে পটে এঁকে তুলছেন এক অবিশ্বাস্য কল্পনার রাজ্য। সেই রাজত্বে আত্মহারা হয়ে পিচ্ছিল তুষারাচ্ছন্ন দীর্ঘ পথ পাড়ি অতিক্রম করে ডুঙ্গাগলি পৌঁছাই। তারপর সেখান থেকে হাঁটু বরফের মধ্য দিয়ে ৪+৩=৭ ঘন্টার স্নো-হাইকিং, নিবীড় জঙ্গলে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ফোমের মত নরম বরফের বিছানায় বিশ্রামগ্রহণ, চুড়ায় উঠে চাঁদের দেশের মত এক বর্নাঢ্য শ্বেতকায় পৃথিবীর রূপসুধা গলধঃকরণ, সাদা কাপের্টে মোড়া যমীনে সসংকোচে পদচিহ্ন এঁকে চলা আর বরফে ডুবন্ত পায়ে জামা‘আতে ছালাত আদায় করার সেই দূর্লভ অনুভূতিগুলো! নাহ, ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। সেসব অপূর্ব সুখস্মৃতি মনে পড়ে আজকের মুগ্ধতায় যেন রাশ টেনে ধরল।
আমরা মসজিদের খত্বীব জনাব ক্বারী ফারূকের দফতরে এসে বসলাম। তিনি গালিয়াত মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের আমীরও বটে। আমাদেরকে কিছু তথ্য যোগান দিলেন আর দিকনির্দেশনা দিলেন কীভাবে তাতরীলা নামক গ্রামটিতে যাওয়া যায়, যেখানে এক প্রবীণ বুযুর্গ মাওলানা দাঊদের বাড়িতে বালাকোট জিহাদের পতাকাটি সংরক্ষিত রয়েছে। ফোনে কথা বলে তাদেরকে জানিয়েও দিলেন যে আমরা যাচ্ছি।
স্থানীয় বাহন ‘ক্যারি ডাববা’তে কালাবাগ পৌঁছলাম। সেখানে এসে গ্রাম অভিমুখী মাইক্রোবাস বা স্থানীয় ভাষায় ‘টোটা’র জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা। অবশেষে পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামের পথে একে বেকে নামতে থাকল গাড়ি। প্রায় আধাঘন্টা যাত্রার পর গিরিসমতলে এসে ছোট্ট গ্রাম তাতরীলায় পৌঁছলাম। জনবসতি কম। বরং প্রায় জনবিরল অঞ্চল মনে হ’ল। অনেক দূর পর পর একেকটি বাড়ি। মেঠো পথ ধরে এক বালক আমাদেরকে পৌঁছে দিল মাওলানা দাঊদ ছাহেবের বাসায়। বেশ অভিজাত পুরোনো দোতলা বাসা। প্রস্ত্ততই ছিলেন তারা। আমাদের সাদরে বৈঠকখানায় বসালেন। খানিকবাদেই মাগরিবের ছালাত। বাড়ির সাথে প্রায় লাগোয়া মসজিদ উমার ফারূক। দোতলা সুন্দর মসজিদটি কুয়েতী এনজিও সংস্থা জমঈয়তে এহইয়াউত তুরাছের তত্ত্বাবধানে নির্মিত। মুছল্লী বলতে আমরা ক’জনই। মাওলানা দাঊদের ছেলে মাওলানা আব্দুল হাফিয জানান, মুছল্লী পূর্ণ হয় জুম‘আর দিন। বাকি দিনগুলোতে তেমন নেই। বাড়ী-ঘর কাছাকাছি না থাকাই মূল কারণ। ছালাত আদায়ের পর বাইরে উঠানেই বসা হ’ল। পাশেই গমের ক্ষেত। খোলা আকাশের নিচে বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে বড় ভাল লাগে। উঁচু পাহাড়ের সারি চারিদিকে। পাহাড়ের ঢালে বাড়ি-ঘরগুলোতে জ্বলে ওঠা আলোয় তৈরী হয়েছে কৃত্তিম তারকারাজির মেলা। কতদিন ভেবেছি এমন এক পাহাড়ী গাঁয়ে প্রকৃতির অকৃত্তিম পরশে কখনও এসে রাত কাটাব। আজ সে সুযোগ এসে ধরা দেয় অযাচিতভাবে। রাত্রিযাপনের কোন পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু গৃহকর্তার প্রবল অনুরোধ ও আন্তরিকতা আমাদেরকে থেকে যেতে বাধ্য করল। জীবনের ছোটখাট শখগুলোও বুঝি আল্লাহ একে একে সবই এভাবে পূরণ করে করে দেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
মাওলানা দাঊদ নবতিপর বৃদ্ধ। কিন্তু দীর্ঘকায় অটুট স্বাস্থ্য দেখে তা বোঝার উপায় নেই। উন্নত নাসিকা আর ফর্সা নূরানী চেহারায় বিনয়াবনত ব্যক্তিত্বের ছাপ উজ্জ্বল। ঠোটের কোনে এক টুকরো প্রফুল্ল হাসি বোধহয় লেগেই থাকে সবসময়। এ অঞ্চলের একজন প্রবীণ আহলেহাদীছ আলেম তিনি। তাঁর বাবাও ছিলেন আলেম এবং তাঁর সন্তান আব্দুল হাফিয (৬০)ও একজন আলেম। এভাবে বংশ পরম্পরায় তাঁরা আহলেহাদীছের দাওয়াত প্রচারে ধারাবাহিক খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমেই জানালেন বালাকোট জিহাদের সবুজ পতাকাটি এই মুহূর্তে তাঁর বাসায় নেই। তাঁদের পরিচিত একজন নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। ফলে এই মুহূর্তে তা দেখানোর সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের আতিথেয়তা করার স্বার্থে এ কথা আগে জানাননি। আমরা কিছুটা হতাশাবোধ করলাম। তাঁর বাবা এই পতাকার সংগ্রাহক ছিলেন। সেই থেকে তাঁর বাড়িতে পতাকাটি গচ্ছিত রয়েছে। অনেকেই মাঝে মধ্যে আসেন পতাকাটি দেখার জন্য।
তিনি গালিয়াতের এই পাহাড়গুলোতে আহলেহাদীছের দাওয়াত প্রসারে বালাকোট জিহাদের ভূমিকার কথা স্মরণ করলেন। এই তাতরীলা গ্রামের চার কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি অঞ্চল অতিক্রম করে শাহ ইসমাঈল শহীদ ও তার সাথীরা বালাকোটে গমণ করেছিলেন। পথে পথে এই জিহাদের কাফেলায় যোগ দিয়েছিলেন এখানকার অনেক মানুষ। সেই থেকে এতদঞ্চলে আহলেহাদীছ আক্বীদা ও আমলের গোড়াপত্তন। আমি ভাবতে থাকি, শাহ ইসমাঈলের গমণপথ হওয়ার বরকতে যদি এত আহলেহাদীছের বসবাস হয় এই দূর্গম, গহীন পার্বত্যাঞ্চলে, তাহ’লে যে বালাকোট ছিল জিহাদের কেন্দ্র, যেখানে দীর্ঘকাল অবস্থান করেছিলেন শাহ ইসমাঈল শহীদ স্বয়ং নিজে, সেই বালাকোটে কেন জিহাদ পরবর্তী সময়ে আহলেহাদীছ আমল-আক্বীদার বিলুপ্তি ঘটল? কেন সেখানে মাত্র কয়েক দশক পূর্বে (১৯৭৭খৃঃ) প্রথম আহলেহাদীছ মসজিদটি নির্মিত হ’ল?[1] পরবর্তীতে দাওয়াতী ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মত প্রয়োজনীয় সংস্কারকের অনুপস্থিতিই কি এজন্য দায়ী? আল্লাহু আ‘লাম।
মাওলানা দাঊদ আরও স্মরণ করলেন কাশ্মীরের মাওলানা ইউনুস আছারীর[2] কথা, যার দাদা বালাকোটে শাহ ইসমাঈল শহীদের হাতে সরাসরি বায়‘আত গ্রহণ করেছিলেন। ফলে তার বংশধররাও আহলেহাদীছ হয়ে যায়। এই মাওলানা ইউনুস আছারীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬০ সালে প্রথম আহলেহাদীছ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় কালাবাগে। মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানের তৎকালীন আমীর এবং প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম ও লেখক মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী (১৮৯৫-১৯৬৮খৃঃ) এসেছিলেন সেই কনফারেন্সে। এরপর থেকে প্রতি বছরই কনফারেন্স হয়ে আসছে এবং পাকিস্তানের খ্যাতনামা আহলেহাদীছ আলেমগণ এতে উপস্থিত হন।
তিনি গর্বের সাথে জানালেন যে, শুরু থেকেই তিনি কনফারেন্সে আসা আলেম-ওলামাকে তাঁর বাড়িতে আতিথেয়তা দিয়ে আসছেন। এটা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। খ্যাতনামা আহলেহাদীছ বুযুর্গ পুরুষ ছূফী মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ[3] প্রতিবছর তাঁর এই বাড়িতে এসে সপ্তাহখানেক কাটাতেন। মাওলানা দাঊদ আবেগী কণ্ঠে শোনান, এই আল্লাহওয়ালা পুত-পবিত্র চরিত্রের ফেরেশতাতুল্য মানুষটি আমার বাড়ির মসজিদে মধ্যরাত থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত একটানা ইবাদতরত থাকতেন। এর মাঝে কারও সাথে কোন কথা বলতেন না। যখনই আসতেন এখানে, আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোক এসে ভিড় জমাতো তাঁর কথা শোনার জন্য, তাঁর কাছে দো‘আ নেয়ার জন্য।
এভাবে অত্র অঞ্চলে আহলেহাদীছদের ইতিহাস শুনতে শুনতে অনেক সময় কেটে যায়। আমরা ভাগ্যবান বোধ করলাম বহু ঘটনার জীবন্ত সাক্ষী নববইয়ের কোঠায় উপনীত এই মুরুববীর সান্নিধ্য পেয়ে এবং তার মুখ থেকে নানা ঘটনার বিবরণ শুনে। আমরা এসেছি জেনে আশ-পাশ থেকে বেশ কয়েকজন মুরুববী আসেন। কুশলাদি বিনিময় করে এবং বাংলাদেশের খবরাখবর জেনে একসময় তারা বাড়ির পথ ধরলেন। এশার ছালাতের পর আমরা বৈঠকখানায় এসে বসলাম। রাতের খাবার এল রুটি, চিকেন কোর্মা আর পাকিস্তানী বিরিয়ানী। তারপর চা পান পর্ব শেষে শোবার আয়োজন। এমনিতেই গ্রামে দ্রুত রাত নামে। আর পাহাড়ে বোধহয় আরও বেশী দ্রুত। দশটার মধ্যে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন ফজরের ছালাতে উঠে ওযূর জন্য গরম পানি পেয়ে কৃতার্থ হ’লাম গৃহকর্তার প্রতি। রাতের তুলনায় আবহাওয়া অনেক বেশী ঠান্ডা। ফজরের জামা‘আতে লোকজনের উপস্থিতি অন্ততঃ মাগরিবের তুলনায় বেশী। জনা দশেক লোকের জন্য সংক্ষিপ্ত দরসে কুরআনের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন মাওলানা আব্দুল হাফিয। ইত্তিবায়ে সুন্নাতের উপর সংক্ষিপ্ত দরস শেষে আমরা উঠতে চাইলাম। কিন্তু মুছল্লীরা ছাড়তে চাইলেন না। বাংলাদেশ নিয়ে অনেক প্রশ্ন তাদের। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রশ্নই বেশী থাকল। তার কারণ ২/৩ জন শহরে বসবাসরত চাকুরীজীবীও উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠলেই যেন পাকিস্তানীদের ভাই হারানোর বেদনা উথলে ওঠে। বিরল দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমার দেখা অধিকাংশ পাকিস্তানীই বাংলাদেশীদের উপর তৎকালীন সামরিক সরকারের যুলুমের কথা অকপটে স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছে। এখানেও ব্যতিক্রম দেখা গেল না। তাদের কৌতুহলের প্রেক্ষিতে আব্দুর রহমান ভাই বাংলায় কিছুক্ষণ ওয়ায করে শোনালেন। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলেন বাংলা ভাষা। ঘন্টাখানেক সময় তাদের সাথে কাটিয়ে আমরা মেজবানের বাড়ীতে ফিরলাম। সকালের নাস্তা সেরে আর দেরী না করে মাওলানা দাঊদ এবং আব্দুল হাফিযের নিকট থেকে বিদায় নিলাম। জানি আর দেখা হবে না। তবুও বিদায়ের বিরহ হালকা করতে কালের সাক্ষী দুই বৃদ্ধের প্রতি আশ্বাসবাণী বের হয়- ‘ফের মিলেঙ্গে’। তাঁরাও প্রশ্রয়ের সুরে চেহারায় দ্যুতি ছড়িয়ে বলেন- ‘যরূর ইনশাআল্লাহ’। আমরা মুসলমানরা বড় ভাগ্যবান যে, অন্যদের ক্ষেত্রে এসব বাক্যগুলো স্রেফ কথার কথা হ’লেও আমরা বিশ্বাসের জায়গা থেকেই তা বলতে পারি। কারণ ক্ষণস্থায়ী জীবনে আর দেখা হওয়ার প্রত্যাশা যদি নাও থাকে, তবু অনন্ত যে জীবন সামনে অপেক্ষমান, সেখানে পুনরায় মিলবার আকাংক্ষা তো কখনও তিরোহিত হওয়ার নয়। মনে পড়ে শ্রীলংকা সফরে কলম্বোয় আমার এক তামিল মেযবান আসলাম ভাইয়ের কথা। বিদায়ের সময় যখন বললাম, ‘আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ, যদি দুনিয়াতে না হয় তবে জান্নাতে’, তখন তিনি উপলব্ধিটা ধরতে পেরেই বুঝি আবেগে প্রায় কেঁদে ফেললেন।
আমরা ফিরতি পথে কালাবাগ বাযার আহলেহাদীছ জামে মসজিদে যাত্রাবিরতি করি। এই বাযারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী আহলেহাদীছ। এখানে একজন পূর্বপরিচিত ভাই ইয়াসির হক্কানী (৩৫)-এর সাথে দেখা হ’ল। ২০১৪ সালে বালাকোট সফরে গিয়ে তার সাথে দেখা হয়েছিল। তার মুখেই প্রথম মাওলানা দাঊদ ও বালাকোট জিহাদের পতাকার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু তাঁর বাড়ি যে এই এলাকাতে সেটা স্মরণে ছিল না। এতদিন পর পুনরায় মিলিত হয়ে দু’জনেই খুব খুশী হ’লাম। তিনি মসজিদের খত্বীব ও সংলগ্ন দাওরা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিলেন। ছোট্ট এই মাদরাসায় ছাত্রসংখ্যা খুব বেশী না হ’লেও এতদাঞ্চলে আহলেহাদীছের দাওয়াত প্রসারে ভাল ভূমিকা রাখছে। প্রাথমিক ক্লাসগুলো সমাপনান্তে তারা মেধাবী ছাত্রদেরকে প্রসিদ্ধ আহলেহাদীছ মাদরাসাগুলোতে পাঠিয়ে দেন এবং তারা পড়াশোনা শেষ করে অনেকে এলাকায় ফিরে আসে। আবার অনেকে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে দাওয়াতী ময়দানে ছড়িয়ে পড়ে।
মাদরাসায় একসাথে দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা মাওলানা ইউসুফের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তারপর ইয়াসির হক্কানী ভাই বাযারে এসে আমাদেরকে তুলে দিলেন ইসলামাবাদগামী মাইক্রোবাসে। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা ফিরে এলাম প্রিয় শহর ইসলামাবাদে। সঙ্গী রইল গালিয়াত উপত্যকার তাওহীদী চেতনাময় একগুচ্ছ অমলিন স্মৃতি।
[1]. দ্রষ্টব্য : সাক্ষাৎকার- মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক মুযাফ্ফরাবাদী, মাসিক আত-তাহরীক, জুন ২০১৪ সংখ্যা।
[2]. তিনি ছিলেন পাকিস্তানে আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ দিকপাল মাওলানা দাঊদ গযনভীর একান্ত শাগরেদ। তাঁর পূর্বপুরুষগণ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর সাথী ছিলেন। পূর্বসূরীদের পদাংক অনুসরণে তিনি আযাদ কাশ্মীরে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রসারে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং আযাদ কাশ্মীরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সরদার আব্দুল কাইয়ূম খান (১৯২৪-২০১৫ইং)-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রে তিনি দীর্ঘদিন সরকারী ওলামা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মাওলানা ইউনুস আছারী একাধারে মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ কাশ্মীরের আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয় (দ্র. প্রবন্ধ : ঝিলাম-নিলামের দেশে, মাসিক আত-তাহরীক, মার্চ ২০১৭ সংখ্যা)।
[3]. মাওলানা ইসহাক ভাট্টি তাঁর জীবনীর উপর একটি গ্রন্থ লিখেছেন- ‘ছূফী মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ রাহিমাহুল্লাহ : হালাত, খেদমাত, আছার’।