পর্ব ১ । শেষ পর্ব ।

জমি জরিপের মূল দায়িত্ব পালন :

(১) কর্মক্ষেত্রে সময়মত আসা-যাওয়া এবং উপস্থিত থাকা মূল দায়িত্বের অন্যতম অংশ। এই সময়ের বিপরীতে কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতন পান। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সম্মতি ছাড়া দেরিতে উপস্থিতি এবং আগেভাগে চলে গেলে ঐ সময়ের জন্য গৃহীত বেতন হারাম হবে। এ সম্পর্কে ‘আল-ইসলাম’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘কখনো এমন ঘটে যে, কর্মচারী তার কর্তব্য পালন করে না। কাজের সময়টা সে অন্য কাজে ব্যয় করে। হয়তো ব্যক্তিগত স্বার্থে তা ব্যয় করে অথবা অন্যান্য কর্মচারীদের কাজ পন্ড করে দেয়। কিংবা সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অলসতা দেখায়, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকে, নির্ধারিত সময়ের পরে হাযির হয় কিংবা কাজ শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময়ের আগেই বের হয়ে যায় এবং এজন্য তার পক্ষে কোন ওযরও নেই, তাহ’লে উল্লিখিত সকল ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মে যতটুকু ছাড় মেলে তার বাইরে যতটুকু সময় সে কাজ না করে নষ্ট করেছে তার বিনিময়ে গৃহীত বেতন তার জন্য হারাম হবে এবং এজন্য সে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবে’।[1]

বাংলাদেশে অফিস ফাঁকি দেওয়া কমবেশী সর্বত্রই চালু আছে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী হাজী রাশেদ মোশাররফ বলেন, এগুলোর কোনটিতেই নিয়মনীতির বালাই নেই। কাগজপত্রের ঠিক-ঠিকানা নেই। গণহয়রানি আর জাল কাজকর্মের প্রতিভূ হিসাবে গড়ে উঠেছে এক একটি অফিস। ভূমি প্রতিমন্ত্রী স্বীকার করেন যে, দেশ জুড়ে এই বেহাল অবস্থার রিপোর্ট তার কাছে আছে।[2]

(২) জমি জরিপকালে জমির প্রকৃত মালিককে তার জমির পরিমাণ কতটুকু, কোন সূত্রে সে জমির মালিক হয়েছে ইত্যাদি নিশ্চিত হয়ে জরিপ কাজ সমাধা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَلْبَيِّنَةُ عَلَى الْمُدَّعِى ‘বাদীর দায়িত্ব প্রমাণ পেশ করা’।[3] জমির মালিক না হয়ে মিথ্যা দাবী করা সম্পর্কে খুব সতর্ক করতে হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,وَمَنِ ادَّعَى مَا لَيْسَ لَهُ فَلَيْسَ مِنَّا وَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি তার অধিকারভুক্ত নয় এমন কিছু নিয়ে দাবী করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয় এবং সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়’।[4]

কেউ কারো জমি অন্যায়ভাবে দখল করলে তা বৈধতা পাবে না এবং ক্বিয়ামতে এজন্য তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَخَذَ شِبْرًا مِنَ الأَرْضِ ظُلْمًا ، فَإِنَّهُ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ سَبْعِ أَرَضِينَ ‘যে ব্যক্তি কারো এক বিঘত পরিমাণ যমীন জোর করে দখল করেছে, ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় সাত তবক পরিমাণ যমীন বেড়ি রূপে পরিয়ে দেওয়া হবে’।[5] এই মর্মে আরো অনেক হাদীছ রয়েছে। এজন্য জমির আইল হেরফের ঘটাতেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, وَلَعَنَ اللهُ مَنْ غَيَّرَ مَنَارَ الأَرْضِ ‘যে ব্যক্তি জমির আইল পরিবর্তন করে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক’।[6]

তবে সেটেলমেন্ট কোর্ট প্রাপ্ত দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে রেকর্ড করবেন। এরপরও যদি সন্দেহ থাকে তবে এই হাদীছের কথা শুনাবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ، وَإِنَّكُمْ تَخْتَصِمُوْنَ، وَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُوْنَ أَلْحَنَ بِحُجَّتِهِ مِنْ بَعْضٍ، وَأَقْضِىَ لَهُ عَلَى نَحْوِ مَا أَسْمَعُ، فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ مِنْ حَقِّ أَخِيهِ شَيْئًا، فَلاَ يَأْخُذْ، فَإِنَّمَا أَقْطَعُ لَهُ قِطْعَةً مِنَ النَّارِ-

‘আমি একজন মানুষ মাত্র। তোমরা আমার নিকট মামলা নিয়ে আস। আর তোমাদের কেউ কেউ অন্যের তুলনায় প্রমাণ উপস্থাপনে বেশী পারঙ্গম। এমতাবস্থায় আমি যা শুনি সে অনুযায়ী তার পক্ষে রায় দেই। এতে আমি যদি তার ভাইয়ের কোন হক বিন্দুমাত্র তাকে দিয়ে থাকি, তাহ’লে সে যেন তা মোটেও গ্রহণ না করে। কেননা আমি তো এর দ্বারা তার জন্য জাহান্নামের একটা অংশের ফায়ছালা দিয়ে দিয়েছি’।[7]

অবশ্য পরবর্তীতে মিথ্যার প্রমাণ মিললে রেকর্ড বাতিল করতে হবে এবং সংশোধন করে আসল মালিকের নামে দিতে হবে।[8]

(৩) কর্তব্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রীতার কোন স্থান দেবে না। কেননা দীর্ঘসূত্রীতার ফলে হকদারের হক পেতে বিলম্ব হয়, যা তার জন্য যুলুম। আর যুলুম মহাপাপ। প্রমাণাদি ঠিক থাকলে যথাসম্ভব স্বল্প সময়ে প্রাপকের কাজ করে দিবে। ইসলামের একটি মূলনীতি হ’লلاَ ضَرَرَ وَلاَ ضِرَارَ  ‘কারো ক্ষতি করা যাবে না এবং ক্ষতিগ্রস্তও হওয়া যাবে না’।[9]

এজন্যই আল্লাহ বলেছেন,وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُوْا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘তোমরা নেকী ও আল্লাহভীতির কাজে একে অপরকে সাহায্য কর। আর পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অপরকে সাহায্য করো না’ (মায়েদাহ ৫/২)

নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ،  ‘মুসলমান তো সেই, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে’।[10]

অতএব কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি স্বেচ্ছায় কাউকে সাহায্য করে, তাহ’লে সে বরং আল্লাহর পক্ষ হ’তে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ-  ‘আল্লাহ বান্দাকে ততক্ষণ সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে’।[11]

বাংলাদেশে জমি সংক্রান্ত জটিলতা খুবই বেশী। বৃটিশের রেখে যাওয়া আইন হুবহু কিংবা আংশিক সংস্কার করে যে ভূমি ব্যবস্থাপনা দেশে চালু আছে, এটা হয়রানিমূলক। সে সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি কথার উদ্ধৃতি প্রদান করছি।- ‘আজকে বিচার বিভাগের কথা ধরুন। আমরা আজকে একটা কোর্টে বিচারের জন্য গেলে, একটা সিভিল মামলা যদি হয়, তাহ’লে বিশ বছরেও কি সেই সিভিল মামলা শেষ হয়? পিতা মারা যাওয়ার সময় দিয়ে যায় ছেলের কাছে, আর উকিল দিয়ে যায় তার জামাইয়ের কাছে। Justice delayed, Justice denied. We have to work a complete change. System আমাদের পরিবর্তন করতে হবে, যেন easily মানুষ বিচার পায়। সমস্ত কিছুর পরিবর্তন দরকার। Colonial power (ঔপনিবেশিক শক্তি)-এর rule নিয়ে দেশ চলতে পারে না। Colonial power এ দেশ চলতে পারে না।[12]

দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পর এত বছর পেরিয়ে গেলেও এই সদিচ্ছার বাস্তবায়ন এখনো ঘটেনি। এরূপ দীর্ঘসূত্রিতার একটি উদাহরণ জনাব কাবেদুল ইসলাম তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, একজন নির্বাচিত ভূমিহীন ০৩/০২/১৯৮৮ তারিখে ভূমির জন্য দরখাস্ত করেছে, যেলা প্রশাসক ২২/৮/১৯৮৯ তারিখে প্রস্তাব অনুমোদিত মর্মে স্বাক্ষর করেছেন। তারপরও ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভূমির কবুলিয়ত সম্পন্ন হয়। মাঝে সময় কেটে গেছে ১৪ বছর। ইসলামী আইনে এ কাজ ঐ ভূমিহীনের উপর মারাত্মক যুলুম।[13]

এক বর্ণনা মতে, দেশের ৮০ শতাংশ মামলা হয় এখন ভূমিকে কেন্দ্র করে। এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, রেকর্ড কিপিং এর তহশীল অফিস, রেজিস্ট্রেশনের সাব রেজিস্ট্রার অফিস এবং জরিপের সেটেলমেন্ট অফিসের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই প্রতিনিয়ত হাযারো মামলা-মোকদ্দমার জন্ম দিচ্ছে।[14] এক একটি বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় এ সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। এই তিনটি বিভাগকে এক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনলে সমস্যা বহুলাংশে লাঘব হবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।[15]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘দ্বীন হ’ল কল্যাণ সাধনের নাম। ছাহাবীগণ বললেন, কার কল্যাণ সাধন? তিনি বললেন, আল্লাহর, তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের, মুসলিম শাসকবর্গের এবং সাধারণ মুসলিম জনগণের’।[16]

এই হাদীছ অনুসারে শাসকদের উচিত জনস্বার্থে আইন সংস্কার করা এবং কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জনকল্যাণের দিকে বেশী নযর দেওয়া। উল্লেখ্য যে, ছাহাবীদের যুগে এত মামলা-মোকদ্দমা ছিল না। আমাদের নিজেদের রচিত আইনের কারণেই জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আল-কুরআনের আলোকে ভূমি ব্যবস্থাপনা :

আমাদের জীবন-জীবিকার জন্য কৃষি, শিল্প, খনি, বন ইত্যাদি যাই বলি না কেন সব কিছুরই মূল উৎস ভূমি। পবিত্র কুরআনে সেজন্য ভূমির প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ قَلِيْلاً مَا تَشْكُرُوْنَ-  ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতার অধিকারী করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণ সৃষ্টি করেছি। বস্ত্ততঃ তোমরা কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (আ‘রাফ ৭/১০)

অন্যত্র তিনি বলেন, هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُوْلاً فَامْشُوا فِيْ مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِنْ رِزْقِهِ،  ‘তিনিই তোমাদের জন্য ভূমিকে অনুকূল করে দিয়েছেন। সুতরাং তার বুকের উপর দিয়ে চলাচল কর এবং তার দেওয়া জীবিকা থেকে আহার কর’ (মুলক ৬৭/১৫)

তিনি আরো বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ  ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপার্জিত সম্পদ থেকে উৎকৃষ্টগুলো ব্যয় কর এবং খরচ কর তা থেকে যা আমি ভূমি থেকে তোমাদের জন্য বের করে দেই’ (বাক্বারাহ ২/২৬৭)

আল্লাহ আরো বলেন, فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلاَةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ ‘ছালাত শেষ হ’লে তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান কর’ (জুম‘আ ৬২/১০)

প্রথম আয়াতে জানা যায়, আল্লাহ মানুষের বসবাসের জন্য যেমন ভূমির ব্যবস্থা করেছেন, তেমনি তাতে তার জীবন ধারণের সব উপকরণ তৈরী করে রেখেছেন।

দ্বিতীয় আয়াতে জীবিকা অনুসন্ধানের জন্য ভূমির উপর চলাচল ও চেষ্টা করতে বলা হয়েছে।

তৃতীয় আয়াতে মুসলমানদেরকে হালাল উপার্জন এবং ভূমি থেকে উৎপাদিত ফসলের হক আদায় করতে বলা হয়েছে।

চতুর্থ আয়াতে ইবাদতের পর বসে না থেকে রূযী সংগ্রহের জন্য পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়তে বলা হয়েছে। আল-কুরআনে ভূমির ব্যবহার সংক্রান্ত এমন অনেক আয়াত রয়েছে।

ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি :

আল-কুরআনে ভূমি ও অন্যান্য অস্থাবর জিনিসের উপর ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত। ব্যক্তি উত্তরাধিকার, ক্রয়, দান, অছিয়ত (উইল), গনীমত, ভাড়া, শুফ‘আ (Preemtion) ইত্যাদি আইনের মাধ্যমে মালিকানা লাভ করতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে কারা কার সম্পত্তির কতটুকু মালিক হবে তা আল-কুরআনের সূরা নিসায় সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে। ব্যক্তিগত ভূমির মালিক ভূমির ব্যাপারে যথেষ্ট স্বাধীন। আল্লাহ বলেন, وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا وَلاَ تُسْرِفُوْا ‘তোমরা খাও, পান কর, কিন্তু অপচয় করো না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, অন্যের ক্ষতিও করবে না’।[17] সুতরাং জমির অপচয় ও অন্যের ক্ষতি না করে নিজের জমি চাষাবাদ, বনায়ন, পুকুর খনন, দোকান-পাট, বাড়ি-ঘর, শিল্প কারখানা নির্মাণ, ইজারা বা ভাড়া প্রদান, দান, হেবা, ওয়াকফ, অছিয়ত ইত্যাদি যে কোন কিছু করতে পারে। ইচ্ছা করলে মালিক নিজে চাষ করতে পারে। শ্রমিক-মজুরকে মজুরির বিনিময়ে চাষের কাজে নিয়োজিত করতে পারে, বর্গাচাষ করতে দিতে পারে, লিজ বা বার্ষিক চুক্তিতে ভাড়া দিতে পারে এবং কোন বিনিময় ছাড়াই কাউকে ভোগ করতে দিতে পারে। মৃত্যুর পর তার সম্পদে উত্তরাধিকার আইন বলবৎ হবে।[18]

মুসলিম কৃষকের এ ধরনের আবাদী জমিতে সেচ ছাড়া উৎপাদিত ফসলে ওশর বা /১০ ভাগ এবং সেচ প্রয়োগে উৎপাদিত ফসলে নিছফে ওশর বা /২০ ভাগ ফসল নিয়ম মাফিক যাকাতের খাতে ব্যয় করতে হবে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি যদি কোন অমুসলিমের হয়, তবে ইসলামী আইন মুতাবেক উৎপাদিত ফসলের একটি নির্ধারিত অংশ সে সরকারকে প্রদান করবে। অথবা সরকার জমির উপর খারাজ হিসাবে টাকার একটি অঙ্ক ধার্য করবে। ওমর (রাঃ) ইরাক, সিরিয়া ও মিসরের জমিতে উভয় প্রকার খারাজই ধার্য করেছিলেন। খারাজ নির্ধারণের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ যেন ক্ষতি ও যুলুমের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যক্তি মালিকানায় লাভের আরেক প্রকার জমি আছে যাকে আরবীতে ‘মাওয়াত’ বলে। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, যেসব জমি অনাবাদী- পানির অভাবে, পানিতে ডুবে থাকা কিংবা অন্য কোন কারণে চাষযোগ্য না হওয়ায় তা এমনিতে পড়েছিল, সেসব জমিকে মাওয়াত বা অনাবাদী জমি বলে। এমন জমি যে ব্যক্তিই প্রথমে আবাদ যোগ্য করে তুলবে সেই তার মালিক হবে। চর, দ্বীপ ইত্যাকার জমি এদেশে ‘মাওয়াত’ শ্রেণীভুক্ত হ’তে পারে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ أَحْيَا أَرْضًا مَيْتَةً فَهِىَ لَهُ ‘যে ব্যক্তি অনাবাদী ভূমি আবাদ করবে সেই ঐ জমির মালিক হবে’।[19] অবশ্য অনাবাদী মাওয়াত ভূমির প্রকৃত মালিক রাষ্ট্র। তাই কেউ তা আবাদ করলেই সাথে সাথে মালিক হবে না, বরং তাকে সরকারের নিকট হ’তে লিখিতভাবে বরাদ্দ নিতে হবে। ইমাম আবু ইউসুফ এ সম্পর্কে বলেন,

وللإمام أن يقطع كل موات وكل ما كان ليس لأحد فيه ملك وكل بالذي يرى أنه خير للمسلمين وأعم نفعًا-

‘অর্থাৎ অনাবাদী, মালিকানাহীন এবং চাষ করা হয় না এমন সকল জমি জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য। এখানে তাকে দু’টি নীতি মানতে হবে। এক- এই বণ্টন দ্বারা মুসলিম জনগণের কল্যাণ হ’তে হবে। দুই- রাষ্ট্র ও সর্বসাধারণের সার্বিক উপকার নিশ্চিত করতে হবে। মাওয়াত ভূমিতেও পূর্বের ন্যায় ওশর ও খারাজ ধার্য হবে।

সরকারী ভূমি :

সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জমি-জায়গা থাকতে পারে, থাকা আবশ্যকও। সরকারী অফিসাদির স্থান, চারণভূমি, সড়ক, রেলপথ, পানিপথ, সেনানিবাস, পার্ক, খেলার স্থান, পুকুর, খাল, বিল, বাজার ইত্যাদির জন্য সরকারের জমির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সময়ই তার চৌহদ্দিতে অবস্থিত সমুদ্র, নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড়, বিল, হরদ, পাহাড়-পর্বত, বন-বনানী, নদীতে জেগে ওঠা নতুন চর, নতুন দ্বীপ ও মরুভূমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন জমিতে পরিণত হয়। কোন ব্যক্তি এগুলোর মালিক থাকে না। অনুরূপভাবে যুদ্ধের  মাধ্যমে গড়ে ওঠা দেশে বিজিত শক্তি দেশ ছেড়ে চলে গেলে তাদের রেখে যাওয়া ভূসম্পত্তি, কলকারখানা, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ইত্যাদিও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে সরকার জনগণের কাছ থেকে উচিত মূল্যে জমি কিনে রাষ্ট্রীয় কাজে তা ব্যবহার করতে পারে। প্রত্যেক রাষ্ট্র তা করেও থাকে।

সরকারের হাতে চাষযোগ্য যেসব জমি থাকে তা চাষের কাজে প্রকৃত কৃষকদের মাঝে বন্দোবস্ত দিবে। এক্ষেত্রে ভূমিহীন ও স্বল্প ভূমিওয়ালা কৃষক অগ্রাধিকার পাবে। কেননা তাদের অভাব বেশী। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَرَكَ مَالاً فَلأَهْلِهِ وَمَنْ تَرَكَ دَيْنًا أَوْ ضَيَاعًا فَإِلَىَّ وَعَلَىَّ ‘যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে মারা যাবে তা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। আর যে ঋণের বোঝা কিংবা অসহায় পরিবার রেখে যাবে, তার দায়িত্বভার আমার উপর’।[20]

নবী করীম (ছাঃ) বনু কায়নুক্বা, বনু নাযির, বনু কুরায়যা থেকে গনীমত, খুমুস ও ফাই হিসাবে যে সম্পত্তি পেয়েছিলেন, তা মদীনার মুসলমানদের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। খায়বারের সম্পত্তিকে তিনি তথাকার ইহুদী চাষীদের মাঝে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকের বিনিময়ে চাষ করতে দেন।[21] আবুবকর (রাঃ)-এর আমলে ভূমি ব্যবস্থাপনার একই ধারা বজায় ছিল।

পরবর্তীকালে ওমর (রাঃ)-এর সময়ে তৎকালীন পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের এক বিরাট এলাকা ইসলামী খেলাফতের অধীনে আসে। মিসর থেকে গোটা ইরান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগে ইসলামের প্রসার ঘটে। তিনি ভূমি ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনি জমিদারী বা সামন্ত প্রথা উচ্ছেদ করেন। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক হবে এবং গরীব শ্রেণী তাদের অধীনে ভূমিদাস হয়ে থাকবে এটা ছিল রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যে প্রচলিত। তিনি প্রকৃত চাষীদের হাতে জমির মালিকানা ছেড়ে দেন। তারা জমি চাষ করবে এবং জমির ফসল থেকে অথবা প্রচলিত মুদ্রায় খারাজ বা ভূমিকর আদায় করবে।

এই নিয়ম ওমর (রাঃ) প্রবর্তন করেন। তিনি মুসলিম সৈনিকদের মধ্যে সকল জমি এজন্য বণ্টন করেননি যে, তারাও এক একজন জমিদার বনে যাবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কোন জমি অবশিষ্ট থাকবে না। আর ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনা, জনকল্যাণে অর্থ ব্যয় এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হবে না।[22]

আরেক প্রকার ভূমি আছে যার প্রত্যক্ষ মালিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু তত্ত্বাবধান সূত্রে সে পরোক্ষ মালিক। এসব জমি সাধারণ বা সমষ্টির কল্যাণে দানকৃত জমি। যেমন ওয়াকফ, মসজিদ, মাদরাসা, গোরস্থান, ঈদগাহ, ধর্মীয় এসব প্রতিষ্ঠানের নামে দানকৃত জমি ইত্যাদি। অমুসলিমদের উপাসনালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দানকৃত ভূমিও এই শ্রেণীভুক্ত। এসব ভূমি থেকে সরকার নিয়মমাফিক ওশর ও খারাজ আদায়ের পর দানের উদ্দেশ্য মাফিক বাকি অর্থ ব্যয় হচ্ছে কি-না তা তত্ত্বাবধান করবে।

রাষ্ট্র উল্লিখিত কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি কিংবা দানকৃত সম্পত্তি অন্য কাউকে প্রদান করার এখতিয়ার রাখে না। এমন কিছু করলে তা যুলুম ও অবৈধ দখল বলে গণ্য হবে।[23]

চাষাবাদযোগ্য জমি ব্যক্তিগত হ’লে তা চাষ করতে হাদীছে বারবার বলা হয়েছে। যেমন ছহীহ মুসলিমে বলা হয়েছে, ازْرَعُوْهَا أَوْ أَزْرِعُوهَا ‘জমি হয় তোমরা নিজেরা চাষ কর, নয় অন্যকে চাষ করতে দাও’।[24]

আর সরকারী ভূমিও যাতে সর্বতোভাবে চাষের আওতায় আসে সেজন্য রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিশেষভাবে তৎপর থাকতে হবে। এক্ষেত্রে খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর একটি ফরমান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর গভর্ণরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমাদের দখলে যেসব সরকারী জমি রয়েছে তা অর্ধেক ফসলের বিনিময়ে ভাগ (বর্গা) চাষের নিয়ম অনুযায়ী জনগণকে চাষাবাদ করতে দাও। এতে যদি চাষাবাদ না হয়, তাহ’লে এক-তৃতীয়াংশের বিনিময়ে (তিন ভাগের এক ভাগ সরকার পাবে এবং দু’ভাগ পাবে চাষী) তা চাষাবাদ করতে দাও। আর এ শর্তেও যদি কেউ জমি চাষ করতে রাযী না হয়, তাহ’লে দশ ভাগের এক ভাগ ফসল পাওয়ার বিনিময়ে চাষাবাদ করতে দাও। এতেও যদি জমি চাষ না হয়, তাহ’লে কোন বিনিময় না নিয়ে এমনিই চাষ করতে দাও। এভাবেও কেউ চাষ করতে না চাইলে তা চাষাবাদের ব্যবস্থা করো এবং কোন জমিই অব্যবহৃত অবস্থায় পতিত থাকতে দেবে না।[25]

ইসলাম পূর্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা ও বর্তমান ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ইসলামী ভূমি ব্যবস্থাপনার কিছু পার্থক্য :

ইসলাম পূর্ব যুগে পারস্য, রোম ও অন্যান্য সাম্রাজ্যের ভূমি থেকে রাজস্ব সংগ্রহকালে কৃষকদের অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখা হ’ত না। বরং ধার্যকৃত কর তাকে দিতেই হ’ত। বর্তমান ভূমি ব্যবস্থাতেও একই অবস্থা বিরাজমান। ইসলামে ভূমি রাজস্ব আদায়ে কৃষকদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে। ফসল কম হ’লে রাজস্ব কমিয়ে দেওয়া এমনকি প্রয়োজনে মাফ করে দেওয়াও বিধেয়।

পূর্বে জমিদারি প্রথা ছিল, বর্তমানেও অনেক দেশে এ প্রথা আছে। তাছাড়া অনেক দেশে ধর্মীয় উত্তরাধিকার সূত্রে মাতা-পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান উত্তরাধিকারী হয়, যেমন খ্রিস্টান ধর্মে। আবার মেয়েরা উত্তরাধিকারী হয় না, যেমন হিন্দু ধর্মের মেয়েরা। আবার কোথাও পরিবারের কেবল ছোট মেয়ে উত্তরাধিকারী হয়, যেমন বাংলাদেশের গারো সমাজে রয়েছে। এতে কেবল মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে জমি কেন্দ্রীভূত হয় এবং বেশীর ভাগ মানুষ ভূমি থেকে বঞ্চিত হয়। আবার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাষ্ট্রই সব জমির মালিক হওয়ায় কোন ব্যক্তির ভূমি মালিকানা থাকে না। ফলে তারা ইচ্ছামত মৌলিক অধিকার পূরণ করতে পারে না। কিন্তু ইসলামে ভূমির উপর জমিদারি প্রথা স্বীকার করা হয়নি এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার জন্য ভূমিতে অধিকার থাকায় কেউ ভূমির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় না। কেউ ভূমিহীন হ’লে মাওয়াত কিংবা সরকারী সম্পত্তি থেকে তার ভূমি লাভের সুযোগ আছে।

প্রাচীন ও আধুনিক কোন ব্যবস্থাতেই জমি থেকে প্রাপ্ত কর ভাতা আকারে দেশের জনগণের মধ্যে বণ্টনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রগুলো গ্রহণ করে না। কিন্তু ইসলামী সরকারের ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য খাতের সংগৃহীত অর্থ বায়তুল মালে জমা হওয়ার পর মুসলিম-অমুসলিম, নারী-পুরুষ, দুধের শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বিশেষে সকলের জন্যই ভাতার ব্যবস্থা করার কথা রয়েছে।[26]

খ্রিস্টান ঐতিহাসিক জুরজী যায়দান বলেছেন, গ্রীকদের ভাতা রেজিস্ট্রার শুধুমাত্র এথেন্স বা অন্যান্য কেন্দ্রীয় শহর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মুসলমানরা একে এতই ব্যাপক করে যে, প্রত্যেক শহর এবং প্রত্যেক স্তরের লোকই এ থেকে উপকৃত হ’ত।[27]

ইসলামে কর নির্ধারণে কৃষকের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে।[28] কৃষকদের চাষাবাদে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিনাসূদে ঋণদানের কথাও ইসলামে স্বীকৃত। ফকীহগণ বলেছেন,أَنَّ صَاحِبَ الْأَرْضِ الْخَرَاجِيَّةِ إذَا عجز عن زِرَاعَةِ ارضه لفقره دفع إليه كفايته من بيت المال قرضا ليعمل ويستغل أرضه ‘খারাজি ভূমির মালিক যদি দরিদ্রতার কারণে তার জমি চাষ করতে অক্ষম হয়, তাহ’লে প্রয়োজনমত তাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিনা সূদে ঋণ দিবে। যেন সে জমি চাষ করতে ও ফসল ফলাতে সক্ষম হয়।[29] কিন্তু ধনতান্ত্রিক ও মিশ্র অর্থ ব্যবস্থায় দেশগুলোতে কৃষি ঋণের জন্য কৃষককে চক্রবৃদ্ধিহারে সূদ দিতে হয়।

দলীল, মিউটেশন বা জমাখারিজ, দাখিলা, পরচা :

দলীল : জমি বেচা-কেনার জন্য সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে সাবরেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর ও সীলমোহর সহ ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে যে চুক্তিনামা সম্পাদিত হয় তাকে ‘দলীল’ বলে। আর সাবরেজিস্ট্রারের অফিস আইন মন্ত্রণালয়ভুক্ত।

মিউটেশন বা জমাখারিজ : যৌথ মালিকানাভুক্ত সম্পত্তির অংশীদারগণ কর্তৃক কিংবা ক্রেতা কর্তৃক বিক্রেতার স্থলে নিজের নাম জারী করে সরকারকে পৃথকভাবে খাজনা দেওয়ার যে ব্যবস্থা করা হয় তাই মিউটেশন, জমা খারিজ বা নামপত্তন নামে পরিচিত। জমি ক্রেতা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন কিংবা পৌর ভূমি অফিসে জমির দলীল দাখিল করার পর তাদের মাধ্যমে উপযেলা ভূমি অফিস থেকে মিউটেশন সম্পন্ন করতে পারেন। মিউটেশন বুনিয়াদে খাজনা দাখিল করা যায় বিধায় এটিও এক প্রকার পরচা। উল্লেখ্য, খাজনা আদায়কারী ভূমি অফিসগুলো যেলা প্রশাসনের অধীনে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন।

দাখিলা : জমির মালিক তার দখলি স্বত্ব বজায় রাখতে প্রতি বছর সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে খাজনা প্রদান করেন। এই খাজনার প্রাপ্তি স্বীকার পত্রই দাখিলা। দাখিলা হ’ল খাজনা আদায়ের রশিদ।

পরচা : পরচা হ’ল সেটেলমেন্ট কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত খতিয়ান। জমির মালিক, জমির পরিমাণ, খাজনা, মৌজা ইত্যাদি উল্লেখপূর্বক জমি জরিপ কর্তৃপক্ষ যে প্রমাণপত্র প্রদান করেন তাই পরচা। পরচা প্রদানকারী সেটেলমেন্ট কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন।

জমির সাথে এই চারটি কাগজ জড়িয়ে আছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই কম-বেশী দুর্নীতি ও ঘুষের লেন-দেন ঘটে বলে এগুলোর পরিচয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নাম জানা থাকা ভাল।

ইসলামী বিধানেও জমি কেনা-বেচায় উল্লিখিত কাগজগুলোর আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীন ‘মাওয়াত’ বা অনাবাদি জমি কাউকে দিলে লিখিতভাবে দিয়েছেন বলে প্রমাণ আছে।[30]

আবার জমি জরিপ যেহেতু বিধেয় ও দরকারী, সেহেতু তার স্বপক্ষে পরচা থাকা খুবই যরূরী। এতে যে খাজনার উল্লেখ থাকবে তা দাখিল করার প্রমাণপত্র থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করতে পারবে না। এজন্যই দাখিলা আবশ্যক।

উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে কিন্তু সরকার নির্ধারিত ফিস ধার্য করা আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সেই ফিস প্রদান করে প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে তা সব সময় হয় না। এটা নেই, সেটা নেই; এটা দরকার-ওটা দরকার। এখানে সমস্যা ওখানে সমস্যা, আজ না কাল, হাতে অনেক কাজ, সময় হবে না ইত্যাদি নানা অজুহাত তুলে গ্রাহকদের হয়রানী করানোর একটা রেওয়াজ যেন আমাদের বিধিলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। তাই ঘাটে ঘাটে ঘুষের বিনিময়ে ভুক্তভোগীদের কাজ আদায় করতে হয়। এহেন দুর্নীতি ইসলামে যেমন হারাম ও নিষিদ্ধ, প্রচলিত সরকার ব্যবস্থাতেও নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় অপরাধ।

আমাদের দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় দেখা যায়, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত লোকগুলোর অধিকাংশই মুসলিম। এরা অনেকে ছালাত আদায় করে, ছিয়াম পালন করে ও ধর্মীয় অন্যান্য বিধান পালন করে। দুর্নীতির অর্থ দান করে, সমাজ সেবার কাজেও লাগায়। অনেকে হজ্জও করে। আর মনে করে এভাবে সব পাপ মুছে যাবে। কিন্তু তা হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ جَمَعَ مَالاً حَرَاماً ثم تَصَدَّقَ بِهِ، لَمْ يَكُنْ لَه فِيهِ أجْرٌ، وَكَانَ إصْرُهُ عَلَيْهِ ‘যে ব্যক্তি অবৈধভাবে সম্পদ সঞ্চয় করে, এরপর তা দান করে, সে ঐ দানের জন্য কোন ছওয়াব পাবে না এবং তার পাপ তাকেই ভোগ করতে হবে’।[31]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাচাত ভাই বিশিষ্ট ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয় যে, ঐ ব্যক্তি একটি প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিল। তখন সে যুলুম করে ও অবৈধভাবে ধন-সম্পদ উপার্জন করে। পরে সে তওবা করে এবং সেই সম্পদ দিয়ে হজ্জ করে, দান করে এবং জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে। তখন ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, হারাম বা পাপ কখনো পাপ মোচন করে না; বরং হালাল অর্থ থেকে ব্যয় করলে পাপ মোচন হয়।[32]

সুতরাং মানুষকে হয়রানি করে, তাদের অর্থ আত্মসাৎ করে পরবর্তীকালে সাধু সাজার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। বরং কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকে অবৈধ পথ পরিহার করে কেবলই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে কাজ করতে হবে। চাই তা জমি জরিপ হোক কিংবা দলীল রেজিস্ট্রি হোক কিংবা মিউটেশন হোক বা দাখিলা কাটা হোক অথবা অন্য কাজ হোক।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে অধীনস্তদের উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখবে। তারা নিজেরা ঘুষ-দুর্নীতি করবে না, অন্যদেরও করতে দিবে না। তারা যদি নিজেরা এর সঙ্গে জড়িত থাকে এবং অধীনস্তদেরও বাধ্য করে তাহ’লে দুনিয়া অশান্তির আগার হবে। আর আখিরাতে এমন কর্তৃপক্ষ আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার হাত থেকে রক্ষা পাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَسْتَرْعِي اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَبْدًا رَعِيَّةً قَلَّتْ أَوْ كَثُرَتْ، إِلاَّ سَأَلَهُ اللهُ عَنْهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، أَقَامَ فِيهِمْ أَمْرَ اللهِ أَمْ أَضَاعَهُ، حَتَّى يَسْأَلَ الرَّجُلَ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ خَاصَّةً- ‘আল্লাহ তা‘আলা তার কোন বান্দাকে কোন জাতির শাসক বানালে চাই তাদের সংখ্যা কম হোক কিংবা বেশী হোক ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাকে তাদের সম্পর্কে একথা জিজ্ঞেস করবেন যে, সেকি তাদের মাঝে আল্লাহর বিধান চালু করেছিল, নাকি তা বরবাদ করে দিয়েছিল। এমনি করে তিনি শেষ পর্যন্ত তাকে বিশেষভাবে তার বাড়ীর লোকদের মাঝে আল্লাহর বিধান চালু করা না করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন’।[33]

এ হাদীছ প্রত্যেক অফিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং তৃণমূল পর্যায়ের অফিসার থেকে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অফিসারকেও সেদিন জবাবদিহি করতে হবে। কাজেই এ জটিল পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে এবং নিজেদের দেশকে সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও অধিকারপূর্ণ করতে ছোট-বড় সকলেই সকলকে সহযোগিতা করতে হবে। এখানে সেখানে দু’একজন বিচ্ছিন্নভাবে সৎ জীবন যাপন করায় সমাজ-রাষ্ট্রের তেমন কোন কল্যাণ হবে না।

অতএব আসুন! দেশ ও জাতির কল্যাণে দুর্নীতি পরিহার এবং সুনীতির অনুশীলন করি। অন্যকে দুর্নীতি পরিহার করতে বাধ্য করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!


[1]. আল-ইসলাম ৩/১৪ পৃঃ

[2]. ইসলামে ভূমি ব্যবস্থা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃঃ ৩৫৩-৫৬

[3]. তিরমিযী হা/১৩৪১-৪২; মিশকাত হা/৩৭৫৮, ৩৭৬৯; ইরওয়া হা/২৬৪১, সনদ ছহীহ

[4]. মুসলিম হা/৬১; ইবনু মাজাহ হা/২৩১৯; মিশকাত হা/৩৭৬৫

[5]. বুখারী হা/২৪২৩, ৩১৯৫; মুসলিম হা/১৬১২; মিশকাত হা/২৯৩৮

[6]. মুসলিম হা/১৯৭৮; মিশকাত হা/৪০৭০

[7]. বুখারী হা/৬৯৬৭, ৭১৬৯; মুসলিম হা/১৭১৩; মিশকাত হা/৩৭৬১

[8]. ইসলামের অর্থনীতি, পৃঃ ১৪৯

[9]. ইবনু মাজাহ হা/২৩৪০-৪১; ছহীহাহ হা/২৫০; ইরওয়া হা/৮৯৬, সনদ ছহীহ

[10]. বুখারী হা/১০-১১, ৬৪৮৪; মুসলিম হা/৪০; মিশকাত হা/৬

[11]. মুসলিম হা/২৬৯৯; আবূদাঊদ হা/৪৯৪৬; ইবনু মাজাহ হা/২২৫; মিশকাত হা/২০৪

[12]. আনু মাহমুদ, গণপরিষদ ও সংসদে বঙ্গবন্ধু (ঢাকা : ন্যাশনাল পাবলিকেশন্স, ২০১৫), পৃঃ ২৩০

[13]. বাংলাদেশের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৮৪-৮৬, গৃহীত : ইসলামে ভূমি ব্যবস্থাপনা, পৃঃ ৩৫৫-৫৬।

[14]. ইসলামে ভূমি ব্যবস্থাপনা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃঃ ৩৬৩

[15]. ঐ, পৃঃ ৩৬৪

[16]. আবূদাঊদ হা/৪৯৪৪; তিরমিযী হা/১৯২৬; নাসাঈ হা/৪১৯৯; মিশকাত হা/৪৯৬৬, সনদ ছহীহ

[17]. ইবনু মাজাহ হা/২৩৪০-৪১; ছহীহাহ হা/২৫০; ইরওয়া হা/৮৯৬, সনদ ছহীহ

[18]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৯৭৪; ইসলামের অর্থনীতি, পৃঃ ১৪৯-১৫৯

[19]. আবুদাঊদ হা/৩০৭৩-৭৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯৭৫-৭৬, সনদ ছহীহ

[20]. মুসলিম হা/৮৬৭; আবুদাঊদ হা/২৯৫৪; ইবনু মাজাহ হা/৪৫; মিশকাত হা/৩০৪১

[21]. বুখারী হা/২৩৩৮, মুসলিম হা/১৫৫১, মিশকাত হা/৪০৫৪।

[22]. আল-ইসলাম, ৩/৬০ পৃঃ; ইসলামের অর্থনীতি, পৃঃ ১৪৭-৪৮

[23]. ইসলামের অর্থনীতি, পৃঃ ১৬১, মাওয়ারদী, আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ, পৃঃ ১৬৮

[24]. বুখারী হা/২৩৩৯; মুসলিম হা/১৫৪৮

[25]. ইসলামে ভূমি ব্যবস্থাপনা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃঃ ৫২; ইসলামের অর্থনীতি, পৃঃ ১৬৩; আবু ওবায়েদ, কিতাবুল আমওয়াল, পৃঃ ৫০৩

[26]. বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : ড. মুহাম্মাদ ইউসুফুদ্দীন, ইসলামের অর্থনৈতিক মতাদর্শ (ঢাকা : ইফাবা, ২য় সংস্করণ মে ২০০৩), ২য় খন্ড, পৃঃ ৬৪-৮২

[27]. ঐ, ২/৮০ পৃঃ

[28]. দ্র: ইসলামের অর্থনৈতিক মতাদর্শ, পৃঃ ২০৬-২০৭

[29]. শামী ৩/৩৬৪ পৃঃ; ইসলামের অর্থনীতি, পৃঃ ২৪৬

[30]. আল-ইসলাম, ৩/১২ পৃঃ

[31]. ছহীহ ইবনু হিববান, হা/৩৩৬৭, ৮/১১ পৃঃ; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৮৮০; সনদ হাসান

[32]. খুৎবাতুল ইসলাম, পৃঃ ১৯৫; ইবনু রজব, জামিউল উলূম, পৃঃ ১২৭

[33]. আহমাদ হা/৪৬৩৭; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭৭৪; ছহীহাহ হা/১৬৩৬





যে সকল কর্ম লা‘নত ডেকে আনে - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা (শেষ কিস্তি) - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইসলামের দৃষ্টিতে সফলতার স্বরূপ - মুহাম্মাদ ওয়ারেছ মিয়াঁ
মানবাধিকার ও ইসলাম (১০ম কিস্তি) - শামসুল আলম
অসুস্থ ব্যক্তির করণীয় ও বর্জনীয় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ঈছালে ছওয়াব : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হজ্জ সফর (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
জামা‘আতে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত ও হিকমত (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
সুন্নাত আঁকড়ে ধরার ফযীলত (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আরও
আরও
.