অল্পে তুষ্টির নমুনা
রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে অল্পে তুষ্টি :
মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন পৃথিবীর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তিনি ছিলেন মানবজীবনের সকল কল্যাণকর বিষয়ে সর্বোত্তম আদর্শ ব্যক্তিত্ব। কেননা তিনি জগৎবাসীর জন্য রহমত ও উসওয়াহে হাসানাহ বা ‘সর্বোত্তম নমুনা’ হিসাবে প্রেরিত হয়েছিলেন (আম্বিয়া ২১/১০৭; আহযাব ৩৩/২১)। তিনি ছিলেন ঈমান ও ইয়াক্বীনের বলে বলীয়ান অল্পে তুষ্ট থাকা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ এবং মানবজাতির জন্য অল্পে তুষ্ট জীবনের পথিকৃত। যারা ইন্দ্রিয়ের সর্বানুভূতির চিহ্ন ক্ষয় করে তাঁর আদর্শকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং সেই আলোকে জীবন গড়তে সক্ষম হয়েছেন, তারাই দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি ও মুক্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও অল্পে তুষ্ট জীবন বেছে নিয়েছিলেন এবং তাঁর মহান আদর্শের মাধ্যমে স্বীয় উম্মতকে সেই জীবনের দিকে আহবান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনের বাঁকে-বাঁকে অল্পে তুষ্টির নমুনা পাওয়া যায়। এখানে আমরা সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
ক. পরিবারকে অল্পে তুষ্টির শিক্ষা প্রদান :
রাসূল (ছাঃ) তাঁর পরিবার-পরিজনকে অল্পে তুষ্টি, ধৈর্যশীলতা এবং দুনিয়াবিমুখতার দিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছেন। সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আখেরাতমুখী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। খায়বার যুদ্ধের পরে যখন মুসলমানদের অবস্থা পূর্বের তুলনায় কিছুটা সচ্ছল হ’ল, তখন মুহাজির ও আনছারদের স্ত্রীদের দেখাদেখি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণও খোরপোষের পরিমাণ বৃদ্ধি করার দাবী জানালেন। নবী করীম (ছাঃ) যেহেতু বিলাসহীন অনাড়ম্বর ও অল্পে তুষ্ট জীবন-যাত্রা পসন্দ করতেন, সেহেতু স্ত্রীদের এই দাবীতে মনঃক্ষুণ্ণ হ’লেন এবং এক মাসের জন্য স্ত্রীদের নিকট থেকে আলাদা হয়ে একাকী বাস করা শুরু করলেন। অবশেষে আল্লাহ এই আয়াত অবতীর্ণ করলেন, ‘হে নবী! তোমার স্ত্রীদের বল, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার বিলাস-ব্যসন কামনা কর, তবে এস আমি তোমাদের ভোগ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদের বিদায় করে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের গৃহ কামনা কর, তবে তোমাদের মধ্যেকার সৎকর্মশীলদের জন্য মহা পুরস্কার প্রস্ত্তত করে রেখেছেন’ (আহযাব ৩৩/২৮-২৯)।
এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর সর্বপ্রথম তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে এটা শুনিয়ে তাকে সংসারে থাকা ও না থাকার ব্যাপারে এখতিয়ার দিলেন এবং বলে দিলেন, নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে পিতা-মাতার পরামর্শ নিয়ে যা করার করবে।
আয়েশা (রাঃ) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, এই ব্যাপারে আববা-আম্মার সাথে পরামর্শ করার কি আছে? বরং আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে পসন্দ করি। অন্য সকল স্ত্রীগণও এই একই মত ব্যক্ত করলেন এবং কেউ রাসূল (ছাঃ)-কে ত্যাগ করে পার্থিব প্রাচুর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দিলেন না’।[1]
খ. খাদ্যের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর অল্পে তুষ্টি :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খানাপিনার ব্যাপারে অল্পে তুষ্ট ছিলেন। উরওয়াহ (রাঃ) বলেন, একবার আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) আমাকে বললেন, ‘হে ভাগ্নে! আমরা দু’মাসে তিনটি নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু (এর মধ্যে) আল্লাহর রাসূলের বাড়ির চুলাগুলোতে আগুন জ্বলত না। আমি বললাম, আপনারা কিভাবে দিনাতিপাত করতেন? তিনি বললেন, الأَسْوَدَانِ التَّمْرُ وَالْمَاءُ، ‘দু’টি কালো বস্ত্ত- খেজুর ও পানি দিয়ে’।[2] অন্যত্র আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, مَا شَبِعَ آلُ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم مُنْذُ قَدِمَ الْمَدِيْنَةَ مِنْ طَعَامِ الْبُرِّ ثَلاَثَ لَيَالٍ تِبَاعًا، حَتَّى قُبِضَ، ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ) মদীনায় আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর পরিবারের লোকেরা এক নাগাড়ে তিন রাত গমের রুটি পেট পুরে খাননি’।[3] আবূ ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, আমরা একবার আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর দাওয়াতে হাযির হ’লাম। খাওয়ার শুরুতে তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, كُلُوا فَمَا أَعْلَمُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَأَى رَغِيْفًا مُرَقَّقًا حَتَّى لَحِقَ بِاللهِ، وَلاَ رَأَى شَاةً سَمِيْطًا بِعَيْنِهِ قَطُّ، ‘আপনারা খান! আমার জানা নেই- নবী কারীম (ছাঃ) মৃত্যুর সময় পর্যন্ত পাতলা রুটি দেখেছেন কি-না। আর তিনি কখনো ভুনা বকরির গোশত চোখে দেখেননি’।[4]
গ. রাসূল (ছাঃ)-এর বিছানা :
রাসূল (ছাঃ) আখেরাতমুখী সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। দুনিয়ার যৎসামন্য আসবাবপত্রে তাঁর অল্পে তুষ্টির নমুনা তুলনাহীন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, একদা নবী কারীম (ছাঃ) একটি খেজুর পাতার মাদুরে শুয়েছিলেন। তাঁর দেহের চামড়ায় (মাদুরের) দাগ বসে গেল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক। আপনি আমাদেরকে অনুমতি দিলে আমরা আপনার জন্য মাদুরের উপর কিছু (তোষক) বিছিয়ে দিতাম। তাহ’লে তা আপনাকে দাগ লাগা থেকে বাঁচিয়ে রাখত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا أَنَا وَالدُّنْيَا إِنَّمَا أَنَا وَالدُّنْيَا كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ، ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا، ‘দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক কি? আমি দুনিয়াতে এমন এক মুসাফির বৈ তো কিছু নই, যে একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিল। অতঃপর তা ত্যাগ করে গন্তব্যের দিকে চলে গেল’।[5]
আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ فِرَاشُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ أَدَمٍ، وَحَشْوُهُ مِنْ لِيفٍ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিছানা ছিল চামড়ার তৈরী এবং তার ভিতরে ছিল খেজুর পাতার আঁশ’।[6]
ঘ. পার্থিব শান-শওকত ও সম্পদের ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর অল্পে তুষ্টি :
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ঘরে প্রবেশ করলাম। সে সময় তিনি খেজুর পাতা নির্মিত একটি চাটাইয়ের উপর কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। আমি সেখানে বসে পড়লাম। তিনি তার চাঁদরখানি স্বীয় শরীরের উপরে টেনে দিলেন। তখন এটি ছাড়া তার পরনে অন্য কোন কাপড় ছিল না। আর পার্শ্বদেশে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিল। এরপর আমি স্বচক্ষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আসবাবপত্রের দিকে তাকালাম। আমি সেখানে একটি পাত্রে এক ছা‘ (আড়াই কেজি) এর কাছাকাছি কয়েক মুঠো যব দেখতে পেলাম। অনুরূপ বাবলা জাতীয় গাছের কিছু পাতা (যা দিয়ে চামড়ায় রং করা হয়) কামরার এক কোণায় পড়ে থাকতে দেখলাম। আরও দেখতে পেলাম ঝুলন্ত একখানি চামড়া, যা পাকানো ছিল না। ওমর (রাঃ) বলেন, এসব দেখে আমার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। তিনি (ছাঃ) বললেন, مَا يُبْكِيكَ يَا ابْنَ الْخَطَّابِ! ‘হে খাত্ত্বাবের পুত্র! কিসের কারণে তোমার কান্না পেয়েছে?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর নবী! কেন অমি কাঁদব না? এই যে চাটাই, যা আপনার শরীরের পার্শ্বদেশে দাগ বসিয়ে দিয়েছে। আর এই হচ্ছে আপনার কোষাগার। এখানে সামান্য কিছু যা দেখলাম তাছাড়া তো আপনার আর কিছুই নেই। পক্ষান্তরে ঐ যে রোমক বাদশাহ ও পারস্য সম্রাট, কত বিলাস ব্যসনে ফলমূল ও ঝরণা পরিবেষ্টিত হয়ে আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করছে। অথচ আপনি হ’লেন আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর মনোনীত ব্যক্তি। আর আপনার কোষাগার হচ্ছে এই!’ তখন তিনি বললেন,يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، أَلَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ لَنَا الْآخِرَةُ وَلَهُمُ الدُّنْيَا؟ ‘হে খাত্ত্বাবের বেটা! তুমি কি এতে পরিতুষ্ট নও যে, আমাদের জন্য রয়েছে আখিরাত আর তাদের জন্য দুনিয়া (পার্থিব ভোগ বিলাস)। আমি বললাম, নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট’।[7] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا يَسُرُّنِي أَنْ لاَ يَمُرَّ عَلَيَّ ثَلاَثٌ، وَعِنْدِي مِنْهُ شَيْءٌ إِلَّا شَيْءٌ أُرْصِدُهُ لِدَيْنٍ، ‘আমার কাছে যদি ওহোদ পাহাড়ের সমান সোনা থাকত, তাহ’লে আমার পসন্দ নয় যে, তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমার কাছে তার কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকুক। তবে সেই পরিমাণ ব্যতীত, যা আমি ঋণ পরিশোধ করার জন্য রেখে দেই’।[8] রাসূল (ছাঃ)-এর এই অল্পে তুষ্টির দৃষ্টান্ত যুগ যুগান্তরে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণক্ষরে চির ভাস্বর হয়ে আছে। রাসূল (ছাঃ)-এর সেই সোলানী আদর্শ আখেরাতের জন্য পাগলপরা প্রত্যেক মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। সেই আদর্শের সোপান পেরিয়ে বান্দা অল্পে তুষ্টির মহান জীবনে পদার্পন করতে পারে।
ছাহাবায়ে কেরামের অল্পে তুষ্ট জীবন :
ছাহাবায়ে কেরাম ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সনিষ্ঠ অনুসারী। রাসূল (ছাঃ)-এর অল্পে তুষ্ট জীবনকে তারা খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন এবং তাঁর জীবনাদর্শের দ্যূতি দিয়ে নিজেদের জীবনকে আলোকিত করেছিলেন। ছাহাবায়ে কেরামের জীবনাচরণে চোখ বুলালে নববী আদর্শের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। নিমেণ সংক্ষেপে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হ’ল-
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদেরকে অল্পে তুষ্টি শিক্ষা দিয়েছেন। ছাওবান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ يَكْفُلُ لِي أَنْ لَا يَسْأَلَ النَّاسَ شَيْئًا، وَأَتَكَفَّلُ لَهُ بِالْجَنَّةِ؟ ‘যে ব্যক্তি আমার সাথে এই ওয়াদা করবে যে, সে কারো কাছে ভিক্ষার হাত বাড়াবে না, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিনদার হবো’। ছাওবান (রাঃ) বললেন, আমি। ফলে তিনি কারো কাছে কিছু চাইতেন না।[9] এমনকি আরোহী থাকা অবস্থায় ছাওবান (রাঃ)-এর হাত থেকে যদি চাবুক নিচে পড়ে যেতো, তিনি কাউকে বলতেন না- এটা আমাকে তুলে দাও। বরং তিনি নিজে বাহন থেকে নেমে সেটা তুলে নিতেন।[10]
(২) রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রীদের জীবনও ছিল সাদামাটা। বিশিষ্ট তাবেঈ হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, كُنْتُ أَدْخُلُ بُيُوتَ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي خِلَافَةِ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ فَأَتَنَاوَلُ سُقُفَهَا بِيَدِي، ‘আমি ওছমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে রাসূল (ছাঃ) স্ত্রীগণের ঘরসমূহে যাতায়াত করতাম। আমি তাদের ঘরের ছাদগুলো আমার দুই হাতের নাগালে পেতাম’।[11] অর্থাৎ উম্মাহাতুল মুমিনীনে বসবাসের ঘরে ছাদ এত নিচু ছিল যে, দুই হাতে সেই ঘরের ছাউনি নাগাল পাওয়া যেত।
(৩) আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি আহলুছ ছুফ্ফার সত্তর জন ছাহবীকে এমন দেখেছি যে, তাদের কারো কাছে গা ঢাকার জন্য চাদর ছিল না। কারো লুঙ্গী ছিল এবং কারো চাদর ছিল। কিন্তু এক সঙ্গে দু’টি বস্ত্র কারো কাছে ছিল না। তারা সেই কাপড়টি গলায় বেঁধে নিতেন। অতঃপর কাপড়টি কারো অর্ধগোছা পর্যন্ত এবং কারো টাখনু পর্যন্ত পৌঁছত। আর তারা হাত দিয়ে জামা ধরে রাখতেন, যাতে লজ্জাস্থান দেখা না যায়’।[12]
(৪) উরওয়া ইবনু যুবাইর (রহঃ) বলেন, একবার আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ) আয়েশা (রাঃ)-কে এক লক্ষ দিরহাম হাদিয়া দিলেন। কিন্তু তিনি তার খাদেমার মাধ্যমে সেই দিরহামগুলো মানুষের মাঝে বণ্টন করা শুরু করলেন। আল্লাহর কসম! সন্ধ্যা হ’তে না হ’তেই সব দিরহাম ছাদাক্বাহ করে শেষ করে দিলেন। সন্ধ্যার পর তিনি খাদেমাকে খাবার প্রস্ত্তত করতে বলেন। কিন্তু তার ঘরে পর্যাপ্ত খাবার ছিল না। তাই খাদেমা আয়েশা (রাঃ)-কে বলল, ‘আপনি যদি এক দিরহাম দিয়ে কিছু গোশত কিনে রাখতেন, তাহ’লে খাবারের আয়োজন করা যেত’। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, তুমি আমাকে আগে স্মরণ করিয়ে দাওনি কেন, তাহ’লে তো আমি কিছু গোশত কেনার ব্যবস্থা করতাম।[13] অর্থাৎ এতগুলো দিরহাম থেকে নিজের জন্য যে কিছু রাখতে হবে, সেটা তিনি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন। সুতরাং সম্পদ সঞ্চয়কারী ও অপচয়কারী মুসলিম নর-নারীদের জন্য এই ঘটনাতে উপদেশ রয়েছে।
(৫) ছহীহ সনদে সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর কাহিনী বর্ণিত আছে। আমের ইবনে আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, যখন সালমান ফারেসী (রহঃ)-এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে, তখন তাকে খুব পেরেশান ও অস্থির মনে হচ্ছিল। লোকেরা বলল, হে আবু আব্দিল্লাহ! আপনি এমন পেরেশান হচ্ছেন কেন? আপনার অতীত তো কল্যাণের সাথে অতিবাহিত হয়েছে। আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে অসংখ্য জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন এবং ইসলামের বড় বড় বিজয়ে বীরোচিত অবদান রেখেছেন। তখন সালমান (রাঃ) বলেন, ‘প্রিয় রাসূল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি বাণী আমাকে অস্থির করে তুলেছে। তিনি বলেছেন, لِيَكْفِ الْمَرْءَ مِنْكُمْ كَزَادِ الرَّاكِبِ ‘তোমাদের মধ্যকার কোন ব্যক্তির জন্য ততটুকু সম্পদই যথেষ্ট, যে পরিমাণ সম্পদ একজন মুসাফিরের পাথেয় হিসাবে যথেষ্ট হয়’। রাবী বলেন, মৃত্যুর সময় সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র পনের দিরহাম। কোন কোন বর্ণনায় পনের দিনারের কথা উল্লেখ আছে।[14] হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, সালমান ফারসী (রাঃ) দুই ফালি কাপড় পরিধান করে খুৎবাহ দিতেন। এক ফালি লুঙ্গি হিসাবে পরিধান করতেন, আর এক ফালি গায়ে জড়িয়ে নিতেন। যখন তাকে কেউ কোন কিছু হাদিয়া দিত, তিনি সেটা দান করে দিতেন। আর তিনি নিজ হাতে খেজুর পাতার পাটি বুনাতেন এবং সেটা বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করতেন’।[15]
সালাফে ছালেহীনের অল্পে তুষ্ট জীবন :
সালাফে ছালেহীন বলতে ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম, তাবে তাবেঈন ও তৎপরবর্তী হেদায়াতপ্রাপ্ত সম্মানিত ইমামগণকে বুঝানো হয়। এছাড়া যারা তাদের সনিষ্ঠ অনুসারী এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হেদায়াতের পথে পরিচালিত হয়েছেন, তাদেরকেও সালাফে ছালেহীনের মাঝে গণ্য করা হয়। সালাফদের ত্যাগপূত জীবন আমাদের জন্য অনুকরণীয়। তাদের জীবনের পরতে পরতেও আমরা অল্পেতুষ্ট থাকার প্রেরণা খুঁজে পাই। তাদের আদর্শ আমদের হৃদয়তন্ত্রীতে অপার্থিব শক্তি সঞ্চারিত করে। নিমেণ কয়েকজন সৎকর্মশীল সালাফের জীবনী থেকে অল্পেতুষ্টির কিছু নমুনা দেওয়া হ’ল-
(১) প্রখ্যাত তাবেঈ আবু হাযেম আল-আশজা‘ঈ (রহঃ) ছিলেন আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর ছাত্র। তার জীবন ছিল অল্পে তুষ্টির অনন্য উদাহরণ। একবার এক উমাইয়া খলীফা আবূ হাযেম (রহঃ)-এর নিকট একটি চিঠি লিখে পাঠালেন এবং তার কোন কিছু প্রয়োজন আছে কি-না জানতে চাইলেন। আবূ হাযেম (রহঃ) পত্রের জবাব দিয়ে বললেন, ‘আপনার চিঠি আমার কাছে পৌঁছেছে। আপনি আমাকে অনুরোধ করেছেন- যেন আপনার কাছে আমার প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করি। কিন্তু আমি তো আমার সব প্রয়োজন আল্লাহর কাছে ব্যক্ত করেছি। তিনি আমাকে যা দিয়েছেন, তা গ্রহণ করেছি এবং আমার থেকে যা কিছু নিবৃত্ত রেখেছেন, সেই ব্যাপারে পরিতুষ্ট থেকেছি। সুতরাং আমাকে আপনার সাহায্য করার কোন প্রয়োজন নেই’।[16]
(২) মুক্বাতিল ইবনে ছালেহ খুরাসানী (রহঃ) বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ হাম্মাদ ইবনু সালামাহ (রহঃ)-এর একটি অভূতপূর্ব কাহিনী বর্ণনা করেছেন। মুক্বাতিল (রহঃ) বলেন, একদিন আমি হাম্মাদ (রহঃ)-এর সাথে তার ঘরে বসে ছিলাম। হঠাৎ তার দরজায় কে যেন করাঘাত করল। তিনি তার ছোট মেয়েকে বললেন, ‘দেখ তো দরজায় কে এসেছে? মেয়েটি দেখে বলল, ‘মুহাম্মাদ ইবনে সুলাইমানের বার্তাবাহক’। মুহাম্মাদ ইবনে সুলাইমান ছিলেন তৎকালীন বছরার গভর্নর। তিনি মেয়েকে বললেন, ‘তাকে একা ঘরে ঢুকতে বল’। বার্তাবাহক একাই ঘরে ঢুকল এবং সালাম দিয়ে তার হাতে একটা চিঠি দিতে চাইল। হাম্মাদ (রহঃ) তাকে বললেন, ‘তুমিই পড়ো!’। এরপর সে চিঠিটা পড়তে লাগল। চিঠির মূল বক্তব্যে বলা হয়েছিল, ‘আমরা একটি মাসআলার সম্মুখীন হয়েছি। এই বিষয়টি আপনার কাছে জানতে চাই। আপনি দয়া করে আমাদের কাছে আসবেন’। চিঠি পড়া শেষ হ’লে হাম্মাদ (রহঃ) মেয়েকে কালি আনতে বললেন এবং বাহককে বললেন, ‘পত্রের অপর পাতায় লেখো-إن وقعت مسألة فائتنا فتسألنا عما بدا لك وأن أتيتني فلا تأتني إلا وحدك ولا تأتني بخيلك ورجلك فلا أنصحك ولا أنصح نفسي والسلام، ‘কোন মাসআলা জানার থাকলে আমাদের কাছে আসবেন। যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করবেন। তবে একাকী আসবেন। কোন আশ্বারোহী ও দলবল নিয়ে আসবেন না। এরকম করলে আপনার প্রতি এবং আমার নিজের প্রতিও কোন প্রকার শুভ কামনা থাকবে না, ওয়াস্সালাম’। বাহক চিঠির উত্তর নিয়ে চলে গেল।
মুক্বাতিল (রহঃ) বলেন, আমি আগের মতোই বসে আছি। হঠাৎ কেউ একজন দরজায় করাঘাত করল। তিনি তার মেয়েকে বললেন, দেখো! দরজায় কে এসেছে। মেয়েটি দেখে বলল, ‘মুহাম্মাদ ইবনে সুলাইমান’। বললেন, ‘তাকে ভিতরে আসতে বল’। গভর্নর মুহাম্মাদ ইবনে সুলাইমান সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তার সামনে বসে কথা বলা শুরু করলেন। গভর্নর বললেন,مالي! إذا نظرت إليك امتلأت رعبا، ‘আপনার দিকে তাকালে আমি ভীতু হয়ে পড়ি। এটা কেন হয়?’। হাম্মাদ (রহঃ) বললেন,العالم إذا أراد بعلمه وجه الله تعالى هابه كل شيء وإذا أراد يكثر به الكنوز هاب من كل شيء، ‘আলেম যখন তার জ্ঞান দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, তখন সবাই তাকে ভয় করে। আর সে যখন জ্ঞান দ্বারা ধন-ভান্ডার বৃদ্ধি করার ইচ্ছা করে, তখন নিজেই অপরের ভয়ে তটস্থ থাকে’।
এরপর গভর্নর তার কাছে বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েল জেনে নিলেন। তারপর হাম্মাদ (রহঃ)-কে বললেন, আপনার কি কোন প্রয়োজন আছে?’ তিনি বললেন,هات ما لم يكن رزية في دين الله، ‘দিতে পারেন, যদি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কোন ক্ষতি না হয়’। গভর্নর বললেন, ‘আপনাকে চল্লিশ হাযার দিরহাম হাদিয়া দিতে চাচ্ছি, এটা আপনার প্রয়োজনে কাজে লাগাবেন’। তিনি বললেন, ‘যাদের প্রতি আপনি অন্যায় করেছেন, এটা তাদেরকে দিয়ে দিন’। গভর্নর বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি মীরাছ সূত্রে সেটা পেয়েছি, সেখান থেকেই আপনাকে দিচ্ছি’। তিনি বললেন, ‘আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমার কাছ থেকে এগুলো সরান, আপনার কাছে থেকেও আল্লাহ এগুলো সরিয়ে রাখুন’। এবার গভর্নর বললেন, ‘যদি অন্য কিছু দেই, নেবেন তো?’ তিনি বললেন, ‘দিতে পারেন, যদি দ্বীনের ব্যাপারে কোন ক্ষতি না হয়’। তখন গভর্নর বললেন, ‘এগুলো নিয়ে আপনি মানুষের মাঝে বণ্টন করে দিবেন’। হাম্মাদ (রহঃ) বললেন, ‘বণ্টন তো ঠিকই করতে পারি। কিন্তু আমি ইনসাফ বজায় রাখলেও কেউ হয়ত না পেয়ে বলবে আমি ইনছাফ করিনি, তখন সে গুনাহগার হবে। সুতরাং এগুলো আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিন। আল্লাহ আপনাকে এসবের বোঝা থেকে মুক্ত করুন’।[17] অল্পে তুষ্টি এমন বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। আল্লাহ আমাদেরকে এখান থেকে উপদেশ হাছিল করার তাওফীক্ব দান করুন।
(৩) সমকালীন কতিপয় মনীষী অল্পে তুষ্টির গুণে নিজেদের জীবনকে গুণান্বিত করেছিলেন। তন্মধ্যে অন্যতম হ’লেন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী (রহঃ)। তিনি ছিলেন মৌরিতানিয়া বংশোদ্ভূত একজন দুনিয়া বিমুখ আলিমে দ্বীন ও বিদগ্ধ মুফাসসির। আব্দুল আযীয বিন বায, ছালেহ আল-উছায়মীন, ড. বকর আবূ যায়েদ (রহঃ), ছালেহ আল-ফাওযান (হাফিঃ) -সহ সঊদী আরবের বহু প্রসিদ্ধ আলিম তার ছাত্র ছিলেন।
শানক্বীত্বী (রহঃ) ছিলেন অল্পে তুষ্ট জীবনের মূর্ত প্রতীক। তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, ‘আববা আমাদের নিয়ে মদীনায় থাকতেন। একবার তাঁর হাত খালি হয়ে যায়। তাঁর কাছে কোন টাকা ছিল না। একজন প্রতিবেশী এটা বুঝতে পেরে তাকে কিছু সম্পদ ঋণ দেওয়ার ওয়াদা করে। তিনি যখন সেই প্রতিবেশীর কাছে ঋণ নিতে গেলেন। দেখলেন, ঋণ দিতে আগ্রহী লোকটা অতি সাদামাটা পোশাক পরিধান করে গৃহস্থলী কাজ-কর্ম করছেন। আববা এটা দেখে ঋণ না নিয়েই বাসায় ফিরে আসলেন। তাকে দেখে মনে হ’ল- যেন তার কোন উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তিনি আমাদের কাছে সেই প্রতিবেশীর বিবরণ পেশ করে বলেন, ‘আমি তাকে দেখে নিজের অজান্তেই রাস্তার ধূলা-বালির ওপরে সিজাদয় পড়ে গেলাম। সিজদা থেকে মাথা উঠানোর সাথে সাথে আমার হৃদয়জুড়ে কি যে খুশি ও প্রশান্তির বাতাস দোলা দিয়ে গেল- তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মনে মনে বললাম, আমি কিভাবে দুনিয়া কামনা করতে পারি, অথচ আমার রব আমাকে ইলমের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন, তাঁর কিতাব অনুধাবন করার তাওফীক্ব দিয়ে আমাকে মর্যাদামন্ডিত করেছেন? তখন আমি অনুভব করলাম, আল্লাহ আমাকে কুরআনের মর্ম অনুধাবনের যে নে‘মত দান করেছেন, তা দিয়ে পুরো দুনিয়া পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে আর কারো কাছে কোন কিছু চাওয়ার আগেই মহান আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা দিয়ে আমার হৃদয়ে অভাবের দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং আমাকে সম্মান ও মর্যাদার চাদরে আবৃত করে নিলেন। তাই আমি ঋণ না নিয়েই চলে আসলাম’।
শায়খের ছেলে আব্দুল্লাহ বলেন, আমার আববা দুনিয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতেন এবং আমাকে উপদেশ দিয়ে বলতেন,احذر من الدنيا؛ فإنها كالماء المالح، والشيطان يكذب عليك ويقول: اجمع الأموال لتتصدق بها، وتبني بها المدارس، وتعمل بها الأربطة. وهو يكذب عليك يريد أن يضيع وقتك، فإذا جمعت المال لا أنت تعطيه للناس، ويشغلك عن عبادة الله، فهذا شيطان يريد أن يصرفك عن ما هو خير لك، ‘দুনিয়ার ব্যাপারে সাবধান থাক! কেননা দুনিয়াটা লবণাক্ত পানির মতো। শয়তান তোমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলবে, তুমি সম্পদ সঞ্চয় করো, যাতে সেই সঞ্চিত সম্পদ দিয়ে দান-ছাদাক্বাহ করতে পার, মাদ্রাসা নির্মাণ করতে পার এবং আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পার। সে তোমাকে আরো মিথ্যা অভয় দিবে এবং চাইবে, তুমি যেন (সম্পদ সংগ্রহে) তোমার সময় অপচয় করে ফেল। কিন্তু যখন তুমি সম্পদ সঞ্চয় করে ফেলবে, তখন তুমি আর মানুষের জন্য দান করতে চাইবে না এবং সেই ধন তোমাকে আল্লাহর ইবাদত থেকে গাফেল করে ফেলবে। এভাবেই শয়তান তোমাকে কল্যাণকর বিষয় থেকে নিবৃত্ত রাখতে সচেষ্ট থাকে’।[18]
ড. মুহাম্মাদ খাযর নাজী বলেন, একবার শায়খ শানক্বীত্বীকে চিকিৎসার জন্য কায়রো নিয়ে আসা হয়। সঊদী দূতাবাস থেকে সরকারীভাবে তার চিকিৎসা বাবদ যাবতীয় খরচের দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়। যখন চিকিৎসা শেষ হয়ে যায়, তখন কিছু অর্থ বেঁচে যায়। তিনি দূতাবাসে সেই উদ্বৃত্ত অর্থ ফিরিয়ে দেন। পরে দূতাবাসের একজন প্রতিনিধি তার কাছে এসে সেই অর্থ পুনরায় তাকে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং বলেন, ‘হে শায়খ! সরকার এই অর্থ আপনার জন্য বরাদ্দ করেছে এবং এটা আপনারই প্রাপ্য’। তখন শায়েখ বলেন, তাহ’লে এটা আমার পক্ষ থেকে চিকিৎসা বাবদ অন্য কাউকে দিয়ে দাও। আমার চিকিৎসা তো শেষ। সুতরাং এটা গ্রহণ করা আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়’।[19]
(৪) সমকালীন মনীষীদের মাঝে আরেকজনের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি হ’লেন আল্লামা মুহাম্মাদ ছালেহ আল-উছায়মিন (রহঃ)। তার জীবনটা অল্পে তুষ্টির স্বচ্ছ সলিলে বিধৌত ছিল। তার জীবনী থেকে দু’টি উপদেশমূলক ঘটনা তুলে ধরা হ’ল-
শায়খ উছায়মীন (রহঃ)-এর ছাত্র সুলাইমান বিন সালেম আল-হানাকী (রহঃ) বলেন, একদিন শায়খ উছায়মীন (রহঃ) মসজিদের বারান্দায় বসে তার ছাত্রদের সামনে দারস দিচ্ছিলেন। ছাত্ররা তাকে বিভিন্ন শারঈ মাসায়েলের ব্যাপারে প্রশ্ন করছিল, আর তিনি সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এমতাবস্থায় একটি আলিশান গাড়ি মসজিদ চত্ত্বরে প্রবেশ করল। চালক গাড়ি থেকে নেমে শায়খের কাছে আসল এবং শহরের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলল, ‘তিনি এই গাড়িটি আপনাকে হাদিয়া দিয়েছেন’। এই কথা বলে সে শায়েখের কাছে গাড়ির চাবি দিতে হাত বাড়াল। কিন্তু তিনি চাবি নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। কিন্তু চালক পীড়াপীড়ি করতে লাগল। তাই শেষ পর্যন্ত চাবিটা নিলেন।
লোকটা চলে গেলে তিনি চাবিটা পাশে রেখে আবার ছাত্রদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। কিন্তু চাবির দিকে একবারও তাকালেন না। এভাবে দরস চলতে থাকল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ এক যুবকের আগমন ঘটল। সে শায়খকে সালাম দিয়ে আরয করে বলল, ‘শায়খ! আজ রাতে আমার বিবাহ সম্পন্ন হবে ইনশাআল্লাহ। আমি মনে প্রাণে কামনা করি যে, আপনি আমার বিবাহে উপস্থিত থাকবেন’। শায়খ ওযর পেশ করে সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করলেন। কিন্তু তার উপস্থিতির জন্য যুবকটি পীড়াপীড়ি করতে লাগল। তখন শায়খ তার প্রতি কোমল হয়ে বললেন, ‘আসলে পরিস্থিতি অনুকূলে হচ্ছে না। তাছাড়া আমি তোমার বিবাহে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতাম। তুমি এক কাজ কর, এই গাড়ির চাবিটা নাও! এটা আমার পক্ষ থেকে তোমাকে উপহার দিলাম। যুবক চাবিটা হাতে নিল এবং গাড়ি নিয়ে চলে গেল। এরপর শায়খ আবার ছাত্রদের সামনে কথা বলা শুরু করলেন। তিনি আগের মতো একদম স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে থাকলেন। যেন কিছুই হয়নি।[20]
সুলায়মান হানাকী (রহঃ) আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। একবার সঊদী আরবের তৎকালীন বাদশাহ খালিদ এবং যুবরাজ ফাহাদ শায়খ উছায়মীন (রহঃ)-এর বাড়িতে তাকে দেখতে যান।
ঘরের অনাড়ম্বর কাঠামো দেখে বাদশাহ তাকে একটি নতুন বাড়ি উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করলেন এবং তাকে একটি প্রাসাদ তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। উত্তরে শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বললেন, ‘আমি আপনার প্রস্তাবের সমাদর করি, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন! তবে ইতিমধ্যেই আমি ছালিহিয়্যা (উনাইযা শহরের একটি এলাকা)-তে একটি বাড়ি নির্মাণ করছি’। বাদশাহ তার জন্য কিছু একটা করতে চাচ্ছিলেন, তখন শায়খ বললেন, ‘যদি আপনি কিছু করতেই চান, তাহ’লে দয়া করে আমার ছাত্রদের বসবাসের জন্য একটি হোস্টেল নির্মাণ করে দিন, অন্যথা তারা মসজিদে বসবাস করছে, আর এটি তাদের জন্য খুব কষ্টকর’। বাদশাহ চলে যাওয়ার পরে, ছাত্ররা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘শায়খ! আমরা তো জানতামই না যে আপনি ইতিমধ্যে ছালিহিয়্যাতে একটি বাড়ি নির্মাণ করছেন?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘তোমরা কি জাননা, ছালিহিইয়াতে একটি কবরস্থান আছে?’ তারা বলল, ‘জ্বী’। তিনি বললেন, ‘আমি সেখানেই আমার পরকালের বাড়ি নির্মাণ করছি’।[21]
ফেৎনা বিদগ্ধ এই সামাজিক পরিবেশে জীবনের রঙ যখন ধূসর হয়ে যায় এবং লোভের ক্রমাগত ঝাপটায় হৃদয় তরী দিকভ্রান্ত হয়ে যায়, তখন সৎকর্মশীল সালাফদের জীবনী নিঙড়ানো এই টুকরো কাহিনীগুলো প্রশান্তির বারি দিয়ে আমাদের হৃদয়কে সজীব-সিক্ত করবে এবং সীরাতে মুস্তাক্বীমে অটল থাকতে প্রেরনা জোগাবে। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁদের প্রতি রহম করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করে তাঁর নেককার বান্দাদের পথে পরিচালিত করুন- আমীন!
[ক্রমশঃ]
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম. এ (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. বুখারী হা/৪৭৮৬; মুসলিম হা/১৪৭৫।
[2]. বুখারী হা/৬৪৫৯; মুসলিম হা/২৯৭৩।
[3]. বুখারী হা/৫৪১৬; মুসলিম হা/২৯৭০; মিশকাত হা/৫২৩৭।
[4]. বুখারী হা/৫৪২১; ইবনু মাজাহ হা/৩৩০৯; মিশকাত হা/৪১৭০।
[5]. তিরমিযী হা/২৩৩৭; ইবনু মাজাহ হা/৪১০৯; মিশকাত হা/৫১৮৮, সনদ ছহীহ।
[6]. বুখারী হা/৬৪৫৬; মুসলিম হা/২০২৮।
[7]. বুখারী হা/৪৯১৩; মুসলিম হা/১৪৭৯, শব্দাবলী মুসলিমের।
[8]. বুখারী হা/২৩৮৯; মুসলিম হা/৯৯১।
[9]. আবূদাঊদ হা/১৬৪৩; নাসাঈ হা/২৫৯০; মিশকাত হা/১৮৫৭, সনদ ছহীহ।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩২৪৪, সনদ ছহীহ।
[11]. বায়হাক্বী, শুআব হা/১০২৪৯; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৫০, সনদ ছহীহ।
[12]. বুখারী হা/৪৪২; মিশকাত হা/৫২৪১।
[13]. ইবনু সাঈদ, আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, তাহক্বীক: আব্দুল ক্বাদের ‘আত্বা (বৈরূত; দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যা, প্রথম সংস্করণ, ১৪১০হি./১৯৯০খ্রি.) ৮/৫৩; মাক্বরীযী, ইমতা‘উল আসমা’ ৬/৪০।
[14]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭০৬; তাবারাণী, মু‘জামুল কাবীর হা/৬১৮২; ছহীহাহ হা/১৭১৬।
[15]. আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া ১/১৯৭; ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব ২১/৪৩৪; যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১/৫৪৭।
[16]. ইবনুস সুন্নী, আল-কানা‘আত, মুহাক্কিক: আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ আল-জুদা‘ঈ (রিয়াদ: মাকতাবাতুর রুশ্দ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৯হি.) হা/১০, পৃ. ৪৩।
[17]. ইমাম নববী, বুস্তানুল ‘আরেফীন (কায়রো: দারুর রাইয়ান লিত তুরাছ, তাবি) পৃ. ৩৫-৩৬।
[18]. আব্দুল আযীয তুইয়ান, যুহূদুশ শায়খ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী ফী তাক্বরীরি আক্বীদাতিস সালাফ (রিয়াদ: মাকতাবাতুল ‘উবাইকান, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৯হি./১৯৯৯খ্রি.) ১/৩৮-৩৯।
[19]. প্রাগুক্ত, ১/৩৯।
[20]. আছেম বিন আব্দুল মুন‘ইম আল-মারী, আদ-দুর্রুছ ছামীন ফী তারজামাতি ফাক্বীহিল উম্মাহ আল্লামাহ ইবনু উছায়মীন (আলেকজান্দ্রিয়া, মিসর: দারুল বাছীরাহ, ১৪২৪হি./২০০৩খ্রি.) পৃ. ২১৮।
[21]. আদ-দুর্রুছ ছামীন, পৃ. ২১৮-২১৯।