পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪

দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার করার উপায়

১. ঈমান তাযা রাখা :

মযবূত ঈমান আল্লাহর পথে ত্যাগ স্বীকারের মূল হাতিয়ার। ঈমান তাযা না থাকলে আল্লাহর পথে যে কোন ধরনের কষ্ট স্বীকারে বান্দা অপারগ হয়ে যায়। ঈমানী দুর্বলতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে মুসলিমদের উপর যাবতীয় দুর্গতি নেমে এসেছে। ঈমানী দুর্বলতার কারণে আমরা আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতে পারি না, কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত হই না, সহজেই গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ি। ফলে আমাদের হৃদয় থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ত্যাগ স্বীকারের মূল স্পিরিট। আমাদের ঈমানী শক্তি খর্ব হওয়ার বিবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম হ’ল- আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকা, শারঈ জ্ঞান ও ঈমানী পরিবেশ থেকে দূরে থাকা, দুনিয়াদার ও গুনাহগারদের সাথে অধিক মেলামেশা, দুনিয়ার মোহ, উচ্চাকাংখা-বিলাসিতা ও ধন-সম্পদ নিয়ে মেতে থাকা প্রভৃতি।

সুতংরাং এই ঈমানী দুর্বলতা থেকে কটিয়ে ওঠার জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করা অতীব যরূরী। ঈমানকে তাযা রাখার প্রধানতম উপায় হ’ল-

(ক) আল্লাহর পরিচয় জানা : ঈমানের প্রবৃদ্ধি এবং মযবূতির শ্রেষ্ঠতম উপাদান হ’ল আল্লাহর পরিচয় জানা বা তাওহীদের জ্ঞান অর্জন করা। তাওহীদের জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসা, ভয়, তাওয়াক্কুল প্রভৃতি গুণাবলীতে হৃদয় পরিপূর্ণ হয়। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে’ (ফাত্বির ৩৫/২৮)। অর্থাৎ যারা আল্লাহর পরিচয় জানে, তারাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করে। ফলে তাদের ঈমান মযবূত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,لو عرف العبد كل شىء ولم يعرف ربه، فكأنه لم يعرف شيئا، ‘বান্দা যদি সবকিছুর জ্ঞান অর্জন করে, কিন্তু তার রবের পরিচয় না জানে, তাহ’লে সে যেন কোন জ্ঞানই অর্জন করেনি’।[1] যুন-নূন মিছরী (রহঃ) বলেন,مَنْ عَرَفَ رَبَّهُ وَجَدَ طَعْمَ الْعُبُودِيَّةِ وَلَذَّةَ الذِّكْرِ وَالطَّاعَةِ، ‘যে ব্যক্তি তার রবকে চিনতে পারল, সে আল্লাহর দাসত্ব, যিকির ও আনুগত্যের স্বাদ উপভোগ করতে পারল’।[2]

(খ) কুরআন তেলাওয়াত ও অনুধাবন করা : আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ- ‘মুমিন কেবল তারাই, যখন তাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করানো হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হ’ল- যখন সে কুরআন তেলাওয়াত করে এর মর্ম অনুধাবন করে, তখন তার হৃদয় ভীত-প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ফলে সে আল্লাহর নির্দেশসমূহ মান্য করে চলে এবং নিষেধ সমূহ বর্জন করে। তখন তার ঈমান বৃদ্ধি পায়, মযবূত হয় এবং সার্বিক জীবনে সে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়’।[3]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, إِذا أردْت الِانْتِفَاع بِالْقُرْآنِ فاجمع قَلْبك عِنْد تِلَاوَته وسماعه وأَلْقِ سَمعك واحضر حُضُور من يخاطبه بِهِ من تكلّم بِهِ سُبْحَانَهُ مِنْهُ إِلَيْهِ فانه خَاطب مِنْهُ لَك على لِسَان رَسُوله، ‘যদি তুমি কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হ’তে চাও, তাহ’লে কুরআন তেলাওয়াত ও শ্রবণের সময় গভীর মনোনিবেশ কর। নিবিষ্টচিত্তে কুরআন শ্রবণ কর এবং যিনি কুরআনে তোমাকে সম্বোধন করে তোমার সাথে কথা বলছেন, সেই সত্তার দরবারে তোমার উপস্থিতি অনুভব কর। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর যবানে কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ তোমাকেই সম্বোধন করেছেন’।[4] জাবের আল-জাযায়েরী (১৯২১-২০১৮খ্রি.) বলেন, ‘ঈমানকে শক্তিশালী করার জন্য গভীর অনুধাবনে কুরআন অনুধাবন করা আবশ্যক’।[5]

(গ) আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা : আল্লাহর সৃষ্টিকুল নিয়ে চিন্তা-গবেষণা একটি বড় ধরনের ইবাদত, যার মাধ্যমে ঈমান ও ইয়াক্বীন সুদৃঢ় হয়। আল্লাহ বলেন, إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ- ‘নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিবসের আগমন-নির্গমনে জ্ঞানীদের জন্য (আল্লাহর) নিদর্শন সমূহ রয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১৯০)। এই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,ويلٌ لمن قرأها ولم يتفكَّرْ فيها، ‘ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য, যে এই আয়াত পাঠ করে, অথচ তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না’।[6]

(ঘ) দ্রুত নেকীর কাজ সম্পাদন করা : ঈমান তাযা রাখার কার্যকরী উপায় হ’ল নেকীর কাজ দ্রুত সম্পাদন করে ফেলা। একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের বললেন, مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا؟ ‘আজ তোমাদের মধ্যে কে ছিয়াম পালন করেছ?’ আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আমি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟ ‘তোমাদের মধ্যে কে আজ জানাযার ছালাতে অংশগ্রহণ করেছ?’ আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আমি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا؟ ‘তোমাদের মধ্যে কে কোন মিসকীনকে আজ আহার করিয়েছ?’ আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আমি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا؟ ‘তোমাদের মধ্যে কে আজ একজন রোগীকে দেখতে গিয়েছে?’ আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আমি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যার মাঝে এই গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[7]

এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, আবূবকর (রাঃ) সময়কে এমনভাবে কাজে লাগাতেন যে, নেকীর কাজ করার কোন সুযোগকেই তিনি হাতছাড়া করতেন না। বরং সঙ্গে সঙ্গে তা দ্রুত সম্পাদন করে ফেলতেন। সালাফে ছালেহীনের অনেকের জীবনাচারে এ ধরনের আমল লক্ষ্য করা যায়। যেমন হাম্মাদ ইবনু সালামাহ (রহঃ)-এর ব্যাপারে ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন, যদি হাম্মাদ (রহঃ)-কে বলা হয় যে, আপনি আগামীকাল মৃত্যুবরণ করবেন; তাহ’লেও তার কোন আমল বৃদ্ধি করার প্রয়োজন পড়বে না।[8] রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, التُّؤَدَةُ فِي كُلِّ شَيْءٍ خَيْرٌ إِلَّا فِي عَمَلِ الْآخِرَةِ، ‘সকল কাজে ধীরতা অবলম্বন করা উত্তম, কিন্তু আখেরাতের আমল সম্পাদনের ক্ষেত্রে নয়’।[9]

(ঙ) মৃত্যুকে স্মরণ করা : বেশী বেশী মৃত্যুকে স্মরণ করার মধ্যমে ঈমান তাযা থাকে। ফলে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে দেহ-মন তৎপর থাকে। আবূ হামিদ আল-লাফ্ফাফ (রহঃ) (মৃ. ২৪০ হি.) বলেন, مَنْ أَكْثَرَ مِنْ ذِكْرِ الْمَوْتِ أُكْرِمَ بِثَلاثَةِ أَشْيَاء؛ تَعْجِيلِ التَّوْبَةِ وَقَنَاعَةِ الْقُوتِ وَنَشَاطِ الْعِبَادَةِ، ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করে, তাকে তিনভাবে সম্মানিত করা হয়: দ্রুত তওবা, অল্প জীবিকায় পরিতুষ্টি এবং ইবাদতের উদ্যমতা’।[10]

সুতরাং পাপ ও নিষিদ্ধ কাজ পরিহার করে নিজেকে সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত রাখা যরূরী। যাতে আমাদের ঈমান তাযা থাকে এবং আল্লাহর পথে যে কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য দেহ-মন সর্বদা প্রস্ত্তত থাকে।

২. সাহসী হওয়া :

আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য সৎ সাহস থাকা আবশ্যক। ভীরু-কাপুরুষেরা তাওহীদের কালেমা সাহসী কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারে না এবং সমাজের বুকে থেকে শিরক-বিদ‘আতের শিকড় উপড়াতে সক্ষম হয় না। যুগে যুগে সাহসী বীর মুজাহিদীনের মাধ্যমে ইসলাম বিজয়ী হয়েছে। সমাজের বুক থেকে অন্যায়-অবিচার অপসৃত হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন সাহসী পুরুষ। আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحْسَنَ النَّاسِ، وَأَشْجَعَ النَّاسِ، وَأَجْوَدَ النَّاسِ، ‘নবী (ছাঃ) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন এবং সর্বাপেক্ষা সাহসী ও দানশীল’।[11]

এমনকি তিনি ছাহাবায়ে কেরামের কাছ থেকে বায়‘আত নিয়েছেন এই মর্মে যে, তারা যেন হক কথা বলতে ভয় না পায় এবং জান্নাতের রাজপথে বীরদর্পে চলতে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে। উবাদাহ ইবনে ছামেত (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিকটে বায়‘আত গ্রহণ করেছিলাম। তন্মধ্যে অন্যতম বায়‘আত ছিল এই যে, أَنْ نَقُومَ أَوْ نَقُولَ بِالحَقِّ حَيْثُمَا كُنَّا، لاَ نَخَافُ فِي اللهِ لَوْمَةَ لاَئِمٍ، ‘আমরা যেখানেই থাকি না কেন হকের উপর সুদৃঢ় থাকব বা হক কথা বলব। আর আল্লাহর পথে চলতে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে আমরা পরওয়া করব না’।[12] সাহসিকতার ফযীলত বর্ণনা করে নবী (ছাঃ) বলেছেন,أَفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ عَدْلٍ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ، أَوْ أَمِيرٍ جَائِرٍ، ‘সর্বাপেক্ষা ফযীলতপূর্ণ জিহাদ হচ্ছে যালেম শাসক বা অত্যচারী নেতার সমানের ইনছাফপূর্ণ কথা বলা’।[13]

সেকারণ ছাহাবায়ে কেরাম ছিলেন সাহসিকতার মূর্ত প্রতীক। বদর, ওহোদ, খন্দক, খায়বার ও মুতার যুদ্ধে তারা যে সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বদর যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন ছাহবী বিশাল কাফের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে আদৌ পরওয়া করেননি। মুতার যুদ্ধে ৩০০০ মুসলিম সৈন্যের বিপরীতে ছিল ২ লাখ রোমক খ্রিষ্টান সৈন্যের বিশাল বাহিনী। মুসলিম বাহিনী প্রথমে একটু দুশ্চিন্তায় পড়লেও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ)-এর অগ্নিঝরা বক্তব্যে উদ্দীপ্ত হয়ে ছাহাবায়ে কেরাম শাহাদাতের তামান্নায় জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতঃপর আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দান করেন। এভাবে যুগ যুগান্তরে সাহসী, উদ্যমী ও নির্ভীক মানুষের মাধ্যমে আল্লাহ দ্বীন ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। মুসলমানদের এই সাহসিকতার মূল উৎস হ’ল তাদের ঈমানী শক্তি। কাফের-মুশরেকরা এই ঈমানী শক্তিকে সবচেয়ে বেশী ভয় পায়। কেননা মুসলমানদের কাছে সংখ্যার আধিক্য বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং দৃঢ় ঈমান, আত্মত্যাগের সৎসাহস ও আল্লাহর উপরে একান্ত নির্ভরশীলতাই তাদের বিজয়ের মূল হাতিয়ার। ড. সাঈদ আল-ক্বাহত্বানী (রহঃ) বলেন,من أعظم أسباب النصر: الاتصاف بالشجاعة والتضحية بالنفس والاعتقاد بأن الجهاد لا يقدم الموت ولا تؤخره؛ ‘(দ্বীনের পথে) বিজয় লাভের অন্যতম বড় মাধ্যম হ’ল সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের গুণে গুণান্বিত হওয়া এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখা যে, জিহাদ মৃত্যুকে পিছাতে বা আগাতে পারে না’।[14]

সুতরাং ভীরুতা ও কাপুরুষতা পরিহার করে সাহসিকতার গুণ অর্জন করা যরূরী। কেননা আল্লাহর পক্ষ থেকে আপতিত বিবিধ পরীক্ষা, জিহাদ ও ত্যাগ স্বীকারের পথে শয়তান সর্বদা মানুষকে ভীরুতার কানপড়া দেয়। শয়তানের এই কুমন্ত্রণাকে সাহসিকতার সাথে মুকাবিলা করতে হয়। কারণ শয়তানের প্ররোচনায় পিছিয়ে গেলেই ব্যর্থ হ’তে হয়। যেমন ইবরাহীম (আঃ) যখন তার প্রাণাধিক পুত্রকে যবেহ করতে উদ্যত হন, তখন শয়তান তাকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি সাহসী পদক্ষেপে শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন। ফলে আল্লাহর নামে স্বীয় পুত্রকে উৎসর্গ করে তিনি সফল হয়েছেন। সুতরাং বান্দা যদি কুফরী শক্তিকে ভয় না করে সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে, তাহ’লে সমাজ সংস্কার ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার তার জন্য সজহসাধ্য হবে ইনশাআল্লাহ।

৩. আখেরাতমুখী জীবন গঠন করা :

মানুষের জীবন যখন আখেরাতমুখী হয়, তখন সে জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে বেশী পসন্দ করে। ফলে সে আল্লাহর দ্বীনের জন্য যে কোন ঝুঁকি নিতে পারে এবং জান-মাল, সময়-শ্রম সবকিছু তাঁর পথে উৎসর্গ করতে কখনো পিছপা হয় না। ছাহাবায়ে কেরাম নির্যাতনের কষ্ট সহ্য করেছেন, শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, শেষতক জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, তথাপি দ্বীন ত্যাগ করেননি। যখন খোবায়েব (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তার উপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার। হত্যার জন্য তাকে শূলে চাড়ানো হ’লে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। বরং জান্নাতের আকাঙক্ষায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, তবু দ্বীন পরিত্যাগ করেননি। শূলে চড়ার আগে তিনি দশ লাইনের এক জ্বালাময়ী কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, যা তার তেজোদীপ্ত ঈমান ও আখেরাতমুখী জীবনের পরিচয় বহন করে। তন্মধ্যে দু’টি লাইন ছিল নিমণরূপ-

وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا * عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ فِي اللهِ مَصْرَعِي

وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ * يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ

‘আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোনো কিছুর পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন্ পার্শ্বে শোয়ানো হচ্ছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খন্ডিত টুকরা সমূহে বরকত দান করতে পারেন’।[15]

অনুরূপভাবে আছেম ইবনে ছাবেত, যায়েদ ইবনে দাছিনাহ, ইয়াসির পরিবারসহ প্রমুখ ছাহাবায়ে কেরাম ইসলামের জন্য নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন এবং শেষতক জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তবুও দ্বীনকে পরিত্যাগ করেননি। বরং ঈমানকে দেহ পিঞ্জরে স্বযত্নে আগলে রেখেছেন। তাদের এই ত্যাগের প্রেরণা ছিল একটাই, সেটা হ’ল পরকালে জান্নাত লাভের আকাঙক্ষা। ১৩ই নববী বর্ষে বায়‘আতে কুবরাতে মদীনা থেকে আগত ৭৫ জন ছাহাবী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের পর নিজেদের জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যার বিনিময়ে হ’লেও তাঁর নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রতি দেন। অতঃপর বলেন,فَمَا لَنَا بِذَلِكَ يَا رَسُولَ اللهِ إنْ نَحْنُ وَفَّيْنَا (بِذَلِكَ)؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমরা এই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করি, তবে এর বিনিময়ে আমাদের কি পুরস্কার রয়েছে?’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাত্র একটি শব্দ দিয়ে উত্তর দিয়ে বললেন, ‘জান্নাত’।[16] সেই জান্নাত লাভের উদগ্র বাসনা নিয়েই তারা শত যুলুম-নির্যাতনকে বুক পেতে সহ্য করেছেন, জান-মাল বাজি রেখে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছেন এবং নিজেদের সর্বস্ব তাঁর পথে বিলিয়ে দিয়েছেন। আমরাও যদি ছাহাবায়ে কেরামের মতো আমাদের জীবনকে আখেরাতমুখী করতে পারি, তাহলে দ্বীনের পথে যাবতীয় অপবাদ, নিন্দাবাদ ও অত্যাচার সহ্য করার অজেয় শক্তি লাভ করতে পারব। ইনশাআল্লাহ।

৪. দানের অভ্যাস গড়ে তোলা :

আল্লাহর পথে উৎসর্গ ও ত্যাগ স্বীকারের অন্যতম উৎকৃষ্ট উপায় হ’ল দান-ছাদাক্বাহ। মহান আল্লাহ জীবন উৎসর্গের আগে মাল উৎসর্গ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘আর তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে তোমাদের মাল দ্বারা ও জান দ্বারা। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানো’ (তাওবাহ ৯/৪১)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ، ‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর তোমাদের জান-মাল এবং যবান দ্বারা’।[17] শায়খ ইবনু বায (রহঃ) বলেন, সম্পদের মাধ্যমে জিহাদ করার উপকারিতা ব্যাপক। কেননা জিহাদের সরঞ্জামাদি কিনতে, মুজাহিদদের ভরণপোষণ নির্বাহে, খাদ্য-পানীয় কেনার জন্য এবং আল্লাহর পথের দাঈদের সেবার জন্য অর্থ-সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সুতরাং উপকারের দিক থেকে দ্বীনের জন্য অর্থ-সম্পদ বেশী উপকারী। তাই মহান আল্লাহ জীবন বিলিয়ে দেওয়ার আগে মাল উৎসর্গ করতে বলেছেন।[18]

সেজন্য রাসূল (ছাঃ) কোন জিহাদে অংশগ্রহণের আগে দান-ছাদাক্বাহর মাধ্যমে মাল উৎসর্গ করতে বলতেন। যেমন তাবূকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ جَهَّزَ جَيْشَ العُسْرَةِ فَلَهُ الجَنَّةُ، ‘যে বক্তি জায়শুল উসরাহ বা তাবূক যুদ্ধের প্রস্ত্ততির জন্য দান করবে, তার জন্য রয়েছে জান্নাত’।[19] জান্নাতের সুসংবাদ শুনে ছাহাবায়ে কেরাম দান-ছাদাক্বাহর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হ’লেন। ওমর (রাঃ) বলেন, তাবূক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সবাইকে ছাদাক্বার নির্দেশ দিলেন, তখন আমার নিকটে পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল। আমি মনে মনে বললাম, দানের প্রতিযোগিতায় আজ আমি আবুবকরের উপরে বিজয়ী হবে। তিনি বলেন, অতঃপর আমি আমার সমস্ত মালের অর্ধেক নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর খেদমতে হাযির হ’লাম। রাসূল (ছাঃ) বললেন, পরিবারের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছ? আমি বললাম, অনুরূপ পরিমাণ। এ সময় আবুবকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত মাল-সম্পদ নিয়ে হাযির হ’লেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আবুবকর! তোমার পরিবারের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছ? তিনি বললেন,أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ، ‘তাদের জন্য আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি’। ওমর বলেন, তখন আমি মনে মনে বললাম, আর আমি কখনোই তাঁর উপরে বিজয়ী হ’তে পারব না’।[20] অতঃপর অন্যান্য ছাহাবীগণও তাদের সাধ্যানুযায়ী দান করলেন। তাছাড়া গরীব-মিসকীন ও মানব সেবায় এবং দাওয়াতী কাজের জন্য দান-ছাদাক্বাহ করাও অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকারের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,مَن عَجَزَ عَنْ الْجِهَادِ بِبَدَنِهِ وَقَدَرَ عَلَى الجهاد بماله وجب الْجِهَادُ بِمَالِهِ، فَيَجِبُ عَلَى الْمُوسِرِينَ النَّفَقَةُ فِي سَبِيلِ اللهِ، ‘যে ব্যক্তি স্বশরীরে জিহাদে যেতে অপারগ, কিন্তু মালের মাধ্যমে জিহাদ করতে সক্ষম, তাহ’লে তার উপর মালের জিহাদ ওয়াজিব। সুতরাং ধনীদের অবশ্য কর্তব্য হ’ল আল্লাহর পথে দান-ছাদাক্বাহ করা’।[21]

৫. শিশু-কিশোরদের মননে ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা তৈরী করা :

প্রত্যেক শিশু ফিৎরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। শিশুকালে তার মন-মগয নানামুখী চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, ইচ্ছাশক্তি প্রভৃতির চাষাবাদের জন্য উর্বর থাকে। সেকারণ শৈশবে যদি তার উর্বর মননে কোন অভ্যাস বা চেতনার বীজ বপন করা হয়, তাহ’লে এর উপরেই তার জীবন গড়ে ওঠে। এজন্য ছাহাবায়ে কেরাম তাদের সন্তানদেরকে শৈশব থেকেই দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারের জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তাদেরকে নিয়ে মসজিদে যেতেন। আবার কখনো জিহাদের ময়দানে নিয়ে যেতেন। উৎসাহ দিয়ে ছিয়াম রাখাতেন। মহিলা ছাহাবীরাও তাদের শিশু সন্তানকে দ্বীন পালনের প্রশিক্ষণ দিতেন। যেমন মহিলা ছাহাবী রুবাই বিনতে মু‘আওবিয (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) আশুরার দিন ভোরে আনছারদের বসতিতে লোক পাঠিয়ে ঘোষণা দেওয়ান যে,مَنْ أَصْبَحَ مُفْطِرًا، فَلْيُتِمَّ بَقِيَّةَ يَوْمِهِ، وَمَنْ أَصْبَحَ صَائِمًا، فَليَصُمْ، ‘সকালে যে খেয়ে নিয়েছে সে যেন বাকি দিন না খেয়ে কাটায়, আর যে ছিয়াম পালনের অবস্থায় সকাল করেছে সে যেন ছিয়াম সম্পন্ন করে’।

বর্ণনাকারিণী বলেন,فَكُنَّا نَصُومُهُ بَعْدُ، وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا، وَنَجْعَلُ لَهُمُ اللُّعْبَةَ مِنَ العِهْنِ، فَإِذَا بَكَى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهُ ذَاكَ حَتَّى يَكُونَ عِنْدَ الإِفْطَارِ، ‘এই ঘোষণা শুনে আমরা পরবর্তী সময়টুকু ছিয়ামে কাটালাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও ছিয়াম রাখালাম। তাদের জন্য আমরা এক প্রকার পশমী খেলনা যোগাড় করে রাখলাম। যখন তাদের কেউ খাবারের জন্য কেঁদে উঠছিল, তখনই আমরা তাদের সামনে ঐ খেলনা এগিয়ে দিচ্ছিলাম। ইফতার পর্যন্ত তারা এভাবেই পার করছিল’।[22] আল্লাহর ইবাদতের জন্য সন্তানদের প্রশিক্ষিত করতে ছাহাবীদের প্রচেষ্টা যে ছিল অন্তহীন তা উপরোক্ত হাদীছ থেকে সহজেই অনুমেয়।

বিশিষ্ট তাবে‘ঈ ছিলাহ ইবনে আশইয়াম (মৃ. ৮৩ হি.) তাঁর পুত্রকে সাথে নিয়ে এক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে স্বীয় পুত্রকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে প্রিয় পুত্র! তুমি এগিয়ে যাও এবং লড়াই করে শহীদ হও, যাতে আমি তোমাকে আল্লাহর সামনে পেশ করতে পারি’। তার পুত্র অস্ত্র ধারণ করলেন এবং লড়াই করে শহীদ হ’লেন। এরপর ছিলাহ ইবনে আশইয়াম (রহঃ) এগিয়ে গেলেন। তিনিও যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। যুদ্ধ শেষে অন্যান্য মহিলারা ছিলাহ (রহঃ)-এর স্ত্রী মু‘আযাত আল-‘আদাবিইয়াহ (রহঃ)-কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার কাছে সমবেত হ’লেন। তিনি আগত মহিলাদের উদ্দেশ্যে বললেন, مَرْحَبًا إِنْ كُنْتُنَّ لِتُهَنِّيَنِّي فَمَرْحَبًا، وَإِنْ كُنْتُنَّ جِئْتُنَّ لِغَيْرِ ذَلِكَ فَارْجِعْنَ، ‘যদি আপনারা আমাকে অভিনন্দন জানাতে আসেন, তাহ’লে আমি আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আর যদি অন্য কোন উদ্দেশ্যে এসে থাকেন, তাহ’লে চলে যেতে পারেন’।[23]

এখানে আরেকজন শিশুর কথাও উল্লেখযোগ্য। শৈশবেই যার পিতা মারা যান। পিতৃহীন শিশুকে মমতাময়ী মা পরম আদরে দ্বীনের পথে গড়ে তোলেন। কনকনে শীতের রাতে ফজরের জামা‘আতে হাযির হওয়ার জন্য শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে মসজিদে যেতেন মা। ছেলেকে জামা‘আতে শামিলে করিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করতেন। অতঃপর ছালাত শেষে ছেলেকে কোলে নিয়ে আবার বাসায় ফিরতেন। সেই ইয়াতীম শিশুটি ছিলেন ভারত উপমহাদেশের আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম অগ্র সেনানী নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী। রাজনৈতিক ও ইলমী ময়দানে তিনি সমানতালে ইসলামের নির্মল জ্যোতি বিকিরণ করেছেন। সুতরাং আমরাও যদি আমদের সন্তান-সন্ততিকে ভোগবাদে অভ্যস্ত না করে শৈশব থেকেই দ্বীনের পথে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারি, তাহ’লে এরাই ভবিষ্যতে জাতির কান্ডারী হবে। ত্যাগের মশাল জ্বেলে দেশ ও জাতিকে বিশুদ্ধ ইসলামের পথে পরিচালিত করবে।

৬. ধৈর্যশীল হওয়া :

দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারের জন্য ধৈর্যশীলতার কোন বিকল্প নেই। ধৈর্যের মাধ্যমে বান্দার দ্বীন ও ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। কেননা আল্লাহর আনুগত্য, পাপ থেকে বিরত থাকা, বাতিলের আঘাত সহ্য করা, বিপদাপদে তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্টিসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বান্দাকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। এই ধৈর্যের সোপান পেরিয়ে বান্দা দোজাহানে সফলতার মনযিলে পৌঁছে। আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন,أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ- ‘তোমরা কি ভেবেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জেনে নেননি কারা তোমাদের মধ্যে জিহাদ করেছে এবং কারা তোমাদের মধ্যে ধৈর্যশীল?’ (আলে ইমরান ৩/১৪২)। অর্থাৎ জান্নাত পেতে হ’লে জিহাদ ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতেই হবে। যেমনভাবে যুগে যুগে নবী-রাসূল ও নেককার বান্দাদের কাছ থেকে আল্লাহ ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন। তাদের কাউকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে, কাউকে লোহার করাত দিয়ে কেটে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে, কাউকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে, অপবাদ ও গালি দেওয়া হয়েছে, কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে, তথাপি তারা দ্বীন থেকে এক বিন্দু সরে আসেননি।

খাববাব ইবনুল আরাত (রাঃ) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তার উপর নেমে আসে লোমহর্ষক নির্যাতন। জ্বলন্ত লোহার উপরে চিৎ করে শুইয়ে তার বুকের উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছিল। ফলে পিঠের চামড়া ও গোশত গলে লোহার আগুন নিভে গিয়েছিল। বারবার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গমন করেন। তখন তিনি কা‘বা চত্বরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করার জন্য আকুলভাবে দাবী করেন। তখন ঘুম থেকে উঠে রাগতঃস্বরে রাসূল (ছাঃ) তাকে দ্বীনের জন্য বিগত উম্মতগণের কঠিন নির্যাতন ভোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বলেন,

كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِى الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ، فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ، مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلاَّ اللهَ أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ.

‘তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহের লোকদের দ্বীনের কারণে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। অতঃপর তাতে নিক্ষেপ করে তাদের মাথার মাঝখানে করাত রেখে দেহকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। তথাপি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। লোহার চিরুনী দিয়ে গোশত ও শিরাসমূহ হাড্ডি থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে। তথাপি এগুলি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তিনি এই ইসলামী শাসনকে এমনভাবে পূর্ণতা দান করবেন যে, একজন আরোহী (ইয়ামনের রাজধানী) ছান‘আ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। অথচ সে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবে না। অথবা তার ছাগপালের উপরে নেকড়ের ভয় করবে। কিন্তু তোমরা বড্ড তাড়াহুড়া করছ’।[24] রাসূল (ছাঃ)-এর মুখ থেকে এই হাদীছ শোনার পরে তার ঈমান ও ধৈর্যশক্তি আরও বৃদ্ধি পায়।

অপরদিকে ইয়াসির ইবনে মালিক, তার স্ত্রী সুমাইয়া এবং পুত্র আম্মার যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন বনু মাখযূম গোত্রের নেতা আবূ জাহ্লের নির্দেশে তাদেরকে খোলা ময়দানে উত্তপ্ত বালুকার উপর শুইয়ে দিয়ে প্রতিদিন নির্যাতন করা হ’ত। একদিন চলার পথে তাদের শাস্তির দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, صَبْراً آل يَاسِر! فَإنَّ مَوْعِدَكُمُ الجَنّةُ، ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা তো জান্নাত’। অবশেষে ইয়াসিরকে কঠিন নির্যাতনের মাধ্যমে হত্য করা হয়। অতঃপর পাষাণহৃদয় আবু জাহ্ল নিজ হাতে ইয়াসিরের বৃদ্ধা স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্য করে। তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ।[25]

খোবায়েব (রাঃ)-কে যখন শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়, তখন তিনি যে ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা অকল্পনীয়। সাঈদ ইবনে আমের (রাঃ) খোবায়েবের হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তিনি উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের হত্যার দৃশ্য স্মরণ হ’লে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে তিনি কতবড় ধৈর্যশীল ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি।[26] অনুরূপভাবে বেলাল (রাঃ)-এর উপরেও চালানো হয়েছিল পাশবিক নির্যাতন। এভাবে যুগে যুগে যারাই আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করেছে, কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরেছে, তাদেরকে চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে।

সুতরাং দ্বীনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বিশ্ব ইতিহাসের কোন যুগেই জান্নাতের পথ মসৃণ ছিল না; আজো নেই। তাই এ পথে চলতে গেল কাঁটার আঘাত সহ্য করতে হবে। ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে ধৈর্যশক্তি সঞ্চয় করে অবিরামভাবে লড়তে হবে শয়তানী অপশক্তির বিরুদ্ধে। তবেই তো জান্নাত ধরা দিবে।

৭. সবকিছুর উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসাকে প্রাধান্য দেওয়া :

পৃথিবীর সকল ভালবাসার উপরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা অগ্রগণ্য। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলে প্রতি ঈমান যার যত মযবূত, তার ভালবাসার দাবী তাকে তত বেশী ত্যাগ স্বীকার করতে প্রণোদিত করে। দুনিয়ার সব কিছুর উপরে আল্লাহর ভালবাসাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে মুমিন বান্দা ত্যাগের সর্বোচ্চ চূড়ায় উপনীত হ’তে পারে। অপরদিকে রাসূল (ছাঃ)-এর ভালবাসাকে সকল কিছুর উপরে প্রাধান্য না দেওয়া পর্যন্ত কোন বান্দা ঈমানদার হ’তে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ، ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সকল মানুষের চেয়ে প্রিয়তর হব’।[27] ওমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই আপনি আমার নিকট সকল কিছুর চাইতে প্রিয় কেবল আমার প্রাণ ব্যতীত। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, না। কখনোই না। যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, যতক্ষণ না আমি তোমার নিকট অধিক প্রিয় হব তোমার প্রাণের চাইতে। অতঃপর ওমর তাঁকে বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহর কসম! অবশ্যই আপনি আমার নিকট আমার প্রাণের চাইতে প্রিয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, الآنَ يَا عُمَرُ ‘এখন তোমার পূর্ণ হল হে ওমর!’।[28] আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ছাহাবায়ে কেরামের এই অকৃত্রিম ভালবাসার কারণেই তারা দ্বীনের জন্য সর্বস্ব বিলিতে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ওহোদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কাফিরদের বেষ্টনীতে পড়েন, তখন সেই সংকটকালীন মুহূর্তে নিঃসঙ্গ রাসূলকে বাঁচানোর জন্য ছাহাবায়ে কেরাম যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, তা ইতিহাসে অতুলনীয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হওয়ার পর আবু দুজানা, মুছ‘আব ইবনে ওমায়ের, আলী ইবনে আবী ত্বালেব, সাহ্ল ইবনে হুনায়েফ, ওমর ইবনুল খাত্তাব, সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ, ত্বালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে লড়াই অব্যাহত রাখেন। সেই মুহূর্তে ত্বালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রাঃ)-এর ত্যাগ ছিল অবিস্মরণীয়। যিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বাঁচানোর জন্য নিজেকে ঢাল বানিয়েছিলেন এবং ৩৯টি আঘাতে জর্জরিত হয়েছিলেন, তথাপি রাসূল (ছাঃ)-কে একা ছাড়েননি। এমনকি পাহাড়ের ঘাঁটিতে ফেরার পথে যখন টিলা পড়ে যায়, তখন রাসূল (ছাঃ) চেষ্টা করেও এর উপর উঠতে পাচ্ছিলেন না, তখন আঘাতে জর্জরিত উৎসর্গিত প্রাণ ত্বালহা (রাঃ) মাটিসে বসে রাসূল (ছাঃ)-কে কাঁধে উঠিয়ে নেন। অতঃপর টিলার উপরে যান। এতে রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেন, أَوْجَبَ طَلْحَةُ أَيِ الجَنَّةَ، ‘ত্বালহা জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিল’।[29]

বীরে মা‘উনার মর্মান্তিক ঘটনায় যায়েদ বিন দাছেনাহ (রাঃ)-কে হত্যার পূর্বে আবু সুফিয়ান যখন তাকে বললেন, তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে হত্যা করি এবং তুমি তোমার পরিবার সহ বেঁচে থাক? তখন তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন, لَا وَاللهِ الْعَظِيمِ مَا أُحِبُّ أَنْ يَفْدِيَنِي بِشَوْكَةٍ يُشَاكَهَا فِي قَدَمِهِ، ‘কখনোই না। মহান আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে তাঁর পায়ে একটি কাঁটারও আঘাত লাগুক’।[30] মুহাম্মাদ সাঈদ আল-বূত্বী (রহঃ) বলেন, إذا تأملنا في جواب زيد بن الدثنة لأبي سفيان، قبيل قتله، علمنا مدى المحبة التي كانت تنطوي عليها أفئدة الصحابة لرسولهم صلّى الله عليه وسلم، ولا ريب أن هذه المحبة من أهم الأسباب التي حببت إلى قلوبهم كل تضحية وبذل في سبيل دين الله تعالى والدفاع عن رسوله، ‘নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তে আবু সুফিয়ানের প্রত্যুত্তরে যায়েদ বিন দাছেনাহ (রাঃ)-এর জবাব নিয়ে যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করি, তাহ’লে বুঝতে পারব যে, ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি কতটা গভীর ভালবাসা পোষণ করতেন। নিঃসন্দেহে এই নিখাঁদ ভালবাসার কারণেই আল্লাহর দ্বীনের পথে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতিরক্ষার জন্য সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করা তাদের কাঙিক্ষত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল’।[31]

৮. ত্যাগী ও দ্বীনদার মানুষের সাহচর্যে থাকা :

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে চলতে গেলে তাকে অপর মানুষের সাথে চলাফেরা ও ওঠা-বসা করতে হয়। যার সাথে বেশী ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়, তার মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়া প্রত্যের মানুষের একটি স্বাভাবিক বিষয়। সেজন্য ইসলাম মানুষকে সবসময় নেককার মানুষের সাথে মিশতে উৎসাহিত করেছে। কারণ সে যদি দ্বীনদার, পরহেযগার, ইবাদতগুযার ও আল্লাহর ত্যাগী বান্দাদের সাহচর্যে আসে, তাহ’লে সেই সৎগুণাবলীর মাধ্যমে সে প্রভাবিত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَثَلُ الجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالسَّوْءِ، كَحَامِلِ الـمِسْكِ وَنَافِخِ الكِيرِ، فَحَامِلُ الـمِسْكِ: إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً، وَنَافِخُ الكِيرِ: إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ رِيحًا خَبِيثَةً، ‘সৎসঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হ’ল একজন আতর বহনকারী ও একজন কামারের মত। আতর বহনকারী হয়ত তোমাকে আতর দেবে, না হয় তুমি তার থেকে (আতর) ক্রয় করবে, অথবা কম পক্ষে তুমি তার থেকে সুঘ্রাণ পাবে। আর কামার, সে হয় তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে অথবা তুমি তার থেকে দুর্গন্ধ অনুভব করবে’।[32]

সুতরাং যারা ইবাদত-বন্দেগী, দান-ছাদাক্বাহ, দাওয়াত-জিহাদ এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আত্মত্যাগী, তাদের সংস্পর্শ ও সাহচর্যে যদি আমরা আসতে পারি, তাহ’লে আমরাও তাদের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হ’তে পারব এবং আল্লাহর দ্বীনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারব।

৯. নিজের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া :

ত্যাগের একটি বড় ক্ষেত্র হ’ল নিজের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। নিজের পসন্দনীয় বিষয় অপরের জন্য বরাদ্দ রাখা, অভাব থাকা সত্ত্বেও দান-ছাদাক্বাহ করা, নিজের চেয়ে অপর মানুষের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রভৃতি গুণাবলী ত্যাগ স্বীকারের অনন্য উদাহরণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন সেই ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। একবার এক মহিলা রাসূল (ছাঃ)-কে নিজ হাতে বুনানো একটি চাদর উপহার দেন। রাসূল (ছাঃ) উপহারটি গ্রহণ করেন এবং এটা তাঁর প্রয়োজনও ছিল। তিনি চাদরটি পরিধান করে ছাহাবীদের কাছে আসেন। অতঃপর ছাহাবীদের একজন সেই চাদরটি তাঁর কাছে চেয়ে বসেন। তখন তিনি চাদরটি খুলে সেই ছাহাবীকে দিয়ে দেন।[33] ছাহাবায়ে কেরামও সবসময় অপর ভাইয়ের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন। যখন মুহাজির ছাহাবীগণ মদীনায় হিজরত করে আসেন, তখন আনছার ছাহাবীগণ ত্যাগের যে নযীর স্থাপন করেছেন, বিশ্ব ইতিহাসে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মেহমানকে আপ্যায়ন করতে গিয়ে আবু ত্বালহা (রাঃ) এবং তার স্ত্রী উম্মে মিলহান (রাঃ) যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, হাদীছের সোনালী পাতায় তা আজো জ্বলজ্বল করছে। মহান আল্লাহ এই ত্যাগী আনছারদের প্রশংসা করে বলেন, وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ، ‘যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করে না। আর তারা নিজেরা অভাবগ্রস্থ হ’লেও নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)

নিজের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার দানের দৃষ্টান্ত ছাহাবী ও তাবেঈদের জীবনে বহু রয়েছে। আবুল জাহম বিন হুযায়ফা আল-‘আদাভী আল-কুরায়শী বলেন, ইয়ারমূকের দিন আমি আমার চাচাতো ভাইকে খুঁজতে লাগলাম। তখন আমার সাথে সামান্য পানি ছিল। আমি মনে মনে বললাম, যদি আমি তাকে প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থায় পাই, তাহ’লে এই পানিটুকু তাকে দেব। অতঃপর আমি তাকে পেয়ে গেলাম ও বললাম, তোমাকে কি পানি দেব? সে ইঙ্গিতে বলল, দাও। এমন সময় পাশ থেকে একজনের আহ্ আহ্ শব্দ কানে এল। তখন ভাইটি আমাকে ইশারায় বলল, ওর কাছে যাও। গিয়ে দেখলাম তিনি হিশাম ইবনুল ‘আছ। বললাম, পানি দেব? ইশারায় বললেন, দাও। এমন সময় পাশ থেকে আহ্ আহ্ শব্দ কানে এল। তখন হিশাম ইশারায় বললেন, ওর কাছে যাও। আমি তার কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি মারা গেছেন। পরে হিশামের কাছে এসে দেখলাম তিনি মারা গেছেন। তখন আমার চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফিরে এলাম। দেখলাম সেও মারা গেছে।[34] মৃত্যুর আগ মুহূর্তে নিজের উপর অপর ভাইয়ের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার এমন ইতিহাস শুধু মুসলিমদেরই রয়েছে। কেননা দয়ার নবী তাদের শিক্ষা দিয়েছেন, وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا يُؤمن أحد حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ، ‘সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, কোন ব্যক্তি ঈমানদার হ’তে পারবে না যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পসন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে’।[35]

১০. আল্লাহর ত্যাগী বান্দাদের জীবনী অধ্যয়ন করা :

আত্মত্যাগের মানসিক শক্তি সঞ্চয়ের অন্যতম বড় উপায় হ’ল নবী-রাসূল ও সালাফে ছালেহীনের ত্যাগপূত ইতিহাস অধ্যয়ন করা। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে পূর্ববতী নবীদের কষ্ট-ক্লেষ ও যুলুম-নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করে তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন, فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ ‘অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর, যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ’ (আহক্বাফ ৪৬/৩০)। তিনি মূসা (আঃ)-এর কষ্টের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَاقَوْمِ لِمَ تُؤْذُونَنِي وَقَدْ تَعْلَمُونَ أَنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ، ‘স্মরণ কর, যখন মূসা তার কওমকে বলেছিল, হে আমার কওম! তোমরা কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছ? অথচ তোমরা জানো যে, আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’ (ছফ ৬১/৫)

মূলত এই বর্ণনাগুলোর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোন নবীর যুগেই দ্বীনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ ও মসৃণ ছিল না। বরং দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে তারা ভীষণ কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন। সুতরাং যুগ যুগান্তরে যারাই আল্লাহর পথের পথিক হবে, তাদের উপরেও নেমে আসবে নির্যাতনের খড়গ। কোন মুমিন বান্দা যখন নবী-রাসূল ও সালাফদের সেই ত্যাগপূত জীবনী ও ইতিহাস অধ্যয়ন করবে, তখন তার হৃদয়জগৎ দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারে প্রস্ত্তত হবে। এজন্য ছাহাবায়ে কেরামও পূর্ববর্তী মনীষীদের জীবনালেখ্য দিয়ে মানুষকে উপদেশ দিতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, তামীম আদ-দারী (রাঃ) ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলের কাহিনী লোকদের শুনিয়ে উপদেশ দিতেন। মুগীরা বিন মিক্বসাম (রহঃ) বলেন, كَانَ الْحَسَنُ يَقُصُّ، وَكَانَ سَعِيدُ بْنُ جُبَيْرٍ يَفِصُّ ‘হাসান বাছরী শিক্ষামূলক গল্প বলতেন, আর সাঈদ ইবনে জুবায়ের ফঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন’।[36]

উপসংহার :

পৃথিবীর ইতিহাসে কোন যুগেই জান্নাতের পথ সহজ ছিল না। এ পথ বড়ই কণ্টকাকীর্ণ ও পিচ্ছিল। যারা এ পথের অভিযাত্রী হয়, তাদেরকে প্রতি পদে পদে বিপদ-মুছীবত ও কষ্ট-ক্লেষের সম্মুখীন হ’তে হয়। কিন্তু যারা ত্যাগ ও ধৈর্যের বর্মে আচ্ছাদিত এ পথ পাড়ি দিতে পারে, দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা তাদেরই পদচুম্বন করে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর নবী-রাসূলদের পথে পরিচালিত করুন। দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারের জন্য মানসিক, শারীরিক ও ধৈর্যশক্তি দান করুন এবং এই ত্যাগের মাধ্যমে জীবনের সকল পাপ ক্ষমা করে নিয়ে জান্নাতুল ফেরদাঊসে প্রবেশের তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!

আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ

 এম.এ (অধ্যয়নরত) আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, তাবি) ১/৮৬।

[2]. বায়হাক্বী, আয-যুহদুল কাবীর, পৃ. ১১১।

[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/১১।

[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত: দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ২য় মুদ্রণ, ১৩৯৩হি./১৯৭৩খ্রি.), পৃ. ৩।

[5]. আবূ বকর জাবের আল-জাযায়েরী, আয়সারুত তাফাসীর ১/৫১৬।

[6]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬২০; সিলসিলা ছহীহা হা/৬৮; সনদ ছহীহ।

[7]. ছহীহ মুসলিম হা/১০২৮।

[8]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/৪৪৭।

[9]. মুসনাদে আবী ইয়া‘লা হা/৭৯২; সিলসিলা ছহীহা হা/১৭৯৪; সনদ ছহীহ।

[10]. সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ৪১।

[11]. বুখারী হা/২৮২০; তিরমিযী হা/১৬৮৭; মিশকাত হা/৫৮০৪১।

[12]. বুখারী হা/৭২০০; মুসলিম হা/১৭০৯; নাসঈ হা/৪১৫৪; ইবনু মাজাহ হা/২৮৬৬।

[13]. আবূদাঊদ হা/৪২৯৩; তিরমিযী হা/২১৭৪; ইবনু মাজাহ হা/৪০১২; মিশকাত হা/৩৭০৫; সনদ ছহীহ্।

[14]. ড. সাঈদ আল-ক্বাহত্বানী, আল-হিক্মাহ ফিদ-দাওয়াহ ইলাল্লাহ (সঊদী আরব : ওয়ারাতুশ শুঊন আল-ইসলামিইয়াহ, প্রথম প্রকাশ, ১৪২৩হি.) ২/৫৩৮।

[15]. বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯; মুসনাদে আহমাদ হা/৮০৯৬।

[16]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবিইয়াহ, তাহক্বীক্ব : মুছত্বফা সাক্বা ও অন্যান্যগণ, (বৈরূত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/৪৪৬।

[17]. আবূদাঊদ হা/২৫০৪; মিশকাত হা/৩৮২১; সনদ ছহীহ।

[18]. ইবনু বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৭/৩৩৮।

[19]. বুখারী হা/২৭৭৮; দারাকুৎনী হা/৪৪৪৭ ।

[20]. তিরমিযী হা/৩৬৭৫; আবূদাঊদ হা/১৬৭৮; মিশকাত হা/৬০২১; সনদ হাসান।

[21]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ইখতিয়ারাতুল ফিক্বহিইয়াহ, পৃ. ৬০৭।

[22]. বুখারী হা/১৯৬০; মুসলিম হা/১১৩৬।

[23]. আহমাদ ইবনে হাম্বল, কিতাবুয যুহ্দ, হাশিয়া : মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম শাহীন (বৈরূত: দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১ম মুদ্রণ, ১৪২০হি./১৯৯৯খ্রি.) পৃ. ১৭০।

[24]. বুখারী হা/৩৬১২, ৬৯৪৩; মিশকাত হা/৫৮৫৮।

[25]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) (রাজশাহী: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারী ২০১৬ খ্রি.) পৃ. ১৪২।

[26]. সীরাত ইবনে হিশাম ২/১২৭; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ৩৯৪।

[27]. বুখারী হা/১৫; মুসলিম হা/৪৪; মিশকাত হা/৭।

[28]. বুখারী হা/৬৬৩২; আহমাদ হা/১৮০৭৬।

[29]. তিরমিযী হা/৩৭৩৮; আহামাদ হা/১৪১৭; মিশকাত হা/৬১১২; সনদ হাসান।

[30]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/৬৬; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ. ৩৯২-৩৯৩।

[31]. মুহাম্মাদ সাঈদ রামাযান আল-বূত্বী, ফিক্বহুস সীরাতিন নাবাবিইয়াহ (দামেশক: দারুল ফিক্র, ২৫তম মুদ্রণ, ১৪২৬হি.) পৃ. ১৮৯।

[32]. বুখারী হা/ ৫৫৩৪; মুসলিম হা/২৬২৮; মিশকাত হা/৫০১০।

[33]. বুখারী হা/২০৯৩।

[34]. বায়হাক্বী শু‘আব হা/৩৪৮৩; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৯৬৯১, ৭/৭২; ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণিত ‘তাফসীরুল কুরআন ২৬-২৮ পারা’ পৃ. ৪০৯-৪১০ দ্রষ্টব্য।

[35]. বুখারী হা/১৩; মসলিম হা/৪৫; মিশকাত হা/ ৪৯৬১।

[36]. আহমাদ ইবনে হাম্বল, কিতাবুয যুহ্দ, পৃ. ১৭৫।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও
আরও
.