পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম সাধনা :

ইসলামী বিধানে ছিয়াম শুধু উপবাসের নাম নয়; বরং এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আরো ব্যাপক, আরো গভীর, আরো সুদূরপ্রসারী। ছিয়াম সাধনার শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক তথা বিভিন্নমুখী দিক রয়েছে। এর সবগুলোই এখানে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিভিন্নমুখী গুরুত্বই ছিয়াম সাধনাকে করে তুলেছে পবিত্রতম ও মহীয়ান।

আল্লাহ তা‘আলা রামাযান মাসের ছিয়াম সাধনাকে ফরয করেছেন (বাক্বারাহ ২/১৮৩)। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ صَامَ يَوْمًا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ بَعَّدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِيْنَ خَرِيْفًا، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ছিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার মুখমন্ডলকে জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে রাখবেন’।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা আসমান ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের সমান দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন।[2]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার ছিয়াম পালন করতেন।[3] কেননা এ দু’দিন বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়।[4] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে ছিয়াম পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।[5] তিনি শাওয়ালের ছয়টি ছিয়াম,[6] আশূরার ১টি বা ২টি ছিয়াম[7] এবং আরাফাহ দিবসের একটি ছিয়াম পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।[8] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,فِى الْجَنَّةِ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابٍ، فِيْهَا بَابٌ يُسَمَّى الرَّيَّانَ لاَ يَدْخُلُهُ إِلاَّ الصَّائِمُوْنَ، ‘জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। তার একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। ছায়েম ব্যতীত ঐ দরজা দিয়ে কেউ প্রবেশ করবে না।[9]

ছিয়াম শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যমই নয়। বরং এর স্বাস্থ্যগত অনেক উপকারিতা রয়েছে। যা নিম্নরূপ :

চিকিৎসা শাস্ত্রবিদগণের সনিষ্ঠ বিবেচনামতে অতিভোজন, সার্বক্ষণিক কিংবা খাওয়া-দাওয়ায় প্রায়শঃ ব্যস্ত থাকা অথবা অন্যান্য দোষক্রিয়ার ফলে কতকগুলো সমস্যার সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাতে দেহযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ খাদ্য গ্রহণোত্তরকালে সঠিক ও নির্ভুলভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এ সময় সৃষ্ট উপসর্গগুলো দূরীভূত করে দেয়ার জন্যে যদি ঔষধের ব্যবহার হয়, তাহ’লে উপসর্গগুলো ক্রমশঃ চাপা পড়ে যেতে থাকে; পরিণতিতে বিষাক্ত উপাদান পুঞ্জীভূত হ’তে থাকে শরীরের মধ্যে। শরীরের মধ্যকার এই বিষাক্ত উপাদানগুলো দ্রুত ও সত্বর দূরীভূত করে দেয়ার জন্যে সবচেয়ে মোক্ষম উপায় হ’ল ছিয়াম পালন। এতে বিশেষতঃ তিনটি সুফল পাওয়া যায়।

(ক) খাদ্য গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, খাদ্য গ্রহণের ফলেই দেহে অধিকতর পরিমাণ বিষাক্ত উপাদান সৃষ্টি হয়ে থাকে।

(খ) দেহে খাদ্যবস্ত্ত মওজূদ না থাকাতে দেহের পরিপাকযন্ত্র দেহ থেকে বিষাক্ত উপাদানগুলো দূরীভূত করে দেয়ার সুযোগ করে নিতে পারে। কারণ মুখে অধিক সময় কিংবা সব সময় খাদ্যবস্ত্ত বিদ্যমান থাকলে রোগ-জীবাণুর জন্যে তা মোক্ষম সুতিকাগারে পরিণত হয়। কারণ প্রতিটি মানুষের আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ রোগ-জীবাণু। মুখ পরিষ্কার থাকলে এই জীবাণু আর মানবদেহে লালিত-পালিত হবার সুযোগ পায় না। কিন্তু যে মুখ সবসময় আহার্যবস্ত্ত নাড়াতেই ব্যস্ত থাকে, সে মুখ রোগ-জীবাণুর লালনক্ষেত্রে পরিণত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। মুখ থেকে এই জীবাণুগুলো ছড়িয়ে পড়ে দেহের বিভিন্ন অংশে। এভাবে নাক, কান, গলা ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের উপসর্গে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে হয় মানুষকে। এসব অসুস্থতার আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষার লক্ষ্যে ছিয়াম নিশ্চিতভাবেই উত্তম প্রক্রিয়া। পর্যবেক্ষণের ফলে দেখা গেছে, তুলনামূলক ভাবে রোগাক্রান্তের সংখ্যা রামাযান মাসে খুবই কম।

(গ) পুরো দেহযন্ত্রটিই তার সর্বাত্মক শক্তি সংহত করে বিষ নিবারণে নিয়োজিত হ’তে পারে এবং শরীরের সমস্ত স্বাস্থ্যপ্রদ শক্তিকে সে সংঘবদ্ধভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলার্থে দৃঢ় ও নিশ্চিতরূপে তৈরী করিয়ে নেবার সুযোগ পায়। স্মর্তব্য, খাদ্য হজম ও গ্রহণে প্রচুর শক্তিমত্তা ব্যয়িত হয়ে থাকে। দেহে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবার পর এই শক্তিমত্তা অবকাশ পেয়ে দেহের বিভিন্ন অংশের পরিষ্করণ ও অন্যান্য দিককার দেখাশোনায় তৎপর হবার সুযোগ পায়।

উপবাস থাকলে দেহ হাল্কা ও উদ্যমী হয়ে ওঠে। খাদ্য গ্রহণ ও হজমীকরণে পরিপাকযন্ত্রের তৎপরতা না থাকায় দেহযন্ত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। এ সুযোগে দেহে প্রচুর পরিমাণে শক্তিমত্তা ও স্বতঃস্ফূর্ততা পুঞ্জীভূত হয়।

ছিয়াম হচ্ছে সুস্বাস্থ্যের জন্যে একটি শক্তিশালী অস্ত্র। বুদ্ধিমত্তার সাথে এর প্রয়োগ হ’লে এ থেকে বিস্ময়কর ফল পাওয়া যেতে পারে।[10]

পন্ডিতগণ বলেছেন, Empty stomach is the prower house of knowlege. ‘ক্ষুধার্ত উদর জ্ঞানের অাঁধার’। ছিয়াম সাধনায় মানুষের মানসিক ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। মনোসংযোগ ও যুক্তি প্রমাণে স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়। আর স্নায়ুবিক প্রখরতার জন্য ভালবাসা, আদর-স্নেহ, সহানুভূতি, অতিন্দ্রীয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। তাছাড়া ঘ্রাণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও বোধশক্তির তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে ডাঃ আলেক্স হেইগ বলেন, ‘ছিয়াম হ’তে মানুষের মানসিক শক্তি ও বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়।[11]

ডাঃ ক্লীভ Peptic Ulcer নামক একটি গবেষণামূলক পুস্তকে যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পেপটিক আলসার অনেক কম। অথচ দক্ষিণ ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় এই রোগ অনেক বেশী। এর কারণ হিসাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দু’টি বিষয় উল্লেখ করেছেন। (১) রামাযান মাসে মুসলমানদের নিয়মিত ছিয়াম পালন এবং (২) তাদের খাবার মেন্যুতে এ্যালকোহল না থাকা। ডাঃ গ্রাহাম বলেন, আলসার (Peptic Ulcer) ও তজ্জনিত ফুলো রোগ এবং প্রদাহ ছিয়াম পালনের কারণে দ্রুত উপশম হয়।

আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, দীর্ঘ জীবন লাভ ও সুস্বাস্থ্যের জন্য খাওয়ার প্রয়োজন বেশী নয়, বরং কম। বছরে একমাস ছিয়াম পালন করলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশ্রাম ঘটে। প্রতিদিন প্রায় ১৫ ঘণ্টা সময় এই বিশ্রামে লিভার, প্লীহা, কিডনী, মূত্রথলী সহ দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো দীর্ঘ এক মাস ব্যাপী বেশ বিশ্রাম পায়। এটা অনেকটা কারখানার মেশিনকে বাৎসরিক বিশ্রাম দেয়ার মতই। এতে করে মানবদেহরূপ মেশিনের কর্মক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায়। সারা বছরে দেহের অভ্যন্তরে যে জৈব (Toxin) বিষ সৃষ্টি হয়, তা এক মাসের ছিয়াম সাধনায় পুড়ে ভষ্মীভূত (Detoxicate) হয়ে যায়।[12]

ডাঃ লুথরজেম অব ক্যামব্রিজ : তিনি ছিলেন একজন ফারমাকোলোজী (Pharmacology) বিশেষজ্ঞ। প্রতিটি বস্ত্তকে গভীরভাবে দেখা ছিল তার স্বভাবগত ব্যাপার। একবার তিনি ক্ষুধার্ত মানুষ (ছায়েম)-এর পাকস্থলীর আর্দ্র পদার্থ (Stomach Secretion) নিয়ে তার ল্যাবরেটরীতে টেষ্ট করেছিলেন। পরীক্ষা করে তিনি দেখতে পেলেন, তাতে সেই খাদ্যের দুর্গন্ধময় উপদান (Food Particles Septic), যার দ্বারা পাকস্থলী রোগ-বাধি গ্রহণ করে, তা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। মি. লুথর বলেন, ছিয়াম শারীরিক রোগ-ব্যাধি বিশেষভাবে পাকস্থলীর রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তির গ্যারান্টি।[13]

কোলেস্টেরল (Cholesterol) হ্রাস : শরীরের শিরা ও ধমনীগুলিকে (Veins and Arteris) নদী-নালার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। নদী-নালার প্রবাহ যত বেশী থাকে, সেগুলি ততবেশী সতেজ থাকে। সেখানে পলি জমলে তা ভরাট হয়ে অচল হয়ে যায়। তেমনিভাবে দেহের মধ্যে কোলেস্টেরল জমলে শিরা-উপশিরাগুলি সরু হয়ে যায় এবং রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ছিয়াম পালনে দেহের চর্বি ও কোলেস্টেরল-এর মাত্রা কমে যায় ও তা স্বাভাবিক থাকে।[14]

ছিয়ামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হ’ল শরীরে প্রবাহমান পদার্থ সমূহের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। মুখের লালাযুক্ত ঝিল্লীর উপরের অংশে সম্পৃক্ত কোষ থাকে, যাকে প্রাপথেলীন কোষ বলা হয়। এগুলো দেহের আর্দ্র পদার্থ নিষ্কাশনে নিয়োজিত থাকে। ছিয়ামের মাধ্যমে এদের কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি পায়।

লালা তৈরীকারী গোশতগ্রন্থি সমূহ, গর্দানের গোশতগ্রন্থি ও অগ্ন্যাশয়ের গোশতগ্রন্থি সমূহ অধিক আগ্রহে বিশ্রামের অপেক্ষায় থাকে, রামাযানে তারা কিছুটা বিশ্রাম পায়। ছিয়ামের সময় দিনে, ধূমপান জনিত বদ অভ্যাস ও উত্তেজক জিনিস হ’তে বিরত থাকার কারণে লাঞ্ছ ক্যান্সার (Lung Cancer), হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা (Heart Weakness) ও অন্যান্য কঠিন রোগ থেকে মানুষের মুক্তি ঘটে।[15]

ডাঃ সলোমান তার গার্হস্থ্য স্বাস্থ্য বিধিতে মানব দেহকে ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করে বলেন, ‘ইঞ্জিন রক্ষা কল্পে মাঝে মাঝে ডকে নিয়ে চুল্লি হ’তে ছাই ও অঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাষিত করা যেমন আবশ্যক, উপবাস দ্বারা মাঝে মাঝে পাকস্থলী হ’তে অজীর্ণ খাদ্য নিষ্কাষিত করাও তেমনি আবশ্যক’।[16]

সিগমন্ড নারায়াড : তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। তার থিওরী মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণের জন্য পথিকৃৎ। তিনি অভুক্ত থাকা ও ছিয়াম রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি বলেন, ছিয়াম মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ (Mental and Psychological) নির্মূল করে দেয়। মানব দেহে আবর্তন-বিবর্তন আছে। কিন্তু ছিয়াম পালনকারীর শরীর বারংবার বাহ্যিক চাপ (External Pressure) গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। ছায়েম দৈহিক খিঁচুনী (Body Congestion) এবং মানসিক অস্থিরতা (Mental Depression) এর মুখোমুখী হয় না।[17]

রামযান মাসে যকৃত (Liver) ও মূত্রাশয় সম্পূর্ণ বিশ্রাম লাভ করে। চার্লস ই.পেজ বলেন, ‘ছিয়ামের ফলে যকৃতের ফোড়া আরোগ্য হয়। এর জন্য অবশ্য এক মাসের মতো ছিয়াম পালন করা লাগে’। মূত্রাশয়ের নানা উপসর্গও এই ছিয়ামের দ্বারা উপশম হয় বলে ডাঃ এম. এ. রাহাত মত প্রকাশ করেন।

ডাঃ লাষ্ট বারনার বলেন, ‘ফুসফুসে কাশি, লোবার নিউমোনিয়া, কঠিন কাশি, সর্দি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি রোগ ছিয়ামের দ্বারা আরোগ্য হয়’। এছাড়াও একজন সুস্থ মানুষের জন্যও ছিয়ামের গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। এ সময় অবাধ গতিতে বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে। ছিয়াম পালনকালে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র সর্বাধিক উজ্জীবিত হয়।[18]

অতি ভোজন, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার ভক্ষণ ইত্যাদি কারণে দেহে চর্বি জমে রক্তবাহী নালাগুলি সরু হয়ে যায়। তাতে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং দেহে রক্তচাপ বেড়ে যায়। তা থেকে হার্ট, ব্রেইন, কিডনী প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চোখের রক্তবাহী আর্টারী সরু হওয়ায় চোখের রেটিনায় নানারূপ পরিবর্তন দেখা দেয়। মুখমন্ডল বাঁকা হয়ে যাওয়া, দেহের অর্ধাংশ অবশ (Paralysis) হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়। ছিয়াম পালন করার ফলে রক্তে চর্বির পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে ছিয়াম ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং তা থেকে সৃষ্ট নানাবিধ জটিলতা থেকে দেহকে রক্ষা করে।[19]

ছিয়াম হৃদপিন্ড ও ধমনির সচলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানব দেহে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি জমার কারণে রক্তে কোলেস্টেরল (Cholesterol) বেশী থাকে। রক্তে স্বাভাবিক কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ’ল ১২৫-১৫০ মিলিগ্রাম, ১০০ মিলিমিটার সিরামে (পাজমে)। এর বেশী হ’লে হৃদপিন্ড, ধমনিতন্ত্র ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো মারাত্মক রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করে এবং ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। যেমন- হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র, পিত্ত থলিতে পাথর, বাত প্রভৃতি মারাত্মক জটিল রোগ। কিন্তু নিয়মিত ছিয়াম পালনের ফলে দেহে অতিরিক্ত মেদ জমতে পারে না এবং রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ স্থিতিশীল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।[20]

পোপ এলফ গাল ছিলেন হল্যান্ডের একজন নামকরা পাদ্রি। ছিয়াম সম্পর্কে তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন যে, আমি আমার অনুসারীদের প্রতি মাসে তিনটি করে ছিয়াম রাখার নির্দেশ দিয়েছি। এ কর্মপদ্ধতিতে দৈহিক ও পরিমাপিক সমন্বয় অনুভব করেছি। আমার রোগীরা বারংবার আমাকে জোর দিয়ে বলেছে যে, আমাকে আরো কিছু পদ্ধতি বলে দিন, কিন্তু আমি নীতি বানিয়ে দিয়েছি যে, দুরারোগ্য রোগীদের প্রতিমাসে তিন নয় বরং পূর্ণ একমাস ছিয়াম রাখার নির্দেশ দেব। আমি ডায়াবেটিস (Diabetes), হৃদরোগ (Heart Diseases) ও পাকস্থলী রোগে (Stomach Diseases) আক্রান্ত রোগীদের পূর্ণ একমাস ছিয়াম রাখার নির্দেশ দিয়েছি। এ পদ্ধতি অবলম্বনে ডায়াবেটিস রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তাদের সুগার কন্ট্রোল হয়ে গেছে। হৃদরোগীদের অস্থিরতা ও শ্বাস স্ফীতি হ্রাস পেয়েছে এবং সবচেয়ে বেশী উপকৃত হয়েছে পাকস্থলী রোগীরা।[21]

ডাঃ আলেক্স হেইগ বলেন, ‘ছিয়াম হ’তে মানুষের মানসিক শক্তি ও বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ এবং যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়’। ডঃ হেনরিক ষ্টার্ন ছিয়ামের উপকারিতা সম্পর্কে বলেন, ‘মানসিক ও স্নায়ুবিক বৈকল্যে ছিয়ামের উপকারিতা দেখে থ হয়ে যেতে হয়। পক্ষাঘাত এবং আধা-পক্ষাঘাত রোগ ছিয়ামের বদৌলতে অতি দ্রুত সেরে যায়। স্নায়ুবিক দৌর্বল্য, এমনকি অনেক সময় উন্মত্ততা রোগও ছিয়ামের কারণে ভাল হয়ে যায়’।[22]

ডাঃ জুয়েলস, ডাঃ ডিউই, ডাঃ এলেক্স হিউ প্রমুখ প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন যে, ছিয়াম শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এর ফলে দেহের জীবাণুবর্ধক অন্ত্রগুলি ধ্বংস হয়, ইউরিক এসিড বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। ছিয়াম চর্মরোগ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গ্যাষ্ট্রিক আলসার ইত্যাদির জন্য অত্যন্ত উপকারী বিবেচিত হয়েছে। মেদ ও কোলেষ্টেরল কমানোয় ছিয়ামের জুড়ি নেই। সর্বোপরি ছিয়াম মনে শান্তি আনে, কু-প্রবৃত্তি প্রশমিত করে, দীর্ঘ জীবন দান করে। আজ উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন জটিল রোগ প্রশমনের ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকগণ ছিয়াম রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন।[23]

[ক্রমশঃ]

কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী

মুহাদ্দিছ, বেলটিয়া কামিল মাদ্রাসা, জামালপুর।


[1]. বুখারী হা/২৮৪০; মুসলিম হা/১১৫৮; ইবনু মাজাহ হা/১৭১৭।

[2]. আবূদাঊদ হা/২৪২১; তিরমিযী হা/৭৪৪, সনদ ছহীহ।

[3]. তিনমিযী হা/৭৪৫; নাসাঈ হা/২৩৬১; ইবনু মাজাহ হা/১৭৪০; ছহীহ আত-তারগীব হা/১০৪৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৯৭০।

[4]. তিরমিযী হা/৭৪৭; ছহীহুত তারগীব হা/১০৪১; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৫৯।

[5]. তিরমিযী হা/৭৬১; নাসাঈ হা/২৪২৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৭৩।

[6]. মুসলিম হা/১১৬৪; আবূদাঊদ হা/২৪৩৩; তিরমিযী হা/৭৫৯।

[7]. মুসলিম হা/১১৬২; আবূদাঊদ হা/২৪২৫; মিশকাত হা/২০৪৪।

[8]. মুসলিম হা/১১৬২; আবূদাঊদ হা/২৪২৫; মিশকাত হা/২০৪৪

[9]. বুখারী হা/৩২৫৭; বায়হাক্বী হা/৮৫২২; মিশকাত হা/১৯৫৭।

[10]. হাসনাইন ইমতিয়াজ, সিয়াম সাধনা: চিকিৎসা শাস্ত্রের আলোকে (ঢাকা : ইফাবা, ২য় মুদ্রণ মার্চ/১৯৮৩), পৃঃ ১১-১২।

[11]. অধ্যাপক সাইদুর রহমান, মাহে রমজানের শিক্ষা ও তাৎপর্য (ঢাকা : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংস্কৃতি কেন্দ্র, ১৯৮৫), পৃঃ ১৭।

[12]. মাসিক আত-তাহরীক, আগষ্ট/২০১০, পৃঃ ৩২।

[13]. সুন্নাতে রাসূল (ছাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান, ১/১৪১-১৪২।

[14]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছিয়াম ও ক্বিয়াম (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জানুঃ ২০২০), পৃঃ ১৭২-১৭৩।

[15]. মাসিক আত-তাহরীক, আগষ্ট ২০১০, পৃঃ ৩৩।

[16]. বাংলা মিশকাত, ছিয়াম পর্ব (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১৯৯৬), পৃঃ ২১২; ছিরাতে মুস্তাক্বীম, ছিয়াম ও রামাযান, পৃঃ ৬৫।

[17]. সুন্নাতে রাসূল (ছাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান ১/১৪২ পৃঃ।

[18]. মাসিক আত-তাহরীক, আগষ্ট ২০১০, পৃঃ ৩৩।

[19]. ছিয়াম ও ক্বিয়াম, পৃঃ ১৭২।

[20]. মাসিক আত-তাহরীক, আগষ্ট ২০০১, পৃঃ ৪-৫।

[21]. সুন্নাতে রাসূল (ছাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান, ১/১৪১ পৃঃ।

[22]. মাসিক আত-তাহরীক, আগষ্ট ২০১০, পৃঃ ৩৩-৩৪।

[23]. ইসলামী বিধান ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ৫০-৫১।






বিষয়সমূহ: চিকিৎসা
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৭ম কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
ক্বলব : মানব দেহের রাজধানী - খাইরুল ইসলাম বিন ইলইয়াস
হজ্জ ও ওমরাহ সংশ্লিষ্ট ভুল-ত্রুটি সমূহ - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (শেষ কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
কুরবানীর মাসায়েল
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
মাসায়েলে কুরবানী - আত-তাহরীক ডেস্ক
কুরআন নিয়ে চিন্তা করব কিভাবে? - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
অসুস্থ ব্যক্তির করণীয় ও বর্জনীয় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (৪র্থ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামীদের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আরও
আরও
.