পূর্বোক্ত ঘটনাবলীসহ নানা উপদেশমালা পবিত্র কুরআনের বিশাল কলেবরে স্থান পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পবিত্র কুরআন বিশ্ব মানবতার একমাত্র সংবিধান। এক আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাসীদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ আকাঙ্ক্ষার বস্ত্ত। আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করে শয়তানের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত মানুষকে ভ্রান্ত পথ হ’তে রক্ষা করে আল্লাহর পথে ও সত্য ধর্মের পথে বহাল রেখেছেন। অনেক সময় অনেক সম্প্রদায় তাদের নবী-রাসূলের উপদেশ লংঘন করে আল্লাহর অস্তিত্ব অবিশ্বাস করে সীমালংঘন করেছে এবং অবশেষে আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়ে সমূলে ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ গযব হ’তে রক্ষা পেয়েছেন। যারা তওবা করে সৎপথে প্রত্যাবর্তন করেছে তারাও রক্ষা পেয়েছে। এভাবে এ নশ্বর পৃথিবীর যাত্রাপথ একদিন শেষ হয়ে যাবে। এসে যাবে পরীক্ষা গ্রহণের সর্বজনবিদিত দিন ‘ক্বিয়ামত’। ঐ দিনই বিচার হবে প্রতিটি মানুষের, কেউ বাদ যাবে না। আল্লাহ বলেন, إِنْ كُلُّ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَنِ عَبْداً، لَقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدّاً، وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْداً- ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে না। তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন। ক্বিয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর কাছে একাকী অবস্থায় আসবে’ (মরিয়াম ৯৩-৯৫)

সেদিন হিসাব-নিকাশ ও বিচার হবে সর্বোচ্চ ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষতার মানদন্ডে এবং স্বয়ং আল্লাহই হবেন বিচারক। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَنَضَعُ الْمَوَازِيْنَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئاً وَإِن كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِيْنَ- ‘আমরা ক্বিয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি কোন যুলুম করা হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমরা তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণে আমরাই যথেষ্ট’ (আম্বিয়া ৪৭)

সেদিনই বাছাই হবে কারা আল্লাহর দল এবং কারা ইবলীসের দল। তাদের হিসাবের খতিয়ান যাচাই হবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, বাদ পড়বে না একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাল বা মন্দ কাজও। সবাই নিজ নিজ জায়গায় তাদের নিজ নিজ হিসাব বহি

(আমলনামা) চোখের সামনে দেখতে পাবে। আল্লাহ তাঁর অনুগত ও বিশ্বাসী দলকে তাদের পুণ্যের পরিমাণ অনুযায়ী দলবদ্ধ করে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করাবেন। অপরদিকে তাঁর প্রতি অবিশ্বাসী ইবলীসের দলকেও তাদের কৃতকর্মের পরিমাণ অনুযায়ী আলাদা করে তাদের নির্ধারিত বিপদজ্জনক অবস্থানে স্থান দিবেন। এভাবে সুদীর্ঘ ক্বিয়ামত দিবসের প্রতিশ্রুত বিচার কাজ শেষ হবে।

শুরু হবে অবিনশ্বর জগতের একদিকে আড়ম্বরপূর্ণ অভিষেক, যার কোন শেষ নেই, কোন ধ্বংস নেই, নেই কোন অম্লান পরিবেশ, সেখানে শুধু সীমাহীন সুখ-শান্তি, শৃংখলা ও তৃপ্তির সমাহার। অপরদিকে শুরু হবে অনাড়ম্বর, অপ্রীতিকর, অপ্রত্যাশিত যন্ত্রণাদায়ক পরিবেশের অভিযান। এরও কোন শেষ নেই, ধ্বংস নেই, নেই কোন সুখ-শান্তি ও আরামদায়ক আবহাওয়ার লেশমাত্র। সেখানে শুধু দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ও অশান্তির সমুদ্র।

মূলতঃ ক্বিয়ামতের বিচারই একটি পরীক্ষা, যা আলোচনার প্রথমাংশেই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অতীব প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থেকে আদেশ পালন করার জন্য বার বার উপদেশ দিয়েছেন। যারা সে উপদেশ পালন করবে, রাসূলের প্রদর্শিত পথে চলবে, তারা হবে সফলকাম। জান্নাতের অফুরন্ত নে‘মত লাভ করে তারা হবে ধন্য। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর উপদেশ মতে চলবে না এবং রাসূলের অনুসরণ করবে না; বরং যথেচ্ছা চলবে, তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে; তারাই ব্যর্থ।

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে ঘিরে যে মহা আকাঙ্ক্ষার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন, তা পবিত্র কুরআনে উপদেশাকারে, প্রয়োজনানুসারে সকল শ্রেণীর মানুষকে স্মরণ করিয়ে অহী অবতীর্ণ করেন। অবতীর্ণ অহী হ’তে জানা যায় শয়তানের আকাঙ্ক্ষা পূরণের অসংখ্য কলাকৌশল। আসলে ইবলীস সৃষ্টিগতভাবেই উচ্চাভিলাষী ও অহংকারী। অতঃপর আল্লাহর দরবার হ’তে বিতাড়িত হয়ে আরও সীমালংঘনে প্রবৃত্ত হয়। ক্বিয়ামতের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত ইবলীসের প্রয়াস ক্রিয়াশীল থাকবে। এমতাবস্থায় হঠাৎ ক্বিয়ামত এসে যাবে, ইবলীস ঘুর্ণাক্ষরেও তা টের পাবে না। সেদিন তার সব জ্ঞানবুদ্ধি, উচ্চাভিলাষ, অহংকার, কলা-কৌশল সমূলে শেষ হয়ে যাবে। তার হাযার হাযার বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা, পৃথিবীর মহারাজত্ব মুহূর্তের মধ্যে ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে। এতদিন সে পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের সামনে ক্বিয়ামতকে আড়াল করে রেখেছিল বা ক্বিয়ামতকে মিথ্যা বলে বুঝাতে সমর্থ হয়েছিল, সেই ক্বিয়ামতই পৃথিবীর সবার সামনে ভয়াবহ রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়ে পড়বে। মুহূর্তের মধ্যে সারা জীবনের ভ্রম ভেঙ্গে যাবে অগণিত ইবলীসপন্থী নর-নারীর। সেদিনের মহাসংকট, মহানাদ, মহাত্রাস ও অলৌকিক শক্তির বাস্তবায়ন ইবলীস বাহিনীকে চরমভাবে আতংকগ্রস্ত ও হতাশাগ্রস্ত করে ফেলবে। শুধু আত্মবিলাপ ও হতাশই হবে তখন তাদের সান্ত্বনা ও ধৈর্যের একমাত্র সম্বল।

ক্বিয়ামত দিবসের ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ইবলীস বাহিনী চরমভাবে দুর্বল ও পথহারা হয়ে পড়বে। ইবলীস তার সুদীর্ঘ দিনের মিথ্যা প্ররোচনা মূলক, প্রহসনমূলক অভিযানকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করার জন্যেই নবতর ভূমিকার অবতারণা করবে। মহান আল্লাহর সম্মুখে সে অপরাধী সম্প্রদায়কে তাদের অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করবে। অপরাধীরাও ইবলীস ও তার দলের প্রধানদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করবে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। কারণ অপরাধীরা স্বজ্ঞানেই তাদের একমাত্র পালনকর্তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ প্রত্যাখ্যান করে ইবলীস ও তার চেলাচামুন্ডাদের পথ অনুসরণ করেছে।

প্রকৃতপক্ষে ইবলীস হ’ল তার স্রষ্টা মহান আল্লাহর আদেশ লংঘনের বা বিরুদ্ধাচরণকারীর বা বিদ্রোহ ঘোষণাকারীর জন্মদাতা। কিন্তু আন্তরিকভাবে ও পরোক্ষভাবে সতর্কতার সাথে সে আল্লাহর মহা ক্ষমতাকে ভয় করে। শুধু তার অহংকার, যিদ ও সীমালংঘন হ’তে সৃষ্ট আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যেই সে জগদ্বাসীকে সুচতুরতা ও বুদ্ধির দ্বারা অহরহ বিভ্রান্ত করে এবং ধর্মদ্রোহী কর্মকান্ডে নিমজ্জিত করতঃ তার দলের স্থায়ী সদস্য বানায়। অথচ নিজেকে ঐ ব্যক্তির নিকট থেকে গুটিয়ে নিয়ে দোষমুক্ত থাকার অপকৌশল করে। আল্লাহ বলেন, كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّيْ بَرِيْءٌ مِّنكَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ- ‘তারা শয়তানের মত, যে মানুষকে বলে, কুফরী করো। অতঃপর যখন সে কুফরী করে, তখন শয়তান বলে, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি বিশ্বপালনকর্তা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করি’ (হাশর ৫৯/১৬)

শয়তান যে কোন মিথ্যার বিনিময়ে হোক সর্বদা নিজেকে দোষমুক্ত রাখার নিষ্ফল প্রয়াস চালিয়ে যাবে। উদাহরণতঃ ক্বিয়ামত দিবসের একটি ছোট্ট দৃশ্যের বর্ণনায় মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিবেন, اَلَّذِيْ جَعَلَ مَعَ اللهِ إِلَهاً آخَرَ فَأَلْقِيَاهُ فِي الْعَذَابِ الشَّدِيْدِ، قَالَ قَرِيْنُهُ رَبَّنَا مَا أَطْغَيْتُهُ وَلَكِنْ كَانَ فِيْ ضَلَالٍ بَعِيْدٍ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্য গ্রহণ করত, তাকে তোমরা কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর। তার সঙ্গী শয়তান বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমি তাকে অবাধ্যতায় লিপ্ত করিনি। বস্ত্ততঃ সে নিজেই ছিল সুদূর পথভ্রান্তিতে লিপ্ত’ (ক্বাফ ৫০/২৬-২৭)

বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনা থেকে ধারাবাহিকভাবে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত ইবলীস বাহিনী বিশাল আকার ধারণ করবে এবং তার দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে। কিন্তু সেদিন ইবলীস বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকেই কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হ’তে হবে। সুচতুর ও মিথ্যাবাদী ইবলীস তা সবার আগেই উপলব্ধি করতে পারবে। অতঃপর সংঘাতময় পরিস্থিতির মোকাবেলায় সে তার নীতির আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। সেদিন সে যথার্থ সত্য ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দ্বারা তার বক্তব্য, মন্তব্য ও অভিমত তুলে ধরে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াস চালাবে। ইবলীসের সেই ভাষণ বিশ্বজনগোষ্ঠীর জ্ঞাতার্থেই বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে অবতীর্ণ করেছেন। সে (ইবলীস) মিথ্যাবাদী হ’লেও তার অন্তিমকালের উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাষণ হবে সঠিক ও সত্য। শয়তানের উক্ত বাণীর সত্যায়নে মহান আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন, ‘যখন সব কাজের ফায়ছালা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছি, অতঃপর তা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার কোন ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু এতটুকু যে, আমি তোমাদেরকে ডেকেছি, অতঃপর তোমরা আমার কথা মেনে নিয়েছ। অতএব তোমরা আমাকে ভৎর্সনা কর না, বরং নিজেদেরকেই ভৎর্সনা কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্যকারী নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্যকারী নও। ইতিপূর্বে তোমরা আমাকে যে আল্লাহর শরীক করেছিলে, আমি তা অস্বীকার করি। নিশ্চয়ই যারা যালেম তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (ইবরাহীম ১৪/২২)

আলোচ্য আয়াতটিতে আল্লাহ তা‘আলা শয়তানের আত্মপ্রকাশ ও সুস্পষ্ট মতবাদ খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। শয়তানের ঐ ভাষণটিই মনে হয় শেষ ভাষণ। পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাগণকে তাদের চিরশত্রুর পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এবং তাদেরকে সেই শত্রু হ’তে সতর্ক থাকার জন্য স্বীয় কালামে পাকে শয়তান ইবলীসের বহুমুখী বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন। স্মরণ করা উচিত যে, শয়তান আমাদের আদি মাতা-পিতাকে জান্নাত হ’তে বহিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই নব উদ্যমে শয়তান আমাদেরকেও ভবিষ্যতে চির শান্তির জান্নাত লাভ হ’তে বঞ্চিত করার প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

উপরের আলোচনায় আকাঙ্ক্ষার উৎসগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। মানব সৃষ্টির সূচনা হ’তেই আমরা আকাঙ্ক্ষার উৎপত্তি দেখতে পাই। অতঃপর পৃথিবী লয়ের মধ্য দিয়ে তার অবলুপ্তি ঘটবে। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের মহাপ্রলয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। এই মহা সংবাদের প্রতি বিশ্বাসী বান্দাদের অকৃত্রিম বিশ্বাস স্থাপনের লক্ষ্যে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে বলেন,كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ، وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ- ‘ভূ-পৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র তোমার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া’ (আর-রহমান ৫৫/২৬-২৭)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِيْ لاَ يَمُوْتُ وَسَبِّحْ بِحَمْدِهِ وَكَفَى بِهِ بِذُنُوْبِ عِبَادِهِ خَبِيْراً- ‘আপনি সেই চিরঞ্জীবের উপর ভরসা করুন, যার মৃত্যু নেই এবং তাঁর প্রশংসায় পবিত্রতা ঘোষণা করুন। তিনি বান্দার গোনাহ সম্পর্কে যথেষ্ট খবরদার’ (ফুরকান ২৫/৫৮)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ক্বিয়ামতের একাংশে একটা সুনির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব ছাড়া পৃথিবীতে কোন প্রাণীর নমুনাও থাকবে না। অতঃপর আল্লাহপাক পর্যায়ক্রমে পৃথিবীতে বসবাসকারী সকল প্রাণীকে জীবিত করবেন। বিচার করবেন এবং আবাসন ব্যবস্থা করবেন। এরপর এখান থেকে আল্লাহর আকাঙ্ক্ষা ব্যতীত সকল আকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ ইবলীসের আকাঙ্ক্ষার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে ইবলীস ও তার অনুসারীরা আকাঙ্ক্ষার বিনিময়ে শুধু অনুতপ্ত ও আত্মবিলাপ করতে থাকবে এবং একে অপরের প্রতি দোষারোপ করতে থাকবে। তাদের ঐসব তর্কবিতর্কের বা কথাকাটাকাটির দৃশ্যগুলোও সমগ্র মানব জাতিকে অবহিত করার লক্ষে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বিধৃত করেছেন। যেমন-

আল্লাহ বলেন, ‘বিপথগামীদের সামনে উন্মোচিত করা হবে জাহান্নাম। তাদেরকে বলা হবে, তারা কোথায়, আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের পূজা করতে? তারা কি তোমাদের সাহায্য করতে পারে অথবা প্রতিশোধ নিতে পারে? অতঃপর তাদেরকে এবং পথভ্রষ্টদেরকে অধোমুখি করে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে এবং ইবলীস বাহিনীর সকলকে। তারা তথায় কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে বলবে, আল্লাহর কসম! আমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব পালনকর্তার সমতুল্য মনে করতাম। আমাদেরকে দুষ্ট কর্মীরাই গোমরাহ করেছিল। অতএব আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই এবং কোন সহৃদয় বন্ধুও নেই। হায়, যদি কোনরূপে আমরা পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পেতাম, তবে আমরা বিশ্বাস স্থাপনকারী হয়ে যেতাম। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন আছে এবং তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়। আপনার পালনকর্তা প্রবল পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু’ (শো‘আরা ২৬/৯১-১০৪)

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তারা জাহান্নামে পরস্পর বিতর্ক করবে, অতঃপর দুর্বলরা অহংকারীদেরকে বলবে, আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম। তোমরা এখন জাহান্নামের আগুনের কিছু অংশ আমাদের থেকে নিবৃত্ত করবে কি? অহংকারীরা বলবে, আমরা সবাই তো জাহান্নামে আছি। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ফায়ছালা করে দিয়েছেন। যারা জাহান্নামে আছে, তারা জাহান্নামের রক্ষীদেরকে বলবে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে বল, তিনি যেন আমাদের থেকে একদিনের আযাব লাঘব করে দেন। রক্ষীরা বলবে, তোমাদের কাছে কি সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তোমাদের রাসূল আসেননি? তারা বলবে, হ্যাঁ। রক্ষীরা বলবে, তবে তোমরাই দো‘আ কর। বস্ত্ততঃ কাফেরদের দো‘আ নিস্ফলই হয়ে থাকে’ (মুমিন ৪০/৪৭-৫০)

ক্বিয়ামত দিবসের সত্যতায় মহান আল্লাহ বলেন,

ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَنْ شَاء اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَآباً، إِنَّا أَنذَرْنَاكُمْ عَذَاباً قَرِيْباً يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُوْلُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِيْ كُنتُ تُرَاباً-

‘এই দিবস (ক্বিয়ামত) সত্য। অতঃপর যার ইচ্ছা, সে তার পালনকর্তার কাছে ঠিকানা তৈরী করুক। আমরা তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম, যেদিন মানুষ প্রত্যক্ষ করবে যা সে সামনে প্রেরণ করেছে এবং কাফের বলবে, হায় আফসোস আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম’ (নাবা ৩৯, ৪০)

আল্লাহর ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা কখনও ব্যর্থ হওয়ার নয়। তাই তিনি তাঁর কিছু অন্বেষণকারীকে সাহায্য করেন। ফলে তারা সারা জীবনের বিড়ম্বনা হ’তে আত্মরক্ষা করবে এবং তারা তাদের সারাজীবনের ঘনিষ্ট বন্ধুদের সংশ্রব হ’তে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঈমানদারদের দলভুক্ত হয়ে জান্নাত লাভ করবে। আল্লাহ তা‘আলা ঐসব ব্যক্তির বিষ্ময়কর বক্তব্যটিও পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন, ‘তাদের (জান্নাতীদের) একজন বলবে, আমার এক সঙ্গী ছিল। সে বলত, তুমি কি বিশ্বাস কর যে, আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব, তখনও আমরা প্রতিফলপ্রাপ্ত হব? আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি তাকে উঁকি দিয়ে দেখতে চাও? অতঃপর সে উঁকি দিয়ে তাকে জাহান্নামের মাঝখানে দেখতে পাবে। সে বলবে, আল্লাহর কসম! তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংসই করে দিয়েছিলে। আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ না হ’লে আমিও যে গ্রেফতারকৃতদের সাথেই উপস্থিত হ’তাম। এখন আমার আর মৃত্যু হবে না। আমাদের প্রথম মৃত্যু ছাড়া এবং আমরা শাস্তিপ্রাপ্তও হব না। নিশ্চয়ই এটা মহাসাফল্য। এমন সাফল্যের জন্য পরিশ্রমীদের পরিশ্রম করা উচিত (ছাফফাত ৩৭/৫১-৬১)

অতঃপর আল্লাহর আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আত্মসমপর্ণকারীরা ইবলীসের ছোবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। কেননা ঈমানদার বান্দারা আল্লাহর নৈকট্যশীল, তারা সর্বদাই আল্লাহর ভয়ে ভীতু থাকে। ফলে তারা শয়তানের অবস্থানকে বহু সুদূরেই মনে করে। কোন কারণে বা কোন সুযোগে শয়তান ঈমানদারদের অন্তরে স্থান পেলেও, তড়িৎ গতিতে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ঈমানদার বান্দারা সুদূর ঊর্ধ্বাকাশের ঊর্ধ্বলোকে অবস্থানরত আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় অকৃত্রিম ইবাদতে আবদ্ধ থাকে এবং শয়তানের প্ররোচনামূলক আক্রমণ হ’তে মুক্ত থাকার জন্য তাকে (শয়তানকে) বহু হীনমত নিম্নদেশে নিক্ষেপ করে, যাতে সে চির হতাশায় ও নিরাশায় দগ্ধ হয়। এরূপ সাফল্যের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনকারীরাই ক্বিয়ামতের মহাপ্রলয়ের মাঝেও জান্নাত লাভে ধন্য হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِيْنَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوْتَ أَنْ يَعْبُدُوْهَا وَأَنَابُوْا إِلَى اللهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَادِ، الَّذِيْنَ يَسْتَمِعُوْنَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُوْنَ أَحْسَنَهُ أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ هَدَاهُمُ اللهُ وَأُوْلَئِكَ هُمْ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ-

‘যারা শয়তানী শক্তির পূজা-অর্চনা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দিন আমার ঐ সকল বান্দাদেরকে, যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর যা উত্তম তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান’ (যুমার ৩৯/১৭-১৮)

অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, لَكِنِ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ لَهُمْ غُرَفٌ مِّنْ فَوْقِهَا غُرَفٌ مَّبْنِيَّةٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَعْدَ اللهِ لاَ يُخْلِفُ اللهُ الْمِيْعَادَ- ‘যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, তাদের জন্য নির্মিত আছে প্রাসাদের উপর প্রাসাদ। এগুলোর তলদেশে নদী প্রবাহিত। আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ প্রতিশ্রুতির খেলাফ করেন না’ (যুমার ৩৯/২০)

একই বিষয়ে প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, ‘যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা উন্মুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে পৌঁছবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাক। অতঃপর সদাসর্বদা বসবাসের জন্য তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর। তারা বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির উত্তরাধিকারী করেছেন। আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা বসবাস করব। মেহনতকারীদের পুরস্কার কতই না চমৎকার’ (যুমার ৩৯/৭৩-৭৪)

বিশ্ববাসীকে অবিনশ্বর পরকালীন জীবনের সুখের ঠিকানা জানাতে গিয়ে কালামে পাকে জান্নাতের বিভিন্ন বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে এবং এর উত্তরাধিকারীদের পরিচয়ও দেয়া হয়েছে। এখানে আর একটু ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমি সৎকর্মীদের পুরস্কার নষ্ট করি না। তাদের জন্য রয়েছে বসবাসের জান্নাত। তাদের পাদদেশে প্রবাহিত হয় নহর সমূহ। তাদের তথায় স্বর্ণ কংকনে অলংকৃত করা হবে এবং তারা পাতলা ও মোটা রেশমের সবুজ কাপড় পরিধান করবে এমতাবস্থায় যে, তারা সিংহাসনে সমাসীন হবে। চমৎকার প্রতিদান এবং কতই না উত্তম আশ্রয়’ (কাহফ ১৮/৩০-৩১)

আলোচনার এ পর্যায়ে বলা যায়, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আকাঙ্ক্ষার মহা ভান্ডার হ’তে ইবলীস ও মানবজাতিকে যৎকিঞ্চিত দান করেছেন, যার মধ্যে তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ ছিল অন্যতম। কিন্তু শয়তান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে মানুষ উক্ত বিদ্রোহের শিকারে পরিণত হয়। অতঃপর শয়তানের কবল থেকে মানব সম্প্রদায়ের মুক্তির জন্য ব্যাপক উপদেশ ভান্ডার অবতীর্ণ হয়েছে। যারা আল্লাহর সন্তোষ লাভের মানসে ও জান্নাত লাভের আকাঙ্ক্ষায় সেসব উপদেশ মেনে চলবে তারা মুক্তি পাবে। আর যারা কেবল দুনিয়া লাভের আকাঙ্ক্ষায় ঐসব উপদেশ প্রত্যাখ্যান করবে, তারা ব্যর্থ হবে।

আকাঙ্ক্ষার ফলাফল :

আশা-আকাঙ্ক্ষার উপকারিতা, ফযীলত ও ফলাফল অনেক। যদি তা যথাযথ স্থানে ও সঠিক পদ্ধতিতে হয়, তাহ’লেই কেবল এটা প্রভুত ফলদায়ক হয়। এখানে আকাঙ্ক্ষার ফযীলত ও ফলাফলের কয়েকটি দিক উপস্থাপন করা হ’ল-

১. প্রভুর নিকটে বান্দার গোলামী, প্রয়োজন ও চাহিদার প্রকাশ : আল্লাহর নিকটে প্রত্যাশা করলে বান্দার দাসত্বের প্রকাশ ঘটে। তেমনি আল্লাহর মহত্ত্ব ও বড়ত্বকে আরো উঁচু করা হয়। আর বান্দা আল্লাহর করুণা, রহমত ও কৃপা থেকে চোখের পলকের সমপরিমাণ সময়ের জন্য অমুখাপেক্ষী হ’তে পারে না।

২. আল্লাহর নিকটে প্রত্যাশী ব্যক্তি তাঁর প্রিয়তর : বান্দাদের মধ্যে আল্লাহর নিকটে প্রিয়তর তারাই যারা তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, তাঁর থেকে পাওয়ার আশা করে, তাঁর নিকটেই অনুগ্রহ, করুণা প্রার্থনা করে। কেননা প্রার্থিত বিষয় তিনি দান করতে পারেন এবং তিনিই বান্দার প্রয়োজন পূরণ করেন।

৩. আল্লাহর ক্রোধ থেকে পরিত্রাণ : যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে চায়, প্রার্থনা করে, তাঁর কাছে আশা করে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন। পক্ষান্তরে যে চায় না, তার প্রতি অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হন। সুতরাং আল্লাহর রোষানল থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপকরণ হচ্ছে তাঁর নিকটে সব কিছুর জন্য প্রার্থনা করা।

৪. প্রত্যাশা সূক্ষ্ম বিষয়, যা দ্বারা বান্দা আল্লাহর পথে চলতে সচেতন হয় : আশা-আকাঙ্ক্ষা দ্বারা বান্দার চাল-চলন উত্তম হয়, আল্লাহর দিকে ও হকের পথে থাকতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়। আল্লাহর পথে সদা অবিচল থাকতে উজ্জীবিত ও জাগ্রত হয়। সুতরাং আশা-আকাঙ্ক্ষা না থাকলে সে এপথে চলে না। পক্ষান্তরে আশাহীন ভীতি বান্দাকে আন্দোলিত ও প্রণোদিত করে না। ভালবাসা তাকে গতিশীল করে, ভীতি তাকে অস্থির করে তোলে আর আশা-আকাঙ্ক্ষা তাকে শানিত ও জাগ্রত করে, উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে।

৫. আশা-আকাঙ্ক্ষা মুহাববতের শীর্ষ চূঁড়ায় উন্নীত করে : বান্দার আশা-আকাঙ্ক্ষা যখন প্রবল হয় এবং কাঙ্ক্ষিত জিনিস সে লাভ করে, তখন আল্লাহর প্রতি তার মুহাববত বৃদ্ধি পায়। আর প্রত্যাশিত বস্ত্ত পেয়ে গেলে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতায় তার শির নত হয়ে আসে এবং আল্লাহর প্রতি সে সন্তুষ্ট হয়।

৬. মর্যাদার শীর্ষে উন্নীত হ’তে উজ্জীবিত হয় : এটা হচ্ছে শুকরিয়ার স্থান, যা ইবাদতের সারৎসার। কেননা যখন প্রত্যাশিত বিষয় অর্জিত হয়, তখন তা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার দাবী করে।

৭. আকাঙ্ক্ষা ও ভালবাসা একে অপরের পরিপূরক : ভালবাসা আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বিচ্ছিন্ন করে না বরং এতদুভয়ের একটা অপরটাকে দীর্ঘ ও শক্তিশালী করে।

৮. আশা ও ভীতি পরস্পরের জন্য অত্যাবশ্যক : আশার জন্য ভীতি এবং ভীতির জন্য একটা অপরটার সাথে জড়িত। একটা অপরটার জন্য যরূরীও বটে। আকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির মনে পাওয়ার আশা যেমন থাকে, তেমনি না পাওয়ার ভয়ও থাকে। সুতরাং প্রত্যেক প্রত্যাশী ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে। আবার প্রত্যেক আল্লাহভীরু ব্যক্তি আল্লাহর পুরস্কারের আশাও করে।

৯. আশা-আকাঙ্ক্ষা আল্লাহর সম্পর্কে ইলমকে বৃদ্ধি করে : তাঁর যাত বা সত্তা, গুণাবলী ও তার যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন করতে ও তাঁর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে আকাঙ্ক্ষা ভূমিকা রাখে। কেননা প্রত্যাশী ব্যক্তি আল্লাহর সুন্দর নাম সমূহের মাধ্যমে তাঁর সাথে সম্পর্ক তৈরী করে। এসবের মাধ্যমে সে আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, তাঁকে ডাকে।

১০. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি : আশা-আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে বান্দা প্রভুর সাথে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরী করে। ফলে আল্লাহ বান্দার প্রত্যাশিত বস্ত্ত তাকে দান করেন। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের প্রকাশ, যা বান্দার নিকটে অতীব সুখের, আনন্দের। প্রত্যাশিত বস্ত্ত না পাওয়ার বেদনার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর।

১১. আল্লাহর যিকর বৃদ্ধি করে : আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্তির প্রতীক্ষা প্রত্যাশার মধ্যে বিদ্যমান, যা বান্দার অন্তরে আল্লাহর যিকরকে আবশ্যক করে। সেই সাথে সর্বদা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর দিকে মনোনিবেশ করে, অন্তরকে তাঁর সন্তোষের দিকে প্রত্যাবর্তিত করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, আশার ফলাফল ভয়ের ফলাফলের চেয়ে ভিন্ন নয়। কেননা দু’টিই অর্জিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের প্রচেষ্টা দ্বারা, তাঁর ইবাদত, আনুগত্য ও সৎকাজ সম্পাদনের মাধ্যমে। আল্লাহ প্রত্যাশী ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ্য করে বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَالَّذِيْنَ هَاجَرُوْا وَجَاهَدُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أُوْلَـئِكَ يَرْجُوْنَ رَحْمَتَ اللهِ ‘যারা ঈমান আনে এবং যারা হিজরত করে ও জিহাদ করে আল্লাহর পথে, তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে’ (বাক্বারাহ ২/২১৮)। অন্যত্র তিনি বলেন,أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاء اللَّيْلِ سَاجِداً وَقَائِماً يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُوْ رَحْمَةَ رَبِّهِ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ ‘যে ব্যক্তি রাত্রি কালে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তাঁর প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান, যে তা করে না? বল, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? বোধশক্তি সম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে’ (যুমার ৩৯/৯)

পক্ষান্তরে হতাশ ও নিরাশ ব্যক্তির জন্য প্রত্যাশা রাখাই হচ্ছে প্রতিকারের উপায়। আল্লাহ বলেন,قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ أَسْرَفُوْا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لاَ تَقْنَطُوْا مِن رَّحْمَةِ اللهِ إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعاً إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ ‘বল, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ আল্লাহর অনুগ্রহ হ’তে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (যুমার ৩৯/৫৩)। সুতরাং প্রত্যাশার সাথে ভীতি থাকতে হবে এবং সৎ আমলের মাধ্যমে তা পূরণে সচেষ্ট হ’তে হবে। আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় সৎকর্ম ও আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে। সুতরাং আল্লাহ আমাদেরকে সেভাবে কাজ করার তাওফীক দিন- আমীন!

রফীক আহমাদ

শিক্ষক (অবঃ), বিরামপুর, দিনাজপুর।






সৃজনশীল প্রশ্ন, অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাস - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
নেতৃত্বের মোহ (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
তাওফীক্ব লাভের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ঈমানের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
পলাশী ট্রাজেডি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বাস্তবতা - ড. ইফতিখারুল আলম মাসঊদ
মানবাধিকার ও ইসলাম (১০ম কিস্তি) - শামসুল আলম
সুন্নাত আঁকড়ে ধরার ফযীলত (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
ইসলামে তাক্বলীদের বিধান (প্রথম কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
মীরাছ বণ্টন : শারঈ দৃষ্টিকোণ - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (২য় কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
জান্নাতের পথ - ড. নূরুল ইসলাম
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আরও
আরও
.