এ
বিশ্ব চরাচরে মানুষ এসেছে নিজেদের সুন্দর কর্ম দ্বারা এ ধরণীকে আরো সুন্দর
করতে। আর তার উ ত্তম কর্মের বিনিময়ে পরকালীন জীবনে নাজাত লাভ করতে। কিন্তু
পৃথিবীতে এসে মানুষ তার আসল কর্তব্যকে ভুলে গেছে। ফলে অধিকাংশ মানুষ হয়েছে
ভোগবাদী। তবে এ জগৎ-সংসারে এমন অনেক লোক আছে যাদের জীবনটা ত্যাগের মহিমায়
ভাস্বর। তারা তাদের কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, ভোগে নয়, ত্যাগেই
প্রকৃত সুখ। আর এ সম্পর্কেই একটি নাতিদীর্ঘ গল্প আমরা উদ্ধৃত করছি।
রাতুল পিতৃ-মাতৃহীন এক অনাথ বালক। শৈশবে পিতামাতা মারা যাওয়ার পর চাচার অপত্য স্নেহে লালিত-পালিত হয়েছে। দিনমজুর পুত্রহীন আবুল মৃত ভাইয়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে ভাতিজাকে পুত্রবৎ লালন-পালন করে বড় করেছে। নিজের সহায়-সম্বল যা ছিল সব ব্যয় করে ভাতিজাকে লেখা-পড়া শিখিয়েছে। আজ রাতুল শিক্ষিত যুবক। আবুল ছাহেব চান রাতুল ভাল কোন চাকুরী পাক এবং তার ছোট মেয়েকে বিবাহ করুক। কিন্তু একথা তিনি সরাসরি রাতুলকে কখনও বলেননি। তবে রাতুলের কানে কথাটা পৌঁছেছে। এম.এ. পাশ করার পর কয়েক বছর কেটে গেছে। কোন চাকুরী সে পায়নি। ছাত্রদেরকে প্রাইভেট পড়িয়ে বেশ টাকা সে রোজগার করে। এতে ৪ সদস্যের চাচার সংসার ভালই কেটে যাচ্ছে। নতুন ঘর করেছে। তিন বেলা খাবার জন্য আর চিন্তা করতে হয় না। সবার পরণে মানানসই পোশাক শোভা পায়। তারপরও স্থায়ী কোন চাকুরী নয় বলে সে বিয়ের কথা ভাবে না। ইতিমধ্যে তার চাচা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি রাতুলকে ডেকে বলেন, বাবা! আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। তোমার বোন রাণুকে পাত্রস্থ করে যেতে পারলাম না। ওকে একটা যোগ্য পাত্রে তুলে দিয়ে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারতাম। চাচার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে রাতুল মনে মনে রাযী হয়ে যায়। কারণ মেয়ে হিসাবে রাণু খারাপ নয়। তাছাড়া ছোট থেকে তাকে দেখে এসেছে। তাই চাচীকে সে বলে, তোমাদের কোন ইচ্ছা থাকলে তোমরা তা পূরণের ব্যবস্থা কর, আমি অমত করব না। রাতুলের ভদ্রোচিত কথায় চাচী খুশি হন। একদিন শুভক্ষণে রাতুল-রাণুর বিয়ে হয়। তারা এখন সুখী দম্পতি। বিয়ের ৩ বছরের মাথায় তাদের ১ম সন্তান হয় রানা। বছর দুয়েক হ’ল রাতুল একটি বহুজাতিক কোম্পানীতে ভাল সম্মানীতে চাকুরীও পেয়েছে। থাকে ঢাকায়। প্রতি মাসে বাড়ী আসে। চাচা-চাচী, স্ত্রী-পুত্র সবাইকে দেখে যায়। সবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে আবার ফিরে যায় কর্মস্থলে।
রাতুলের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার ও কর্মস্পৃহা এবং সততায় মুগ্ধ কোম্পানীর মালিক। রাতুল আসার পর কোম্পানীর উন্নতিও হয়েছে কল্পনাতীত। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করার চমৎকার ক্ষমতা রয়েছে তার মাঝে। এজন্য যামান ছাহেব রাতুলকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। যামান ছাহেব একমাত্র মেয়ে রায়হানাকে সখ করে বিবাহ দিয়েছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনীর দুলালের সাথে। কিন্তু তার মাদকাসক্তি ও উচ্ছিন্ন অবস্থার কারণে যামান ছাহেব মেয়েকে ছাড়িয়ে নিতে বাধ্য হন। তখন থেকে তিনি মনে মনে একটি চরিত্রবান ছেলেকে খুঁজছেন। এক্ষেত্রে রাতুলই তার প্রথম পসন্দের পাত্র। তিনি রাতুলের সার্বিক অবস্থা জেনেও নিজের মেয়েকে তার হাতে তুলে দিতে রাযী। এ বিষয়ে স্ত্রী এবং মেয়ের সাথে কথাও বলেছেন। মেয়ের নিঃসঙ্গতা ঘুচানোর জন্য কোম্পানীর কিছু বিষয় দেখার জন্য তাকে কিছু দায়িত্বও দিয়ে রেখেছেন। তাই কাজের সুবাদে রাতুলের সাথে তার কিছুটা পরিচয় আছে বৈকি। এজন্য বাবার পসন্দে রায়হানা অমত করেনি।
যামান ছাহেব এক সময় রাতুলের গ্রামের বাড়ী চলে যান। কথা বলেন, রাতুলের চাচার সাথে। যামান ছাহেবের পরিচয় পেয়ে আবুল হোসেন ভাতিজার ভবিষ্যতের কথা ভেবে অমত করেন না। কিন্তু এসব রাতুল জানতে পারেনি। এক সময় যামান ছাহেব রাতুলকে ডেকে বিষয়টি বললেন। রাতুল অমত করে। বলে যে, প্রয়োজনে আমি চাকুরী ছেড়ে দিতেও রাযী। কিন্তু এই অসম বিবাহ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার স্ত্রী-সন্তান সবই আছে। যামান ছাহেব তাকে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের কথা বলে বুঝানোর চেষ্টা করেন। এতে রাতুলের মন নরম হয়। সে কিছুদিন সময় চেয়ে নেয়। বাড়ি এসে চাচা-চাচীকে প্রথমে বলে। তারা বিষয়টি রাতুলের উপরে ছেড়ে দেয়। রাতুল স্ত্রীর কাছে বলে। রাণু তাকে বলে, পৃথিবীতে সবকিছুর ভাগ মানুষ দিতে পারে। কিন্তু নারী তার স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে চায় না। শরী‘আতে যেহেতু একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ নয়, সেহেতু আমি আপনাকে নিষেধ করতে পারছি না। তবে আপনার হৃদয়ে আমার জন্য একটা জায়গা চাই; আমার সন্তানের জন্য চাই একটা নিরাপদ আশ্রয়ের। এসব থেকে আমরা যেন বঞ্চিত না হই।
রাতুল কর্মস্থলে ফিরে আসে। মালিক তাকে আবার ডেকে এ বিষয়ে বলেন। তখন সে বলে, আমি দরিদ্র কর্মচারী মাত্র। আপনার মেয়ের যোগ্য আমি নই। যামান ছাহেব বলেন, তোমার সব জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি অমত কর না। তোমার স্ত্রী-ছেলে কেউ অধিকার বঞ্চিত হবে না। তবে তুমি আরো কিছু সময় ভেবে দেখ। এদিকে রায়হানা তার মাকে নিয়ে চলে যায় রাতুলের বাড়ীতে। অনেক গল্প করার পর রাণুকে কথাটা বলে। রাণু শুধু বলে, বোন হিসাবে তোমাকে আমার হৃদয়ে স্থান দেওয়ার সুযোগ পেলে এবং তোমাকে আমার পাশে পেলে নিজেকে ধন্য মনে করব। রাণুর কথায় খুশিমনে রায়হানা ফিরে যায়। শুভক্ষণে যামান ছাহেব মেয়েকে তুলে দেন রাতুলের হাতে। এক সময় কোম্পানীর দায়-দায়িত্ব সব বুঝিয়ে দেন রাতুলকে। অনেক দিন হয়ে যায়। রায়হানার কোন সন্তান হয় না। অনেক চিকিৎসা করেও কোন লাভ হয়নি। সে জানতে পারে যে, তার আর সন্তান হবে না। ওদিকে রাণুর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরীক্ষায় ধরা পড়ে তার দু’টা কিডনীই নষ্ট হয়ে গেছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তি করতে দেরী হয়ে গেছে অনেক। সত্বর অপারেশন করতে হবে। কিন্তু রাণুর রক্তের গ্রুপের সাথে মি০ পাওয়া যায় না। তার বড় বোনের রক্তের গ্রুপ মিলে গেলেও সে কিডনী দিতে রাযী নয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও কিডনী পাওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় জানা যায় তার রক্তের গ্রুপের সাথে রায়হানার গ্রুপের মিল রয়েছে। সে একটা কিডনী দিতেও চায়। সবাই তাকে নিষেধ করে। কিন্তু কারো কথা সে মানতে নারায। সবার কথা উপেক্ষা করে সে একটা কিডনী রাণুকে দান করে। রায়হানা বলে, যে আমাকে তার স্বামীর অংশ দিয়েছে, আমার নিংসঙ্গতাকে দূর করতে সহযোগিতা করেছে, আমার নির্জীব জীবনে সজিবতা এনে দিয়েছে, আমাকে বেঁচে থাকার পথ করে দিয়েছে, আমি তাকে আমার দেহের অংশ দিয়ে তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলাম। তাছাড়া আমার চেয়ে রাণুর বেঁচে থাকা বেশী দরকার। কেননা তার সন্তান আছে। আমার তো কেউ নেই।
নাফীসা আমীন
গাছবাড়িয়া, কালিয়া, নড়াইল।