এ জগতে উত্থান-পতন, ভাঙ্গা-গড়ার খেলা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। যাঁর ইশারায় উত্থান-পতন, ভাঙ্গা-গড়ার খেলা সংঘটিত হয়, তিনিই সর্বশক্তিমান আল্লাহ। মানুষ জ্ঞান সাধনা বলে জগতে অনেক কিছু বিস্ময়কর বস্ত্ত আবিষ্কার করে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। মানুষ সময় ও দূরত্বকে জয় করেছে। এত কিছু করার পরও মানুষের নিয়তি বা ভাগ্যের উপর কোন হাত নেই। এখানে মানুষ একেবারে অসহায়। নিয়তির কারণেই একজন সুখ-সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হয়, আরেকজন সুখ-সমৃদ্ধ জীবন হ’তে ছিটকে পড়ে যায়। ভাগ্যচক্রেই তাকে অন্তহীন অশান্তি ও দুঃখময় জীবনে প্রবেশ করতে হয়। ভাগ্য-বিড়ম্বনার একটি ঘটনা নিম্নে বিবৃত করা হ’ল।-

নাজমা একজন অতি সুন্দরী ও বিদূষী যুবতী। কিন্তু তার আপনজন কেউ নেই। শৈশবেই সে পিতা মাতাকে হারায়। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সৌন্দর্যের গুণেই এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। এখন নাজমার আর সুখের শেষ নেই। স্বামীর সোহাগ ও শ্বশুর-শাশুড়ীর  আদরে  তার  দিন  কাটে। সন্তানহীন পরিবারে সন্তানের আগমন বার্তা পরিবারে অতি আনন্দের দোলা লাগে। নাজমা এখন সন্তান সম্ভবা।

একদিন  বিকালে স্বামী-স্ত্রী গাড়ী যোগে বেড়াতে বের হয়। স্বামীই চালক। দুর্ঘটনা বলে কয়ে আসে না। স্বামী গাড়ীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। উভয়ে চরম আঘাত প্রাপ্ত হয়। নাজমা গর্ভবতী থাকার কারণে তার আঘাত প্রবল হয়। ডাক্তারদের সেবা-যত্নে উভয়েই আরোগ্য লাভ করে। কিন্তু নাজমার গর্ভের সন্তানটি মারা যায়। এর সাথে সে চিরদিনের জন্য সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

স্বাভাবিক কারণেই পরিবারের উত্তরাধিকারের প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিয়ের আবশ্যকতা দেখা দেয়। নাজমা স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়েতে অনুমতিও দেয়। কিন্তু পরে তার মনে কেমন একটা ভাবের সৃষ্টি হয়। তার সামনে তার সতীনের ঘোরাফেরা অসহ্য হবে এবং সতীন সন্তান দান করে সংসারের যাবতীয় ব্যাপারে একচ্ছত্র অধিকারিণী হবে। ভাবতে তার মন শিউরে উঠে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, স্বামীর ঘর ছেড়ে সে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়াবে। সে তার মনোবেদনা ব্যক্ত করে স্বামীর নামে চিঠি লিখে রেখে সবার অলক্ষ্যে বাড়ী ছেড়ে চলে যায়। নাজমার তো আপনজন বলতে কেউ নেই। এটাই পরিবারের সবাইকে পীড়া দেয়। তাদের ভাবনা-মেয়েটা না জানি কতইনা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়ে আছে। স্বামী তাকে খুঁজে পেতে অক্লান্ত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

ইতিমধ্যে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে। কিন্তু সে প্রথম স্ত্রীর কথা ভুলতে পারে না। শ্বশুর-শাশুড়ীও বউয়ের কথা ভুলতে পারে না। দ্বিতীয় স্ত্রীর এক পুত্র ও কন্যা সন্তান হয়। কিন্তু তাতে কি হবে? নাজমার অভাবই যেন পরিবারের অশান্তির কারণ হয়ে দেখা দেয়।

নাজমা অজো পাড়াগাঁয়ে পাঠ্য জীবনের এক বান্ধবীর আশ্রয়ে উঠে। সেখানে সে শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। সে কয়েক বছর ধরেই তার শিক্ষকতার টাকা সঞ্চয় করে রাখে। ভাগ্য যার প্রসন্ন নয়, কোনখানেই তার সুখ হয় না। নাজমা মরণব্যাধি লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।

এতদিন ধরে যে অজ্ঞাত বাস করে এসেছে, মরণকালে সে স্বামীকে তার ঠিকানা জানিয়ে চিঠি লেখে। চিঠি পেয়ে স্বামী সেখানে ছুটে যায়। বহুদিন পর স্বামী-স্ত্রীতে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়। স্বামী তাকে ঢাকা নিয়ে এসে চিকিৎসা করতে চায়। কিন্তু তখন আর সময় নেই। মানুষ নিজের মনের খবর নিজেই জানে না। যে নাজমা সতীনের ঘোরাফেরা অসহ্য হবে মনে করে এবং সতীন সন্তান দান করলে নাজমা পরিবারের অপ্রয়োজনীয় বস্ত্ততে পরিণত হবে ভেবে বাড়ী ছেড়ে চলে এসেছিল, সে নাজমাই আজ তার সঞ্চিত সব টাকা-পয়সা সতীনের সন্তানের জন্য স্বামীর হাতে তুলে দেয়। অতঃপর সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

মুহাম্মাদ আতাউর রহমান

সন্ন্যাসবাড়ী, বান্দাইখাড়া, নওগাঁ।






আরও
আরও
.