শাফীক বালখী কর্তৃক বাদশাহ হারূনুর রশীদকে উপদেশ

বর্ণিত আছে, একদা শাফীক বালখী বাদশাহ হারূনুর রশীদের দরবারে প্রবেশ করলে বাদশাহ তাকে বললেন, আপনি কী শাফীক যাহেদ (দুনিয়াবিরাগী শাফীক)? তখন তিনি বললেন, আমি শাফীক, তবে যাহেদ নই। বাদশাহ তাকে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে আবুবকর ছিদ্দীকের আসনে আসীন করেছেন। অতএব তিনি আপনার থেকে অনুরূপ সত্যবাদিতা কামনা করেন। তিনি আপনাকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের মসনদ দান করেছেন। তাই তিনি আপনাকে তাঁর মত সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসাবে দেখতে চান। তিনি আপনাকে ওছমান ইবনু আফফান (রাঃ)-এর আসনে সমাসীন করেছেন। অতএব তিনি আপনার থেকে তাঁর মত লজ্জাশীলতা ও দানশীলতা প্রত্যাশা করেন। তিনি আপনাকে বিজ্ঞ আলী ইবনু আবী ত্বালিবের সিংহাসনে আরোহণ করিয়েছেন। অতএব তিনি আপনার থেকে তাঁর মত জ্ঞান ও লোকদের প্রতি ন্যায়বিচার কামনা করেন, যেমন তার থেকেও কামনা করেছিলেন। বাদশাহ বললেন, আপনি আরো কিছু উপদেশ দিন। তখন শাফীক বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই উপদেশ দিব। জেনে রাখুন, আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম নামক একটি ঘর নির্মাণ করেছেন এবং আপনাকে সে ঘরের দারোয়ান (রক্ষক) নিযুক্ত করে তিনটি জিনিস দান করেছেন। সেগুলো হ’ল- বায়তুল মাল, চাবুক ও তরবারী। অতঃপর নির্দেশ দিয়েছেন যাতে আপনি এ তিনটি দ্বারা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জীবকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করতে পারেন। অতএব যে কোন অভাবী আপনার নিকট আসলে তাকে বায়তুল মাল হ’তে বঞ্চিত করবেন না। কোন ব্যক্তি তার প্রতিপালক আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে তাকে চাবুক দ্বারা আদব শিক্ষা দিবেন তথা শায়েস্তা করবেন। কোন ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে তাকে নিহতের অভিভাবকের অনুমতিক্রমে তরবারী দ্বারা হত্যা করবেন। আপনি যদি এই নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন না করেন তাহ’লে আপনি হবেন জাহান্নামীদের সর্দার এবং অধঃপতিতদের সর্বাগ্রে অবস্থানকারী। খলীফা হারূনুর রশীদ বললেন, আরো উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন, আপনার দৃষ্টান্ত পানির ঝরণার মত, আর পৃথিবীতে আলেমগণ হ’লেন ছোট ছোট নদী তুল্য। যদি ঝর্ণার পানি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার থাকে, তাহ’লে নদীর ঘোলাটে অস্বচ্ছ পানি তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। পক্ষান্তরে ঝরণার পানি যদি অস্বচ্ছ ও অপরিষ্কার থাকে, তাহ’লে নদীর স্রোত ও পরিষ্কার পানি দ্বারা কোন ফায়দা হবে না। 

ফুযায়েলের উপদেশ

এক রাতে বাদশাহ হারূনুর রশীদ ও তার সহযোগী আববাস ফুযায়েল ইবনু ইয়ায-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হ’লেন। তারা তার দরজায় পৌঁছলে তাকে কুরআনুল কারীমের নিম্নের আয়াতটি পাঠ করতে শুনলেন, ‘দুষ্কৃতিকারীরা কি মনে করে যে, আমি জীবন ও মৃত্যুর দিক দিয়ে তাদেরকে তাদের সমান গণ্য করব যারা ঈমান আনে ও আমল করে? তাদের সিদ্ধান্ত কত মন্দ’! (জাছিয়া ৪৫/২১)। অর্থাৎ গুনাহ উপার্জনকারী ও মন্দ আমলকারীরা কী ধারণা করে যে, আমি পরকালে তাদের মাঝে ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী সৎ আমলকারীদের মাঝে সমতা স্থাপন করব? এটা কখনও না। তাদের বিচার-বুদ্ধি কতইনা মন্দ! তখন বাদশাহ হারূণ বললেন, আমরা যদি উপদেশ গ্রহণ করার জন্য এসে থাকি, তাহ’লে এই উপদেশই যথেষ্ট। অতঃপর বাদশাহ আববাসকে দরজায় করাঘাত করার নির্দেশ দিলে আববাস দরজায় করাঘাত করে বললেন, আমীরুল মুমিনীনের জন্য দরজা খুলুন। তখন ভিতর থেকে ফুযায়েল জিজ্ঞেস করলেন, আমীরুল মুমিনীন! আমার এখানে কী করবেন? তিনি বললেন, আমীরের আনুগত্য করুন এবং দরজা খুলুন। তখন রাত হওয়ায় ঘরে বাতি জ্বলছিল। তিনি বাতি নিভিয়ে দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। বাদশাহ হারূণ ঘরে প্রবেশ করে ফুযায়েলের সাথে মুছাফাহা করার জন্য অন্ধকারে ঘরের এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি শুরু করলেন। যখন তার হাতে হাত পড়ল তখন ফুযায়েল বলে উঠলেন, এ নম্র হাতের জন্য আফসোস! যদি না এই হাত ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা না পায়। অতঃপর তাঁকে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করার জন্য প্রস্ত্তত হোন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এক এক করে প্রত্যেক মুসলমানের সাথে দাড় করিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি তাদের প্রত্যেকের সাথে ইনছাফ করেছেন কি-না? বাদশাহ হারুণ এটা শুনে অঝোর নয়নে কাঁদলেন এবং তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন তাঁকে আববাস বলল, থামুন! আপনি তাঁকে নিঃশেষ করে দিলেন।

তখন ফুযায়েল বললেন, হে হামান! আপনি এবং আপনার লোকেরা তাঁকে ধ্বংস করে দিয়েছেন আর আপনি আমাকে বলছেন থামুন? খলীফা হারূণ বললেন, তিনি আপনাকে হামান বলার অর্থ হ’ল তিনি আমাকে ফেরাঊন ভাবছেন। অতঃপর বাদশাহ হারুণ তার সামনে এক হাযার দীনার রেখে দিয়ে তাকে বললেন, এগুলো হালাল সম্পদ, আমার মায়ের মোহর ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ। তখন ফুযায়েল তাঁকে বললেন, আমি আপনাকে যে অবস্থা হ’তে মুক্ত হওয়ার কথা বলছি, আপনি কি-না আমাকে সে অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? তিনি সেই উপঢৌকন গ্রহণ না করে সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন।

আব্দুর রহীম

নওদাপাড়া মাদরাসা (আমচত্বর), রাজশাহী।






আরও
আরও
.