
দুনিয়াদারের অবস্থা হ’ল
অতিথিসম! যেন তার জন্য দস্তরখানা বিছানো হ’ল। এদিকে অতিথিপরায়ণ ব্যক্তির
অভ্যাস হ’ল স্বীয় অতিথিবৃন্দের সামনে ঘর সাজানো, আগ্রহের সাথে অতিথিকে
স্বাগত জানানো, এক দল সৈন্য বা গোত্রকে খাওয়ানোর পর আরেক দল সৈন্য বা
গোত্রকে খাবারের প্রতি আহবান করা, তাদের সামনে ধূপসম্বলিত জহরতপূর্ণ সোনার
পাত্র উপস্থাপন করা এবং ধূপ জ্বালানোর জন্য রূপার অংগার ধানিকা দান করা যেন
অতিথিবৃন্দ তা থেকে সুগন্ধি লাভ করতে পারে। অতঃপর রীতি অনুযায়ী
স্বর্ণ-রূপার পাত্র তার মালিককে ফিরিয়ে দিতে হয় যাতে পরবর্তী অতিথিবৃন্দকে
তা দ্বারা আপ্যায়ন করতে পারে। এমতাবস্থায় আতিথেয়তার নিয়মাবলী সম্পর্কে
জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি এগুলো ব্যবহার করতঃ সুগন্ধি লাভ করবে এবং বিদায়ের
প্রাক্কালে পাত্রসমূহ মালিকের নিকট রেখে চলে যাবে এবং এর প্রতি কোন রকম
লোভ-লালসা করবে না এবং তাদের হৃদয়ে এগুলোর প্রতি সামান্যতম চাহিদাও থাকবে
না। বরং সে পরিবেশক ও মেযবানকে কৃতজ্ঞতা জানাবে। কিন্তু এই সম্পর্কে অজ্ঞ
ব্যক্তি তথা দুনিয়া লোভী ধারণা করবে যে, এই পাত্রগুলোও তাকে দিয়ে দেওয়া
হয়েছে। ফলে সে বিদায়ের প্রাক্কালে পাত্রগুলো সাথে করে নিয়ে যেতে চাইবে।
কিন্তু সে এগুলো নিয়ে যেতে পারবে না। কারণ মালিক কর্তৃক তা ফেরত চাওয়া হবে।
অতএব সে ভগ্ন প্রাণ ও মনমরা হয়ে পড়বে এবং নিজের কৃত ভুল কর্মের জন্য ক্ষমা
প্রার্থী হবে। বলাবাহুল্য দুনিয়া হচ্ছে পথিকের রাস্তা এবং অতিথিশালার মত।
এখান থেকে মানুষ যেন শুধুমাত্র খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে। অতিথিশালা ও
মেযবানের পাত্রের প্রতি কোন লোভ না করে।
দুনিয়ালোভী ইহকাল-পরকাল উভয়ই হারায়
দুনিয়াদার এবং আখেরাতের কথা ভুলে গিয়ে শুধু দুনিয়াবী কাজে লিপ্ত ব্যক্তি ও দুনিয়াকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে পরকালকে হেয়প্রতিপন্নকারী ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টান্ত হ’ল ঐ দলের মত যারা নৌকাযোগে সমুদ্র ভ্রমনে বের হ’ল। অতঃপর মলমূত্র ত্যাগ করতঃ তা থেকে পবিত্রতা লাভের উদ্দেশ্যে কোন এক দ্বীপে অবতরণ করল। জলযান হ’তে অবতরণ কালে মাঝি তাদেরকে অন্য কোন কাজে লিপ্ত না হয়ে শুধু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে পবিত্রতা লাভ করতঃ ছালাত আদায়ের পর যথাসময়ে নৌকায় ফিরে আসার আহবান জানাল। সাথে সাথে এ বলে সতর্ক করে দিল যে, দেরী করলে নৌকা ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু তারা দ্বীপের মধ্যস্থলে গিয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ছিল তারা বেশী দেরী না করে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে পবিত্রতা অর্জন করতঃ ছালাত আদায় করে তাড়াতাড়ি ফিরে আসল এবং জলযান খালি পেয়ে ইচ্ছামত আরামদায়ক ও উপযুক্ত উঁচু আসনে জায়গা করে নিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একদল এমন ছিল যারা দ্বীপের মধ্যবর্তী অপূর্ব দৃশ্যাবলী অবলোকন করার জন্য বেড়াতে লাগল। সেখানকার ফল-ফুল দেখতে লাগল, সুশোভিত বৃক্ষরাজির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ল, পাখীদের কল-কাকলী ও সংগীত শুনতে লাগল এবং রং-বেরঙের পাথরের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। অতঃপর যখন জলযানের দিকে ফিরে আসল তখন আর তারা কোনরকম প্রশস্ত জায়গা পেল না। অগত্যা তাদেরকে সংকীর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় আসন গ্রহণ করতে হ’ল। তাদের মধ্যে আরেক দল ছিল তারা শুধু দ্বীপের মধ্যে ভ্রমণ করল না। বরং সেখান হ’তে কিছু রঙিন পাথরও কুড়িয়ে নিয়ে আসল এবং তাদের ভাগ্যে এমন সংকীর্ণ জায়গা জুটল যে কোন রকমে শুধু নিজেরা বসতে পারল এবং পাথরে বোঝা স্ব স্ব কাঁধের উপরেই রাখতে হ’ল। দুই একদিন অতিবাহিত হওয়ার পর যখন পাথরের টুকরাগুলো কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল এবং দুর্গন্ধময় হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগল তখন জায়গার সংকীর্ণতার জন্য না নীচে নামিয়ে রাখতে পারল? না ফেলে দিতে পারল। অতএব স্ব স্ব কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং পাথরের বোঝা বহন করার জন্য লজ্জিত হওয়া ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর থাকল না। তাদের মধ্যে অপর একটি দল ছিল যারা দ্বীপের আশ্চর্যজনক দৃশ্যাবলী দেখে এমনভাবে বিমোহিত হয়ে পড়ল যে জলযানে ফিরে আসার কথা পর্যন্ত একেবারে ভুলে গেল। এমতাবস্থায় নৌকা ছেড়ে চলে গেল। ফলে তারা তাদের সাথীদের নিকট হ’তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল এবং তাদের পিছু ডাক আর কারো কর্ণগোচর হ’ল না। অবশেষে দ্বীপের হিংস্র জন্তুসমূহের আহারে পরিণত হ’য়ে তারা প্রাণ হারাল।
বলা বাহুল্য তাদের মধ্যে প্রথম দলটি হ’ল মুমিন সংযমী ও পরহেযগার ব্যক্তিবর্গের এবং শেষের ধ্বংসপ্রাপ্ত দলটি হ’ল কাফির ও মুশরিকদের যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভুলে গিয়েছিল এবং দুনিয়ার প্রতি সর্বাত্মকভাবে নিজেদের সমর্পণ করেছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘এটা এজন্য যে তারা দুনিয়ার স্বার্থকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দিয়েছে’ (নাহল ১৬/১০৭)।
এখন বাকী থাকল মধ্যবর্তী দু’টি দল- এরা সকলেই পাপী। তবে তারা তাদের মূল ঈমান ঠিক রেখেছে। কিন্তু দুনিয়া পূজা হ’তে তারা হস্ত সংবরণ করেনি। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ভোগ করেছে এবং বাকী সংখ্যক দরিদ্রতার জন্য ভোগ করতে পারেনি। এমতাবস্তায় তাদের উপর কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার বোঝা ভারী হয়ে যাওয়ায় তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এর ফলে তাদের পাপের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
আব্দুর রহীম
আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।