বুদ্ধিমান বালক

বহু দিন আগের কথা। প্রাচীনকালে তিন ব্যক্তি ব্যবসা করত। একবার জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা ডাকাতের কবলে পড়ে। ডাকাতরা তাদের সমস্ত জিনিস পত্র কেড়ে নেয়। তারা শূন্য হাতে বাড়ী ফিরতে চায়নি। তাই তারা একটি শহরে প্রবেশ করল। নিজেরা পরামর্শ করল, একসাথে কাজ করে খরচ কমিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করবে। অতঃপর পূর্বের ব্যবসায় ফিরে গিয়ে পরিবারের জন্য টাকা-পয়সা ও উপহার সামগ্রী নিয়েই বাড়ী ফিরবে।

শহরের একটি কফি শপে তারা প্রথম রাত কাটায়। রাতের খাবার ও ভাড়া বাবদ শপের মালিকের কাছে ঋণী হয়ে যায়। প্রথম দিন থেকেই তারা কাজের সন্ধান করতে থাকে। তাদের তিনজনের একজন ছিল রাজমিস্ত্রি তাকে ‘শ্রমিক’ বলা হ’ত। আরেকজন কথা বলায় পারদর্শী ছিল, তাকে ‘দালাল’ বলা হ’ত। তৃতীয় ব্যক্তি শক্তিশালী ছিল। মারামারিতে সে পারদর্শী ছিল। তাকে ‘পালোয়ান’ বলা হ’ত। শ্রমিক লোকটি ফজরের ছালাত পড়ে দালালকে ডেকে বলত, হে ভাই! তুমি এখনো উঠনি? তুমি তাড়াতাড়ি উঠে আমার জন্য কাজ খুঁজে দাও। দালাল তৃতীয় ব্যক্তিকে জাগিয়ে বলত, তুমি আমাদের সাথে আসো। কোন সমস্যা হ’লে সমাধান করে দিবে।

শ্রমিকরা কাজের জন্য যেখানে অপেক্ষা করে তিনজন সেই মোড়ে এসে দঁাড়ায়। কোন ব্যক্তি শ্রমিকের খেঁাজে এসে কারো সাথে কথা বলা শুরু করতেই দালাল দৌড়ে এসে বলে, জনাব! আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে। তাকে এক কোণে ডেকে বলে, আমরা তিনজন এই শহরে নতুন এসেছি। আমরা একটি জাহাযের যাত্রী ছিলাম। সেই জাহাযটি ডুবে যাওয়ায় আমাদের সবকিছু হারিয়ে যায়। আমাদের একজন অভিজ্ঞ শ্রমিক বন্ধু আছে। আমরা কাজ না পেলে আহার জুটবে না। যেহেতু আপনার একজন শ্রমিক প্রয়োজন সেহেতু আমাদের এই বন্ধুকে কাজে নিলে আমরাও তার সাথে কাজ করব।

মালিক বলল, আমার একজন রাজমিস্ত্রি প্রয়োজন। সহযোগী হিসাবে তোমার বন্ধুকে নেব। তখন উপস্থিত অন্যান্য শ্রমিকরা প্রতিবাদ করে বলল, আগে ঘর তবে পর। আমরা এই শহরের বাসিন্দা। আগে আমাদের কাজ দিতে হবে। এ সময় পালোয়ান লোকটি তাদের সামনে গিয়ে বলে, আমি জাবালকা শহরের পালোয়ান। বেশী কথা বললে সবাইকে পিষে ফেলব। একাই সত্তর জনকে দমনের শক্তি রাখি। শ্রমিকরা ঝগড়াটে ছিল না। পালোয়ানের সুঠাম দেহ দেখে তারা বলল, ঠিক আছে আপনি আমাদের মেহমান। আমরা ঝগড়া পসন্দ করি না। আগে আপনিই কাজ নেন।

অতঃপর লোকটি শ্রমিককে কাজে নিয়ে গেল। সে খুব পরিশ্রমী হওয়ায় তাকে ভাল মজুরি দিয়ে বলল, কাল সকালে দ্রুত কাজে এসো। রাতে শ্রমিক বাড়ী ফিরে আসে। মজুরী পরস্পরে ভাগাভাগি করে নেয়। তারা ঋণ পরিশোধ করে। পরদিন সে আবার কাজে চলে যায়। অন্য দু’জন এখানে সেখানে ঘুরত, বিভিন্ন জিনিস কিনে টাকাগুলো খরচ করে ফেলত। শ্রমিক প্রতিবাদ করলে দালাল বলত, আমি না থাকলে কাজই পেতে না। অপরজন বলত, আমি সমাধান না করলে কাজই জুটত না। এভাবেই চলতে থাকল।

রাজমিস্ত্রি কাজ করত আর অন্য দু’জন উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করত। এভাবে কয়েক মাস কেটে গেলে তৃতীয় ব্যক্তির কাছে কিছু টাকা জমা হ’ল। শ্রমিক বলল, এবার আমরা টাকাগুলো ভাগ করে নিজেদের মত আলাদা হয়ে কাজ করি। দালাল জবাব দিল, এই টাকায় আমাদের তিন জনেরই অধিকার আছে। কারো হক যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য বিশ্বস্ত কারো কাছে এই টাকা জমা রাখব। এখন একশত পঞ্চাশ টাকা না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরব। অতঃপর টাকা তিনভাগ করে মালামাল কিনে নিজেদের শহরে ফিরে যাব। সকলেই তার কথা মেনে নিল। শহরে একজন বৃদ্ধ আমানতদার, পরোপকারী লোক ছিল তার কাছে টাকা জমা রাখা হ’ল। তারা বৃদ্ধকে বলল, আমরা এই শহরে অপরিচিত। কাউকে চিনি না। একশ’ টাকা আপনার কাছে আমানত রাখতে চাচ্ছি। যখনই আমরা তিনজন একসাথে আসব তখন এই টাকা চাইলে আমাদের দিয়ে দিবেন। তিনজন একসাথে না আসলে দিবেন না। বৃদ্ধ তাদের কথামত টাকা গচ্ছিত রাখল আর তারা নিজেদের কাজে ফিরে গেল।

কিছুদিন পর হঠাৎ শ্রমিকের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। দালালের দালালী আর কোন কাজে আসল না। অন্যজন বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি আমাদের পয়সা রাখার ব্যাগ আর সাবান কেনার সামান্য টাকাটাও দাওনি। শ্রমিক বলল, এখনো কিছুই করতে পারলাম না। না জানি আবার কবে কাজ পাব। গোসল করতেও যেতে হবে। একজন বৃদ্ধের কাছে গিয়ে একটা ব্যাগ আর সাবান কেনার টাকা ধার করে আনলে ভাল হয়। পরে হিসাব করে দিয়ে দেব। দালাল বলল, তুমি গেলে ভাল হয়। আমার আত্মসম্মান আছে। ধার চাওয়া একটা লজ্জাজনক কাজ। পালোয়ান বলল, আমি এই শক্তিশালী দেহ নিয়ে বুড়ার কাছে ধার চাইতে যেতে পারব না। তুমি দিনমজুর, তুমিই এই কাজ ভাল পারবে।

শ্রমিক মনে মনে ভাবল, আজব মানুষ এরা! আমি পরিশ্রম করে নিজের হাতের কামাই তাদের সাথে ভাগ করে নেই আর আজ আমাকে আত্মসম্মান খোয়াতে হবে? ঠিক আছে। আমি গিয়ে আমার টাকা নিয়ে নেব। তারপর তারা বুঝবে কাজ করতে কেমন কষ্ট লাগে। সে বলল, ঠিক আছে আমি বৃদ্ধের কাছে যাচ্ছি। কিন্তু তোমরাও গলির মধ্যে থেকো। যদি তিনি বিশ্বাস না করেন তাহ’লে তোমরা সাক্ষ্য দিও। শ্রমিক তাদেরকে গলির ভেতর রেখে বৃদ্ধের বাড়ীতে প্রবেশ করে বলল, আমাদের টাকাগুলো নিতে এসেছি। সেই টাকা দিয়ে সাবান কিনে গোসল করব। বৃদ্ধ বলল, ঠিক আছে। তবে শর্ত ছিল টাকা একজনের হাতে দেয়া যাবে না। তিনজনকেই আসতে হবে। শ্রমিক বলল, আমরা তিনজনই আছি। আসলে আমাদের তাড়া আছে। তারা বাইরে গলির মধ্যে দঁাড়িয়ে আছে। আপনি চাইলে আপনার বাড়ীর ছাদে উঠে তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। বৃদ্ধ বাড়ীর ছাদে উঠে তাদেরকে দেখে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের বন্ধু সত্য বলছে কি? সাবান কেনার জন্য টাকা দেব? তারা সম্মতি দিল। বৃদ্ধ তখন তার হাতে সব টাকা দিয়ে দিল। আসলে টাকাগুলো তারই কষ্টার্জিত ছিল। সে টাকা পেয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে নিজের শহরে ফিরে গেল।

এদিকে তারা দু’জন সেখানে দীর্ঘ সময় দঁাড়িয়ে থেকে দেখল তাদের বন্ধু আর আসছে না। তাই তারা বৃদ্ধের বাড়ীতে গিয়ে বলল, আমাদের বন্ধু কোথায়? বৃদ্ধ বলল, সে তো অনেকক্ষণ আগেই টাকা নিয়ে চলে গেছে। এখন কোথায় আমি জানি না। তারা চিৎকার করে বলে উঠল কেন আপনি তাকে টাকা দিলেন? সাধারণ লোকজন জমা হয়ে গেল। জানতে চাইল কী হয়েছে? বৃদ্ধ সবকিছু খুলে বলল। নগরবাসী বলল, বৃদ্ধ ঠিকই করেছে। সে তো আপনাদের কাছে অনুমতি চেয়েছে। আপনারাও অনুমতি দিয়েছেন। এখন তার কিছুই করার নেই। কিন্তু তারা কারো কথা না শুনে শহরের কাযীর কাছে বিচার দিল।

বিচারক বললেন, কারো আমানত রাখলে সেটা শর্ত অনুযায়ী ফেরত দিতে হবে অথবা আমানত রাখবে না। ঐ লোক তোমাকে ধেঁাকা দিলেও তুমি তিনজনের টাকার আমানতদার ছিলে। সেকারণ তোমাকে উক্ত টাকা দিতে হবে। বৃদ্ধ লোকটি অনুনয়-বিনয় করে বললেন, আমার কোন দোষ নেই। কিন্তু বিচারক শুনলেন না। তিনি বললেন, যদি কারো কাছে আমানত রাখা হয় আর সে যদি খেয়ানত করে অথবা অবহেলা করে নষ্ট করে, তবে তার দায়ভার তার উপরই বর্তায়। সেজন্য যার আমানত তাকে ফেরত দিতে হবে। নিরুপায় হয়ে বৃদ্ধ একদিনের জন্য সময় চেয়ে বললেন, আগামীকালের মধ্যে আমি পলাতককে খুঁজে বের করব। কাযী তাকে সময় দিলেন। বৃদ্ধ মনক্ষুণ্ণ হয়ে কাযীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কঁাদতে কঁাদতে পথ চললেন। আর ভাবলেন, আমানত রাখলাম ছওয়াব পাব বলে। কিন্তু এখন পড়লাম এক মহা বিপদে!

সেই গলিতে খেলছিল কয়েকজন বালক। তারা বৃদ্ধকে এরকম পেরেশান অবস্থায় দেখে ঘিরে ধরল। জিজ্ঞেস করল, দাদু তুমি কঁাদছ কেন? বৃদ্ধ বলল, বিশেষ একটা কারণে। আমি ভুল করে ধরা পড়েছি। তোমরা বুঝবে না। এক বালক বলল, আমরা আনন্দ করছিলাম। কিন্তু তোমার এই অবস্থা দেখে আমাদেরও কষ্ট লাগছে। বলো না, তোমার কী হয়েছে? অবশেষে বৃদ্ধ সবকিছু খুলে বলল, এবার মাথায় ঢুকল তো? বালকটি বলল, কেন ঢুকবে না? ভালই ঢুকেছে। যদি আমি এই সমস্যার সমাধান করে দেই তাহ’লে আমাদেরকে এক বাটি খেজুর দিবে? বৃদ্ধ বলল, এক বাটি কেন, দুই বাটি দেব।

বালকটি হেসে বলল, এখনই কাযীর কাছে গিয়ে বল সেই বাদী দু’জন এবং কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাকে সাক্ষী হিসাবে হাযির করুন। তারপর বলবে, টাকা জমা রাখার ঘটনা সকলের সামনে বাদীরা বলুক। ঘটনা বলার পর বলবে আমার কাছে আমানত ছিল ঠিকই। কিন্তু শর্তমতে তিনজন একসাথে আসলেই আমি সেটা দেব। আর এখন তো তিনজন এখানে নেই। তাই আমিও আমানত দিতে বাধ্য নই। এটা বললে, কাযীর আর কিছুই বলার থাকবে না।

বালকটির কথা শুনে বৃদ্ধের চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি দ্রুত কাযীর কাছে গিয়ে সেভাবেই বললেন। কাযী বাদীর কথা ও বৃদ্ধার উত্তর শুনে বললেন, এটাই সঠিক কথা এবং শরী‘আতের বিধান। শর্ত ছিল তোমরা তিনজন একত্রে এসে টাকা নিবে; কিন্তু এখন তোমরা দু’জন উপস্থিত। যাও তৃতীয় বন্ধুকে নিয়ে এসো তারপর টাকা পাবে। বাদীরা সুবিধা করতে পারল না। কাজ করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় রইল না।

অতঃপর কাযী বৃদ্ধকে বললেন, আগে কেন এই জবাব দিলে না? লোকটি বলল, এই জবাবটি দুই বাটি খেজুরের বিনিময়ে কিনে এনেছি। তারপর বালকটির কথা বললেন। কাযী বালকটিকে ডেকে পাঠালেন এবং তার বুদ্ধিমত্তা দেখে তার পড়াশোনার দায়িত্বগ্রহণ করলেন। পরবর্তীতে বালকটি অনেক বড় শিক্ষিত পন্ডিত হ’ল [গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত]।

শিক্ষা : কখনও কখনও ছোটরাও সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে। সেজন্য তাদের সাথেও পরামর্শ করা এবং তাদের মতামত নেওয়া উচিত।

আল্লাহ আমাদেরকে এ গল্প থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক্ব দান করুন।-আমীন!


মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।






মৃত্যু যাত্রায় কেউ আমাদের সাথী হবে কি? - আনাস বিন আমানুল্লাহ, নওদাপাড়া, রাজশাহী
অপরাধী স্বীয় অপরাধের প্রতিফল পাবে - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
লক্ষ্যহীন জীবনের প্রতি - নাজমুন নাঈম
আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
উত্তম মৃত্যু - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ক্বিয়ামতের সামান্য দৃশ্য - আত-তাহরীক ডেস্ক
কৃতজ্ঞতা - মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম - আব্দুল্লাহ বিন আবদুর রাযযাক
যেমন পিতা তেমনি সন্তান - হাফেয মুহাম্মাদ সাইফুয্যামান, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব
প্রবৃত্তি দমনের পুরস্কার - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আদর্শ মা-বাবার যোগ্য ছেলে
পর্দার বিধান পালন না করার পরিণতি - উম্মে হাবীবা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আরও
আরও
.