শৈশবেই
পিতৃহারা বালক আব্দুল্লাহ। পিতার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন যাবৎ সে মায়ের সাথেই
বাস করে আসছে। মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় কিছু হবে। তাই
শত কষ্টের মাঝেও সন্তানের পড়ালেখার খরচ নিজেই বহন করতেন। নিজের কষ্টগুলো
লুকিয়ে রেখে ছেলের আদর-যত্নে কোন কমতি রাখতেন না। বাড়ির সব কাজ তিনি একাই
সামলাতেন। ছেলের লেখাপড়াতে যাতে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, সেজন্য কখনো তাকে
কোন কাজে বলতেন না। ছেলে এক সময়ে স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পা রাখলো।
পড়াশুনা ভালোভবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু না। সন্তানের সেই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখার পূর্বেই মা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। মাতৃবিয়োগে তরুণ ছেলেটি একবারে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ল। অনেক দিন পরেও প্রত্যেক ছালাতে সে মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে কান্নায় বুক ভাঁসাতো। মায়ের জন্য সে নিয়মিত দান-ছাদাক্বা করত। সব সময় সে প্রার্থনা করত যেন আল্লাহ তা‘আলা তার নেক আমলের প্রতিদান তার মাকে প্রদান করেন।
এরপর বহুদিন অতিবাহিত হ’ল। পড়াশুনা শেষ করে সে একদিন প্রতিষ্ঠিত হ’ল। ভালো চাকুরী পেয়ে বিবাহ-শাদী সেরে সচ্ছল জীবন-যাপন করতে লাগলো। একসময় আল্লাহ তার ঘরে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান দান করলেন। তার নাম রাখা হ’ল মুহাম্মাদ। ছেলেও দিনে দিনে বড় হ’তে থাকল।
একদিন তিনি ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে এলাকার মসজিদের দিকে বের হ’লেন। দেখলেন কয়েকজন লোক মুছল্লীদের জন্য ঠান্ডা পানি সরবরাহ করতে মসজিদে ফিল্টারযুক্ত ফ্রিজ স্থাপন করছে। পরদিন দেখলেন লোকজন তৃপ্তিসহকারে ঐ ফ্রিজ থেকে পানি পান করছে এবং দাতার জন্য দো‘আ করছে। এসব দেখে তিনি মনে মনে ভাবলেন, অহেতুক কাজে কত টাকাই তো খরচ হয়ে যায়। অথচ মসজিদের এই প্রয়োজনীয় কাজে খরচ করার কথা কখনো আমার মাথায় আসেনি! এরকম একটা ছাদাক্বায়ে জারিয়া থেকে আমি বঞ্চিত হ’লাম!
কিছুদিন পর মসজিদে মুছল্লীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আরেকটি ফ্রিজ স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিল। একথা জেনে তিনি আর সময় নষ্ট করলেন না। এ কাজটি সম্পন্ন করার প্রস্তাব নিয়ে ইমাম ছাহেবের নিকটে এসে সালাম দিলেন। কিছু বলার পূর্বেই ইমাম ছাহেব তার উদ্দেশ্যে বললেন, হে মুহাম্মাদের আববা! এই ফ্রিজটি দান করার জন্য আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আপনার জীবনকে বরকতমন্ডিত করুন। একথা শুনে তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমি তো দান করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি মাত্র। ইমাম ছাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি কি বলছেন? আমরা এই ফ্রিজটা তো আপনার পক্ষ থেকেই পেয়েছি।
এমন সময় তার ছেলে মুহাম্মাদ এসে হাযির। সে বলল, আববু! আপনার পক্ষ থেকে আমিই এই ফ্রিজটি দান করেছি। পিতা যেন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। পিতার হাতে চুমু খেয়ে মুহাম্মাদ বলল, আববু! বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আপনাকে দেখি দাদীর জন্য কিভাবে আপনি দান করে চলেছেন। তাই অনেক দিন থেকে আমার খুব ইচ্ছা যে, আমি আপনার জন্য কিছু একটা দান করব। আল্লাহ আমার এই দানের বিনিময়ে যেন আপনার গুনাহসমূহ ক্ষমা করেন এবং আপনাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের অধিবাসী করেন। পিতার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, বাবা! তুমি তো কোন চাকুরী করো না, কেবল ইনটারমিডিয়েট পড়। এত টাকা তুমি কোথায় পেলে?
ছেলে বলল, ‘গত পাঁচ বছর যাবৎ আমি এ টাকা সঞ্চয় করছি। আপনি আমাকে প্রতিদিন যে হাত খরচ দিতেন, সেখান থেকে একটু একটু করে জমা করেছি। পাঁচ বছর পর আল্লাহ আমার সে আশা পূর্ণ করেছেন’। ফালিল্লাহিল হামদ!
শিক্ষা : পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ ঋণ দানের মত। পিতা-মাতার প্রতি আমরা যে আচরণ করব, অবশ্যই আমাদের সন্তানদের পক্ষ থেকেও আমরা অনুরূপ আচরণ পাব। সুতরাং পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা এবং তাদের প্রতি রূঢ় আচরণের পূর্বে ভবিষ্যত চিন্তা করা আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের সকলকে আব্দুল্লাহ ও মুহাম্মাদের মতো মানুষ হওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!