মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছে বাদীনী মুনীরা বেগম।
যবানবন্দী দিতে আদালতের কর্মচারীর সহায়তায় হলফ পড়ছে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ব্যতীত মিথ্যা বলিব না, কোন কথা গোপন করিব না’।
স্যার আমি মামলাটি প্রত্যাহার চাই।
-মামলা চালাবেন না কেন? প্রশ্ন করি আমি।
উনার সাথে আমার মিটমাট হয়ে গেছে, উত্তর দেয় বাদিনী।
-কিভাবে মিটমাট হ’ল, সংসার করছেন?
-না স্যার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
কতদিন হ’ল ছাড়াছাড়ি হওয়ার?
-প্রায় এক মাস।
বাদিনীর সাথে কথা বলার সাথে সাথে আরজির পাতায় পাতায় চোখ চলছে নির্নিমেষ গতিতে। তৃতীয় পাতায় মুনীরার তিন বছরের শিশু সন্তানের জায়গায় এসে চোখ আটকে যায় আমার।
-বাচ্চাটি কোথায়?
-ওরা নিয়ে নিয়েছে।
-আপনি নিলেন না কেন?
-আমাকে দেয়নি।
মুহূর্তেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মুনীরার সদ্য সাবেক স্বামীর দিকে চোখ তুলে দেখি তার কোলেও বাচ্চা নেই।
স্বামীকে জিজ্ঞেস করি আলভী কোথায়?
-বাইরে আমার মায়ের কোলে; আসামীর সাহসিকতাপূর্ণ উত্তর।
‘আদালত বাচ্চাটিকে দেখতে চায় ভিতরে আনা হোক’ খুব আদেশ দিতে ইচ্ছে করে আমার।
কিছুক্ষণ পরে আলভী তার দাদীর কোলে চড়ে আদালতে প্রবেশ করে।
কনকনে শীতে আলভীর মুখ কালো হয়ে গেছে।
একবার আলভীর দিকে আর একবার তার পিতা-মাতার দিকে পুনঃ পুনঃ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি।
কাউকে কিছু বলতে পারি না।
আলভীর মাকে জিজ্ঞেস করি- সংসারটা হ’ল না কেন?
-স্যার ওরা খালি যৌতুক চায় আর মারে।
একই কথা বলি আলভীর পিতাকে। সে বলে আমি যৌতুক চাইনি স্যার। সে খালি কারণে-অকারণে বাপের বাড়ি চলে যায়, কথা শুনতে চায় না।
এবার উভয়কেই জিজ্ঞেস করি- আলভীর কি দোষ?
কেউ কোন জবাব দিতে পারে না। আদালতে তখন পিনপতন নীরবতা। আলভীর দাদীকে বলি আলভীকে তার মায়ের কোলে দিতে।
মাকে দেখতে পেয়ে দুই হাত প্রসারিত করে আলভী। কোলে চড়ে মায়ের গাল নাড়তে থাকে, বুকে মাথা রাখে আর একটু করে হাসে। তৃপ্তির হাসি। মনে হয় পানি থেকে ডাঙ্গায় তুলে আনা মাছ আবার লাফিয়ে পানিতে চলে গেল। আমার চোখ আর কিছুতেই বাধা মানে না। লোকভর্তি আদালতে বেশ কয়েকবার কেঁদেছি আমি। কিন্তু সেটা নীরবে। চোখের পানি অনেকবার আড়াল করার চেষ্টা করেও আর পারা গেল না। আদালতের মাইক্রোফোনের সুইচ অফ করে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকলাম কিছুক্ষণ।
আলভী তার মায়ের কোলে খেলা করছে। ওর বাবা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
মিনিট পাঁচেক পর আলভীর পিতা-মাতাকে বিনয়ের সুরে বলি- সংসারে ছোটখাটো ঝগড়ার কারণে আলভী খুব কষ্ট পাচ্ছে। আপনারা আলভীকে কষ্ট দেবেন না।
...কান্না সংক্রামক। আলভীর পিতা-মাতাও কাঁদতে থাকে।
মুখ তুলে আকাশের পানে চেয়ে বলি হে প্রভু! আমাকে সাহায্য কর। আর সাহায্য কর এই ছোট্ট আলভীকে।
অবশেষে তারা আবার সংসার করতে রাযী হয়।
কয়েকজন আইনজীবী এগিয়ে আসে। আমাকে সহায়তা করে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তালাক দেয়া আলভীর পিতা এসে হাত ধরে মুনীরার। আমার সাথে সাথে বলে- ‘আমি তালাক প্রত্যাহার করলাম। তোমাকে ফিরিয়ে নিলাম’।
খুশিতে আলভী বাবা-মা দু’জনের গলা জড়িয়ে ধরে।
-মামলা নয়, তালাক প্রত্যাহার হ’ল।
অন্যান্য মামলার শুনানি শেষে প্রায় দুই ঘন্টা পরে আদালত থেকে নেমে কোর্টের নাজিরকে সাথে নিয়ে সোজা চলে যাই বাজারে।
আলভীর জন্য একটা সোয়েটার কিনি।
ফিরে এসে দেখি আলভী নেই। ওর মা-বাবার সাথে চলে গেছে...
আলভীকে দেখতে না পেয়ে ভীষণ খারাপ লাগে আমার।
আলভী মনে হয় এখন খেলা করছে ওর বাবা-মার সাথে। আলভীকে দেখতে পেতে আমাকে আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে, মামলার পরবর্তী তারিখ না আসা পর্যন্ত....।
সত্যি বলতে কি, আমরা যারা বিচারকের দায়িত্ব পালন করি, তাঁরাও কারো না কারো পিতা। আমাদেরও সন্তান আছে, পরিবার আছে। দিন শেষে আমরাও ফিরে যাই আমাদের আলভীদের কাছে। আল্লাহ রাববুল আলামীন প্রত্যেকের আদরের ধন মায়াময় আলভীদের ভালো রাখুন! সবসময় সেই দো‘আ করি।
[ধন্যবাদ দরদী বিচারককে! আল্লাহ তার বিচক্ষণতা ও সূক্ষ্ম বিচার ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দিন-আমীন! (স.স.)]
মুতীউর রহমান
অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), পঞ্চগড়।