রোগ প্রতিরোধে শীতের সবজি
শীতকালে নানা ধরনের সবজি বাজারে পাওয়া যায়। এসব সবজি শুধু দেহের পুষ্টিচাহিদা পূরণ করে তাই নয়; বরং কিছু কিছু রোগের পথ্যের কাজও করে।
বাঁধাকপি : বাঁধাকপি উচ্চপুষ্টিমানসম্পন্ন, সুস্বাদু, সহজে রন্ধনযোগ্য, সহজপাচ্য সবজি। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ ও ‘ই’ এবং সালফারের মতো খনিজ উপাদান। প্রতি ৩ দশমিক ৫ আউন্স বাঁধাকপিতে থাকে ২৪ ক্যালোরি পুষ্টি। এক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, লেবুর জুস থেকে কাঁচা বাঁধাকপিতে ভিটামিন ‘সি’-এর পরিমাণ অনেক বেশী থাকে। কাঁচা বাঁধাকপি পাকস্থলীর বর্জ্য পরিষ্কার করে একং রান্না করা বাঁধাকপি খাদ্যদ্রব্য হজমে বেশ সহায়ক। কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতেও এই সবজি দারুণ কার্যকর। বাঁধাকপি ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসাবেও কাজ করে। বিশেষ করে কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে এই সবজি বেশ ভূমিকা রাখে। বাঁধাকপি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া বাঁধাকপি মানবদেহের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে, আলসার নিরাময় এবং দেহের রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি সাধন করে। তাই শীতে অন্যান্য সবজির সঙ্গে বাঁধাকপি নিয়মিত খাওয়া উচিত।
টমেটো : পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এ সবজিতে লাইকোপেন নামের এক উপাদান থাকে, যা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই লাইকোপেন প্রোস্টেট, স্তন, ফুসফুস, প্যানক্রিয়াস এবং ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। টমেটোর এই লাইকোপেন চোখের রোগও উপশম করে। তাছাড়া টমেটোতে অন্যান্য ভিটামিনের সঙ্গে আছে প্রচুর পরিমাণ রিবোফ্লোবিন, যা ঘন ঘন মাথাব্যথা রোগে ওষুধের কাজ করে। এছাড়া ওযন কমানো, জন্ডিস, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়ারিয়া ও রাতকানা রোগে টমেটো হ’তে পারে সবচেয়ে ভাল পথ্য।
ঢেঁড়শ : অাঁশে পরিপূর্ণ এ সবজিতে আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও কম মাত্রার ক্যালোরি। এটি ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কাজ করে। ঢেঁড়শের সহজপাচ্য অাঁশ রক্তের সেরাম কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ঢেঁড়শে আছে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’, আয়ামিন, ফলিক এসিড, রিবোফ্লোবিন ও জিংক। মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ প্রতিরোধে ঢেঁড়শ ভাল কাজ করে। এছাড়া মেদভুঁড়ি কমাতে ঢেঁড়শ নিয়মিত খাওয়া উচিত।
গাজর : পুষ্টিগুণে অনন্য গাজরে বিটা ক্যারোটিন নামের এক ধরণের উপাদান আছে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, শ্বাসতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায়, হজমে সাহায্য করে, দাঁত, হাড় ও চুল শক্ত করে, আলসার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এছাড়া গাজর তবকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ায়।
মুলা : প্রাচীনকালে মুলা শুধু ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হ’ত। মুলায় আছে উচ্চমাত্রার কপার ম্যাঙ্গানিজ, পটাসিয়াম ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রণ, জিংক ও সোডিয়াম। মুলা হজমে সাহায্য করে। রক্ত বিশুদ্ধকরণ, ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতেও মুলা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
তিল : তিলের বীজ, তিলের নাড়ু মজাদার খাদ্য। খাজা-গজায়ও তিল ব্যবহৃত হয়। সুস্বাদু অনেক খাবারে মসলা হিসাবেও তিল প্রচলিত। মধ্যপ্রাচ্যে তিলের বীজের মাখন ছড়িয়ে দেওয়া হয় রুটির ওপর। হালভা ক্যান্ডিতে তিল প্রধান উপকরণ। চীনে কেক, কুকিস ও পায়েসে তিল দেয়া হয়। তিলবীজে রয়েছে হৃদসুখকর পলিআন স্যাচুরেটেড তেল (৫৫%), উচ্চমাত্রায় প্রোটিন (২০%) এবং অন্যান্য ভিটামিন এ, ই ও বি। তিলবীজে প্রচুর খনিজদ্রব্য, ক্যালসিয়াম, তামা, ম্যাগনেসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, দস্তা ও পটাসিয়াম রয়েছে। তাছাড়া এতে আছে মিথিওনিন ও ট্রিপটিফ্যান।
ধনেপাতা : ধনেপাতা আমাদের দেশে অতি পরিচিত। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধনেপাতা পাওয়া যায়। ধনেপাতা শুধু রান্নার উপকরণ নয়, এর রয়েছে নানাবিধ ঔষধি গুণ। তাই এই পাতাকে বলা হয় ‘হার্বাল প্যান্ট’ বা ঔষধি পাতা। ধনেপাতার ইংরেজী নাম হ’ল মিলানট্রো।
ধনেপাতায় রয়েছে ভিটামিন সি ও এবং এ ফলিক এসিড। এই ভিটামিনগুলো শরীরে পুষ্টি জোগায়, ত্বক ও চুলের ক্ষয়রোধ করে, মুখের ভেতরের নরম অংশগুলোকে রক্ষা করে। মুখ গহবরের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ধনেপাতার ভিটামিন ‘এ’ চোখে পুষ্টি জোগায়, রাতকানা রোগ দূর করতে ভূমিকা রাখে।
কোলেস্টেরলমুক্ত ধনেপাতা দেহের চর্বির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। শরীরের এলডিএল নামক কোলেস্টেরল শরীরের শিরা-উপশিরার দেয়ালে জমে হৃৎপিন্ডে রক্ত চলতে বাধা দেয়। পরিণামে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হ’তে পারে। ধনেপাতা এই খারাপ কোলেস্টেরলকে কমিয়ে দেয় এবং শরীরের জন্য উপকারী কোলেস্টেরল এইচডিএল-এর মাত্রা বৃদ্ধি করে। ধনেপাতায় বিদ্যমান আয়রণ রক্ত তৈরিতে এবং রক্ত পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
এছাড়া ভিটামিন ‘কে’তে ভরপুর ধনেপাতা হাড়ের ভঙ্গুরতা দূর করে শরীরকে করে শক্ত-সামর্থ্য। তারুণ্য ধরে রাখতেও এর অবদান অপরিসীম। তবে ধনেপাতা রান্নার চেয়ে কাঁচা খেলে উপকার বেশী পাওয়া যায়।
মস্তিষ্কের রোগ অ্যালঝেইমারস নিরাময়ে ধনেপাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধনেপাতা শীতকালীন ঠোঁট ফাটা, ঠান্ডা লাগা, জ্বর জ্বর ভাব দূর করতে যথেষ্ট অবদান রাখে। ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ধনেপাতায় ‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ রয়েছে, যা দেহের কাটাছেঁড়া অংশগুলো শুকানোর জন্য অতীব যরূরী। ধনেগাছের বীজের তেলেও নানাবিধ ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন ব্যথানাশক, খাবার হজমে সহায়ক, ছত্রাকনাশক, ওযন ও খিদে বর্ধক। ধনেপাতা চিবানোর পর সেই থেতলে যাওয়া পাতার রস দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁতের মাঢ়ি মযবুত হয়, রক্তপড়া কমে, মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়। তাই সবার উচিত প্রতিদিনের খাবার মেন্যুতে ধনেপাতাকে স্থান দেয়া। তবে অধিক পুষ্টির আশায় মাত্রাতিরিক্ত ধনেপাতা খাওয়া অনুচিত।
পার্থেনিয়াম : এক ভয়ংকর উদ্ভিদ
বাংলাদেশে সফররত অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আগাছা বিশেষজ্ঞ এ্যাডিকিনফ ‘পার্থেনিয়াম’ নামক এক ভয়ংকর উদ্ভিদের সন্ধান পেয়েছেন সুন্দরবন, যশোর, রাজশাহীর চারঘাট, পবা, মোহনপুর, নওগাঁর মান্দা প্রভৃতি স্থানে। এটি দেখতে অনেকটা ধনে গাছের মতো। এটি সর্বোচ্চ দু’ফুটের মতো উঁচু হয়। গাছ ছোট ছোট সাদা ফুলে ভরা থাকে। এ উদ্ভিদের মারাত্মক ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে স্টিভ এ্যাডকিনফ বলেন, দশ মিটার দূর থেকে পার্থেনিয়ামের ফুলের রেণু মানুষের এলার্জি, হাঁপানি ও চর্মরোগের সৃষ্টি করতে পারে। ফসলের ক্ষেত্রে একইভাবে এর রেণু বাতাসে মিশে মরিচ, টমেটো ও বেগুনের ফুল ঝরিয়ে দেয়। তাছাড়া এ থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণের ফলে ডাল জাতীয় ফসলের গাছের নাইট্রোজেন তৈরিতে সহায়তাকারী ব্যাকটেরিয়া অকার্যকর করে ফেলে। এ আগাছা খেয়ে গরু-ছাগল চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। গাভীর দুধ তিতা হয়ে যায়, যা দীর্ঘসময় ধরে পান করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তিনি আরো জানান, এ ঘাস গরু খাওয়ার পর গোবরের সঙ্গে বের হ’লেও এর বীজ নষ্ট হয় না। তা থেকে আবার গাছ হয়। গাছ হওয়ার ৩০ দিনেই এর ফুল হয়ে যায়। এ থেকে বাঁচতে হলে ফুল হওয়ার আগেই একে ধ্বংস করে ফেলতে হয়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, বেনাপোল ও সোনামসজিদ স্থল ও বন্দরসহ অন্যান্য বন্দর দিয়ে ট্রাকের চাকায় লেগে পার্থেনিয়ামের বীজ এদেশে এসেছে। এছাড়াও সীমান্ত পথ দিয়ে প্রচুর পরিমাণ গরু আসছে। এই সব গরুর গোবরের মাধ্যমে এই বীজ ছড়াচ্ছে।
নারকেলের মাকড় দমনে করণীয়
নারকেল শুকিয়ে ছোট আকার হওয়ার জন্য দায়ী এক প্রকার ক্ষুদ্র মাকড়, যা খালি চোখে দেখা যায় না। স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য নারকেল গাছ সূর্যের আলো ও পানির বিক্রিয়ায় পাতায় যে খাদ্য তৈরি করে তা দেহের বিভিন্ন অংশে প্রেরণ করে থাকে। গাছ বর্ধিষ্ণু ফল-এ অপেক্ষাকৃত বেশি খাদ্য সরবরাহ করে এবং বোটা দিয়েই এই খাদ্য ফলে সঞ্চালিত হয়। ক্ষুদ্রাকৃতির এই মাকড় দলবদ্ধ ভাবে কচি ফলের বোটার কাছে বৃতির নিচে বসে পুষ্টি চুষে নেয়। এতে করে ফলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। রস চোষার সময় কচি নারকেলের খোলার পরিবহণ কলায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। একবীজপত্রী উদ্ভিদ হওয়ায় নারকেলের কান্ডে বা ফলে কোন ক্ষত সৃষ্টি হ’লে তা আর পূরণ হয় না। ফলের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এসব ক্ষতের আকারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলের বয়স ৭-৮ মাস হ’লে পাতায় তৈরি খাদ্য সরবরাহ কমতে থাকে। এসময় মাকড় অন্য কোন নতুন কাদিতে চলে যায়। গাছে ফল না থাকলে এরা কচি পাতায় চলে যায়। নারকেলের এ মাকড় খুব ধীরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। তারা উড়তে পারে না; কেবল বাতাস, কীট-পতঙ্গ ও পাখির মাধ্যমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায়। গাছের ফল থেকে পুষ্টিকর খাবার খায় বলে এরা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এদের জীবনকাল মাত্র ৭দিন। ডিম থেকে বাচ্চা হ’তে লাগে ৩দিন। এ মাকড় দমন করতে নিয়ম ও পদ্ধতি মোতাবেক মাকড়নাশক প্রয়োগ করতে হয়। মাকড় প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে। নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ, ইটের ভাটার ধোঁয়া প্রভৃতি কারণে মাকড়ের শত্রু ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা খাবার খেতে কচি ফল ও ফুলে অবস্থান নেয়। তাই ফুল ও কচি ফল টোপ হিসাবে ব্যবহার করে এদের ধ্বংস করা যায়। শীতের পর নারকেল গাছে মাসে ২-৩টি ফুলের ছড়া বের হয়। আক্রান্ত গাছে শীতের শেষে ফুলসহ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত সকল ফল কেটে ফেলতে হবে। তারপর গাছে উমাইট ১.৫ মি.লি. বা ভার্টিমেক ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে কচি পাতাসহ গাছের মাথায় স্প্রে করতে হবে। যখন গাছে নতুন ফুল দেখা দেবে তখন থেকে প্রতি একমাস অন্তর ৪-৫ বার মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে। যাতে অন্য গাছ থেকে পুনরায় আক্রমণ না করতে পারে, তাই এলাকা ভিত্তিক মাকড় দমন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। গাছের গোড়ায় আধা কেজি করে নিমের খোল প্রয়োগ করলে গাছের রোগ ও পোকা মাকড়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউশন ট্রাইকো কম্পোস্ট নামে এক ধরনের জীবাণুনাশক সার উদ্ভাবন করেছে, যা গাছের রোগ-বালাই এর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
\ সংকলিত \