আনারস একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর
সুস্বাদু ও স্বল্পমেয়াদি ফল। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাজা ফল
হিসাবে আনারস খাওয়া হয়। তবে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার (জুস,
জ্যাম, জেলি ইত্যাদি) তৈরির কাজে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে পৃথিবীর সর্বত্রই
আনারসের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাণিজ্যিক ফল হিসাবেও আন্তর্জাতিক
বাজারে আনারস একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। পার্বত্য যেলা সমূহ এবং মৌলভীবাজারের
শ্রীমংগল ও টাংগাইল যেলার মধুপুর এলাকায় কৃষকদের কাছে আনারস একটি অন্যতম
অর্থকরী ফসল। অতীতে শুধুমাত্র বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ
মাস থেকে শ্রাবণ-ভাদ্র মাস পর্যন্ত) আনারস পাওয়া যেত। ইদানীং বাংলাদেশ কৃষি
গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উৎপাদন কৌশল
ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিশেষ করে পার্বত্য যেলাগুলোতে বছরব্যাপী
আনারস উৎপাদন হচ্ছে। আর এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি পণ্য হিসাবে
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আনারস বিশেষ অবদান রাখছে।
আনারসের পুষ্টিমান ও ঔষধিগুণ : আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি ও সি। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে পুষ্টি উপাদানের শতকরা পরিমাণ হচ্ছে পানি ৮৬ ভাগ, ভিটামিন-এ ৬০ আই.ইউ, ভিটামিন সি ৬৩ মি.গ্রাম, আমিষ ০.৪ ভাগ, শ্বেতসার ১২ ভাগ, রাইবোফ্লোবিন ১২০ মি.গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.০২ ভাগ, ফসফরাস ০.০১ ভাগ, লৌহ ০.৯ ভাগ, স্নেহ জাতীয় পদার্থ ০.১ ভাগ, খনিজ পদার্থ ০.৫ ভাগ ও অাঁশ ০.৩ ভাগ।
পৃথিবীতে উৎপাদিত আনারসের বেশিরভাগই প্রক্রিয়াজাত করা হয়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে আনারসের ফল অ্যালকোহল ও সাইট্রিক এসিড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আনারস-এর রসে ব্রোমিলিন নামক এক প্রকার জারক রস থাকে বলে আনারস পরিপাক কাজে সহায়ক। এছাড়া কচি ফলের শাঁস ও পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে সেবন করলে ক্রিমি দমনে সহায়ক হয়।
জাত : পৃথিবীতে আনারসের অনেক জাত থাকলেও বাংলাদেশে হানি কুইন, জায়েন্ট কিউ ও ঘোড়াশাল এই তিন জাতের আনারস চাষ হয়ে থাকে। হানি কুইন জাতের আনারস পার্বত্য যেলাগুলোতে ও শ্রীমংগলে এবং জায়েন্ট কিউ জাতের আনারস মধুপুর অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে আনারসের হানি কুইন ও জায়েন্ট কিউ এই দু’টি জাতই জনপ্রিয়। এই জাতের ফল অত্যন্ত সুমিষ্ট, কম আঁশযুক্ত, রসালো আকারে ছোট, স্বাদ ও গন্ধে সর্বোৎকৃষ্ট। অপরদিকে জায়েন্ট কিউ জাতের ফল আকারে বড় ও ওযনে ভারী। তাই অসমতল জমিতে চাষ করলে ফল পুষ্ট হওয়ার আগেই গাছ হেলে পড়ে এবং ফল ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই পাহাড়ের ঢালে হানি কুইন জাতের আনারস চাষ করা উত্তম। বর্তমানে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি যেলায় হানি কুইন জাতের আনারস বেবিপাইনঅ্যাপেল নামে হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে সারা বছর উৎপাদন হচ্ছে এবং বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বংশবিস্তার : স্বাভাবিক অবস্থায় আনারসের বীজ হয় না। বিধায় বিভিন্ন ধরনের চারা/সাকারের মাধ্যমে আনারসের বংশবিস্তার হয়ে থাকে। সাধারণত সাইড সাকার বা পার্শ্ব চারা, সিলপ সাকার বা বোঁটার চারা, মুকুট চারা বা ক্রাউন ও গুঁড়ি চারা বা গ্রাউন্ড সাকার দিয়ে আনারসের বংশবিস্তার হয়ে থাকে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক চাষের জন্য সাইড সাকার সর্বোত্তম।
চাষ পদ্ধতি : পাহাড়ের ঢালে আনারস চাষ করার জন্য এমন জমি নির্বাচন করতে হবে, যেখানে পাহাড়ের ঢাল খুব বশি খাড়া নয়। এছাড়া বেশি ঢালু জমিতে পরিচর্যা করা অসুবিধা ও ভূমিধসের সম্ভাবনা থাকে।
জমি তৈরি : পাহাড়ের ঢালে আনারসের চাষ করার জন্য কোনক্রমেই জমি চাষ দিয়ে বা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করা উচিত নয়। এতে ভূমিক্ষয়ের মাধ্যমে উর্বর মাটি ধুয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুধু পাহাড়ের জঙ্গল বা আগাছা মাটির স্তরে কেটে পরিষ্কার করে জমি চারা রোপণের উপযোগী করে তুলতে হবে।
রোপণ পদ্ধতি : পাহাড়ের ঢালে আনারস চাষের জন্য কন্টুর পদ্ধতি বা সমউচ্চতা বরাবর ঢালের বিপরীতে আড়াআড়িভাবে জোড়া সারি করে চারা রোপণ করা হয়ে থাকে। কখনো ঢাল বরাবর সারিতে চারা রোপণ করা উচিত নয়। এতে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায়। পাহাড়ের ঢালে জোড়া সারিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০ সে. মি. ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ২০-২৫ সে. মি. দেয়া উচিত। এতে হেক্টরপ্রতি ৫০ হাযার বা কানি প্রতি (৪০ শতাংশ) ৮ হাযার চারা প্রয়োজন। নির্ধারিত স্থানে চারা রোপণের পর গোড়া ভালোভাবে চেপে দেয়া উচিত।
পরিচর্যা :
আগাছা দমন : পাহাড়ের ঢালে আগাছা বেশি হয় বলে আগাছা বেড়ে উঠার আগেই দমন করা উচিত। জোড়া সারির মাঝখানে আস্তরণ দিয়ে আগাছা দমন করা সহজ হয়। এছাড়া আস্তরণ ব্যবহার করলে আরো যে উপকার পাওয়া যায় তাহ’ল- ১. মাটির ক্ষয় কম হয়, ২. শুকনো মৌসুমে মাটিতে আর্দ্রতা সংরক্ষণ হয়, ৩. পচে জৈবসার যুক্ত হয়। ফলে উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
সার প্রয়োগ : চারা রোপণের দুই মাস পর গাছপ্রতি ইউরিয়া ও টিএসপি সার ১০ গ্রাম করে গাছের গোড়া থেকে ১৫ সে. মি. দূরে ডিবলিং পদ্ধতিতে/পেগিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে। একইভাবে গাছের বয়স যখন ৭-৮ মাস হবে, তখন আরেক বার একই মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হয়।
আনারস গাছে ফুল ধরা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সাধারণত চারা রোপণের ১৫-১৬ মাস পর আনারস গাছে ফুল আসে এবং ফুল আসার ৪-৫ মাস পর ফল পাকে। সাধারণত জুন-জুলাই মাস আনারসের ফল পাকার সময়। অমৌসুমে ফল পাওয়ার জন্য হরমোন প্রয়োগ করে ফুল-ফল ধরা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ইথ্রেল বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রধানত হরমোন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ৫০০ পি পি এম ঘনত্বের দ্রবণ গাছপ্রতি ৫০ মি. লি. পরিমাণ গাছের বয়স ৮-১১ মাস বা ৩০-৪০টি পাতা হ’লে গাছের মাথায় চুঈীর মধ্যে ঢেলে দিতে হবে। বৃষ্টির সময় হরমোন প্রয়োগ না করাই ভালো।
\ সংকলিত \