ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। সম্প্রতি এই অতি প্রয়োজনীয় ফসলটি ব্লাষ্ট নামক ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা কেন্দ্র এবং অন্যান্য কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এই রোগ প্রতিরোধে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। মিডিয়াতেও এ নিয়ে প্রচুর প্রচার-প্রচারণা চলছে। গবেষকগণ ছত্রাকজনিত এই রোগের যে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে মানসম্মত বীজের অভাব, জমি তৈরীতে প্রচুর রাসায়নিক সারের ব্যবহার এবং বিশেষ করে বীজ রোপণ থেকে ধান কাটা পর্যন্ত অত্যধিক ইউরিয়া বা নাইট্রোজেনের প্রয়োগকে দায়ী করেছেন। পাশাপাশি আগাছানাশক, কীটনাশকের প্রভাব তো রয়েছেই। দীর্ঘ দিনের কেমিকেল ব্যবহারের বিরূপ প্রভাব ব্লাষ্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যা আমাদের হাতের ফসল। এর জন্য আমরাই দায়ী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সদাচরণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সদাচরণকারীদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/১৯৫)।
রাসায়নিক সার, আগাছানাশক ও কীটনাশক নির্ভরশীল ধান পরবর্তী বছর বীজ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ধান বীজে যেন পোকা আক্রমণ করতে না পারে এজন্য এক ধরনের বিষ ব্যবহার করা হয়। বীজে ব্যবহৃত কেমিকেল ধানের বোঁটার উন্মুক্ত অংশে জমে ফাংগাস সৃষ্টির সম্ভাবনাও আছে। দেখা যাচ্ছে বিষযুক্ত বীজ দিয়ে ধান চাষের প্রাথমিক স্তর শুরু হয় বীজতলা তৈরির মাধ্যমে। বীজতলা তৈরীতেও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয় এবং চারাগুলোকে সতেজ ও সবল করার জন্য বীজতলায় নাইট্রোজেন ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক সার অত্যধিক ব্যবহারের কারণে বীজতলায় চারাগুলোকে সবুজ মনে হলেও সেগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অতএব ধান চাষে অত্যধিক কেমিকেল ব্যবহার করে পরিবেশের তথা ধানের যে ক্ষতি আমরা নিজ হাতে করছি তা আমাদেরই কামাই। আল্লাহ বলেন, ‘আপনার যে কল্যাণ হয়, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। আর যে অকল্যাণ হয়, তা আপনার (আমলের) কারণে হয়’ (নিসা ৪/৭৯)। তাই ব্লাষ্ট প্রতিরোধ করার জন্য এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জমি প্রস্ত্ততকরণে প্রাকৃতিক পদ্ধতি : অর্গানিক উপাদান দিয়ে জমি প্রস্ত্তত করাকে কালচারাল ম্যানেজমেন্ট বলা হয়। যেখানে আমাদের কৃষকগণ কেমিকেল ম্যানেজমেন্টে অভ্যস্ত। পূর্বের ধান খড়কে বড় করে জমিতে রেখে দিয়ে জমিতে চাষ দিতে হবে, ধইনচা বীজ বা কালাই জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। চারাগুলো বড় হলে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। আমাদের বাড়ীতে ব্যবহার্য বর্জ্য যেমন শাকসবজির উচ্ছিষ্ট, ডিমের খোসা ইত্যাদি গর্তে ফেলে উৎপাদিত কম্পোষ্ট জমিতে ফেলতে হবে। এছাড়াও হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠা ও গোবর সার ফেলতে হবে। এই পাঁচ ধরনের সার দিয়ে গত দুই বছর ধরে আমি গবেষণায় ব্যবহৃত জমি প্রস্ত্তত করে আসছি। জমি প্রস্ত্ততকালীন কোন রকম রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করলে জমির উর্বরশক্তি দিন দিন বাড়বে বৈ কমবে না। অথচ আমাদের দেশের জমিগুলো দিন দিন উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। ধানের চারাকে আমরা একটি ভালক্ষেত্র তৈরী করে দিলে সে পরের সময়টি ভালভাবে বেড়ে উঠার পরিবেশ পাবে।
চারা রোপণে একত্ত্ব : মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের উপমা একটি বীজের ন্যায়। যা থেকে সাতটি শিষ জন্মে’ (বাক্বারাহ ২/২৬১)। যদিও আয়াতটি দান ও ছাদাকার সাথে সংশ্লিষ্ট তবে গবেষকদের জন্য অনেক কিছুই রয়েছে উক্ত আয়াতে। একটি করে চারা রোপণ করলে ঐ চারাটি তার আশেপাশে পর্যন্ত খাবার পায় এবং সুস্থ-সবল ভাবে বেড়ে উঠে। একটি চারা থেকে গজানো অন্যান্য চারাগুলো সমানভাবে বেড়ে উঠে। কান্ডগুলো শক্ত হয় এবং ধান গাছটি অত্যন্ত সবল হয়, যা বাতাস ফেলে দিতে পারে না। অপরপক্ষে আমাদের কৃষকগণ ৪-৮টি চারা এক গোছায় ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে চারাগুলো এত চাপাচাপিতে থাকে যে সেগুলো সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে না বরং গাছগুলো চিকন ও দুর্বলভাবে বেড়ে উঠে। অধিকন্তু চারাগুলোর আশেপাশে যে খাবার থাকে তা যথেষ্ট হয় না। আবার মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন ব্যবহার করলে চারা প্রয়োজনের থেকে বেশী খাবার পায়। ফলে চারাগাছগুলো নরম হয়ে পোকামাকড়কে আকৃষ্ট করে। সুতরাং প্রয়োজনের চেয়ে বেশী খাবার ধান গাছের রোগের একটি সম্ভাব্য কারণ। আমার গবেষণায় একটি করে চারা রোপণের কার্যকারিতা প্রমাণিত। এতে যেমন বীজের অপচয় রোধ হয়, জমিতে প্রস্ত্তত চারার খাবারের সুষম বণ্টন হয় এবং চারা হয় রোগ প্রতিরোধকারী যা বাতাসে হেলেও পড়েনা। শীষগুলো অনেক লম্বা হয় এবং পাতান খুবই কম হয়। আমার দুই বছরের গবেষণায় একটি চারা রোপণ পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৩৫টি শীষ হয়েছে একটি ধানের থোক থেকে। সর্বোচ্চ শীষের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি লম্বা প্রমাণিত হয়েছে। আল-কুরআনের সূরা বাকারার ২৬১নং আয়াতটি আমাদের ধান চাষে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রাকৃতিকভাবে চারার যত্ন : আমাদের কৃষকগণ দুই থেকে তিন বার বিভিন্ন রকম রাসায়নিক সার চারা রোপণের পর থেকে ধান কাটা পর্যন্ত জমিতে ব্যবহার করে। ঘাস নাশক, বিভিন্ন হরমোন ও কীটনাশকের ব্যবহার তো আছেই। রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন নাশকের প্রভাবে ধান গাছগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। যদিও বাহ্যিকভাবে ধানের গাছগুলো খুবই সবুজ ও স্বাস্থ্যবান মনে হয়। নরম গাছগুলোকে বিভিন্ন পোকামাকড় আক্রমণ করে সেই সাথে বিভিন্ন রোগ বালাই তো আছেই।
আমার গবেষণায় চারারোপণ পরবর্তী জমির পরিচর্যা প্রাকৃতিক উপায়ে হয়েছে। জমিতে কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোষ্ট প্রয়োগ করা হয়েছে চারা রোপণের ২২ দিন পরে। খইল মিশ্রিত পানির সাথে গরুর প্রস্রাব মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করা হয়েছে ৩ বার। এতে জমি খুবই সবুজ আকার ধারণ করেছে। যথেষ্ট পরিমাণ পাখি বসার জন্য মাচা তৈরী করা হয়েছে, যা পার্চিং নামে পরিচিত। যাতে পাখি বসে পোকামাকড় ধরে খেতে পারে। পোকা দমনের জন্য তিতা স্বাদের বিভিন্ন গাছের পাতার রস গরুর প্রস্রাবের সাথে মিশে জমিতে স্প্রে করা হয়েছে। এছাড়াও জাত নিমের পাতা, ইউক্লিপটাসের পাতা, ভাইটের পাতা, সেগুন গাছের ফলের বিচি, মরিচের গুড়া, সাবানের পানি ইত্যাদি পদ্ধতিও ব্যবহার করা যায় পোকা দমনের জন্য। এখন সবজি চাষে বিষমুক্ত ‘সেক্স ফেরমোন বক্স’ ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র ২৫ টাকায়। ধান চাষেও উক্ত বক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও নিশিন্দা, করঞ্জা, ধুতরা, কলকেফুল, বিষকাঠালি, তামাক পাতা, পেয়াজ, রসুন ইত্যাদি ভেষজ উদ্ভিদের কীটবিতাড়ক গুণ রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছু’ (বাক্বারাহ ২/২৯)। মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত উপাদানগুলো ব্যবহার করে উপকার নিতে পারে যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন।
ধান পরিপূর্ণভাবে পেকে আসলে শীষসহ কেটে রোদে শুকিয়ে পলিথিন ব্যাগে ভরে বীজের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন ফসল কাটবে, তখন খোরাকি বাদে বাকী ফসল শিষ সমেত রেখে দিবে’ (ইউসুফ ১২/৪৭)। শীষসমেত ধানকে বীজ হিসেবে রেখে দিলে বীজের তাপমাত্রা সঠিক অবস্থায় থাকে। মায়ের পেটে শিশু যেমন নারীর সাথে নিরাপদে থাকে, ঠিক তেমনি ধানের বোটার সাথে বীজ লেগে থাকলে ‘এমব্রো’ সুস্থ থাকে যা বীজের সুস্থতা ও গজানোর জন্য দায়ী।
দুই বছর ধরে আমি শীষ সহ বীজ সংরক্ষণ করে আসছি। বীজের সংরক্ষণের জায়গায় শুটকি মাছ পুড়িয়ে রেখে দেওয়া হয়েছিল যেন গন্ধে বিড়াল আসে। ফলে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে শীষসহ ধানবীজ বেঁচে গেছে। এ বছর বীজতলা তৈরীতে শীষের বীজ আলাদা করে বীজতলায় ফেলা হয়েছে। এই বীজ খুব ভাল গজিয়েছে এবং ধান গাছ থেকে শীষগুলো লম্বা ও পুষ্ট হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন ও প্রাণের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ফল-শস্যাদি বিনষ্টের মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫)। বর্তমানে কৃষকগণ উৎপাদিত ধানের যাকাত বা ওশর আদায় করে না বললেই চলে। ফসলের হানি হওয়ার এটিও একটি সম্ভাব্য কারণ। যথাযথভাবে ফসলের ওশর আদায় ও প্রাকৃতিক উৎপাদন পদ্ধতির উপর জোর দিলে ধানের ব্লাষ্ট প্রতিরোধ সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।
ভাল বীজে ভাল ফসল। কিন্তু বিষ মেশানো দীর্ঘ সময় শীষ থেকে আলাদা কার্বন নিঃসরিত ও বিদ্যুতের ব্যবহার জনিত বীজ কতটুকু রোগবালাই সহনীয়? পক্ষান্তরে আল্লাহ প্রদত্ত প্রযুক্তিতে শীষসহ ধান রেখে দিলে পরবর্তীতে তা বীজ হিসেবে ব্যবহার করলে বিষ+হিমাগার+বিদ্যুতের খরচ+ পরিবেশ দূষণ পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব। সেই সাথে ধানে ব্লাষ্টেরও প্রতিরোধ সম্ভব। জৈব পদ্ধতিতে বা অর্গানিক উপায়ে উৎপাদিত ধান বীজে ফলনের সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশী। কারণ পুষ্ট বীজে সবল চারাগাছ এবং সবল চারাগাছে ভাল ফসল সম্ভব। ধানের ব্লাষ্টের জন্য যেহেতু ত্রুটিযুক্ত বীজ ও অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োগকে দায়ী করা হচ্ছে। সুতরাং অর্গানিক ধান বীজ, জৈব সার ও প্রাকৃতিক পোকাদমন পদ্ধতি ধানের ব্লাষ্ট প্রতিরোধে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে ধান চাষ গবেষণার ফলাফলটি প্রথমত আমার যেলা কুড়িগ্রামে মাননীয় যেলা প্রশাসক মহোদয়ের সম্মেলন কক্ষে ২০১৬ সালে যেলার শীর্ষস্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা ও অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। রেডিও চিলমারিতে এ ব্যাপারে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও দৈনিক সংবাদ পত্রও বিষয়টি প্রচার করেছে। ২০১৬ সালে দু’টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গবেষণার ফলাফলটি উপস্থাপন করা হয়েছে। একই বছর রংপুর বিভাগীয় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের ৩ দিনের সম্মেলনে ২য় দিনে অর্গানিক ধানবীজের ধারণাটি উপস্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন শিরোনামে ৩টি নিবন্ধ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ৫ম HSBC ও The Daily Star Climate Awards এর জন্য গবেষণার বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছিল। গত ২৭/০৪/২০১৭ তারিখে হোটেল রেডিসন ব্লু’-তে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমি দাওয়াত পেয়েছিলাম অর্গানিক ধান বীজ ধারণাটিকে উপলক্ষ্য করে।
যেহেতু আমাদের কৃষকগণ মিডিয়াগুলো সেভাবে পর্যবেক্ষণ করেনা। আমাদেরকে পরিবেশবান্ধব ধানচাষ পদ্ধতি নিয়ে তাদের দ্বারপ্রান্তে যাওয়া যরূরী। তাদেরকে হাতে কলমে অর্গানিক পদ্ধতিতে ধানচাষ শিখিয়ে দেওয়া দরকার। আশা করা যায় সম্মিলিত প্রয়াসে ধানের ব্লাষ্ট প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। কারণ প্রতিষেধক ব্যবহারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম ও টেকসই। আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃষকদের বাড়ীতে যেতে প্রস্ত্তত কিন্তু পদক্ষেপটি কে নেবে?