কৃষির নতুন সম্ভাবনা চুইঝাল লতাজাতীয় এক অমূল্য সম্পদ। প্রাকৃতিকভাবে এটি ভেষজগুণ সম্পন্ন গাছ। এটি গ্রীষ্ম অঞ্চলের লতাজাতীয় বনজ ফসল হ’লেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে খুব ভালোভাবে জন্মে। বিশেষ করে ভারত, নেপাল, ভুটান, বার্মা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড চুইচাষের জন্য উপযোগী। প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চুইঝালের আবাদ হয়ে আসছে। আমাদের দেশের কিছু আগ্রহী চাষী নিজ উদ্যোগে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অনেক দিন আগ থেকেই চুইঝাল চাষ করে আসছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় চুইঝাল বেশ জনপ্রিয় এবং দেশের সিংহভাগ চুইঝাল সেখানেই আবাদ হয়।

চুইয়ের ব্যবহার : চুইলতার শিকড়, কান্ড, পাতা, ফুল ও ফল সব অংশই ভেষজগুণ সম্পন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পুরো গাছ উপকারী। চুইঝালের কান্ড, শিকড় ও পাতার বোঁটা রান্নার সাথে ব্যঞ্জন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বড় বড় মাছ বা যেকোন গোশতের সাথে খাওয়া যায়। আঁশযুক্ত নরম কান্ডের স্বাদ ঝালযুক্ত। কাঁচা কান্ডও অনেকে লবণ দিয়ে খান। ছোলা, ভাজি, আচার, হালিম, চটপটি, ঝালমুড়ি, চপ ও ভর্তা তৈরীতে চুইঝাল ব্যবহৃত হয়। মোটকথা মরিচ, গোলমরিচ ঝালের বিকল্প হিসাবে যেকোন কাজে চুইঝাল ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারকারীরা বলেন, এটি তরকারীতে ব্যবহার করলে তরকারীর স্বাদ বেড়ে যায়। কাঁচা অবস্থায় চিবিয়েও চুই খাওয়া যায়। চুইয়ের লতাকে শুকিয়ে গুঁড়া করেও দীর্ঘদিন রাখা যায় এবং প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা যায়।

ঔষধি গুণ : চুইঝালে আছে অসাধারণ ঔষধিগুণ। চুইঝাল (১) গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে (২) খাবারের রুচি বাড়াতে এবং ক্ষুধামন্দা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে (৩) পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহে উপকার করে (৪) স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে (৫) ঘুমের ওষুধ হিসাবে, শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে এবং শরীরের ব্যথা নিরাময় করে (৬) সদ্য প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা দ্রুত কমাতে ম্যাজিকের মতো সাহায্য করে (৭) কাশি, কফ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও রক্তস্বল্পতা দূর করে। এছাড়া আরও বহুবিদ ভেষজগুণ সম্পন্ন ফসল চুইঝাল।

চাষপদ্ধতি :

জমি ও মাটি : চুইঝালের জন্য আলাদা কোন জমির প্রয়োজন নেই। সাধারণ ফলবাগান বা বৃক্ষ বাগানের জমির উপযুক্ততাই চুইয়ের জন্য উপযুক্ত। শুধু খেয়াল রাখতে হবে বর্ষায় বা বন্যায় যেন চুইঝাল গাছের গোড়ায় পানি না জমে।

রোপণের সময় : বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) এবং আশ্বিন-কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাস এ দু’বার হ’ল চুইঝালের লতা রোপণের উপযুক্ত সময়।

বংশবিস্তার : বীজ ও লতার কাটিং দিয়ে বংশবিস্তার করা যায়। তবে লতার কাটিংয়ে বৃদ্ধি তাড়াতাড়ি হয় এবং ফলন দ্রুত পাওয়া যায়। বীজ থেকে বংশবিস্তার জটিল, সময়সাপেক্ষ বলে আমাদের দেশে শুধু লতা থেকে বংশবিস্তার করা হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সবক’টি নার্সারিতে চুইঝালের চারা পাওয়া যায়।

কাটিং শোধন : ভালো বালাইমুক্ত আবাদের জন্য চুইঝালের কাটিং তৈরি চারা রোপণের আগে অবশ্যই শোধন করে নিতে হবে। ১ লিটার পানিতে ২-৩ গ্রাম প্রোভ্যাক্স/নোইন/ব্যাভিস্টিন বা অন্যকোন উপযুক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে কাটিং ৩০ মিনিট চুবিয়ে রাখার পর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে কাটিং রোপণ করতে হবে। এতে পরবর্তীতে রোগ পোকার আক্রমণ হয় না বা অনেক কম হয়। লতা ভালোভাবে বেড়ে উঠে।

সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা : চুই চাষে চাষীরা সাধারণত কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না। পোড় বা শাখা রোপণের আগে গর্তে পচা আবর্জনা, ছাই বা গোবর ব্যবহার করেন। তবে কেউ কেউ কোথাও কোথাও কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী সাধারণ হারে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি বর্ষার আগে ও পরে গাছের গোড়া থেকে ১ হাত দূরে প্রয়োগ করেন। শুকনো মৌসুমে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। অন্তত সপ্তাহে ১ বার গাছের গোড়ায় সেচ দিলে গাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে। আর বর্ষাকালে চুইঝালের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়।

বাউনি দেয়া : চুইঝাল যেহেতু লতা জাতীয়, তাই এর জন্য আরোহণের সাপোর্ট লাগে। সেক্ষেত্রে আম, কাঁঠাল, জাম, সুপারি, নারিকেল, মেহগনি ও কাফলা (জিয়ল) গাছ বাউনি হিসাবে চুই চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। বাউনি না দিলেও মাটিতে বাড়তে পারে। বিশেষ করে অন্যান্য দেশে মাটিতে কোন বাউনি ছাড়া চুইঝালের চাষ হয়। তবে এক্ষেত্রে বর্ষা মৌসুমে গাছের লতার বেশ ক্ষতি হয়। কৃষকের মতে আম, কাঁঠাল ও কাফলা গাছে চাষকৃত চুই খুব সুস্বাদু হয়। আরোহী গাছের গোড়ায় সামান্য গোবর মাটি মিশিয়ে লতার ১টি গিট মাটির নীচে রোপণ করলে ক’দিন পরেই বাড়তে শুরু করে। ১০ থেকে ১২ মাসের মধ্যেই লতা কাটা যায়। সাধারণ যত্নেই চুই বেড়ে ওঠে। খুব বেশী ব্যবস্থাপনা ও যত্নের প্রয়োজন হয় না।

ফসল সংগ্রহ ও ফলন : চুই লাগানোর বা রোপণের ১ বছরের মাথায় খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে ভালো ফলনের জন্য ৫-৬ বছর বয়সের গাছই উত্তম। সে মতে ৪-৫ বছর অপেক্ষা করা ভালো। হেক্টরপ্রতি ২.০ থেকে ২.৫ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়। ৫-৬ বছরের একটি গাছ থেকে বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২৫ কেজি পর্যন্ত চুইঝাল লতার ফলন পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব : নার্সারী শিল্পে চুইঝাল একটি মূল্যবান উপাদান হিসাবে বিশেষ বিবেচনা করা যায়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এরই মধ্যে চুই লতার চারা উৎপাদন বাণিজ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় চুই প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর অঞ্চলে চুইয়ের আবাদ এবং বাযার রমরমা। শুকনো এবং কাঁচা উভয় অবস্থায় চুই বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা চুইঝাল লতা অঞ্চল ভেদে ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে শাখা ডাল থেকে শিকড়ের ডালে ঝাল বেশী হয় বলে এর দামও একটু বেশী। শুকনো চুইয়ের দাম কাঁচার চেয়ে আরও ২-৩ গুণ বেশী। ১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত।

একজন সাধারণ কৃষক মাত্র ২-৪টি চুই গাছের চাষ করে নিজের পরিবারের চাহিদা মিটাতে পারেন। বেশী ফলনের মাধ্যমে নিজের চাহিদাও মিটিয়ে বাড়তি আয় করতে পারেন। বাংলাদেশে মরিচের বদলে চুইঝালের চাষের বিস্তার ঘটিয়ে হাযার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। অবাক করা বিষয় হ’ল যে খুলনার চুই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রফতানী হচ্ছে।

\ সংকলিত \






আরও
আরও
.