আমার
নাম কাযী এ.এম ইউসুফ জাহান। পিতা ডাঃ কাজী ওলিউর রহমান। সাতক্ষীরা যেলার
কালিগঞ্জ থানার মৌতলা গ্রামে আমার পৈত্রিক বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম
তথাকথিত ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ। ‘তথাকথিত’ এই কারণে যে আমি ইসলাম হিসাবে যে
ধর্ম পালন করতাম সে ধর্মের অন্যতম গুরু আমার মাতামহ ও প্রমাতামহ অত্র
এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় কামিল পীর ছাহেব (বিশেষ করে প্রমাতামহের প্রসিদ্ধি
ছিল ব্যাপক)। স্বাভাবিকভাবেই আমার এবং আমার সমাজের মানুষের বিশ্বাস ছিল
পূর্ববর্তী যে সকল পীরগণ ইন্তিকাল করেছেন তাঁরা কবরে জীবিত। কারণ আল্লাহর
অলীগণ মরেন না। সুতরাং তারা কবরে মানুষের ডাক শুনতে পান ও বিপদ-আপদে
সাহায্যের ক্ষমতা রাখেন। সে কারণে আমাদের অধিকাংশ ইবাদত কবুলের ওয়াসীলা ছিল
পীর ও মাযার কেন্দ্রিক। সেখানে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় ওরসের। জ্বালানো হয়
হরেক রকমের প্রদীপ। মনের বাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য মাযারে গিয়েই দো‘আ করা হয়।
মাযারে রক্ষিত তাবারক যা দেওয়া হয় সেটি যে কোন রোগ, বালা-মুছীবত অথবা
যেকোন মনের আশা পূর্ণ হওয়ার নিয়তে ভক্ষণ করলে তা পূরণ হয় প্রভৃতি। অথচ
রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ইহুদী ও নাছারা (খৃষ্টান)-দের প্রতি
লা‘নত করুন, যারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে ইবাদতের স্থানে পরিণত করে নিয়েছে (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৭১২)।
যে নবী করীম (ছাঃ) নিজের উপর অত্যাচারকারীদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ না করে
প্রাণখুলে তাদের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করতেন অথচ সেই কোমল অন্তরের দয়ালু
নবী সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে আমার কওমের বিরুদ্ধে এ মর্মে অভিশাপ দিলেন!
এবার আসি তা‘বীযের রমরমা ব্যবসা সম্পর্কে। আমার মনে পড়ছে আমি নিজেও নানাজানের তা‘বীয ব্যবসার সহায়তা স্বরূপ বহু তা‘বীয লিখে দিয়েছি। বহু মানুষকে নানাজানের কাছে আসতে দেখেছি যারা আসত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টির তা‘বীয নিতে। এছাড়া রোগ-বালাই, আপদ-বিপদ, বালা-মুছীবত থেকে মুক্তির তা‘বীয, বদনা চালা দিয়ে পরীক্ষার্থীদের আগাম প্রশ্ন জেনে নেওয়া, আরো কত কি! মনে পড়ে আমার গলায়, হাতে, কোমরে নানাজানের দেয়া কত মাদুলি-তা‘বীয শোভা পেত! গত ৬ই রামাযান ২০১২ ঈসায়ী নানাজানের মৃত্যুর পর আমার তিন মামা জোরদারভাবে তা‘বীযের ব্যবসা শুরু করেছেন। তাঁদের এ সিলসিলা হয়তবা কিয়ামত অবধি অব্যাহত থাকবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় তিন মামার মধ্যে এক মামা অনেক বড় মাপের আলেম ও মসজিদের খত্বীব হওয়া সত্বেও তিনি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বিনা পুঁজির ব্যবসাটিকে ধরে রেখেছেন। অথচ এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা যারা গোপন করে ও তৎপরিবর্তে নগণ্য মূল্য (পার্থিব মূল্য) গ্রহণ করে, অবশ্যই তারা স্ব-স্ব উদরে আগুন ছাড়া অন্য কিছু ঢুকায় না। কিয়ামতের দিবসে আল্লাহ তাদের সাথে কথাই বলবেন না। তাদের জন্য প্রস্ত্তত আছে যন্ত্রণাদায়ক মহাশাস্তি’ (বাক্বারাহ ২/১৭৪)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তা‘বীয ঝুলালো সে শিরক করল’ (মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৮৮৪, সনদ ছহীহ)। অথচ শিরকের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আমরা কে না অবগত? এছাড়া ইবাদতের নামে তারা চালাচ্ছে যত সব মনগড়া মতবাদ। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘বিদ‘আতকে আশ্রয়দানকারীর প্রতি আল্লাহ, রাসূল ও সমগ্র মানব জাতির অভিশাপ’ (বুখারী, হা/৭৩০৬; মুসলিম, হা/৫২৪১)। এজন্যই আমি আমাকে ‘তথাকথিত ধার্মিক’ বলে পরিচয় দিয়েছি।
যেভাবে পেলাম মুক্তির পথ : বহুকাল পূর্বে নিজ যেলা সাতক্ষীরায় এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমীরে জামাআত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর সর্বপ্রথম প্রকাশিত ছোট আকারের ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বইটি। বলতে দ্বিধা নেই সেদিন খুব মানসিক অস্বস্তির সাথে গ্রহণ করেছিলাম বইটি। কারণ পূর্বেকার ধারণা অনুযায়ী আহলেহাদীছকে মনে করতাম ইসলাম বহির্ভূত একটি ভ্রান্ত ফিরকা। আর আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে আমার পীরালী বংশের লোকজন প্রকাশ্যভাবে যে তীব্র বিষোদগার ও নেতিবাচক মন্তব্য করতেন তা আজ কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। যাই হোক আমি ছিলাম বইয়ের পোকা। বই যেহেতু একটা পেয়েছি পড়তে তো আর দোষ নেই। শুরু করলাম পড়তে। কিন্তু হায় যতদূর পড়লাম গোমরাহ (?) ড. গালিব যে আমাদের বিরুদ্ধেই সব লিখেছেন। গোঁড়ামির শীর্ষচূড়ায় বসে থেকে সেদিন অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম যে, তিনি আসলে আমাদের বিরুদ্ধে লেখেননি, বরং লিখেছেন ধর্মের নামে অধর্মের বিরুদ্ধে, ইবাদতের নামে বিদ‘আতের বিরুদ্ধে, ইসলামের নামে প্রচলিত যতসব জাহেলী কর্মের বিরুদ্ধে, কলুষময় মিথ্যা ও বানোয়াট মতবাদের বিরুদ্ধে।
বিভ্রান্ত ড. গালিব (?) : আমীরে জামা‘আত-এর ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বইয়ের সশব্দে আমীন বলা, বুকে হাত বাঁধা, রাফউল ইয়াদাইন, মোনাজাত প্রসঙ্গ, মৃত্যুর পর প্রচলিত বিদ‘আত প্রভৃতি আলোচনাগুলো আমাকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। কারণ আমার সমাজে এর সম্পূর্ণ বিপরীতটাই প্রচলিত ছিল। তবে একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম এজন্য যে তিনি যা কিছু লিখেছিলেন তার প্রমাণে গ্রহণযোগ্য কিতাবের উৎসগুলো ফুটনোটে উল্লেখ করেছেন। যদিও মনে করেছিলাম চালাকি করার জন্যই বুঝি তিনি এসব উল্লেখ করেছেন। আসলে মূল হাদীছে এসবের কিছুই পাওয়া যাবে না। তারপরও ফুটনোটগুলো মূল গ্রন্থের সাথে মিলিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মনজুড়ে তখন চিন্তা ছিল একটাই যে ড. গালিব আমাদের মাযহাবের শত্রু। অতএব তিনি ইসলামের শত্রু, বিভ্রান্ত এবং পথভ্রষ্ট। আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দো‘আ করি আল্লাহ তুমি আমাকে সঠিক ও পর্যাপ্ত জ্ঞান দান কর। তোমার প্রবর্তিত সঠিক ইসলাম আমাকে বুঝার ও মানার তাওফীক দান কর এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে ও মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে (ড. গালিব) তাদের সমুচিত জবাব দিতে আমাকে সাহায্য কর।
নিরাপদ দূরত্বে ছালাতুর রাসূল : যেহেতু ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’-এর প্রায় সব অংশই আমার এত বড় মাযহাবের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে, সুতরাং এটা পড়লে আমার পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া আমার ওপর বড় পীর ছাহেব হুজুরদের অভিশাপ নেমে আসবে। এসব কত শত চিন্তা মাথায় ঘুরতে লাগল। বইটি একবার পুড়িয়ে ফেলা কিংবা নষ্ট করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি করিনি। কারণ এ বইয়ের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে বিস্তর পড়াশুনা করে।
কা‘বার ভিডিও ফুটেজ : বেশ কিছুকাল পর কা‘বাগৃহে ছালাত আদায়ের একটি ভিডিও ফুটেজ দেখার সুযোগ হয়। এরপর সঊদী চ্যানেল থেকে কা‘বার সরাসরি সম্প্রচারিত ছালাত দেখে অাঁতকে উঠি। ওহ! সেখানকার ইমাম ও মুক্তাদীরা ঠিক সেভাবে ছালাত পড়ছে, যেভাবে ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। তারাও আহলেহাদীছদের মত বুকে হাত বাঁধছে, রাফউল ইয়াদাইন করছে, ছালাতে জোরে আমীন বলছে!! মনের মধ্যে হাযারও প্রশ্নের ভিড়ে এবার সত্যিই দিশেহারা বোধ করতে লাগলাম। এরই মধ্যে এইচ.এস.সির রেজাল্ট হ’ল। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হলাম ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় গ্রন্থাগারে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হ’ল। সেখানে বুখারী অধ্যয়ন করতে গিয়ে তো অবাক। ‘কিতাবুছ ছালাত’ অধ্যায়টি যেন হুবহু ড. গালিব ছাহেবের ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হ’লে গ্রামে গিয়ে আমার সমাজের একজন বড় ইমামের সাথে কা‘বার ছালাত ও ড. গালিবের ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ সম্পর্কে আলোচনা করলাম। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন ওরা সব অন্য মাযহাবের লোক, আমরাই ঠিক আছি, বড় মাযহাব হ’ল হানাফী মাযহাব ইত্যাদি। কিন্তু আমার মন সেদিন ভিন্ন চিন্তায় অগ্রসর হ’তে চলল। ভাবলাম আল্লাহর রাসূল যে দেশে এসেছেন, যে ভাষায় কথা বলেছেন, সে ভাষায়ই কুরআন নাযিল হয়েছে, যে দু’টি সম্মানিত মসজিদকে কেন্দ্র করে ছিল রাসূলের যাবতীয় কর্মকান্ড; সেই দেশের মানুষ, সেই ভাষাভাষী মানুষ, সেই মসজিদ দু’টির ইমাম ও মুছুল্লীদের চেয়ে কুরআন হাদীছের অধিক কাছাকাছি অন্য কারো তো হবার কথা নয়। অতএব তারা যে পদ্ধতি (মাযহাব) অনুসরণ করছে সেই পদ্ধতিই (মাযহাব) অনুসরণ করা উচিত। সেটিই ছিল আমার তাৎক্ষণাৎ চিন্তা।
পরিবর্তন শুরু : শীঘ্রই আমার মধ্যে পরিবর্তন শুরু হ’ল। আমি বুঝতে পারলাম কুরআন ও ছহীহ হাদীছই মূলত আল্লাহর অহী। এই অহীই সত্যের একমাত্র মানদন্ড; কোন পীর বা ইমাম নয়। আলহামদুলিল্লাহ এ সত্য বুঝতে পারার পর তা গ্রহণ করতে আমি আর দেরী করিনি। আমার অন্তরটা দিনের আলোর মত স্বচ্ছ হয়ে উঠল। ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ যেন আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে লাগলাম। সাথে সাথে সদ্য খুঁজে পাওয়া সত্যের এই আলোকদ্যুতিকে সমাজের বুকে ছড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছা আমার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল। শুরু করলাম প্রকাশ্যেই ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী ছালাত আদায়। মানুষকে স্বাধীনভাবে দাওয়াত দিতে লাগলাম। ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, তাই কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ ও ভয়-ভীতি এ কাজে আমাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। হঠাৎ করেই চারপাশে আমার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে শুরু করল। আমি কামিল পীর পরিবারের ভদ্র মেধাবী সন্তান। ক্লাসে প্রথম হ’তাম। তাই আমাকে নিয়ে সবার বাড়তি মাথা ব্যথা শুরু হ’ল। আমাকে বলা হ’ল তোমার নানাজানরা বড় বড় অলী-আওলিয়া। আমরা তাদের অনুসরণ করি। তাছাড়া সমাজের লক্ষ-কোটি মানুষ কি ভুল করছে? ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের বক্তব্যের জবাবে সূরা আ‘রাফের এই আয়াতটি বলেছিলাম ‘তোমরা অনুসরণ কর তা-ই যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন অলী-আওলিয়ার অনুসরণ কর না। তোমরা কমই উপদেশ গ্রহণ কর’ (আ‘রাফ ৩)।
কিন্তু অচিরেই আমি মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হই। সমাজের মানুষের বিভিন্নমুখী যুক্তি আমাকে প্রতারিত করল। এমনকি আমার মত আক্বীদা পরিবর্তনকারী একজনকে এজন্য মসজিদের মধ্যে প্রচুর মারপিটও করা হ’ল। ফলে আমি আবার পূর্বের জাহেলিয়াতে ফিরে যাই। কিন্তু মনে শান্তি পাই না। পড়াশুনা অব্যাহত রাখি। একবার এক ইসলামী জলসায় মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী ছাহেবের সাথে পরিচয় হ’ল। শুনলাম তিনি ড. গালিবের খুব স্নেহধন্য মানুষ। দীর্ঘ সময় তাঁর সাথে কথা হ’ল। তাঁকে বললাম, আমার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমীর ছাহেবের সাথে একটু কথা বলতে।
আমীরে জামাআতের সাথে রুদ্ধশ্বাস বৈঠক : সেদিন ঢাকায় ছিলাম। হঠাৎ শায়খ আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী ফোন করলেন। জানালেন আমীর জামা‘আত একটি প্রোগ্রামে ঢাকা এসেছেন, আমি যেন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করি। তখন মোহাম্মাদপুরে আমীরে জামা‘আত তাঁর এক শুভাকাঙ্খীর বাসায় অবস্থান করছিলেন। আমি ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিরতে অনেক দেরী হ’ল। অবশেষে আমীরে জামা‘আতের অবস্থানস্থলে পেঁŠছলাম সন্ধ্যার কিছু পূর্বে। ভিতরে ঢুকে সালাম বিনিময় হ’ল। আমাকে দেখেই আমীরে জামা‘আত বললেন, তুমিই কি ইউসুফ? তারপর পাশে বসালেন এবং স্বস্নেহে আতর মাখিয়ে দিলেন। আমার আসতে এত দেরী হ’ল কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি কিছুই বললেন না। সার্বিক খোঁজ-খবর নেয়ার পর তিনি আমাকে উদ্দেশ্যে করে ৩টি কথা বললেন- (১) বল, তুমি দুনিয়া চাও না আখিরাত? (২) জেনে রেখ! ভীরু ও কাপুরুষের জন্য জান্নাত নয়, (৩) আমাদের অনুসরণ করতে হবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ তথা অহী-র বিধান। যত মুছীবতই আসুক হকের উপর অটল থাকতে হবে। এছাড়াও পড়াশোনার ব্যাপারেও কিছু মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। দিলেন ধৈর্যের উপদেশ। সাক্ষাতের পর আমি অনুভব করলাম, এমন একজন মহানুভব সুন্নাতের পাবন্দ মানুষ আমি আর কখনও দেখিনি। আমি তাঁর ছাত্রেরও ছাত্রের বয়সী এবং বিদ্যা-বুদ্ধি, শিক্ষা-অভিজ্ঞতা সবদিক থেকে অতীব নগণ্য; তবুও তিনি যেভাবে আমাকে মূল্যায়ন করলেন তা অবিশ্বাস্য। তাঁর পিতৃসুলভ অথচ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে আমার অন্তর মুগ্ধতায় ভরে গেল। তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নামকরা প্রবীণ অধ্যাপক, তা আমাকে বুঝতেই দেননি। সত্যিই ছহীহ শুদ্ধ আসমানী জ্ঞান ও আল্লাহর খাছ মদদ ব্যতীত এমন মহৎ চরিত্রের মানুষ হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়।
পরিপূর্ণ ছহীহ আক্বীদায় প্রত্যাবর্তন : আমীরে জামা‘আতের সাথে স্বল্প সময়ের অবস্থান কিন্তু তাঁর ব্যাপকার্থক বক্তব্যগুলো আমার ভেতর খুব রেখাপাত করল। মনের গহীনে অনির্বচনীয় আন্দোলন শুরু হ’ল। তাঁর তথ্যনির্ভর, যৌক্তিক ও বাস্তবধর্মী নির্দেশিকার মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমার ঈমান বহুগুণে বাড়িয়ে দিলেন, তা অনুভব করতে পারলাম। আরো ব্যাপকভাবে গবেষণা ও অধ্যয়ন শুরু করলাম। যতই কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অধ্যয়ন করি ততই আহলেহাদীছ আক্বীদার সাথে এর মেলবন্ধন খুঁজে পাই। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এবার যতই ঘাত-প্রতিঘাত, যুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন আর অপমান আসুক না কেন, এই সত্য শাশ্বত পথ থেকে আমি আর এক চুলও সরে যাব না।
গ্রামবাসী ও পরিবারের বিরোধিতা : পুনরায় মুখোমুখি হ’তে হ’ল নিজ পরিবারের চরম বিরোধিতার। আপন বড় ভাই (বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত) হয়ে গেলেন আমার অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ। তার যত আক্রোশ ড. গালিবের বিরুদ্ধে। তার ধারণা ড. গালিব মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে ফেলছেন, মসজিদ পর্যন্ত ‘আহলেহাদীছ’ নামকরণ করে সমাজকে বিভক্ত করে ফেলছেন, আহলেহাদীছ একটি ভ্রান্ত ফিরকা প্রভৃতি। গ্রামের মানুষও বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্যসহ চরম অপমানসূচক উক্তি বর্ষণ করা শুরু করল। অপরের মন্তব্যগুলো সহ্য করতে পারলেও নিজের আপনজনদের বিশেষত বড় ভাইয়ের বক্তব্যগুলো হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাতে লাগল। তবে আল্লাহ আমার ধৈর্যের মাত্রাও বৃদ্ধি করে দিয়েছিলেন। ফলে কখনও বদদো‘আ করিনি, বরং সর্বান্তকরণে তাদের জন্য দো‘আ করতাম আর বলতাম, হে আল্লাহ! আমার পরিবার ও কওমের মানুষগুলো ভ্রান্ত পথকে সঠিক মনে করে জাহান্নামী হ’তে চলেছে, তুমি তাদের হেদায়াত কর।
বড় ভাইয়ের সুপথে ফেরা : মনের গহীনে দীর্ঘদিন ব্যথা বহন করে চলেছি। কারণ বড় ভাইয়ের সাথে একমাত্র বিরোধ দ্বীন নিয়ে অন্য কিছু নিয়ে নয়। সবসময় তার জন্য মনেপ্রাণে দো‘আ করতাম। অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে সেই কাংখিত দিনটি এল। ২০১২ সালের কোন একদিন হঠাৎ বড় ভাইয়ের ফোন, ‘ইউসুফ! ছালাতে বুকে হাতটা কিভাবে বাঁধতে হবে? আমরা যেভাবে মীলাদে কিয়াম করার সময় হাত বাঁধি সেভাবে?’ বিস্ময়ে আনন্দে আমার মনটা ভরপুর হয়ে উঠল। সেদিনের সেই অনুভূতি কাউকে বলে বুঝাতে পারবো না। তার কথা বলার ধরন ও প্রশ্ন শুনে নিশ্চিত বুঝেছিলাম, এই সুর ও প্রশ্ন তাঁকে সুপথে ফেরার নিশ্চিত সংকেত বহন করছে। আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ওভাবে হাত বাঁধতে হবে আর মীলাদ চিরতরে ছাড়তে হবে। এরপর বড় ভাইকে বুখারী-মুসলিম সহ সকল হাদীছের গ্রন্থ পড়ার আহবান জানালাম। তিনি গুরুত্বপূর্ণ তাফসীরসহ সকল হাদীছের গ্রন্থ কিনে ফেললেন। এরপর ঐ বছরই সিদ্ধান্ত নিলেন হজ্জব্রত পালন করবেন। কিন্তু পদ্ধতি হবে সম্পূর্ণ আমীরে জামা‘আত ড. গালিবের নির্দেশনা অনুসারে অর্থাৎ ছহীহ হাদীছ অনুসারে। কারণ তিনি ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছেন আমীরে জামা‘আত এবং ছহীহ হাদীছের অনুসরণ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আল্লাহ তাঁর সে আশা পূরণ করলেন। হজ্জ করলেন এবং সেখান থেকেও মূল্যবান কিতাবপত্র ক্রয় করেছেন। আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা যে, তিনি আজ ছহীহ পথের একজন নিবেদিতপ্রাণ দাঈ, যিনি ছিলেন ইতিপূর্বে অন্যতম প্রধান বিরোধী। আল্লাহ তাঁকে কবুল করুন।
মানুষের মাঝে সাড়া : সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যে আমি ও আমার পরিবার (যারা আল্লাহর অশেষ রহমতে একে একে সকলেই ছহীহ পথ গ্রহণ করেছে) এবং সঙ্গী-সাথীরা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি যৎসামান্য জ্ঞান নিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করতে। যদিও জানি আমাদের এ প্রয়াস মহাসমুদ্রের মধ্যকার এক ফোঁটা জলবিন্দুর চেয়েও কম পরিমাণ। তবুও তো এক ফোঁটা! আর আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মহান আল্লাহ যাঁর জন্যই এই প্রচেষ্টা, তাঁর তো কোন সীমাবদ্ধতা নেই। অতএব তিনি আমাদের ক্ষুদ্রবিন্দুসম প্রয়াসকে আপন রহমত ঢেলে সিন্ধুতে পরিণত করে দিতে পারেন। এ বিশ্বাস আমাদের অন্তর জুড়ে বহমান। আজ খুব খুশী লাগে যখন দেখি দেশের সর্বত্র পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। আর সে পরিবর্তনের ঢেউয়ে নিরন্তর শক্তিমান বায়ুপ্রবাহের যোগান দিয়ে চলেছেন আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ও তাঁর নেতৃত্বাধীন আহলেহাদীছ আন্দোলন। তাদের অব্যাহত সংগ্রামের বরকতে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও যাবতীয় গোঁড়ামির অর্গল ছিন্ন করে আজ সত্য সঠিক অবিকৃত ও বিশুদ্ধ ইসলামের স্পর্শ আমরা পেয়েছি। এটাই তো সেই ইসলাম যা আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে মনোনীত করেছেন। এটাই তো সেই ইসলাম যে, ইসলাম আমাদের নবী করীম (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের রক্তের উপর বিজয়লাভ করেছে। কুরআনের আয়াতটিকে আজ খুব আবেগ দিয়ে অনুভব করি, ‘মিথ্যা পরাজিত হয়েছে মিথ্যা নিশ্চয়ই মিথ্যা পরাজিত হওয়ার যোগ্য (বনী ইসরাঈল ৮১)’। ফালিল্লাহিল হামদ।
শেষ কথা : পরিশেষে একটি প্রবাদ বাক্যকে সামনে রেখে বলতে চাই ‘গোঁয়ালের কাছের ঘাস গরু খায় না’ আজ বিকৃত ইসলাম থেকে ফিরে এসে বুঝতে পারছি কি অমূল্য রত্নের সন্ধান আমি পেয়েছি। আজ মনে হয় এটাই বুঝি দুনিয়ার জান্নাত। অথচ অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, যারা পৈতৃক সূত্রে আহলেহাদীছ তারা আজ এর মর্যাদা হয়তো অনেকেই অনুধাবন করতে পারছেন না। কারণ আমাদের মত এত ত্যাগ স্বীকার তাদের করতে হয়নি। আর ‘ফ্রি’ কোন জিনিসের কদর একটু কম দিয়ে থাকে মানুষ। যদিও গবেষণায় দেখা যায় যে, সকল জিনিস আল্লাহ ‘ফ্রি’ দিয়েছেন, সেগুলো অমূল্য সম্পদ। যা ক্রয় করার সাধ্য মানুষের নেই অথচ তা অপরিহার্য। যেমন অক্সিজেন, পানি, আলো, বাতাস প্রভৃতি। আমি অনেক আহলেহাদীছ ভাইকে জানি, যারা ছালাতে বুকে হাত বাঁধা, রাফউল ইয়াদাইন করা এবং জোরে আমীন বলাই যেন ছহীহ হাদীছের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ বলে আত্মতুষ্টি লাভ করেন। তারা বেমা‘লুম ভুলে যান ছালাতের ক্ষেত্রে যেমন ছহীহ হাদীছ অনুসরণ করছেন ঠিক তেমনি জীবনের প্রতিক্ষেত্রে ছহীহ হাদীছের অনুপ্রবেশ ঘটানো যরূরী। তা না পারলে আহলেহাদীছ দাবী না করে ‘আহলে ছহীহ ছালাত’ (শুধু ছহীহ ছালাতের অনুসারী) দাবী করাই যুক্তিপূর্ণ। কারণ ইসলাম তো আর অন্য কোন ধর্মের মত নিছক কতকগুলো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি মহান স্রষ্টা প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। সঙ্গত কারণেই মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (বাক্বারাহ ২০৭-২০৮)। এ আয়াতের দাবী শুধু ছালাতে ছহীহ হাদীছের অনুসরণ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ছহীহ হাদীছের অনুসরণের নামই পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ ও শয়তানের সঙ্গ ত্যাগ করা। এবার আমার প্রাক্তন সমাজের উদ্দেশ্যে অল্প কথায় বলতে চাচ্ছি- আজ আমাদেরকে (যারা ছহীহ পথের অনুসরণ করছি) আপনারা বিভ্রান্ত, মিথ্যাবাদীসহ নানা নেতিবাচক মন্তব্য করছেন, আপনাদের প্রতি আমাদের আকুল আহবান, আসুন দেখুন আমরা দলীলসহ আল্লাহর পথে চলছি। আপনারা যদি আপনাদের দাবী মোতাবেক সত্যের অনুসারীই হয়ে থাকেন, তাহ’লে আল্লাহর ভাষায় বলতে চাই- ‘আপনারা সত্যবাদী হ’লে প্রমাণ নিয়ে আসুন’ (নামল ৬৪)। না হ’লে শৃগালের ন্যায় ফাঁকা আওয়াজের কোন মূল্য জঙ্গলের পশুদের কাছে থাকলেও জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের কাছে থাকার অবকাশ নেই। প্রাণীর ডাক জঙ্গলে সুন্দর সভ্য জগতে নয়। আজ যারা আমাদেরকে মিথ্যাবাদী বিভ্রান্ত বলছেন এতে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না, হ’লেও দুনিয়ার বিচারে তা যৎসামান্য। কিন্তু প্রমাণবিহিন এসব ফাঁকাবুলির কাফফারা স্বরূপ কাল বিচার দিবসে কি কঠিন মুহূর্তের সম্মুখীন হ’তে হবে তা একবার চিন্তা করুন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘জাহান্নামের দ্বাররক্ষীগণ যখন বলবে, তোমাদের কাছে কি কোন সতর্ককারী যায়নি? তখন তারা বলবে, হ্যাঁ গিয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদের মিথ্যাবাদী বলেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ এসব কিছুই নাযিল করেননি, তোমরাই মহা বিভ্রান্তিতে পড়ে আছ’। তারা আরো বলবে, ‘হায় সেদিন যদি শুনতাম ও বুঝতাম তাহ’লে আজ জাহান্নামের অধিবাসী হ’তাম না’ (মূলক ৮/১০)।
তবে আশার কথা হ’ল বিচারের দিবস এখনও আসেনি, আল্লাহ আমাদের সামনে সংশোধন হওয়ার সুযোগ রেখেছেন এখনও। অতএব আপনাদের আজকের কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ আগামী দিনের জন্য আক্ষেপের কারণ হবে সেটা ভেবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী নিজের জীবনকে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা নিন-সেটিই হবে সর্বোচ্চ বুদ্ধিমানের পরিচয়। মানুষ ইচ্ছা করলে চেষ্টা দিয়ে, সাধনা দিয়ে ভুলকে ফুলরূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। আসুন না সে পথে সকলে মিলে ধাবিত হই! আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!
কাজী এ.এম ইউসুফ জাহান
ইংরেজী বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।